আমাজনের জন্য বিংশ শতাব্দীর শেষের দিনগুলো বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল। কোম্পানিটির প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও জেফ বেজোস সহ রাত-দিন পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে যাওয়া কর্মচারী ও বিনিয়োগকারীদের জন্য দিনগুলো তীব্র উদ্বেগের হলেও, সে সময়ের প্রাপ্তির বিশালতা তাদের মাঝে সবটুকু দিয়ে কোম্পানিটির জন্য কাজ করে যাওয়ার অনুপ্রেরণা যোগায়।
প্রযুক্তির উৎকর্ষতাকে কাজে লাগিয়ে ভোক্তা পণ্য বিক্রয়ের যে বিশাল মার্কেটটি তৈরি হচ্ছে, সেখানে বুক স্টোর হিসেবে যাত্রা শুরু করা কোম্পানিটির জন্য বড় বড় প্রতিযোগীদের মাঝে টিকে থাকা সহজ ছিল না। আমাজনের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকেই উপলব্ধি করতে পারছিল, ডট কম প্রযুক্তিকে ঘিরে নতুন গজিয়ে উঠা কোম্পানিগুলোর মধ্যে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে হলে উদ্ভাবনী শক্তিকে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে এগিয়ে যেতে হবে।
এছাড়াও, জেফ বিশ্বাস করতেন, নিজেদের বিবর্ধন না করতে পারা যেকোনো কোম্পানিই বিপদসীমার মধ্যে অবস্থান করে এবং একমাত্র উদ্ভাবনই পারে একটি কোম্পানিকে লাভজনক করে তুলতে। তাই তো, বার্নস এন্ড নোবেলের সাথে ঝামেলায় জড়ানোর পরপরই নিজেদের কোম্পানির শ্লোগান পরিবর্তন, বইয়ের সাথে সাথে অন্যান্য পণ্য বিক্রয়ের ঘোষণা এবং আইপিও সার্বজনীন করার মাধ্যমে বিশ্ব বাজার ও গ্রাহকদের কাছে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করার কাজগুলো বেশ দ্রুতই শেষ করেন। এর পরপরই, নিজস্ব গণ্ডি থেকে বেরিয়ে বিশ্ব ভোক্তা-পণ্য বাজারে রাজত্ব করার পাশাপাশি প্রযুক্তি বিপ্লবেও নিজেদের অবস্থান মজবুত করতেই যেন একের পর এক বিস্ময়কর প্রযুক্তিসেবা ও পণ্য বাজারে নিয়ে আসে কোম্পানিটি।
কঠিন সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার মাধ্যমে আমাজনের সব ধরনের পণ্য বিক্রয় প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠা এবং বহুজাতিক প্রযুক্তি কোম্পানি হিসেবে আজকের অবস্থানে পৌঁছনোর গল্পই থাকবে ‘জেফ বেজোস এবং অনলাইন বুক স্টোর হিসেবে আমাজনের উত্থান’-এর এবারের পর্বে।
ইন্টারনেটভিত্তিক সেবা ও বিনোদন খাতে বিনিয়োগ
ঘটনাবহুল ১৯৯৭ সালের পর আমাজনের ব্যবসায়িক মডেলের আসন্ন পরিবর্তন নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা তেমন কঠিন কিছু ছিল না। তবে সব ধরনের পণ্য বিক্রয়ের প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠার পিছনে নানা যুক্তি থাকলেও, কেউ চিন্তাও করতে পারেনি ইন্টারনেটভিত্তিক সেবা ও বিনোদন খাতের দিকে কোম্পানিটি এগোবে। এছাড়া, ১৯৯৮ সালের মতো কঠিন একটি সময়ে প্রায় ৫৫ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে ‘ইন্টারনেট মুভি ডাটাবেস (IMDb)’ ক্রয় করার মাধ্যমে আমাজন প্রতিদ্বন্দ্বীদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল, সব দিক দিয়ে প্রস্তুত হয়েই তারা প্রতিযোগিতার মাঠে নেমেছে।
ব্যাপারটিতে আরো জোর দিতেই যেন একই বছরে আমাজন ১.৫ মিলিয়ন ব্যবহারকারীর ‘PlanetAll’ নামের সোশ্যাল মিডিয়া সাইটটিও নিজেদের মালিকানায় নিয়ে আসে। সাইটটি ক্রয়ের পিছনে জেফ বেজোসের যুক্তি ছিল, এই বিশাল সংখ্যক ব্যবহারকারীকে তিনি আমাজন ডট কম থেকে বই এবং অন্যান্য পণ্য ক্রয় করার ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলতে পারবেন! একই বছরে আমাজন বইয়ের পাশাপাশি সিডি ও ডিভিডি বিক্রয় শুরু করে।
ওয়ান ক্লিক
আমাজনের মূল উদ্দেশ্যই যেহেতু ইন্টারনেটের সুবিধা ব্যবহার করে সর্বস্তরের গ্রাহকদের কাছে পণ্য পৌঁছে দেওয়া, সেহেতু তাদের এমন একটি সিস্টেম দাঁড় করানো প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল, যার মাধ্যমে ইন্টারনেটে অনভ্যস্ত গ্রাহকরাও যেন আরো সহজে পণ্য অর্ডার করতে পারে। এ সমস্যা সমাধানের জন্য বেজোস ও তার উদ্ভাবনী ইঞ্জিনিয়ার দল আমাজন ডট কমের জন্য ‘ওয়ান ক্লিক’ নামের নতুন একটি সিস্টেম দাঁড় করায়। সিস্টেমটি তৈরির লক্ষ্য ছিল, বারবার ক্রেডিট কার্ডের তথ্য এবং পণ্য প্রেরণের ঠিকানা দেওয়ার মতো বিরক্তিকর কাজগুলো থেকে গ্রাহকদের উদ্ধার করা।
মূলত, গ্রাহকরা প্রথমে কোনো পণ্য ক্রয় করার পর সিস্টেমটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হয়ে যায় এবং কোনো কিছু পুনরায় ক্রয় করতে হলে, গ্রাহককে নতুন করে তাদের ক্রেডিট কার্ডের তথ্য এবং পণ্য প্রেরণের ঠিকানা দিতে হয় না; সিস্টেমটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে গ্রাহকের পূর্ববর্তী ইনপুট থেকে সেগুলো অর্জন করে নেয়। তবে সুবিধাটি ব্যবহারের জন্য গ্রাহককে অবশ্যই ‘ওয়ান ক্লিক’ নামের নেভিগেশন বাটনটি ব্যবহার করতে হয়।
১৯৯৯ সালের সেপ্টেম্বরের ২৮ তারিখে ‘Method and System for Placing a Purchase Order Via a Communications Network’ শিরোনামে উনিশ পৃষ্ঠার একটি আবেদনপত্রের মাধ্যমে ওয়ান ক্লিক সিস্টেমটির প্যাটেন্ট করা হয়। মজার বিষয় হচ্ছে, এর মাত্র ২৩ দিন পর আমাজন, বুক জায়ান্ট বার্নস এন্ড নোবেলের বিরুদ্ধে প্যাটেন্ট লঙ্ঘনের মামলা করে। আদালতের নির্দেশে বার্নস এন্ড নোবেলকে তাদের ওয়েব সাইট থেকে চেক-আউটের জন্য অতিরিক্ত একটি স্টেপ যুক্ত করতে হয়। বলা বাহুল্য, এভাবেই খুব সূক্ষ্মভাবে জেফ বেজোস বার্নস এন্ড নোবেলকে তাদের পূর্ববর্তী শ্লোগান বিষয়ক মামলার জবাব দেন।
eBay’কে কেনার চেষ্টা, নিজেদের অকশন সাইট তৈরি এবং প্রথমবারের মতো বড় রকমের ব্যর্থতার স্বাদ গ্রহণ
AuctionWeb নামে ১৯৯৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ebay’র যাত্রা শুরু হয়। নানা ধরনের পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য সাইটটির ব্যবহার হলেও, কোম্পানিটির ব্যবসায়িক মডেল প্রচলিত ই-কমার্স থেকে কিছুটা ভিন্ন। এটি মূলত নিজেদের পণ্য বিক্রয়ের বদলে ভোক্তা থেকে ভোক্তা ও ব্যবসায়িক থেকে ভোক্তাদের মাঝে নিলামভিত্তিক ক্রয়-বিক্রয়ের সেবা দিয়ে থাকে এবং ক্রয়-বিক্রয়ের কোনো ঘটনা ঘটলেই গ্রাহকদের কাছ থেকে ক্ষুদ্র অংশের কমিশন পায়। আর এভাবেই ১৯৯৮ সালের মাঝে কোম্পানির সম্পদের পরিমাণ হয়ে ওঠে প্রায় ৫০ মিলিয়ন ডলার এবং সেই বছর আইপিও সর্বজনীন করার এক বছরের মধ্যেই তাদের সম্পদের পরিমাণ দাঁড়ায় ২২৪.৭ মিলিয়ন ডলারে।
আমাজনের সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে খুব সহজেই কোম্পানিটির কার্যক্রম বেজোসের চোখে পড়ে। তাছাড়া, এ ধরনের ‘আনলিমিটেড সিলেকশন স্টোর’ তৈরির চেষ্টাই সেসময় তিনি করে যাচ্ছিলেন। তাই মিত্র হিসেবে ই-বে’কে পাওয়া, অথবা পুরো কোম্পানিটির মালিকানা কিনে নেওয়ার জন্য তার উঠে-পড়ে লাগাটা তখন বেশ স্বাভাবিক ছিল। আর সেই বিষয়ে আলোচনা করতেই তিনি ১৯৯৮ সালের গ্রীষ্মে ই-বে’র প্রতিষ্ঠাতা পিয়েরে ওমিদিয়ার এবং সিইও মেগ হ্যোয়াইটম্যানকে সিয়াটলে আমন্ত্রণ জানান।
নানা প্রস্তাব নিয়ে দু’দল হাজির হয় এবং প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্তে হয়, দুটোর কোনো একটি ওয়েবসাইটে যদি গ্রাহকের সন্ধান করা পণ্যটি না থাকে, তাহলে একে অপরকে রেফার করবে। তবে বেজোস আরো উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। তিনি ই-বে’তে ৬০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার প্রস্তাব করেন। ই-বের সে সময়ের মূল্য অনুযায়ী অর্থের পরিমাণ এত বেশি ছিল যে, ওমিদিয়ার ও মেগ ধরেই নেয়, বেজোস কোম্পানিটি কেনার চেষ্টা করছেন। প্রথমদিকে, ওমিদিয়ারকে বেশ আগ্রহী মনে হয়। তিনি আমাজনের ডসন ডিস্ট্রিবিউটর সেন্টার পরিদর্শন করেন এবং সেখানে অটোমেশন প্রযুক্তির ব্যবহার দেখে মুগ্ধ হন। কিন্তু হ্যোয়াইটম্যানকে এসব তেমন একটা প্রভাবিত করতে পারেনি। তিনি বারবার ওমিদিয়ারকে মনে করিয়ে দেন, কোনো ওয়ারহাউজ নয়, কোনো প্রোডাক্ট প্যাকেজিং নয়, কোনো ডিস্ট্রিবিউশন নয়; গ্রাহকদের মাঝে মধ্যস্থতা অবলম্বন করেই তাদের ব্যবসা চলে আসছে। তা থেকে বের হওয়ার কোনো ইচ্ছাই ই-বের নেই। আর এভাবেই আমাজন ও ই-বের মাঝে ব্যবসা সংক্রান্ত পরিকল্পনার ইতি ঘটে।
তবে, বেজোসের মাথায় ই-বের অকশন সাইটের আইডিয়াটি ভালোভাবেই চেপে বসেছিল। তিনি গোপনে নিজেদের অকশন প্রজেক্টে হাত দেন। কলম্বিয়া সেন্টারে শুরু করা প্রজেক্টটি EBS বা Earth Biggest Selection নামে পরিচিত ছিল। কর্মচারীরা রসিকতা করে ‘eBay by spring’ নামেও ডাকতো।
১৯৯৯ সালের মার্চে বেশ জোরেশোরেই আমাজন অকশনের কার্যক্রম শুরু হয়। জেফ তার সবটুকু দিয়ে প্রজেক্টটির পিছনে লেগেছিলেন। বিভিন্ন নিলাম, ওয়েবে ব্রডকাস্টের জন্য একটি কোম্পানির ক্রয় করা, হাই-এন্ড পণ্যের জন্য বিখ্যাত আর্ট ডিলার কোম্পানি Sotheby’s Auction House এর সাথে চুক্তি করা সহ বেশ বড় অংকের টাকা তিনি প্রজেক্টটিতে বিনিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু তার সকল চেষ্টা মাঠে মারা যায়। সাধারণ ক্রেতা, যারা মূলত গতানুগতিক শপিংয়ের জন্য আমাজন ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল, তাদের কাছে আমাজন অকশন পৌঁছতে ব্যর্থ হয়। একসময় দেখা যায়, এটি পুরোপুরি অপরিচ্ছন্ন সেকেন্ড-হ্যান্ড অনলাইন মার্কেট হিসেবে পরিচিতি কুঁড়ায়। তাই শুরুর বেশ কিছু দিন পর আমাজন প্রজেক্টটি বন্ধ ঘোষণা করে। আর এভাবেই প্রথমবারের মতো বেজোস এবং তার কোম্পানি বড় রকমের ব্যর্থতার মুখোমুখি হয়। সমালোচকদের মাঝে যা আমাজনের ‘উচ্চাকাঙ্ক্ষী ব্যর্থতা’ হিসেবে বেশ পরিচিতি পায়। তবে বেজোসের পরবর্তী পদক্ষেপগুলো দেখলেই বোঝা যায়, তিনি এই ব্যর্থতা নিয়ে তেমন চিন্তিত ছিলেন না।
আমাজনের লোগোতে পরিবর্তন
২০০০ সালের জুন মাসে আমাজন তাদের লোগোতে পরিবর্তন আনে। নতুন লোগোতে দেখা যায়, নামের নিচে হাসির মতো দেখতে বাঁকানো কমলা রঙের তীর চিহ্ন A থেকে Z পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে আছে। তীর চিহ্নের হাসিটি গ্রাহকদের সন্তুষ্টির প্রতি যত্নশীলতার প্রতিনিধিত্ব করে এবং A থেকে Z পর্যন্ত বিস্তৃতি দ্বারা বোঝানো হয়, আমাজন সব ধরনের পণ্য বিক্রয় প্রতিষ্ঠান। লোগোটির ডিজাইনও যে আমাজনের চিন্তা-চেতনার উৎকৃষ্টতার প্রমাণ রাখে, তা বলা বাহুল্য।
একবিংশ শতাব্দীতে ক্রমবিবর্তন ও বিবর্ধন
একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকের ডট কম বাবল বিস্ফোরণে অনেক ই-কোম্পানিই মুখ থুবড়ে পড়েছিল। যারা টিকে ছিল, তাদেরও ইন্টারনেটের মতো নবীন এবং দ্রুত বিবর্তিত প্রযুক্তির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে বেশ খাটাখাটি করতে হয়েছিল। আমাজনের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। কোম্পানিটি তখনো সব কিছু কীভাবে কাজ করে, তা বুঝে ওঠার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। তবে খুব দ্রুতই কোম্পানিটি তাদের লক্ষ্যের দিকে ছুটতে শুরু করে।
পরিধেয় পোশাক পণ্য বিক্রয়ের দিকে ঝোঁক
২০০২ থেকে আমাজন বেশ বড় পরিসরে পরিধেয় পোশাক পণ্য বিক্রয় শুরু করে। কোম্পানিটি ল্যান্ড’স এন্ড, নর্ডস্ট্রম ও দ্য গ্যাপের মতো প্রায় একশোরও বেশি বড় বড় খুচরা কাপড় বিক্রেতা ব্র্যান্ডের সাথে যুক্ত হয়। এমনকি, শিশুদের পোশাক, খেলনা বিক্রেতা অনলাইন কোম্পানি ‘Toys ‘R Us’ এবং মিউজিক ও বইয়ের খুচরা বিক্রেতা ‘বর্ডারস গ্রুপ ইনকর্পোরেশন’ এর মতো সাইটগুলোকে আমাজন সার্ভিসের আওতায় নিয়ে আসে। ফলে আমাজনের গ্রাহকরা খুব সহজেই এসব থার্ড পার্টি কো-ব্র্যান্ডেড সাইটগুলো থেকেও পণ্য ক্রয়ের সুযোগ পায়। সে বছরই আমাজন ওয়েব সার্ভিস এবং ক্লাউড কম্পিউটিং প্লাটফর্মের দিকেও ঝুঁকতে শুরু করে।
ই-কমার্স সার্চ ইঞ্জিন ‘A9’ তৈরি এবং পরীক্ষামূলক নানা পণ্য বিক্রয়
২০০৩ সালে আমাজন প্রথমবারের মতো ই-কমার্স ভিত্তিক বাণিজ্যিক সার্চ ইঞ্জিন তৈরি করে। ‘A9‘ নামের সার্চ ইঞ্জিনটি মূলত পণ্যের কোয়ালিটির উপর গ্রাহকদের রিভিউ, গ্রাহক সন্তুষ্টি, শিপিং স্পিড, সেলস র্যাংকিং, দামসহ নানা ফ্যাক্টর বিবেচনায় এনে ব্যবহারকারীর ইনপুট দেওয়া কিওয়ার্ডের উপর ভিত্তি করে র্যাংকিংয়ে উপরে আছে এমন ব্র্যান্ড ও অনলাইন মার্কেটসহ নির্ধারিত পণ্যটির ফলাফল প্রদর্শন করে। এতে করে গ্রাহকরা খুব সহজেই পরিমিত মূল্যের মাঝে ভালো পণ্যটি খুঁজে বের করতে পারে।
একই সময়ে আমাজন প্রায় ত্রিশ হাজার আলাদা আলাদা ব্র্যান্ডের খেলনা যোগ করা সহ নানা ধরনের পণ্য তাদের স্টোরে যোগ করতে থাকে। সে সময়ের ছোটখাট সফলতাগুলো ছাপিয়ে পরীক্ষামূলক পণ্য বিক্রয় স্পৃহা তাদের জুয়েলারি পণ্য বিক্রয়ের দিকে ধাবিত করলেও তেমন একটা সফলতার মুখ দেখেনি।
চীনের বাজারে আমাজন
২০০৪ সালে কোম্পানিটি চীনের সবচাইতে বড় বই এবং ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য বিক্রয় প্রতিষ্ঠান Joyo’কে কেনার মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান চাইনিজ মার্কেটে প্রবেশ করে। কোম্পানিটির নাম পরিবর্তন করে ‘আমাজন চায়না’ রাখা হয়। তবে, আলিবাবার মতো শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীকে পাশ কাটিয়ে তেমন একটা সুবিধা করে উঠতে পারেনি তারা। ২০১৮ সালের eMarketer এর হিসেব অনুযায়ী, চীনব্যাপী আমাজনের বিক্রয় মাত্র ০.৭ শতাংশ, যেখানে আলিবাবা ৫৮.২ শতাংশ বিক্রয় নিয়ে সর্বোচ্চ অবস্থানে আছে।
আমাজন প্রাইম
২০০৫ সালে কোম্পানিটি ‘আমাজন প্রাইম’ নামের একটি সার্ভিস উন্মুক্ত করে। এটি একটি প্রিমিয়াম সাবস্ক্রিপশন সার্ভিস, যার মাধ্যমে গ্রাহকরা বছরে মাত্র ৭৯ ডলারের বিনিময়ে যেকোনো অর্ডারে দুই দিনের মধ্যে ফ্রি শিপিং সুবিধা পেয়ে থাকে। সার্ভিসটি উন্মুক্ত করার পরপরই বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আমাজনের সবচাইতে মূল্যবান সম্পদগুলোর মধ্যে আমাজন প্রাইমের অবস্থান বেশ উপরে। অনেকেই দাবি করে, আমাজন প্রাইমের সফলতার উপর ভিত্তি করেই পরবর্তী দশ বছরের মধ্যে কোম্পানিটি ইতালি, জাপান, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, কানাডাসহ আরো কয়েকটি দেশে নিজেদের ব্যবসা ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়। বর্তমানে, পুরো পৃথিবীব্যাপী আমাজন প্রাইমের সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা প্রায় ১০০ মিলিয়ন।
ই-রিডারের বাজারে আমাজন
আমাজনের জন্য ই-রিডারের বাজারে প্রবেশ করা তেমন বিস্ময়কর কিছু ছিল না। বই দিয়ে নিজেদের যাত্রা শুরু করা কোম্পানিটি তাদের উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বই বাণিজ্যের সাথে সংশ্লিষ্ট সব রকমের সম্ভাব্য পন্থাগুলো বিবেচনা করে এগোবে, তা-ই যেন স্বাভাবিক ছিল। ২০০৭ সালে ‘আমাজন কিন্ডল’ ই-রিডার বাজারে নিয়ে আসার মাধ্যমে কোম্পানিটি তা-ই প্রমাণ করে।
১৯৯৮ সালে নুভমিডিয়ার হাত ধরে প্রথমবারের মতো ‘রকেট ই-বুক’ ই-রিডারটির কমার্শিয়াল সংস্করণ বের হয়। এরপর প্রায় ছয় বছর পর, ২০০৪ সালে সনি কর্পোরেশন হাত ধরে ‘সনি লিব্রিই’ এবং ২০০৬ সালে ‘সনি ই-রিডার’ বাজারে আসে। তবে, আমাজন কিন্ডলের মতো ই-রিডারের বাজারে কেউ বাজিমাত করতে পারেনি।
২০০৭ সালে বাজারে আসার মাত্র সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে সবগুলো কিন্ডল ই-রিডার বিক্রি হয়ে যায়। এখন পর্যন্ত কোম্পানিটি কিন্ডলের প্রায় তেরটি সংস্করণ বাজারে এনেছে। এদের মধ্যে সবচাইতে জনপ্রিয় ই-রিডারটি, কিন্ডল পেপারহ্যোয়াইট। কিন্ডল স্টোরের সাথে সংযুক্ত থাকায়, পাঠকদের মাঝে ডিভাইসটির জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়েই চলছে। প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বার্নস এন্ড নোবেলের ‘নুক’ সিরিজ এবং ‘Kobo’র মতো বেশ জনপ্রিয় কিছু ই-রিডার বাজারে থাকলেও, কিন্ডল এখনো প্রতিযোগিতার দৌড়ে বেশ এগিয়ে।
আমাজনের Audible এবং Zappos ক্রয়
আমাজন ২০০৮ সালে ৩০০ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে অডিও-স্ট্রিমিং সার্ভিস ‘Audible’ এর স্বত্ত্ব ক্রয় করে নেয়। কোম্পানিটি মূলত পেইড সাবস্ক্রিপশনের মাধ্যমে গ্রাহককে অডিও-বুক, রেডিও প্রোগ্রাম শোনার ব্যাপারে সাহায্য করে। কিন্ডল ওয়াসিসসহ ফায়ার ট্যাবলেটের বদৌলতে কিন্ডল গ্রাহকরাও দিন দিন অডিও-বুকের দিকে ঝুঁকছে। স্মার্টফোন এবং স্ট্রিমিং সিস্টেম আছে এমন গাড়িগুলোর দ্রুত বৃদ্ধির ফলে এ ধরনের অডিও-স্ট্রিমিং সার্ভিসের মার্কেটও দিন দিন বড় হচ্ছে। বর্তমানে অডিও-বুক মার্কেটের প্রায় ৪১ শতাংশই Audible এর আওতায়।
Audible ক্রয়ের মাত্র এক বছরের মধ্যে, ২০০৯ সালে কোম্পানিটি লাস ভেগাসভিত্তিক জুতা ও কাপড়ের খুচরা বিক্রেতা অনলাইন কোম্পানি ‘Zappos’ এর প্রায় ১.২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের সবগুলো শেয়ার কিনে নেয়। কোম্পানিতে এত বড় পরিমাণের বিনিয়োগের মূল কারণ ছিল, জুতো বিক্রয়ের অনলাইন বাজারে Zappos’ এর সাথে প্রতিযোগিতায় পেরে উঠতে না পারা।
বাজারে কিন্ডল ফায়ারের আগমন
ট্যাবলেট কম্পিউটারের বাজারে আমাজনের আগমন ২০১১ সালে। আইপ্যাডের মতো জনপ্রিয় ট্যাবলেটের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবেই যেন আমাজন কিন্ডল ফায়ার বাজারে ছাড়ে ঐ বছরের নভেম্বরে। স্বল্প দামের মধ্যে হওয়ায় ট্যাবলেটটি বেশ প্রশংসাও কুঁড়ায়।
আমাজনের রোবটিক্স কোম্পানি ক্রয়
২০১২ সালে আমাজন ৭৭৫ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে ‘কিভা সিস্টেমস’ নামক একটি ওয়ারহাউজ রোবট প্রস্ততকারক কোম্পানি ক্রয় করে। অল্প মানবশক্তি ব্যবহার করে পণ্য সরবরাহে আরো গতি যোগ করতে কোম্পানিটি কাজ করে যাচ্ছে।
আমাজন ইকো
আমাজনের স্মার্ট স্পিকার ‘আমাজন ইকো’ বাজারে আসে ২০১৪ সালের নভেম্বরে। বাজারে আসার পরপরেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ‘অ্যালেক্সা’ নিয়ন্ত্রিত ডিজিটাল হোম অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিভাইসটি পৃথিবীব্যাপী প্রায় বিশ মিলিয়ন বাড়িতে জায়গা করে নেয়। ভয়েস নিয়ন্ত্রিত ডিভাইসটি ব্যবহারকারীর নির্দেশে কর্মপরিকল্পনা তৈরি, সংবাদপত্র পড়ে শোনানো, গান বাজানো সহ ডিজিটাল হোম অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে থার্মোস্ট্যান্ট, সিকিউরিটি ক্যামেরা, গ্যারেজের দরজা, স্মার্ট লক, লাইট, পাখা সহ নানা আইওটি ডিভাইস নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। আমাজন ইকোর মাধ্যমেই কোম্পানিটি মূলত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দুনিয়ায় পুরোপুরিভাবে প্রবেশ করে।
আমাজনের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ
বর্তমানে আমাজন ট্রিলিয়ন ডলারের কোম্পানি। বহুজাতিক প্রযুক্তি কোম্পানি অ্যাপল ইনকর্পোরেশনের পরপর আমাজনই এই বিশাল সম্পদের মাইলফলক পাড়ি দিতে পেরেছে। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে কোম্পানিটি আরো এগিয়ে যাচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বিগ ডাটা, নিউরো কম্পিউটিং থেকে শুরু করে চাঁদে উপনিবেশ স্থাপনে জেফ বেজোসের মালিকানাধীন অ্যারোস্পেস কোম্পানি ‘ব্লু অরিজিন’ এর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার পেছনেও যে আমাজনের শক্ত ইন্ধন রয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
ভবিষ্যতে পণ্য ডেলিভারিতে আরো গতি বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমাজন নিজেদের ড্রোন ডেলিভারি বিষয়ক প্রজেক্ট ‘আমাজন প্রাইম এয়ার’ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে বেশ কয়েক বছর ধরে। হেলথ কেয়ার এবং এন্টারটেইনমেন্ট প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ, স্মার্ট হোম পণ্য তৈরি থেকে শুরু করে কোম্পানিটি বোস্টন ডায়নামিকের মতো রোবটিক্স কোম্পানির পিছনেও মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করছে।
সামান্য অনলাইন বুক স্টোর হিসেবে যাত্রা শুরু করা কোম্পানিটি প্রায় সব দিক থেকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নিজেদের আত্মপ্রকাশ ঘটিয়েছে। দিন দিন কোম্পানিটি ‘এভ্রিথিং স্টোর’ থেকে ‘এভ্রিথিং কোম্পানি’ হয়ে উঠছে। তারপরেও কোম্পানিটির প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও জেফ বেজোস মনে করেন, “আমাজন এখনো দেউলিয়া না হওয়ার মতো বড় কোম্পানি হয়ে ওঠেনি।” জেফ বেজোসের এ ধরনের মনোভাবই যে আমাজনকে আরো বেশি শক্তিশালী ও সম্পদশালী করে তুলবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
প্রথম পর্ব: জেফ বেজোস এবং অনলাইন বুক স্টোর হিসেবে আমাজনের উত্থান