আমাদের মধ্যে অনেকেই বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজাই, যেমন- গিটার, বেহালা, ড্রামস, বেইস, সেতার, বাঁশি ইত্যাদি। তবে আমাদের পরিচিত প্রায় সব বাদ্যযন্ত্রই বাজাতে হয় হাত বা মুখের সাহায্যে। একেবারেই স্পর্শ না করে বাদ্যযন্ত্র বাজানো যায় না, এটাই তো স্বাভাবিক, তা-ই না?
উঁহু, না ছুঁয়েও বাজানো যায় একটি যন্ত্র, এবং আমাদের অনেক পরিচিত ও বিখ্যাত বিভিন্ন গান ও সুরেও এই যন্ত্রের ব্যবহার হয়েছে। এই যন্ত্রের নাম থেরেমিন। একে ইথারফোন ও থেরেমিনবক্স নামেও ডাকা হয়। এই বাদ্যযন্ত্র বাজাতে একে ছোঁয়ার দরকার নেই। সামনে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ালেই এই যন্ত্র থেকে সুরেলা আওয়াজ বের হয়। তবে তার পেছনেও রয়েছে বিজ্ঞান ও মানবজাতির অসাধারণ সৃষ্টিশীলতার পরিচয়।
কীভাবে হয়েছিল থেরেমিনের জন্ম?
আগামী বছরেই থেরেমিন শতবর্ষী হতে যাচ্ছে। অন্যান্য পরিচিত বাদ্যযন্ত্রের ইতিহাসের সাথে তুলনা করলে একে শিশুই বলা চলে। তবে থেরেমিনের ইতিহাস যেমন রোমাঞ্চকর, তেমনি অদ্ভুত, অনেকটা যন্ত্রটার মতোই। এই যন্ত্র আবিষ্কৃত হয় সোভিয়েত যুগে।প্রক্সিমিটি সেন্সর নামক একটি তরঙ্গ সংবেদী যন্ত্র নিয়ে গবেষণার সময় তরুণ সোভিয়েত বিজ্ঞানী লেভ সের্গেইয়েভিচ তেরমেন বা থেরেমিন ১৯২০ সালের অক্টোবর মাসে এই যন্ত্র আবিষ্কার করে বসেন। যন্ত্রের নাম দেন তেরমেনভক্স, যার অর্থ তেরমেনের কণ্ঠস্বর। সেই সময় চলছিল রাশিয়ান গৃহযুদ্ধ, প্রক্সিমিটি সেন্সর নিয়ে সরকারের গবেষণাও ছিল যুদ্ধের উদ্দেশ্যেই, শত্রুকে যুদ্ধক্ষেত্রে খুঁজে বের করার জন্য। এরকম যন্ত্র নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে তেরমেন আবিষ্কার করেন একটি বাদ্যযন্ত্র!
তেরমেন যন্ত্রটি নিয়ে ইউরোপে একটি লম্বা সফর দিলেন, কিন্তু তেমন সুবিধা করতে পারলেন না। এরপরে তিনি আমেরিকায় এসে তার যন্ত্রের প্যাটেন্ট নিলেন ১৯২৮ সালে। আমেরিকায় এই যন্ত্র অনেকের নজর কেড়েছিল। ১৯৩০ সালের দিকে লুসি বিগলো এবং তার স্বামী ওয়াল্টার বিগলোর পৃষ্ঠপোষকতায় এই যন্ত্রের জনপ্রিয়তা অনেক বেড়ে গিয়েছিল।
আভাঁ-গার্ড শিল্পী জোসেফ শিলিঞ্জার প্রথম দেখাতেই বুঝে ফেলেন থেরেমিনের অপার সম্ভাবনা। ১৯২৯ সালে তিনি নিউ ইয়র্কে তার ‘প্রথম এয়ারফনিক স্যুট’ আয়োজন করেন, যাতে তেরমেন স্বয়ং সোলো থেরেমিনবাদকের ভূমিকা পালন করেন। আমেরিকান ইলেক্ট্রনিক কোম্পানি আরসিএ এই সুযোগে থেরেমিন যন্ত্রটির বাজারজাতকরণের চেষ্টা করে। কিন্তু তা বিফলে যায়, প্রথমাবস্থায় থেরেমিনের মাত্র ৪৮৫ ইউনিট বিক্রি হয়।
থেরেমিনের গড়ন
থেরেমিন শুধু একটি (অস্পৃশ্য!) যন্ত্র হিসেবেই অদ্ভুত নয়, এটি পৃথিবীর প্রথম উল্লেখযোগ্য ইলেক্ট্রনিক বাদ্যযন্ত্রও বটে! থেরেমিন দেখতে একটি বাক্সের মতো। এতে সাধারণত দুটি অ্যান্টেনা থাকে; একটি আনুভূমিক বা হরাইজন্টাল ও একটি উল্লম্ব বা ভার্টিক্যাল। এই দুই অ্যান্টেনার চারপাশেই তড়িৎচৌম্বকীয় ক্ষেত্র থাকে। থেরেমিনের সামনে হাত নাড়ানোর মাধ্যমে আপনি ব্যাতিচার বা ইন্টারফিয়ারেন্স তৈরি করছেন, কারণ প্রাকৃতিকভাবে মানবদেহে নিহিত থাকে ইলেকট্রিক চার্জ, যা থেরেমিনের তড়িৎচুম্বকীয় ক্ষেত্রের জন্য প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।
আনুভূমিক অ্যান্টেনার মাধ্যমে আপনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন ধ্বনি তীব্রতা বা ভলিউম, আর উল্লম্ব অ্যান্টেনার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয় ধ্বনির পিচ বা মাত্রা।
কীভাবে বাজাবেন থেরেমিন?
সাধারণত থেরেমিন বানানো হয় ডানহাতি থেরেমিনবাদকের জন্য, বাঁহাতিদের জন্য বিশেষ থেরেমিন তৈরি হয়েছে বেশ পরে। তাই আমরা থেরেমিন বাজানোর উদাহরণ হিসেবে ডানহাতি পরিপ্রেক্ষিতেই জানব।
একজন থেরেমিনবাদক থেরেমিনের কাছে দাঁড়াবেন (মনে রাখতে হবে, অ্যান্টেনা থেকে দূরত্বের পরিমাণের উপরও সঙ্গীতের তীব্রতা ও মাত্রা নির্ভর করবে)। উল্লম্ব অ্যান্টেনার সামনে তিনি তার ডান হাত ডানে-বামে নাড়াবেন। এতে ধ্বনির পিচে পরিবর্তন আসবে, অ্যান্টেনা থেকে প্রায় ২ ফুট দূরে সর্বনিম্ন পিচ শোনা যায়। যত কাছে যাওয়া হয়, ততই পিচের দৈর্ঘ্য কমতে থাকে। আনুভূমিক অ্যান্টেনার সামনে তিনি তার বাম হাত উপর-নিচ করবেন, তাতে ভলিউম নিয়ন্ত্রিত হবে। সর্বনিম্ন তীব্রতার আওয়াজ শোনা যায় অ্যান্টেনা থেকে ২.৫ সেন্টিমিটার উচ্চতায়। থেরেমিনবাদক হাত যত উপরে ওঠাবেন, আওয়াজ তত তীব্র হবে।
শুনে খুব জটিল মনে হচ্ছে? হ্যাঁ, থেরেমিন বাজাতে বেশ অনেকটা অনুশীলন করতে হবে আপনাকে। দুই হাতের সমন্বয় করতেও অনেকটা সময় নেবে। কিন্তু ধৈর্যের সাথে এই যন্ত্র বাজাতে শিখলে আপনি নিরাশ হবেন না, সেটা নিচে দেয়া থেরেমিনের কিছু বিখ্যাত সুর শুনলেই বুঝতে পারবেন।
থেরেমিনের সংগীত, থেরেমিনের সুর
ইলেক্ট্রনিক সংগীতের দুনিয়ায় প্রথম উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার এই থেরেমিন, এবং এই ধরনের সংগীতের ভিতও তৈরি হয়েছে থেরেমিনের আগমনের ফলেই। ইলেক্ট্রনিক সংগীতের খানিকটা জিরজিরে (Buzzy) এবং ঝনঝনে (tinny) যে আওয়াজের সাথে আমরা পরিচিত, সেই স্টাইলের জন্যও থেরেমিনের কাছেই ঋণ স্বীকার করতে হবে।
প্রথমাবস্থায় মাত্র ৪৮৫ ইউনিট বিক্রি হওয়া একটি যন্ত্র হিসেবে বিশ্বসংগীতে থেরেমিনের প্রভাব ছিল বিস্ময়কর। তখনও ইলেকট্রিক গিটার ও সিন্থেসাইজার আবিষ্কৃত হয়নি। এ সময় থেরেমিন একটি জাদুর বাক্সের মতোই ছিল দর্শক-শ্রোতার কাছে। ক্লারা রকমোর ও লুসি রসেনের মতো শিল্পীদের হাতে থেরেমিনের সুর মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতো দর্শকদের, যারা এতকাল ন্যাচারাল অ্যাকৌস্টিক্স শুনে অভ্যস্ত ছিল।
থেরেমিনের জন্য কনসার্ট মিউজিক রচনা করেছেন পার্সি গ্রেইঞ্জার, ক্রিস্টিয়ান ওউলফ, মরিটয এগার্টের মতো আরও অনেক স্বনামধন্য কম্পোজার। অনেকে থেরেমিন আন্সাম্বলও রচনা করেছেন ৫-৬টি থেরেমিন নিয়ে, যা প্রথাগত স্ট্রিং কার্তেতের বিকল্প হিসেবে পরীক্ষিত হয়েছিল।
থেরেমিনের সংগীতের একটি বিশেষ কৌশল ‘গ্লাইড করা’ বা এক মাত্রা থেকে আরেক মাত্রায় অনেকটা ‘পিছলিয়ে’ যাওয়া। এই কৌশলের সুবাদে এই যন্ত্রে অনেক বিখ্যাত সুরকার পৃথিবীর প্রথম ‘ফ্রি মিউজিক’ রচনা করেন।
বর্তমান সময়ে ধ্রুপদী ধারার অনেক সুরকার এই যন্ত্রের ব্যবহার ফিরিয়ে আনছেন, লক্ষ্যণীয়ভাবে নারী সুরকারদের কম্পোজিশনে থেরেমিনের ব্যবহার অনেক বেশি, যেমন লিডিয়া কাভিনা, পামেলিয়া কার্স্টিন, বারবারা বুশোলজ প্রমুখ।
পপ মিউজিকেও থেরেমিনের ব্যবহার হয়েছে অনেক, এখনও হচ্ছে। রক গানে থেরেমিনের প্রথম ব্যবহার করে ‘লোথার অ্যান্ড দ্য হ্যান্ড পিপল’ নামে একটি ব্যান্ড, ১৯৬৫ সালে। এর এক বছর পরেই বিখ্যাত ব্যান্ড ‘দ্য বিচ বয়েজ’ ১৯৬৬ সালে ‘গুড ভাইব্রেশন্স’ নামক সিঙ্গেলে ইলেক্ট্রো-থেরেমিন নামক একটি যন্ত্র ব্যবহার করেন, যা থেরেমিন না হলেও একটি সমগোত্রীয় যন্ত্র। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ সম্ভবত লেড জেপেলিনের বিখ্যাত ‘হোওল লটা লাভ’ এবং ‘নো কোয়ার্টার’ গানে থেরেমিনের ব্যাবহার।
বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠতম সুরকার বলে যাকে মনে করেন অনেকে, সেই দিমিত্রি শোস্তাকোভিচ তার অর্কেস্ট্রাল মিউজিকে সর্বপ্রথম থেরেমিন অন্তর্ভুক্ত করেন, এবং এই মিউজিক লিওনিদ ত্রাউবার্গের ‘ওদনা’ (১৯৩১ সালে নির্মিত) ফিল্মে ব্যবহার করেন। থেরেমিন ফিল্ম মিউজিকে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করে, এবং এখনও এই জনপ্রিয়তা অব্যাহত রয়েছে। এর মূল কারণ সম্ভবত থেরেমিনের অদ্ভুত টোন, যা সায়েন্স ফিকশন ও হরর মুভির আবহের সাথে অনেক ভালোভাবে যায়। অনেক বিখ্যাত মুভি যেমন স্পেলবাউন্ড, দ্য রেড হাউজ, দ্য ডে দি আর্থ স্টুড স্টিল, দ্য থিং ফ্রম এনাদার ওয়ার্ল্ড এবং আরও অনেক মুভিতে থেরেমিনের শব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে। টেলিভিশন নাটক ও টেলিফিল্মেও থেরেমিনের প্রচুর ব্যবহার হয়েছে।
থেরেমিনের দাম খুব বেশি নয়, মাত্র ২৫ ডলারেই কাজ চালানোর মতো থেরেমিন পাওয়া যায়, তবে তার সাউন্ড কোয়ালিটি খুব একটা ভালো হবে না। একটু টাকা খরচ করে ১২০-২৫০ ডলারে খুব ভালো থেরেমিন পেতে পারেন আপনিও; বার্ন্স বি৩, মুগ থেরেমিন, বি৩ ডিলাক্স, মুগ ইথারওয়েভ ইত্যাদি ভালো ভালো ব্র্যান্ড থেকে।
তবে আর দেরি কেন? আপনিও একটি থেরেমিন কিনে শুরু করে দিন বাজানো। বাংলাদেশের সংগীতাঙ্গনে থেরেমিন নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
ফিচার ইমেজ- carolinaeyck.com