লেবানন; ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী মধ্যপ্রাচ্যের ছোট্ট একটি দেশ। দেশটির নানা ঐতিহাসিক স্থাপত্য, চোখ জুড়ানো সব সমুদ্রসৈকত, পটে আঁকা ছবির মতো সুন্দর পাহাড়-পর্বত আর অবশ্যই লেবানিজ ক্রুইজিনের সুস্বাদু সব খাবারের বদৌলতে মধ্যপ্রাচ্য তো বটেই, সারা পৃথিবীর মানুষের কাছেই দেশটি একটি লোভনীয় গন্তব্য। নানা সময়ে বিভিন্ন সভ্যতার সংস্পর্শে এসে লেবানন সমৃদ্ধ হয়েছে ইতিহাস, ভাষা ও সংস্কৃতিতে। ক্যানানাইট, ফিনিশীয়, আরব ও ফরাসি সভ্যতার সেসব নিদর্শন আজও দেখা যায় লেবাননের মাটিতে।
লেবানন ইসলাম ও খ্রিস্টবাদের বিস্ময়কর সহাবস্থানের ভূমি। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সভ্যতার আশ্চর্য মেলবন্ধনও এখানে লক্ষ্যণীয়। এটি এমনই এক দেশ, যেখানে সব রুচির মানুষ মুগ্ধ হওয়ার মতো কোনো না কোনো উপকরণ পাবেনই। চলুন এবার জেনে নেয়া যাক লেবাননের রুপে মন রাঙাতে ও লেবাননের বিচিত্র ইতিহাসের স্পর্শ পেতে কোন জায়গাগুলো অবশ্যই ঘুরে দেখতে হবে।
জিটা গ্রটো
লেবাননের রাজধানী বৈরুত থেকে ১৮ কি.মি. দূরে নাহর আল-কালবের উপত্যকায় অবস্থিত জিটা গ্রটো মূলত একটি গুহা। এখানে দুটি আলাদা কিন্তু আন্তঃসংযুক্ত চুনাপাথরের গুহা প্রায় ৯ কি.মি. এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। গুহার অভ্যন্তরে কুলকুল ধ্বনিতে বয়ে যায় ভূগর্ভস্থ নদী। এই নদী লেবাননের লক্ষ মানুষের খাবার পানির যোগান দেয়।
গুহার ছাদ ছুঁতে চাওয়া চুনাপথরের স্তম্ভ স্ট্যালাগমাইট আর ছাদ থেকে মাটি ছুঁতে চাওয়া স্ট্যালাকটাইটের চোখধাঁধানো রুপ আপনাকে মুগ্ধ করবেই। জিটা গ্রটো লেবাননের অন্যতম সেরা পর্যটন আকর্ষণ। দর্শনার্থীদের জন্য ভূগর্ভস্থ নদীতে নৌকাভ্রমণের ব্যবস্থা রয়েছে এখানে। এটি নতুন নির্বাচিত প্রাকৃতি সপ্তাশ্চর্যের একটি।
ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব বৈরুত
লেবাননের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে হলে এই জাদুঘরটি ঘুরে দেখতেই হবে। লেবাননের ইতিহাসের নানা পথ পরিক্রমার নানা স্মারককে কাচবন্দী করেছে এই জাদুঘর। ফিনিশীয় থেকে শুরু করে গ্রিক, বাইজেন্টাইন ও আরব শাসনামলের নানা স্মৃতিচিহ্নের দেখা মেলে এখানে।
এখানে রয়েছে ফিনিশীয় গহনা, হস্তশিল্প ও শিলালিপির প্রদর্শনী। জাদুঘরের ভূগর্ভস্থ কক্ষে রয়েছে একটি সমাধিসৌধ ও চোখধাঁধানো কিছু দেয়ালচিত্র। জাদুঘরে প্রবেশের পর লেবাননের ইতিহাসের উপর নাতিদীর্ঘ প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়, যা দেখলে লেবাননের ইতিহাস সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা পাওয়া যায়।
কাদিশা উপত্যকা
লেবাননের উত্তর মুহাফাজার (রাজ্য) দুই শহর বীচার ও জিগার্টার মাঝখানে অবস্থিত অনিন্দ্যসুন্দর এই উপত্যকা। উপত্যকায় পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কাদিশা নদী।
কাদিশা উপত্যকা যাওয়ার পথে চোখে পড়বে বীচারের নয়নাভিরাম পাহাড়ি গ্রামগুলো, যা হতে পারে আপনার দেখা লেবাননের সেরা দৃশ্যগুলোর একটি। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ ধরে যতই উপরে ওঠা যায়, কাদিশা উপত্যকা ততই মনোমুগ্ধকর রুপে ধরা দিতে থাকে। এটি একটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট।
এখানে পাহাড়ের গায়ে রয়েছে পাথরের তৈরি আশ্রম, লাল টালির বাড়িঘর আর সবুজ বন। বনে বুনোফুলের ছড়াছড়ি। বণ্যপ্রাণীরও দেখা মেলে এখানে। এখানে বেশ কিছু হাইকিং ট্রেইলও আছে।
টায়ার
দক্ষিণ লেবাননের সাগর পাড়ের শহর টায়ার। টায়ার একটি প্রাচীন ফিনিশীয় শহর। বর্তমানে এটি লেবাননের চতুর্থ বৃহত্তম শহর।
টায়ার শহরকে ঘিরে আছে নানা কিংবদন্তী। কথিত আছে, বেগুনি রঙ নাকি এখানেই প্রথম তৈরি হয়েছিল। হয়তো তাই টায়ার বন্দর থেকে দূরে সরু রাস্তার পাশের বাড়িঘরগুলো সব উজ্জ্বল বেগুনি রঙের। টায়ারের পুরনো অংশে রয়েছে বেশ কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। মিনা তার মধ্যে অন্যতম।
ব্লিবস
ফিনিশীয়, রোমান এবং ক্রুসেডের সময়কার ধ্বংসাবশেষ এবং সুশোভিত বালুকাবেলা ব্লিবসকে করেছে লেবাননের অন্যতম সেরা পর্যটন আকর্ষণে। ২০১৬ সালে ব্লিবসকে ‘আরবের পর্যটন রাজধানী’ ঘোষণা করা হয়েছিল।
সিডন
দক্ষিণ লেবাননে ভূমধ্যসাগরের পাড়ে অবস্থিত এই শহরটি লেবাননের তৃতীয় বৃহত্তম শহর। সিডনের রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস।
সাইট্রাস ও কলাগাছে ঘেরা সিডন লেবাননের ব্যস্ত বন্দরনগরী। সিডরের প্রধান পর্যটন আকর্ষণের মধ্যে রয়েছে দ্য সী ক্যাসল, সিডরের পুরনো বাজার এবং মধ্যযুগীয় নানা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন।
বালবেক
সিরিয়া সীমান্তে অবস্থিত বালবেক শহরটি পৃথিবীর বৃহত্তম রোমান ধ্বংসাবশেষ ধারণ করে আছে। বালবেক অবস্থিত বেকা উপত্যকায়, বৈরুতের উত্তরে।
দ্বিতীয় শতাব্দীরও আগে নির্মিত এখানকার মন্দিরগুলো ছিল রোমানদের পবিত্র তীর্থ। এখানকার রোমানরা তিন দেবতার (জুপিটার, ভেনাস ও মার্কারি) উপাসনা করতো।
বালবেকের প্রধান মন্দির জুপিটারের মন্দির। বড় বড় পাথরের টেরেস বেষ্টিত এই মন্দিরটি ২০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত।
সেন্ট্রাল ডিস্ট্রিক্ট অব বৈরুত
লেবাননের রাজধানী বৈরুতের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত সেন্ট্রাল ডিস্ট্রিক্ট অব বৈরুত লেবাননের ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-সংস্কৃতি এবং বিনোদনের কেন্দ্রবিন্দু। এটি বৈরুত শহরের উত্তরপ্রান্তে অবস্থিত। লেবাননের গৃহযুদ্ধের সময় শহরের এই অংশ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
শহর পুনর্নির্মাণ করতে লেবানন সরকারকে গুনতে হয়েছে অনেক অর্থ। বৈরুতের সব সরকারি অফিস-আদালত এখানে অবস্থিত। দেখার জায়গার অভাব নেই এখানে। শহরের প্রাণকেন্দ্র নাজিম স্কয়ার থেকেই শুরু করা যেতে পারে। এখানেই অবস্থিত লেবাননের পার্লামেন্ট ভবন। এছাড়া আছে ক্লক টাওয়ার। দেশীয় ফুল-ফল ও খাদ্যদ্রব্যে ঠাসা বৈরুতের বাজারগুলোতে বিশ্বের নানা দেশের লোকজনের ব্যাপক ভীড় বৈরুতের বাজারকে বিশ্বজনীন রুপ দিয়েছে। এছাড়া বৈরুতে রয়েছে গ্র্যান্ড ওমারি মসজিদ ও অটোমান সাম্রাজ্যের নানা নিদর্শন। তবে সেন্ট্রাল বৈরুতের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দর্শনীয় স্থান সম্ভবত কর্নিচ।
প্রশস্ত এই চত্বরের একপাশে রয়েছে খোলা সাগর আর অন্যপাশে সগর্বে দাঁড়িয়ে মাউন্ট লেবানন।
সিডারস অব গড
লেবাননের সুবিশাল সিডার বনের একটুকরো নিদর্শন সিডারস অব গড। প্রাচীনকালে মাউন্ট লেবাননের গায়ে গড়ে উঠেছিল বিশাল সিডার বন।
সিডার গাছ লেবাননের জাতীয় প্রতীক। কয়েকশ বছর ধরে চলা নির্মম মরুকরণের ফলে এই বনের অনেকটাই আজ হারিয়ে গেছে। পুরানে আছে, দক্ষিণ মেসোপটেমিয়ার পবিত্র সিডারবনে ডেমিগড আর সাধারণ মানুষের যুদ্ধ হয়েছিল। যুদ্ধে সাধারণ মানুষ জিতে গিয়ে যখন বনে প্রবেশ করলো, তখন সুমেরীয় দেবতা এনলিল পুরো বনকে উজাড় করে ফেলে। বলা হয়ে থাকে, সুমেরীয় রাজা গিলগামেশ সিডার গাছ কেটে শহর বানিয়েছিল।
এ তো গেলো পুরানের কাহিনী। বাস্তবেও শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ফিনিশীয়, রোমান, তুর্কীরা সিডার গাছ কম কাটেনি। ফিনিশীয়রা সিডার গাছে কেটে জাহাজ বানাতো।
আল সউফ সিডার ন্যাচার রিজার্ভ
এটি লেবাননের সউফ জেলায় অবস্থিত একটি প্রাকৃতিক অভয়ারণ্য। কারোক পর্বতের ঢালে অবস্থিত এই অভয়ারণ্যে রয়েছে প্রচুর সিডার গাছ। এটি লেবাননের সবচেয়ে বড় সিডার রিজার্ভ।
সিডার গাছ সংরক্ষণের মহতী উদ্যোগ দেখতে ঘুরে আসুন আল সউফ সিডার ন্যাচার রিজার্ভ থেকে।
জিবরান জাদুঘর
লেবাননের বিশ্ববিখ্যাত কবি, দার্শনিক ও চিত্রশিল্পী কাহলিল জিবরানের স্মৃতিবিজড়িত এই জাদুঘরটি। এটি বৈরুত থেকে ১২০ কি.মি. দূরে অবস্থিত। এখানে রয়েছে জিবরানের কবর, তার ব্যবহার্য নানা জিনিস এবং তার আঁকা ৪৪০টি চিত্রকর্ম।
বেতএদ-দিন প্রাসাদ
এটি লেবাননের ছোট্ট একটি শহর। এটি মূলত বেতএদ-দীন প্রাসাদের জন্য সুপরিচিত। ঊনবিংশ শতাব্দীতে পাহাড়ের উপর নির্মিত এই দৃষ্টিনন্দন প্রাসাদটি লেবানিজ স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শন।
এর সুসজ্জিত ও জাঁকজমকপূর্ণ কোর্ট ও টেরেস এর ভূতপূর্ব বাসিন্দাদের বিলাসবহুল জীবনযাত্রার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। প্রতিবছর গ্রীষ্মকালে এই প্রাসাদে বিশেষ একটি উৎসবের আয়োজন করা হয়, যা পুরো মধ্যপ্রাচ্যে বেশ জনপ্রিয়।