গত ১৯ অক্টোবর ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের অমৃতসরে দশেরার রাবণের কুশপুত্তলিকা দহনের সময়ে ঘটে যায় এক মর্মান্তিক ঘটনা। যখন দশেরা উদযাপনে বহু মানুষ একত্রিত হয়েছে অমৃতসরের জোড়া ফটক অঞ্চলে, ভিড় উপচে পড়েছে পাশের রেললাইনের উপরে; সবার নজর রাবণ দহনের দিকে, তক্ষুনি একটি দ্রুতগামী ট্রেন হুড়মুড়িয়ে এসে পড়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের উপরে। তৎক্ষণাৎ ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় বহু মানুষ। ষাটজনের মৃত্যু ঘটে; আহত হয় আরও প্রচুর মানুষ।
ভয়ঙ্কর এই ঘটনা ঘটার পরপরই শুরু হয়ে যায় দোষারোপের খেলা। রাজনীতির আঁচ পড়তেও বেশি সময়ে লাগে না। বলা হয়, দশেরার ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের শাসক দল কংগ্রেসের এক নেত্রী। এবং অবস্থা বেগতিক দেখে তিনি নাকি সটান পলায়ন করেন ঘটনাস্থল থেকে। দোষ পরে ট্রেনের ড্রাইভারের উপরেও। প্রশ্ন ওঠে, কেন তিনি গাড়ি দাঁড় করাননি অত মানুষের ভিড় দেখেও।
ঘটনা হচ্ছে; এমন একটি ট্র্যাজেডি ঘটার পরে স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ মানুষ ক্ষিপ্ত থাকবেন। প্রশাসন, রেল, উদ্যোক্তা বা রাজনৈতিক নেতৃত্বকে তারা দুষবেন, বলা হবে সাধারণ মানুষের জীবনের ন্যূনতম সুরক্ষা নিয়ে কেউ বিন্দুমাত্র ভাবিত নয়। ‘কর্তৃপক্ষ নিপাত যাও’ ধরনের স্লোগান উঠবে।
সবসময় সরকারের দোষ দেখা সমস্যার সমাধান নয়
যাদের প্রিয় মানুষগুলো এই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাল, তাদের প্রতি পূর্ণ সমবেদনা নিয়েই বলতে বাধ্য হতে হয়: এই ধরনের দুর্ঘটনার জন্যে দায় সাধারণ মানুষেরও কম নয়। মানবাধিকার সংগঠনগুলো ইতিমধ্যেই আসরে নেমে পড়েছে; রাজ্য সরকার এবং ভারতীয় রেলওয়ের উচ্চ আধিকারিকদের কাছ থেকে এ ব্যাপারে পূর্ণাবয়ব রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছে। গণতান্ত্রিক কাঠামোতে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সবসময়ে সরকারের দোষ দেখাটা কি যুক্তিসংগত? সরকার আমাদের নেতৃত্ব দিলেও যেখানে সাধারণ বুদ্ধির হিসেবে আমরা নিজেদের ন্যূনতম সুরক্ষা নিজেরাই নিতে পারি, সেখানেও সরকারের উপরে অতিরিক্ত নির্ভরতা কেন? এ কি এক ধরনের উত্তর-ঔপনিবেশিক অভ্যাসের পরিচয়?
সরকারের মুখ চেয়ে থাকি, আবার সরকারের নিয়মই ভাঙি
সমস্যা হচ্ছে, একদিকে যেমন আমরা ধরেই নিই সরকারই আমাদের অভিভাবক, সুখে দুঃখে সেই আমাদের পাশে দাঁড়াবে; অন্যদিকে আমরাই আবার সেই সরকারেরই তৈরী নিয়ম ভাঙার খেলায় মেতে উঠি। নিয়মভঙ্গের মধ্যে এক জয়ের গৌরব খুঁজে পাই, যার মধ্যেও রয়েছে সেই একই উত্তর-ঔপনিবেশিক মানসিকতা। এই মানসিকতার থেকে তৈরি হয় এক ধরনের গা-ছাড়া মনোবৃত্তি আর সেই মনোবৃত্তি যখন এক বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে, তখনই বেজে ওঠে বিপদের দামামা। অমৃতসরের ঘটনা সেটাই প্রমাণ করে।
ছুটন্ত ট্রেনের দিকে দৌড়ে যাওয়া এবং মৃত্যু: কতটা দায়িত্বজ্ঞান রয়েছে আমাদের গণমাধ্যমের?
অমৃতসরের পরেও ট্রেন দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল থেমে যায়নি। একদিকে যখন ওই ভয়ঙ্কর ঘটনার রেশ চলেছে, খবর এল পশ্চিমবঙ্গে কয়েকটি কমবয়সী ছেলে একটি ধাবমান ট্রেনের দিকে ছুটছিল বাজি ধরে এবং তাদের মধ্যে একজন ঠিক সময়ে সরতে না পারাতে কাটা পড়ে। এই ভয়ঙ্কর কাণ্ডটি আমরা দেখেছিলাম বছর বিশেক আগে বলিউডে তৈরি হওয়া ‘গুলাম’ নামের একটি ছবিতে। সেখানে ছবির নায়ক আমির খান এমনই একটা কাণ্ড করেছিলেন বাজি লড়ে; ছুটেছিলেন চলন্ত ট্রেনের নাক বরাবর। আমিরের স্টারডম তাকে বাঁচিয়ে দেয় কিন্তু কঠোর বাস্তবে সাধারণ মানুষকে আর কে বাঁচাবে? ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়; অনিবার্য মৃত্যু।
ঘটনা হচ্ছে, বলিউডের মতো একটি শক্তিশালী মিডিয়াও কি সেক্ষেত্রে একইরকমভাবে দোষী নয়? বিনোদনের মশলা সরবরাহ করতে গিয়ে সাধারণ যুবক-কমবয়সীদের সামনে ভয়ঙ্কর কাজকারবার প্রলোভন দেখানো কোন সামাজিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে? আমির খান তো বিগত এক দশকে অনেক সামাজিক সচেতনতামূলক ছবি বানিয়েছেন, কিন্তু যখন তিনি জানতে পারবেন যে দুই দশক আগে তারই অভিনীত একটি ছবির মতো স্টান্ট করতে গিয়ে ঝরে গিয়েছে একটি তরুণ প্রাণ, তখন তার কী প্রতিক্রিয়া হবে?
“ও কিছু হবে না” মানসিকতা
ভারতীয়দের একটি বড় ব্যাধি হচ্ছে তারা সুরক্ষার সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী নয়। “ও কিছু হবে না” ভাবনায় বিশ্বাসী। তাই নদীর পথে ঘর তৈরি করা; পাহাড়ের ঢালুতে দালান তুলে ফেলা; রেলপথের উপরে নৃত্য করা- এসবে তাদের অনীহা নেই। কিন্তু সর্বনাশ ঘটলে তখন সব দোষ সরকারের, কারণ দিনের শেষে তাকে আমরা কর দিচ্ছি। তাকে গালিগালাজ করার এক সহজাত অধিকার যেন তৈরি হয়ে যাচ্ছে আমাদের। এই দ্বিচারিতা থেকে বেরোনোর পথ যদ্দিন না আমরা খুঁজে বের করতে পারছি, আমাদের দুর্দশা চলতেই থাকবে।
উন্নয়নশীল সমাজে দৈবের উপরে ভরসা করার ব্যাধি
আসলে উত্তর-ঔপনিবেশিক সমাজব্যবস্থায় বোধহয় দৈবের উপরে ভরসা করার প্রবণতা বেশি হওয়ার কারণ রয়েছে। উন্নয়নশীল দেশ বা সমাজে যেখানে অনেক কিছুরই এখনও অভাব; মানুষের দৈনন্দিন চাহিদা মেটানোর জন্যে যথেষ্ট ক্ষমতা প্রতিষ্ঠানের নেই, সেখানে ভগবান ভরসা অনেকেরই কাছে। আর এই ভগবানের উপরে নির্ভরশীল থাকার মানসিকতা নিজেদের অজান্তেই আমাদের মধ্যে কখন যেন ঢুকিয়ে দেয় এক চূড়ান্ত উদাসীনতা। আমরা হয়ে উঠি বেপরোয়া। একদিকে নিয়মের তোয়াক্কা না করা, অন্যদিকে দৈবের উপরে নির্ভরতা- এই দুইয়ের মেলবন্ধনে তৈরি হয় এক বিপজ্জনক মানসিক আকার। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলছে এই ট্র্যাডিশন আর এর থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় ধৈর্য ধরে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি। আর সেটা শুধু সরকারের কাজ নয়। গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে এই কর্ম সম্পাদনের জন্য।
রাজনীতিকরা ভোট হারানোর ভয়ে আসল সমস্যা কী তা বলতে রাজি নন
সমস্যা আরও জটিল হয় যখন সমাধান খুঁজতে গিয়ে শুরু হয় রাজনৈতিক বাদানুবাদ। উন্নয়নশীল বিশ্বের জনবহুল দেশগুলোতে রাজনীতির কারবারিদের কাছে মানুষ হচ্ছে সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক মূলধন। আর তাই যেকোনো প্রাণহানিকর ঘটনায় প্রথমেই শুরু হয়ে যায় বিরোধীদের বিরুদ্ধে আক্রমণ। অমৃতসরের ঘটনার পরে পূর্বতন শাসক দল শিরোমণি অকালি দলের অধ্যক্ষ সুখবীর সিং বাদলকে বলতে শোনা গেল ‘মাস ম্যাসাকার’ কথাটি। তিনি শব্দটি ব্যবহার করলেন কর্তৃপক্ষকে দুষতে গিয়ে। এখানে পরিষ্কার বোঝা যায় আমাদের দেশের পপুলিস্ট নেতাদের অবস্থান। সাধারণ মানুষের ত্রুটিকে দেখিয়ে দেওয়ার সৎ সাহস নেই কোনো রাজনৈতিক নেতৃত্বেরই, কারণ দিনের শেষে একটি মানুষ হচ্ছে একটি ভোট। তাই যত পারো বিপক্ষকে দোষ দাও, লোককে খেপিয়ে দাও, ‘মাস ম্যাসাকার’-এর মতো গুরুতর শব্দ ব্যবহার করে প্রমাণ করার চেষ্টা করো যে, ঘটনাটার পেছনে আসলে দায়ী দিনের শাসকই। এই প্রবণতাটি আরও ভয়ঙ্কর, কারণ এর অর্থ দেশের কাণ্ডারীরা আসল ভোট হারানোর ভয়ে সমস্যার শিকড়ে যেতে রাজি নয়। আর যদি নেতৃত্বই এই কাজ করে, তাহলে তো সমাধানের পথ অধরাই থেকে যায়।