যেসব ড্রাগ মানুষকে হ্যালুসিনেশন বা হ্যালুসিনেশনের মতো বিভিন্ন মনস্তাত্ত্বিক অভিজ্ঞতা এনে দেয় তাদেরকে বলা হয় সাইকেডেলিক ড্রাগ। সাম্প্রতিক সময়ে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে আমাজন অঞ্চলের আয়াহুয়াস্কা নামের একটি সাইকেডেলিক ড্রাগ। একে ঘিরে গড়ে উঠছে বেশ বড়সড় ইন্ডাস্ট্রি। অনেক মানুষ প্রচুর টাকা ঢালছে এর তীব্র সাইকেডেলিক অভিজ্ঞতা নেওয়ার জন্যে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে এ ড্রাগটি এখনো নিষিদ্ধ বলে বহু মানুষ নিয়মিত যুক্তরাষ্ট্র থেকে সাউথ-আমেরিকায় পাড়ি জমাচ্ছে, তাদের ‘আয়াহুয়াস্কা-সফর’ এর জন্য।
এ ড্রাগটি তৈরি করা হয় মূলত দু’ধরনের গাছের অংশ থেকে। Psychotria viridis নামের একটি গাছের পাতা ও Banisteriopsis caapi নামের একটি গাছের ঢাল একসাথে সেদ্ধ করে তৈরি করা হয় এ ভেষজ পানীয়টি। এই পাতা বা ঢাল কোনোটারই স্বতন্ত্রভাবে কোনো সাইকেডেলিক প্রভাব নেই। তবে পাতাগুলোতে ডি.এম.টি নামক একধরনের রাসায়নিক পদার্থ থাকে। এ পদার্থটি প্রাকৃতিকভাবে আমাদের মস্তিষ্কেও উৎপন্ন হয়। অতিরিক্ত গ্রহণ করলে এটি খুবই শক্তিশালী হ্যালুসিনেশনের অভিজ্ঞতা এনে দিতে পারে। এমনকি এ পদার্থ গ্রহণ করা ব্যক্তিদের পরবর্তীতে এটি বোঝানোও কষ্টকর হয়ে পড়ে যে, তারা আসলে হ্যালুসিনেশনে ভুগছিল।
সাধারণত আমাদের শরীরে থাকা কিছু এনজাইম ডি.এম.টিকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। আয়াহুয়াস্কার পাতা থেকে নেওয়া ডি.এম.টির ক্ষেত্রেও তা-ই হয়। আর এখানেই আসে ঢালটির ভূমিকা, এটি এনজাইমগুলোকে নিষ্ক্রিয় করে ডি.এম.টিকে রক্তে প্রবেশের রাস্তা করে দেয়। একসময় এটি গিয়ে উপস্থিত হয় আমাদের মস্তিষ্কে। গ্রহণের প্রায় আধাঘণ্টা পর এর প্রভাব দেখা দেয়, তীব্র হ্যালুসিনেশন ও স্বপ্নালু পরিস্থিতি অনুভূত হয়। চার থেকে ছয় ঘণ্টা পর্যন্ত থাকে এর প্রভাব। তবে এল.এস.ডি বা অন্যান্য ড্রাগের চেয়ে এর প্রভাব কিছুটা ভিন্ন। এক্ষেত্রে গ্রহণকারী সচেতনভাবে বুঝতে পারে যে, তার হ্যালুসিনেশন ঘটছে।
এ ড্রাগটি সাম্প্রতিক সময়ে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও, এর ব্যবহার অনেক প্রাচীনকাল থেকেই আছে। ব্রাজিলের বিভিন্ন উপজাতি ও ধর্মীয় মতবাদে আধ্যাত্মিক অনুশীলনের অংশ হিসেবে এটিকে গ্রহণ করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন উৎসবেও মনে প্রশান্তি আনতে একে ব্যবহার করা হতো। গ্রহণকারীদের মতে, এটি তাদের আধ্যাত্মিক জগতের সাথে সংযুক্ত করে। জীবন ও জগতকে নতুন দৃষ্টিতে দেখতে শেখায়। ১৯৮৭ সালে, ব্রাজিলে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে ব্যবহারের জন্য এ ড্রাগকে আইনসিদ্ধ করা হয়।
ডিপ্রেশন প্রতিকারে এ ড্রাগের সম্ভাবনার বিষয়টি ইন্টারনেটে জনপ্রিয় করে তোলে লিয়ন নামের একজন ব্রাজিলিয়ান তরুণ। জীবনের দীর্ঘ সময় ধরে ভীষণ হতাশাগ্রস্থ হয়ে কাটিয়েছেন তিনি। তার অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে, সাধারণ এন্টি-ডিপ্রেশন ড্রাগগুলো আর কাজ করতো না তার ক্ষেত্রে।
ডিপ্রেশন বা হতাশা বর্তমান সমাজে দুর্লভ কিছু নয়। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের সমীক্ষা অনুসারে বর্তমান পৃথিবীতে তিনশো মিলিয়ন মানুষ এ সমস্যায় ভুগছেন। এর মধ্যে প্রায় তিরিশ শতাংশের অবস্থাই লিয়নের মতো। প্রথাগত চিকিৎসা এদের হতাশাগ্রস্থ মনকে স্বাভাবিকে ফিরিয়ে আনতে পারছে না। পারছে না তাদের অস্থিরতা কমাতে বা মন থেকে আত্মঘাতী চিন্তা দূর করতে। লিয়ন তার এ সমস্যা প্রতিকারের সম্ভাবনা খুঁজে পান আয়াহুয়াস্কাতে। সান্টো ডাইম চার্চে একটি আয়াহুয়াস্কা উৎসবে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। এটি ছিল এমন একটি ধর্মীয় সংগঠনের অনুষ্ঠান, যারা আধ্যাত্মিকতার সন্ধানের জন্য আয়াহুয়াস্কার দ্বারস্থ হয়।
লিয়ন এরপর তার ব্লগে এ ড্রাগ গ্রহণ করার অনুভূতি বিস্তারিত বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, এটি নেওয়ার পর তার জীবন ও সম্পর্কগুলোকে নতুন করে দেখতে পেরেছিলেন। এছাড়া আধ্যাত্মিক সিদ্ধি লাভের পবিত্র অনুভূতিও পেয়েছিলেন। হতাশা ও অস্থিরতা কমাতে এটি তাকে সাহায্য করেছে।
লিয়নের মতো ব্যক্তিদের কথা তো গেল। এখন বড় প্রশ্ন হলো, গবেষকরা কী বলেন এ বিষয়ে? খুব সম্প্রতি ব্রাজিলে তিনজন গবেষক এ নিয়ে একটি পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। তারা এর জন্যে ২১৮ জন ডিপ্রেশনে আক্রান্ত ব্যক্তিকে নেন পর্যবেক্ষণের জন্যে। এদের মধ্য থেকে বাছাই করা হয় ২৯ জনকে, যাদের ডিপ্রেশনের চিকিৎসা কোনো কাজে আসছিল না। এছাড়া স্কিৎজোফ্রেনিয়া বা অন্যন্য মানসিক রোগও ছিল না, যা আয়াহুয়াস্কার কারণে বেড়ে যেতে পারে।
এরপর বাছাই করা ব্যক্তিদের কাউকে আয়াহুয়াস্কা ও কাউকে প্লাসিবো তরল পান করতে দেওয়া হয়। প্লাসিবো হচ্ছে এমন ধরনের ড্রাগ, যাকে সম্পূর্ণ আসল ড্রাগের মতো করে তৈরি করা হয়, কিন্তু এতে আসল ড্রাগের উপাদানগুলো থাকে না। রোগীকে জানানোও হয় না যে এটি আসল ড্রাগ নয়। তবে ড্রাগের সবগুলো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এতে বিদ্যমান থাকে। প্লাসিবো ইফেক্ট মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসার ক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ অনেক রোগীকে দেখা যায়, প্লাসিবো ড্রাগ নিয়েই বেশ সুস্থবোধ করছেন, যদিও আসলে তারা কোনো ড্রাগ নেননি।
প্লাসিবো ইফেক্ট কয়েকটি কারণে হয়। সবচেয়ে বড় কারণটি হলো যেহেতু রোগটি মানসিক, সেহেতু তারা মনে করেন যেহেতু তারা ড্রাগ নিয়েছেন, সেহেতু এটি কাজ করবে। ফলস্বরূপ তারা মানসিকভাবে ভালো বোধ করতে শুরু করেন। তাই কাউকে যখন ডিপ্রেশনের জন্য কোনো ড্রাগ নিতে দেওয়া হয়, তখন এ প্রশ্নটি জাগে আসলেই কি ড্রাগটি কিছু করছে নাকি মানসিক শক্তি পাওয়ার ফলেই ভালো বোধ করছেন তিনি?
এ সন্দেহ দূর করতেই আয়াহুয়াস্কার প্রভাব পরীক্ষার জন্যে গবেষকরা প্লাসিবো ড্রাগ ব্যবহার করেছেন। এসব ড্রাগে আয়াহুয়াস্কার কোনো উপাদান না থাকলেও, এর যেসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় তার সবগুলো এর ফলেও ঘটে। এ পর্যবেক্ষণের একদিন পর দেখা গেল প্রায় অর্ধেক মানুষ কিছুটা ডিপ্রেশনমুক্ত হয়েছেন। এক সপ্তাহ পর দেখা গেল, যারা আয়াহুয়াস্কা গ্রহণ করেছিলেন তাদের মধ্যে ৬৪ শতাংশ তখন পর্যন্ত ডিপ্রেশনের প্রভাব অনেকটা কম অনুভব করছেন। অন্যদিকে প্লাসিবো ড্রাগ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে এ সংখ্যা শতকারা সাতাশ ভাগ মাত্র। এখানে আয়াহুয়াস্কাকে কিছুটা কৃতিত্ব দেওয়া যায় তাই।
এ গবেষণার ফলাফল মিলেছে আয়াহুয়াস্কা নিয়ে এর আগে করা পর্যবেক্ষণের সাথেও। এর পূর্বে ব্রাজিলের সাও পাওলো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ডক্টর জেইম হাল্লাক তার পর্যবেক্ষণে দেখেছেন, আয়াহুয়াস্কা গ্রহণের পর প্রায় ২১ দিন পর্যন্ত ডিপ্রেশনের প্রকোপ অনেকটা কম থাকে। অবশ্য তার পর্যবেক্ষণে তিনি কোনো প্লাসিবো ড্রাগ ব্যবহার করেননি। এসব প্রাথমিক গবেষণার ফলাফল দেখে গবেষকরা তা-ই ভাবছেন, এ সাইকেডেলিক ড্রাগটি ডিপ্রেশন, অস্থিরতা ইত্যাদি প্রতিকারের উপায় হিসেবে বেশ সম্ভাবনাময়।
আয়াহুয়াস্কা রিট্রিট সেন্টারের কর্মকর্তারা দাবী করেন, এ ড্রাগটি আসক্তির জন্ম দেয় না। উপরন্তু আসক্তি-প্রতিরোধেও এটি সাহায্য করতে পারে। আয়াহুয়াস্কা গ্রহণকারীদের মধ্যে অ্যালকোহল, কোকেন ইত্যাদি গ্রহণের হার কমে যায় বলে জানা গেছে। তবে এর যে একদমই কোনো ক্ষতিকর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই তেমনটি না। এটি নেওয়ার পর সাময়িকভাবে তীব্র, বমি, ডায়রিয়া, উচ্চ রক্ত-চাপ ও হৃৎকম্পন বেড়ে যাওয়ার মতো লক্ষণ দেখা যায়। এমনকি আয়াহুয়াস্কা নিতে গিয়ে কয়েকজনের মৃত্যুর সংবাদও পাওয়া গেছে। এটি হয়তো তাদের নেওয়া অন্য কোনো ওষুধের সাথে বিক্রিয়ার কারণে হয়ে থাকবে কিংবা তারা এমন কোনো রোগে ভুগছিলেন, আয়াহুয়াস্কা নেওয়ার ফলে এর তীব্রতা বেড়ে গেছে।
সমস্যা হলো এ বিষয়ে গবেষণা এতই কম হয়েছে যে, এসব নিয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয়। এসব নিয়ে গবেষণা করা বেশ কঠিন, কারণ এ ড্রাগগুলো অধিকাংশ দেশেই নিষিদ্ধ। ক্লিনিক্যাল গবেষণার অনুমতি মিললে হয়তো গবেষকরা নিশ্চিত হতে পারবেন এ ড্রাগটি কীভাবে বা কোন পদ্ধতিতে প্রয়োগ করলে এটি ডিপ্রেশন কমাতে ব্যবহার করা যেতে পারে। বা আদৌ যাবে কি না। এছাড়া অন্যান্য সাইকেডেলিক ড্রাগের মতো এর অপব্যবহার বিষয়েও সচেতনতা জরুরি।