আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু হলো প্রিমা ব্যালেরিনা আসোলিউটা (Prima ballerina assoluta)। নারী ব্যালে নৃত্যশিল্পীদের জন্য সর্বোচ্চ সম্মাননা এটি। তবে এক লাফে যেমন গাছের মগডালে চড়ে বসা যায় না, তেমনি সরাসরি আজকের এই আলোচ্য বিষয়বস্তু সম্পর্কেও পূর্ণাঙ্গ ধারণা একবারে পাওয়া সম্ভব না। তাই আমরা ধাপে ধাপে এগোবো। প্রথমে আমরা জানবো ব্যালে নৃত্য সম্পর্কে, এরপর ব্যালেরিনা সম্পর্কে, তারপর প্রিমা ব্যালেরিনা সম্পর্কে, এবং সবশেষে প্রিমা ব্যালেরিনা অ্যাসোলিউটা সম্পর্কে।
ব্যালে শব্দটির উৎপত্তি
ব্যালে শব্দটি মূলত ফরাসি ভাষার। তবে ফরাসি ভাষায় এই শব্দটির আগমন ইতালীয় ব্যালেটো শব্দ থেকে, যেটি আবার এসেছে লাতিন ভাষার শব্দ ব্যালো বা ব্যালারে থেকে। এই শব্দদ্বয়ও লাতিন ভাষার মৌলিক সৃষ্টি নয়। লাতিন ভাষায় তাদের আগমন গ্রিক ভাষার বালিজো থেকে, যার অর্থ হলো নাচা বা লাফানো। ১৬৩০ সাল থেকে নিয়মিত ইংরেজি ভাষায় ফরাসি ব্যালে শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
ব্যালে নৃত্য কী?
ব্যালে নৃত্যের ব্যাপারে কমবেশি ধারণা নিশ্চয়ই সকলেরই আছে। সামনাসামনি না হোক, টিভির পর্দায় অসংখ্যবার দেখা হয়েছে ব্যালে নৃত্য। তাই এই নৃত্যের কার্যবিধি অজ্ঞাত কোনো বিষয় নয়।
এটি হলো নৃত্য ও নৃত্যকলা কৌশলের একটি সমন্বিত রূপ, যেখানে কেবল নৃত্যই নয়, এর পাশাপাশি অভিনয়, মূকাভিনয় এবং সংগীত (কন্ঠ ও যন্ত্র) সবকিছুর সমন্বয়ে একটি স্বতন্ত্র শিল্পধারার সৃষ্টি করা হয়। এটি যেমন এককভাবে প্রদর্শিত হতে পারে, তেমনি পারে অপেরার অংশ হিসেবেও।
পঞ্চদশ শতকে ইতালীয় রেনেসাঁ চলাকালে ব্যালে নৃত্যের উদ্ভব ঘটে, এবং পরবর্তীতে ফ্রান্স ও রাশিয়ায় গিয়ে এটি কনসার্ট নৃত্যের রূপ লাভ করে। এখন গোটা জগৎজুড়ে এই নৃত্যের খ্যাতি। পশ্চিমা বিশ্বের অনেক দেশের দেখাদেখি আজকাল প্রাচ্যের অনেক দেশের স্কুলগুলোতেও প্রাথমিক স্তর থেকেই ব্যালে নৃত্য বাধ্যতামূলক শিক্ষার অঙ্গীভূত হয়েছে। অনেক দেশের সংস্কৃতিতেই এখন ব্যালে নৃত্যের নিজস্ব ঘরানার সংস্করণের উৎপত্তি ঘটেছে। এবং এই ব্যালে নৃত্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই নতুন নতুন অনেক নৃত্যরূপও সৃষ্টি হয়েছে।
যেহেতু এই নৃত্যশৈলীতে অনেক বেশি শারীরিক কসরতের প্রয়োজন হয়, তাই খুব বেশি বয়স পর্যন্ত কেউ সক্রিয়ভাবে ব্যালে নৃত্যের সাথে যুক্ত থাকতে পারে না। অধিকাংশ শিল্পীই ৩৫ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে অবসর গ্রহণ করেন। ইনজুরির কারণে অনেকের ক্যারিয়ার আবার এর অনেক আগেই শেষ হয়ে যায়।
ব্যালেরিনা
ব্যালেরিনা হলো ব্যালে নৃত্যশিল্পীদের প্রাথমিক উপাধি। তবে যারা ব্যালে নৃত্য করে, তারা সবাই কিন্তু ব্যালেরিনা হয় না। সাধারণ ব্যালে নৃত্যশিল্পীদের নিছকই ব্যালে ডান্সার বলে অভিহিত করা হয়। কেবলমাত্র সেসব ব্যালে ডান্সার, যারা খুব ভালো নাচে, তারাই ব্যালেরিনা উপাধিতে ভূষিত হয়। যেকোনো ব্যালে ডান্সারেরই লক্ষ্য থাকে একসময় ব্যালেরিনা হয়ে ওঠার।
আজকালকার আধুনিক ব্যালে কোম্পানিগুলোতে অবশ্য ব্যালেরিনা উপাধির ব্যবহার প্রায় উঠে গেছে বললেই চলে। বরং সেখানে যোগ্যতার ক্রমানুসারে কয়েকটি পদ সৃষ্টি হয়েছে।
- কর্পস ডি ব্যালে: ব্যালে নৃত্যগোষ্ঠীর সর্বনিম্ন পদ এটি। ব্যাকগ্রাউন্ড ডান্সারের মতো তারা দলবেঁধে মূল নৃত্যশিল্পীর পেছনে নাচতে থাকে। আলাদা করে এদের কোনো বিশেষত্ব নেই, কিন্তু এই ধরনের সকল নৃত্যশিল্পীর একই ছন্দে নেচে যাওয়া আবশ্যক।
- করিফিস: কর্পস ডি ব্যালে হিসেবে মোটামুটি ভালো করলে তাদের এই পদে উত্তীর্ণ করা হয়। তখন তারা বড় দলের বাইরে এসে কয়েক মুহূর্তের জন্য একক নৃত্যশৈলী প্রদর্শনেরও সুযোগ পায়।
- প্রিন্সিপাল ক্যারেক্টার আর্টিস্ট: তারা শুধু নাচেই না, পাশাপাশি কোনো নির্দিষ্ট চরিত্রে অভিনয়েরও সুযোগ পায়।
- সেকেন্ড সোলোইস্ট: তারা করিফিসদের এক ধাপ উঁচুতে অবস্থান করে। করিফিস হিসেবে ভালো করলে পরবর্তীতে তারা এই পদে এসে আরও বেশি সময়ের জন্য একক নৃত্যশৈলী প্রদর্শনের সুযোগ পায়।
- ফার্স্ট সোলোইস্ট: তারা আগের পদের চেয়েও এক ধাপ এগিয়ে। এই পর্যায়ে এসে তাদের গুরুত্ব যেমন বেড়ে যায়, তেমনি দলের সর্বোচ্চ পদলাভের সম্ভাবনাও হাতছানি দিতে থাকে।
- প্রিন্সিপাল ড্যান্সার: তারাই থাকে নাচের লিড রোলে। সবার সামনে থেকে তারা একক নৃত্য প্রদর্শন করে। সকল আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতেও তারাই থাকে।
- প্রিন্সিপাল গেস্ট আর্টিস্ট: তারা খুবই জনপ্রিয় নৃত্যশিল্পী, এবং সামান্য সময়ের জন্য অতিথি হিসেবে এসে প্রিন্সিপাল ড্যান্সারের সাথে বা পাশাপাশি নৃত্য প্রদর্শন করে যায়। তারা সাধারণত বাইরে বা অন্য দল থেকে আসা অতিথি হয়ে থাকে।
আগে যাদেরকে ব্যালেরিনা বলা হতো, তারাই মূলত এখন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রিন্সিপাল ড্যান্সার হিসেবে পরিচিত হয়ে থাকে।
প্রিমা ব্যালেরিনা
একজন ব্যালে ডান্সার যখন ব্যালেরিনা উপাধি পেয়ে যায়, তখন তার নতুন লক্ষ্য হিসেবে আবির্ভূত হয় প্রিমা ব্যালেরিনা হওয়া। এটি যেকোনো ব্যালেরিনার জন্য সম্ভাব্য দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খেতাব। একজন ব্যালেরিনা যখন নৃত্যশৈলী ও জনপ্রিয়তায় সমসাময়িক অন্যান্য ব্যালেরিনাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে যায়, তখন তাকে প্রিমা ব্যালেরিনা খেতাব প্রদান করা হয়। এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী ১৫২ জন ব্যালে নৃত্যশিল্পী প্রিমা ব্যালেরিনা খেতাবে ভূষিত হয়েছে। এ থেকেই বোঝা যায় কত বিরল একটি সম্মাননা এটি।
প্রিমা ব্যালেরিনা অ্যাসোলিউটা
এবং একজন ব্যালেরিনার জন্য সম্ভাব্য সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি হলো প্রিমা ব্যালেরিনা অ্যাসোলিউটা। ব্যালে নৃত্যশিল্পীদের জন্য বিরলতম সম্মাননা এটি। যখন একজন ব্যালেরিনা পুরো একটি প্রজন্মের সেরা শিল্পীতে পরিণত হন, তখনই তাকে প্রদান করা হয় প্রিমা ব্যালেরিনা অ্যাসোলিউটা সম্মাননা। এই সম্মাননা লাভের অর্থ হলো, ব্যালেরিনা হিসেবে সেই শিল্পী সম্ভাব্য সবকিছুই জয় করে ফেলেছেন। নতুন করে তার আর অর্জনের কিছুই বাকি নেই।
এখন পর্যন্ত মাত্র ১৩ জন ব্যালেরিনা এই সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। তবে অফিসিয়াল রেকর্ড বলছে কেবল ১১ জনের কথা। বাকি দুজনের এই সম্মাননা লাভের কথা বিভিন্ন সূত্রে শোনা গেলেও, তার পক্ষে নিরেট কোনো তথ্য-প্রমাণের সন্ধান আজ অবধি মেলেনি।
সর্বপ্রথম ১৮৯৪ সালে সর্বোচ্চ কোম্পানি র্যাংক হিসেবে প্রিমা ব্যালেরিনা অ্যাসোলিউটা টার্মটি ব্যবহৃত হয়। ফরাসি ব্যালে মাস্টার মারিউস পেটিপা এই সম্মাননা প্রদান করেন তার শিষ্যা, ইতালীয় ব্যালেরিনা পিয়েরিনা লেগনানিকে। তার মতে, লেগনানি ছিলেন ঐ সময়ে গোটা ইউরোপ মহাদেশের শ্রেষ্ঠ ব্যালেরিনা।
দ্বিতীয় এই খেতাবটি প্রদান করা হয় লেগনানিরই সমসাময়িক মাথিলডে স্কেসিনস্কাকে। তবে পেটিপা স্কেসিনস্কাকে প্রদত্ত এই খেতাব মেনে নেননি। তার বিশ্বাস ছিল, স্কেসিনস্কা একজন অসাধারণ ব্যালেরিনা হলেও, সর্বোচ্চ সম্মাননা লাভের যোগ্য তিনি ছিলেন না। কেবল রাশিয়ান ইম্পেরিয়াল কোর্টের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকার ফলেই তাকে এই সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে তিনজন ব্যালেরিনা এই সম্মাননা লাভ করেন। তারা হলেন গালিনা উলানোভা, মায়া প্লিসেৎস্কায়া, এবং নাতালিয়া মাকারোভা। ১৯৭০ সালে কিরোভ ব্যালেতে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে নৃত্য প্রদর্শনের পর প্রিমা ব্যালেরিনা অ্যাসোলিউটা খেতাব পান সুইস বংশোদ্ভূত আমেরিকান ইভা এভদোকিমোভা। তাকে এই সম্মাননা প্রদান করেছিলেন ঐ কোম্পানির ব্যালে মিস্ট্রেস নাতালিয়া দুদিনস্কায়া।
এছাড়া এই খেতাবপ্রাপ্ত অন্যান্য ব্যালেরিনাদের মধ্যে রয়েছেন সুইডেনের অ্যানেলি আলহানকো, কিউবার অ্যালিসিয়া আলোনসো, ইতালির অ্যালেসান্দ্রা ফেরি, এবং ইংল্যান্ডের অ্যালিসিয়া মারকোভা ও মারগট ফন্টেইন।
ব্যালে নৃত্যের জন্মস্থান ফ্রান্স হলেও, মাত্র একজন ফরাসির ভাগ্যেই জুটেছে প্রিমা ব্যালেরিনা অ্যাসোলিটা হওয়ার সম্মান। তিনি উভেত্তে শভিরে। দক্ষিণ আফ্রিকার একমাত্র প্রিমা ব্যালেরিনা অ্যাসোলিউটা হলেন ফিলিস স্পাইরা।
উপর্যুক্ত ব্যালেরিনাদের মধ্যে অ্যালিসিয়া মারকোভা ও অ্যালিসিয়া আলোনসোর এই খেতাব জেতার অফিসিয়াল কোনো রেকর্ড নেই। আর অবাক করা ব্যাপার হলো, সর্বকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যালেরিনা অ্যানা পাভলোভা, পৃথিবীর সব দেশেই যার খ্যাতি, তিনিই কখনও প্রিমা ব্যালেরিনা অ্যাসোলিউটা হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে ভূষিত হননি।
এখন আর এই সম্মাননা দেয়া হয় না কেন?
সর্বশেষ প্রিমা ব্যালেরিনা অ্যাসোলিউটা হয়েছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের নাতালিয়া মাকারোভা। কিন্তু চলতি শতকে আর কোনো ব্যালেরিনাকেই এই সম্মাননা প্রদান করা হয়নি। এর পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে।
- এই সম্মাননা প্রদানের কোনো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পদ্ধতি নেই, যার ফলে এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিভিন্ন মহলে বিতর্ক রয়েছে।
- এমন অভিযোগও রয়েছে যে, রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত প্রিমা ব্যালেরিনা অ্যাসোলিউটাদের মধ্যে অনেকেই যতটা না তাদের শিল্পগুণের জন্য এই খেতাব পেয়েছেন, তার চেয়ে বেশি তাদের রাজনৈতিক সংস্লিষ্টতার কারণে।
- সরাসরি সমালোচক বা সাধারণ দর্শকের মতামতের ভিত্তিতে কখনও কাউকে এই খেতাব প্রদান না করায়, জনসাধারণের ভেতর এই খেতাবের প্রতি উদাসীনতা দেখা যায়।
এ সকল কারণেই প্রিমা ব্যালেরিনা অ্যাসোলিউটা খেতাব প্রদানের রীতি ক্রমশ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এখনও অনেকেই এই টার্মটি ব্যবহার করে বটে, কিন্তু তা কেবলই অনানুষ্ঠানিকভাবে, কোনো ব্যালেরিনাকে প্রশংসিত করতে ব্যবহৃত বিশেষণ হিসেবে। এছাড়া কিছু ব্যালে কোম্পানি তাদের লিড ড্যান্সারের প্রচারণার ক্ষেত্রেও এই টার্ম প্রয়োগ করে থাকে।
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/