এ বছরের জুলাই মাসের ঘটনা। ভারতের কেরালা রাজ্যের একটি স্বনামধন্য পত্রিকা মাথুরিভুমি হানান হামিদ নামের একজন মেয়ের একটি খবর প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়- কী করে ২১ বছরের সেই মেয়েটি একা তার ভাঙা পরিবারের দেখা-শোনা ও নিজের পড়ালেখা দুই-ই চালিয়ে যাচ্ছে। খবরটি প্রকাশের পরে অনলাইন মিডিয়া এবং পত্রপত্রিকায় সবাই মেয়েটিকে বাহবা দিলেও কিছুদিন পরই তারা হানানকে নিয়ে নিন্দাপূর্ণ খবর প্রকাশ করতে থাকে।
কিন্তু এর কিছুদিন পরই উঠে আসে সত্য ঘটনা এবং মেয়েটি নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে যায়। সবাই তাদের ভুল বুঝতে পেরে হানানের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। ঘটনা মূলত এটুকুই। কিন্তু এই সামান্য ঘটনা আমাদের বর্তমান অনলাইন বা সাইবার পরিবেশের এক কুৎসিত, কুরুচিপূর্ণ দৃশ্য দেখায়।
পেছনের কথা
হানান হামিদের বাস কেরালার ইরনাকুলাম জেলার মাদাভানায়। সেখানে একটি ছোট ভাড়া বাসায় মা আর ছোট ভাইকে নিয়ে থাকে হানান। সে এখন পড়ছে কোচির একটি প্রাইভেট কলেজে রসায়ন নিয়ে, স্নাতক ৩য় বর্ষে। তার বাবা ছিলেন একজন গয়না বিক্রেতা ও একইসাথে একজন মাতাল। ছোটবেলা থেকেই বাবাকে গয়না তৈরির কাজে সাহায্য করতো হানান। তার মা-ও ছোটখাট কাজ করে আয় করতেন, কিন্তু সমস্যা শুরু হলো যখন তার বাবা অত্যধিক পরিমাণে মদ্যপান শুরু করলেন। মাতাল হয়ে প্রায়ই স্ত্রীকে মারতেন তিনি। পরিণামে কিছুদিন পর হানানের মায়ের মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। দায় এড়াতে বাবাও সরে পড়েন পরিবার থেকে।
ভারসাম্যহীন মা আর ছোট ভাইকে নিয়ে অকুল পাথারে পড়ে হানান। ৭ম শ্রেণীতে পড়ার সময় থেকেই পুরো পরিবারের ভার নেয় সে। একটু বাড়তি রোজগারের জন্য কী করেনি সে! স্কুলের পড়ার ফাঁকে ফাঁকে কখনো সে বাচ্চাদের পড়াতো, তো কখনো ভাড়ায় কবিতা লিখে দিত, চলচ্চিত্রে ডাবিংয়ের কাজও করেছে সে; এলাকার ছোটখাট অনুষ্ঠানে হয়েছে উপস্থাপিকা আর অন্য সময় হাতে ফুল নিয়ে অনুষ্ঠানের অতিথিদের আপ্যায়ন করেছে!
প্রথমে ফুল, পরে কাঁটা
দীর্ঘ ৯ বছর ধরে সে যে এতকিছু করেছে, তার কিছুই নজর কাড়েনি মিডিয়ার। কিন্তু সবার টনক নড়লো মাথুরিভুমির সেই আর্টিকেল দেখে। কেন? কারণ সেখানে তাকে দেখা যাচ্ছিল মাছ বিক্রি করতে। মাথায় প্লাস্টিকের ক্যাপ, পরনে কলেজের ভালো ইউনিফর্ম, আর মনে হচ্ছে মুখে মেকআপও করা হয়েছে! খবরটি যখন প্রকাশিত হল, তখন কেরালাসহ ভারতের বিভিন্ন জায়গা থেকে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে অভিনেতা, রাজনীতিবিদরা মেয়েটির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।
কিন্তু কাল হলো যখন অরুণ গোপী নামের একজন বিখ্যাত মালয় চলচ্চিত্র পরিচালক হানানকে তার নতুন চলচ্চিত্র ‘ইরুপাথিয়ুন্নাম নুত্তান্দু’তে একটি চরিত্রে অভিনয় করার প্রস্তাব দেন। অরুণ গোপী টুইটারে তার এই ইচ্ছার কথাটি জানানোর কিছুক্ষণের মধ্যেই ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষজন হানানের উপর মন্তব্যের পাথর ছুড়তে শুরু করলো। অথচ এর আগে তারা সবাই হানানকে খুব প্রশংসা করে আসছিল।
তখন সবাই খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো হানানকে, যে হানান এতদিন প্রায় অদৃশ্যই ছিল তাদের কাছে। “একজন সামান্য মাছ বিক্রেতা হয়ে এত বনে-ঠনে আছে কেন, মুখে তো দুঃখের কোনো ছায়া নেই, বরং হাসি-খুশি দেখাচ্ছে, মুসলিম মেয়ে হয়েও মাথায় হিজাব বা কাপড় নেই কেন!”- এই ধরনের চিন্তা শুরু হয় অনলাইন সেবা ব্যবহারকারীদের মাথায়।
হানানকে তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে বাজে মন্তব্য করা হয়। কিছু মন্তব্য ছিল এমন-
“তুমি শেষ। মালয়দের তুমি বোকা বানাচ্ছ! আমরা ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গকেও ছেড়ে দেইনি! তুমি সামান্য মাছ বিক্রেতা হয়ে আমাদের শিক্ষা দিতে এসেছ? তোমার ছবি কেরালাতে রিলিজ হবে, তাই না? আমরা তোমাকে শিক্ষা দিব”।
“সে হতভাগার কথা ভাবো যে ওকে বিয়ে করবে! সে তাকেও প্রতারিত করবে।”
“আমাকে একা ছেড়ে দাও”
যখন হানানের উপর এমন কটূক্তি ও বাজে মন্তব্যের বন্যা চলছে, তখন কেরালাতে সত্যিকার অর্থেই শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা চলছে। জুলাই মাসে শুরু হওয়া এই বন্যায় এখন পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ৪৪৫ ছাড়িয়েছে। অত্যধিক মৌসুমি বৃষ্টিতে কেরালার প্রায় ১৪টি জেলা এখন হয় পানির নিচে, নয়তো খুব ঝুঁকির মুখে আছে।
জুলাইতে হানানের খবর প্রকাশের পর একদল মানুষ যেমন এমন কদর্য আচরণ করেছে, কেরালার আরেক মহল তার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে সাহায্যের হাত। আগস্ট মাস পর্যন্ত তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা পড়েছে ১.৫ লক্ষ রুপি।
হানানকে নিয়ে যারা ব্যাঙ্গ করছিল তাদের মতে, হানান অরুণ গোপীর সেই চলচ্চিত্রে অভিনয় করার জন্যই এতসব নাটক করেছে। অনেকে তার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে অন্যান্য চলচ্চিত্র তারকাদের সাথে তোলা ছবি দেখে বলছে, সে আসলে মোটেও অর্থকষ্টে নেই, সবই নাম কামানোর ধান্ধা। নুরুদ্দিন শেখ নামে কোচির একজন বাসিন্দা ফেসবুক লাইভে এসে হানানকে নিয়ে কটূক্তি করেন। ছবিতে হানানের হাতে থাকা একটি স্বর্ণের আংটি দেখে তিনি ভিডিওতে বলেন, হানান একজন প্রতারক। নাহলে এত অভাবে হাতে সোনার আংটি কেন থাকবে।
এসব শুনে কান্নায় ভেঙে পড়া হানান পত্রিকায় একটি সাক্ষাতকারে তার নিজের কথা জানায়। সে বলে, তাকে ভোর ৩টায় কোচির চাম্পাকারা মার্কেটে মাছ কিনতে যেতে হয়। সেই মাছ এক পরিচিতের বাড়িতে রেখে ঘর থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে তার কলেজে যেতে হয়। সন্ধ্যায় কলেজ শেষে সে যায় থাম্মানাম-কোচি জংশনে মাছ বিক্রি করতে। সেখানে রাত ৯টা পর্যন্ত মাছ বিক্রি করে সে বাড়ি ফেরে। সেজন্যই তার পরনে থাকে কলেজ ইউনিফর্ম।
“… যেহেতু আমি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ফুল দেই, উপস্থাপনা করি, আমাকে প্রায়ই মেকআপ করতে হয়। আর আমার হাতের আংটিটি আমি অনেক বছর কষ্ট করে টাকা জমিয়ে কিনেছি, কারণ আমার এটার অনেক শখ ছিল।”- হানান হামিদ
এছাড়া হানানের স্কুলের শিক্ষকসহ তার সহপাঠী, বন্ধুবান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশীরা সকলেই বলেছেন তার জীবন সংগ্রাম মিথ্যা নয়। কেরালার প্রধানমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ানও টুইট ও সাক্ষাতকারের মাধ্যমে হানানের পক্ষে কথা বলেছেন এবং নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীকে এ ধরনের সাইবার অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর হতে বলেছেন। ফলশ্রুতিতে সর্বপ্রথম যে হানানের ব্যাপারে ভিডিও করেছিল, সেই নুরুদ্দিন শেখকে কোচি পুলিশ আটক করে।
এবার সত্যিকার অর্থে মানুষ তাদের ভুল বুঝতে পারে। কিন্তু হানান তার সাথে হওয়া ন্যাক্কারজনক ঘটনা ভোলেনি। যারা তাকে ভণ্ড বলছিল, তাদের মুখে চপেটাঘাতস্বরূপ এক কাজ করলো সে। আগস্ট মাসে তার পোস্ট ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ার পর তাকে যে দেড় লক্ষ রুপি সাহায্য দেয়া হয়েছিল, তার পুরোটা সে কেরালায় বন্যার্তদের সাহায্যার্থে জমা দেয়ার ঘোষণা দিলো। তার মতে, “আমার বিপদের সময়ে তারা আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। এখন তারা কষ্টে আছেন। তাদের জন্য এটি আমার অল্প একটি প্রচেষ্টা মাত্র।”
সাইবার নার্সিসিজমের প্রকাশ: ট্রল
ট্রল হলো কোনো ব্যক্তি বা বস্তুকে নিয়ে সোজা বাংলায় ব্যাঙ্গ করা। আমরা সবাই হাসতে ভালোবাসি এবং এই হাসির উৎস বিভিন্ন রকমের হয়। ট্রল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের হাসির একটি বড় যোগানদাতা।
অন্যদিকে সাইবার নার্সিসিজম একপ্রকার মানসিক ব্যাধি। নার্সিসিজম কী তা আমরা সবাই কম-বেশি জানি। যখন কোনো ব্যাক্তি নিজেকে অন্য সবার চেয়ে উপরে ভাবে, সবার চেয়ে মূল্যবান, শক্তিশালী ভাবে আর অন্য সবাইকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, তখন তাকে আমরা নার্সিসিস্ট বা আত্মপ্রেমী বলতে পারি। যদি এই আত্মপ্রেমীদের ব্যাপারে বেশি জানতে চান, তাহলে দেখে আসুন রোর বাংলার এই লেখাটি।
যা-ই হোক, সাইবার নার্সিসিজম গতানুগতিক নার্সিসিজম থেকে কিছুটা আলাদা। সাইবার নার্সিসিজম আলাদা কোনো রোগ নয়; বরং যারা আগে থেকেই আত্মপ্রেমী, তাদের আত্মপ্রেম প্রকাশের একটি মাধ্যম হিসেবে কাজ করে আজকের দিনের সোশ্যাল মিডিয়াগুলো।
যেহেতু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে নিজের পরিচয় গোপন রাখা সহজ হয়, আর যে কেউই চাইলে এখানে তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারে, সেহেতু এসব মাধ্যমই নার্সিসিস্টদের স্বর্গরাজ্য হয়ে যায়। এখানে তারা নিজেদের ভালো দিক যেমন প্রচার করতে প্রচুর আগ্রহী, তেমনি অন্যদের খুঁত ধরা বা তাদের ছোট করে দেখিয়ে মানসিক শান্তি অর্জন করাও তাদের চাই।
কেরালার একজন অভিনেত্রী এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মালা পার্বতী বলেন, “কেরালাতে ছোটবেলা থেকেই ছেলে-মেয়েদের আলাদা রাখা হয়। তাদের মধ্যে কখনো বন্ধুত্ব হয় না। তাই মেয়েদের প্রতি ছেলেদের দৃষ্টিভঙ্গি থাকে ভিন্ন। তাদের কাছে মেয়েদেরকে এক রহস্য মনে হয়, যা বিয়ের পরেও যায় না।” কেরালাতে পুরুষরা নারীদেরকে কীভাবে দেখে তার পিছনে সেখানকার পর্নোগ্রাফির সংস্কৃতি দায়ী বলে তিনি মনে করেন। তাই আজ হানান মেয়ে বলে এবং মাছ বেচেও মালয়ের বাকি নারী মাছ বিক্রেতাদের মতো পোশাক না পরায় তাকে এভাবে আক্রমণ করা হয়েছে।
আগেই বলা হয়েছে, ফেসবুকসহ বর্তমান যোগাযোগ মাধ্যমে তথ্য ছড়ানো এখন একটি ক্লিকের ব্যাপার মাত্র। সেটিকেই সাইবার নার্সিসিস্টরা হাতিয়ার বানাচ্ছে। ব্রিটিশ-অস্ট্রীয় মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ম্যালানি ক্লেইন একে নাম দিয়েছেন প্রজেক্টিভ আইডেন্টিফিকেশন। এর অর্থ যখন মানুষ নিজের মধ্যে থাকা অপূর্ণতা, চাওয়া-পাওয়া বা উপস্থিত-অনুপস্থিত বৈশিষ্ট্যগুলো অন্য কারো ভিতরে দেখতে চায়। এটি ইতিবাচক/নেতিবাচক দুই-ই হতে পারে এবং নার্সিসিস্টদের বেলায় এটি নেতিবাচকই হয়।
নার্সিসিস্টরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একাকিত্বে ভোগে, অসামাজিক হয়। তাই তারা অন্য কারো মধ্যেও একাকিত্ব দেখতে পছন্দ করে। এটি ব্যাখ্যা করে কেন কিছু মানুষ হানানকে আক্রমণ করছিল। পুরুষতান্ত্রিক এবং কেরালার মতো লিঙ্গবিভেদপূর্ণ সমাজে একটি ২১ বছরের মেয়ে একা সব সমস্যা দূর করছে তা তারা মেনে নিতে পারছে না।
যতক্ষণ পর্যন্ত হানান শুধু একজন খণ্ডকালীন মাছবিক্রেতা ছিল, ততক্ষণ পর্যন্ত সাইবার নার্সিসিস্টরা ঘুমিয়ে ছিল। কারণ তারা হানানকে দয়া করেছিল, তার প্রতি করুণা অনুভব করে নিজেরা একটি শ্রেষ্ঠত্বের স্বাদ পেয়েছিল; কিন্তু যখন হানান তাদের ছাড়িয়ে যেতে চাইল, একটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করে রাতারাতি তারকা বনে যেয়ে, তখনই এসব ছদ্মবেশী সাইবার নার্সিসিস্টরা তাকে চেপে ধরলো।
আমেরিকার ইন্সটিটিউট অব সাইবার সিকিউরিটির ডিরেক্টর মনোবিশেষজ্ঞ চিয়ারান ম্যাকমোহান বলেন, “আমরা সবাই আসলে কম-বেশি নার্সিসিস্ট। বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে তা আরো বেশি বোঝা যাচ্ছে।” কিন্তু তা-ই বলে অন্যকে অনলাইন বা যেকোনো মাধ্যমে হেয় করা কখনো মেনে নেয়া যায় না।
চলুন, আমাদের নিজেদের ভালো দিক প্রকাশের চিন্তায় যেন আমরা অন্যের খারাপ দিক প্রকাশ না করি। পুরো ঘটনা না জেনে মন্তব্য করা, কটূক্তি করা কাউকে শারীরিকভাবে আঘাত করার চেয়েও জঘন্য এবং তথ্য-প্রযুক্তি আইনের আওতাভুক্ত একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
ফিচার ইমেজ: NewIndian Express