একজন ব্যাংক ডাকাত তার জীবনে সর্বোচ্চ কত বার ব্যাংক লুট করতে পারে? দশ বার? বিশ বার? পঞ্চাশ বার? একশো বার? ফরেস্ট সিলভা টাকারের ক্ষেত্রে সংখ্যাটি হবে সম্ভবত অগণিত। তার ৬৫ বছরের অপরাধী জীবনের মধ্যে শুধুমাত্র ১৯৮০ সালের এক বছরেই তিনি লুট করেছিলেন ৬০টি ব্যাংক! শেষ জীবনে তার টাকা-পয়সার কোনো অভাব ছিল না, কিন্তু তারপরেও নিশ্চিত আরাম-আয়েশের জীবন ছেড়ে জীবনের শেষ ব্যাংকটি যখন তিনি লুট করতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন, তখন তার বয়স ছিল ৭৯ বছর!
এতগুলো ডাকাতির জন্য ফরেস্ট টাকারকে মূল্যও কম দিতে হয়নি। তার জীবনের অধিকাংশ সময়ই কেটেছে জেলখানায়। এর ফাঁকে ফাঁকে ঠিক ততটুকু সময়ই তিনি মুক্ত অবস্থায় বাইরে কাটাতে পেরেছেন, যতটুকু সময় তিনি জেল থেকে পালানোর পর পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে লুকিয়ে থাকতে পেরেছিলেন। একবার না, দুইবার না, এক জীবনে তিনি জেল থেকে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন ৩০ বার! এরমধ্যে ১৮ বার সফল হয়েছিলেন, বাকি ১২টি প্রচেষ্টা শেষমুহূর্তে ব্যর্থ হয়েছিল। আমাদের আজকের আয়জন ফরেস্ট টাকারের ব্যাংক ডাকাতির এবং জেল পালানোর গল্প নিয়ে।
ফরেস্ট সিলভা টাকারের জন্ম ১৯২০ সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায়। তার বয়স যখন মাত্র ৬ বছর, তখন তার বাবা তার মা এবং আট ভাই-বোনকে ফেলে চলে যান। গ্রেট ডিপ্রেশনের সেই সময়ে চরম দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে তিনি বেড়ে উঠতে থাকেন তার নানীর কাছে। তার অপরাধ জীবনের শুরু হয় সেই কিশোর বয়সেই, খেলাচ্ছলে সাইকেল চুরির মধ্য দিয়ে। কিন্তু শুধু সাইকেল চুরির মধ্যেই তার অ্যাডভেঞ্চার সীমিত ছিল না। মাত্র ১৫ বছর বয়সে গাড়ি চুরির অপরাধে প্রথমবারের মতো জেলে যান।
ফরেস্টের দাবি ছিল, তিনি টাকার জন্য বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে গাড়ি চুরি করেননি, করেছিলেন শুধুমাত্র গাড়ি চালানোর শখ মেটানোর জন্য। কিন্তু আদালতে বসে যখন তিনি বুঝতে পারছিলেন যে, তার কয়েক মাসের জেল হয়ে যাতে পারে, তখনই তিনি জীবনে প্রথমবারের মতো পালানোর পরিকল্পনা করতে শুরু করেন। কয়েকদিনের মধ্যেই তার সামনে সুযোগ চলে আসে। এক রাতে ফ্লোরিডার মার্টিন কাউন্টি জেলের ডাইনিং টেবিলে যখন তিনি হাত-পায়ের বাঁধন ছাড়া অবস্থায় ডিনার করছিলেন, তখন জেলার একটু অন্যদিকে তাকানোমাত্রই তিনি দৌড় দেন।
সবার চোখের সামনে দিয়েই ফরেস্ট দরজা দিয়ে বেরিয়ে বেড়া টপকে উধাও হয়ে যান। তার খোঁজে পুলিশ পুরো এলাকা চষে ফেলে। দুইদিন পর যখন পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে, তখন তিনি পাশের একটি এলাকার কমলা বাগানে বসে নিশ্চিন্ত মনে কমলা খাচ্ছিলেন। অবিলম্বে তাকে জেলখানায় ফিরিয়ে আনা হয়। কিন্তু পুলিশ জানত না, প্রথমবার পালানোর আগেই ফরেস্ট জেলের ভেততর এক জায়গায় জামাকাপড়ের স্তুপের নিচে কিছু রেত, বাটালি এবং করাত লুকিয়ে রেখে গিয়েছিলেন।
সেদিন রাতে জেলখানায় ফিরেই তিনি তার দুই বন্ধুকে নিয়ে করাত দিয়ে লোহার শিক কেটে দ্বিতীয়বারের মতো জেল থেকে পালিয়ে যান। এবার অবশ্য পুলিশ মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যেই তাদেরকে খুঁজে বের করে ফেলে। পুলিশের দৃষ্টি থেকে বাঁচতে তারা পার্শ্ববর্তী নদীর পানিতে নাক পর্যন্ত ডুবিয়ে লুকিয়ে ছিলেন। ফিরিয়ে এনে এবার তাদেরকে পাঠানো হয় অধিকতর নিরাপদ সেইন্ট লুইস কাউন্টি জেলে। কিন্তু ততদিনে ফরেস্ট জেল পালানোর ব্যাপারে অভিজ্ঞ হয়ে গেছেন। মাত্র দুই মাসের মধ্যেই তিনি তৃতীয়বারের মতো জেল থেকে পালাতে সক্ষম হন।
ফ্লোরিডা থেকে পালিয়ে ফরেস্ট জর্জিয়াতে বসবাস করতে শুরু করেন। এক বছরের মধ্যেই তার বিরুদ্ধে মানুষের ঘরে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইসহ নানান অভিযোগ জমা হতে শুরু করে। এবার যখন তিনি পুলিশের হাতে ধরা পড়েন, তখন তাকে সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। প্রথমেই তাকে কামারশালায় নিয়ে দুই পায়ের গোড়ালিতে লোহার শিকল পরিয়ে দেওয়া হয়। ভারী লোহার শিকল ধীরে ধীরে তার চামড়া কেটে বসে যেতে থাকে। ছয়মাস পরে তিনি মুক্তি পান। কিন্তু পরের বছরই গাড়ি চুরির দায়ে আবারও জেলে যেতে হয়। এবার তার কারাদণ্ড হয় ১০ বছরের।
৭ বছর জেল খাটার পর ১৯৪৫ সালে ২৪ বছর বয়সী ফরেস্ট টাকার প্যারোলে মুক্তি পান। কিন্তু ততদিনে তার ভবিষ্যত জীবন নির্ধারিত হয়ে গেছে। গ্রেট ডিপ্রেশনের সে সময়ে দারিদ্র্য কিংবা সামাজিক অবিচারের শিকার হয়ে অপরাধে জড়িয়ে পড়া খলনায়কদের কাহিনীর উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা উপন্যাস এবং চলচ্চিত্রগুলো বেশ জনপ্রিয় ছিল। বড়লোকদের উপর ক্ষুদ্ধ, বঞ্চিত মানুষদের মধ্যে রবিন হুড টাইপের ব্যাংক ডাকাতদের প্রতি এক ধরনের প্রচ্ছন্ন সমর্থনও ছিল। ফরেস্ট টাকারও এ সময় নিজেকে সেরকম একটি চরিত্র হিসেবে কল্পনা করতে শুরু করেন।
অন্য যেকোনো অপরাধীর তুলনায় সে সময় ব্যাংক ডাকাতদেরকে ভিন্ন চোখে দেখা হতো। ২৪ বছর বয়সী সুদর্শন, সুঠাম দেহের অধিকারী যুবক ফরেস্ট টাকার এসময় ব্যাংক ডাকাত হিসেবেই নিজেকে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন। প্রায় সময়ই তিনি সিনেমাতে দেখা ব্যাংক ডাকাতদের মতো পোশাক পরে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের প্রতিবিম্বের দিকেই পিস্তল তাক করে ব্যাংক লুট করার কাজ অনুশীলন করতেন।
প্রথমবার ব্যাংক ডাকাতি করেন তিনি ১৯৫০ সালে। তখন তার বয়স ছিল ৩০ বছর। সেদিন সকালে এক সময়ের আলোড়ন সৃষ্টিকারী ব্যাংক ডাকাত জেসি জেমসের মতো কাপড় পরে, মুখে রুমাল বেঁধে, হাতে একটি পিস্তল নিয়ে তিনি হাজির হন মায়ামির একটি ব্যাংকে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি সেখান থেকে ১ হাজার ২৭৮ ডলার নিয়ে নিরাপদে বেরিয়ে যান। কয়দিন পর তিনি আবারো ফিরে আসেন একই ব্যাংকে। এবার পুরো সেফ বক্সটিই তুলে নিয়ে যান। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পর পুলিশের অনুসন্ধান বন্ধ হয়ে গেছে মনে করে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে যখন তিনি বক্সটি খোলার চেষ্টা করছিলেন, তখনই পুলিশ তাকে ঘিরে ফেলে।
জেলে গিয়ে ফরেস্ট আবারও পালানোর পথ খুঁজতে শুরু করেন। কয়েক সপ্তাহ পেরিয়ে যাওয়ার পরেও কোনো সুযোগ না পেয়ে একদিন তিনি ব্যাথায় কাতরাতে শুরু করেন। জেল কর্তৃপক্ষ তাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেয়। ডাক্তাররা তার অ্যাপেন্ডিক্সের ব্যাথা সন্দেহ করে অস্ত্রপচার করেন। সেরে উঠার সময় এক সুযোগে তিনি সরু তার দিয়ে হ্যাণ্ডকাফ খুলে ফেলেন এবং সবার অলক্ষ্যে হাসপাতাল ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন। এবার তিনি শহর ছেড়ে ক্যালিফোর্নিয়ায় চলে যান। যাত্রাপথে প্রায় প্রতিটি শহরেই তিনি একই পদ্ধতিতে একের পর এক ব্যাংক লুট করেন।
ক্যালিফোর্নিয়ায় গিয়ে ফরেস্ট একজন সঙ্গী জোগাড় করেন। রিচার্ড বেলিউ নামের তার সেই সঙ্গীও ছিল অভিজ্ঞ ব্যাংক ডাকাত। তারা দুজনে মিলে দুই বছর ধরে তাদের লুটপাটের যজ্ঞ চালিয়ে যেতে থাকেন। তাদের ডাকাতির সংবাদগুলো সে সময়ের স্থানীয় পত্রপত্রিকার প্রথম পাতা দখল করে রাখত। এমনকি ১৯৫২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রস্তুতির মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সংবাদগুলোও তাদের ডাকাতির সংবাদের নিচে চাপা পড়ে থাকত।
নিয়মিত ব্যাংক লুট করলেও ফরেস্ট টাকারের ব্যবহার ছিল অত্যন্ত ভদ্র। তিনি পিস্তল দেখাতেন ঠিকই, কিন্তু তার দীর্ঘ অপরাধ জীবনে একবারও তিনি গুলি চালাননি, বা কাউকে মারধোরও করেননি। হাসিমুখে ভদ্রবেশে তিনি ব্যাংকে প্রবেশ করতেন, আস্তে করে পিস্তলের অস্তিত্ব জানান দিতেন, এরপর টাকা নিয়ে ধীরে-সুস্থে বেরিয়ে চুরি করা গাড়িতে উঠে শান্ত ভঙ্গিতে পালিয়ে যেতেন। যাওয়ার সময় ব্যাংকের ম্যানেজার এবং কাস্টমারদেরকে ধন্যবাদ এবং মৃদু হাসি উপহার দিতেও তিনি ভুলতেন না!
তিনি মোট তিনবার বিয়ে করেছিলেন। তার প্রথম বিয়ে বেশিদিন টেকেনি। ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকার সময় ১৯৫১ সালে তিনি দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন। এ ঘরে ১৯৫২ সালে তার একটি পুত্র সন্তানও হয়। কিন্তু তার পেশা যে ছিল ব্যাংক ডাকাতি, সেটা তার কোনো আত্মীয়-স্বজন তো বটেই, তার স্ত্রীও জানত না। তার স্ত্রীর কাছে তার পরিচয় ছিল একজন গীতিকার হিসেবে। এমনকি তিনি বিয়েটাও নিজের আসল নামে করেননি, করেছিলেন ডাকাতিতে তার সঙ্গী রিচার্ড বেলিউর পরিচয়ে!
১৯৫৩ সালে সান ফ্রান্সিসকোর একটি ব্যাংকে ডাকাতি করতে গিয়ে ধরা পড়েন ফরেস্ট টাকার। এবার তার জেল হয় ৩০ বছরের এবং স্থান হয় আমেরিকার সবচেয়ে কুখ্যাত কারাগারগুলোর একটি, আলকাটরাজে। সানফ্রান্সিসকো উপসাগরে ছোট একটি দ্বীপের উপর অবস্থিত এই কাগারারে শুধু আমেরিকার সবচেয়ে বিপজ্জনক এবং বারবার জেল পালানো অপরাধীদেরই স্থান হতো। কিন্তু আলকাটরাজও ফরেস্টকে দমানোর জন্য যথেষ্ট ছিল না। দ্বীপটিতে পা দেওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই তিনি টেডি গ্রিন নামের আরেক বন্দীর সাথে মিলে পালানোর পরিকল্পনা করতে শুরু করেন।
টেডি গ্রিনেরও জেল পালানোর খ্যাতি ছিল। এর আগে তিনি একবার পাদ্রী সেজে এবং আরেকবার পুরানো কাপড়ের বক্সের ভেতর লুকিয়ে জেল থেকে পালিয়েছিলেন। কিন্তু আলকাটরাজ ছিল অন্য যেকোনো জেলের চেয়ে অনেক বেশি সুরক্ষিত। টেডি গ্রিন এবং ফরেস্ট টাকার জেলখানার ওয়ার্কশপে কাজ করার সুযোগে গার্ডদের চোখ ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি এনে নিজেদের সেলের টয়লেটে লুকিয়ে রাখতে শুরু করেন। এরপর সুযোগের অপেক্ষা। কিন্তু তার আগেই একদিন তারা ধরা পড়ে যান। ফরেস্টের স্থান হয় অন্ধকার, ঠান্ডা, ক্ষুদ্র একটি প্রকোষ্ঠে, যেখানে তাকে সারাক্ষণ খালি শরীরে একাকী কাটাতে হতো।
আলকাটরাজে বন্দী থাকা অবস্থায় ফরেস্ট আইন নিয়ে পড়াশোনা করার চেষ্টা করেন এবং কর্তৃপক্ষের কাছে তার শাস্তি পুনর্বিবেচনার জন্য বারবার আপিল করেন। তিন বছরের প্রচেষ্টার পর ১৯৫৬ সালের নভেম্বরে তার মামলাটি পুনর্বিবেচনার জন্য আদালতে তোলা হয়। আলকাটরাজ থেকে শুনানির জন্য তাকে কাউন্টি জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে থাকাকালে তিনি কিডনিতে প্রচণ্ড ব্যথার অভিনয় করে হাসপাতালে ভর্তি হন এবং প্রথম সুযোগ পাওয়ামাত্রই নিজের পায়ের গোড়ালিতে একটি পেন্সিল সজোরে প্রবেশ করিয়ে এমনভাবে রক্তাক্ত করে ফেলেন যে, সাথে থাকা গার্ডরা তার পায়ের শেকল খুলে দিতে বাধ্য হয়।
ফরেস্টের হাতে অবশ্য তখনও হ্যান্ডকাফ পরানো ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও হুইল চেয়ারে করে তাকে এক্সরে রুমে নিয়ে যাওয়ার সময় গোড়ালির আঘাত নিয়েই তিনি লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ান এবং দুই গার্ডকে ধরাশায়ী করে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে পড়েন। কয়েক ঘণ্টা পর তিনি যখন হাসপাতালের গাউনে হ্যান্ডকাফ পরা অবস্থাতেই নিকটবর্তী এক শস্যক্ষেতের মাঝে দাঁড়িয়ে মুক্তির ক্ষণস্থায়ী স্বাদ উপভোগ করছিলেন, তখন পুলিশ তাকে পুনরায় আটক করে। আলকাটরাজ প্রিজন বন্ধ হয়ে যাওয়া পর্যন্ত বাকি দিনগুলো তাকে সেখানেই কাটাতে হয়েছিল।
ফরেস্ট টাকারের সবচেয়ে বিখ্যাত জেল পালানোর ঘটনা ঘটে ১৯৭৯ সালে, যখন তার বয়স ৫৯ বছর! সে সময় আরেকটি ব্যাংক ডাকাতির দায়ে স্যান কুয়েন্টিন নামে ক্যালিফোর্নিয়ার সমুদ্র তীরবর্তী একটি জেলে বন্দী ছিলেন তিনি। প্রিজন ওয়ার্কশপের অধীনে সমুদ্রের তীরে কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে তিনি এবং তার দুই সঙ্গী মিলে কাঠ, প্লাস্টিকের ক্লথ, ডাক্ট টেপসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি জড়ো করেন এবং এক বিকেলে ফরেস্ট সেগুলো দিয়ে ১৪ ফিট লম্বা একটি নৌকা বানিয়ে ফেলেন!
ফরেস্ট তাদের জামার উপর গাঢ় কমলা রংয়ের প্রলেপ দেন এবং সেই রংয়ের উপর নিকটবর্তী ম্যারিন ইয়াট ক্লাবের লগো এঁকে দেন। রং শেষ হয়ে আসছিল বলে তিনি নৌকাটির শুধু একদিক রং করেন, যে দিকটি গার্ডদের ওয়াচ টাওয়ার থেকে দেখা যাবে। এরপর আগস্টের ৯ তারিখে সবার অলক্ষ্যে নৌকাটি ভাসিয়ে দিয়ে তিনজন মিলে জেল এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান। কিছুদূর যাওয়ার পরে তারা গার্ডদের চোখে পড়ে যান, কিন্তু ফরেস্টের দক্ষ হাতে নির্মিত নৌকাটি আর তাদের ছদ্মবেশ দেখে গার্ডাদের সন্দেহ করার কোনো কারণ ছিল না!
কয়দিন পর থেকেই শুরু হয় সিরিজ ব্যাংক ডাকাতি। টেক্সাস এবং ওকলাহোমার ব্যাংকগুলোতে কয়দিন পরপরই ডাকাতি হতে শুরু করে। প্রতিটি ডাকাতির ঘটনা একইরকম – তিন-চার জন ষাটোর্ধ বৃদ্ধ ধীরে-সুস্থে ব্যাংকে প্রবেশ করে, একজন পিস্তল বের করে দেখায়, এরপর টাকা-পয়সা নিয়ে চোরাই গাড়িতে করে চলে যায়। এ সময়ই এক বছরের মধ্যে ফরেস্ট এবং তার দল ষাটটিরও বেশি ব্যাংক ডাকাতি করে। এ সময় তার সাফল্যের অন্যতম রহস্য ছিল তার কানে গোঁজা একটি হিয়ারিং এইড, যেটা মূলত পুলিশের রেডিও হিসেবে কাজ করত। ফরেস্টদের দলটি এসময় ওভার দ্য হিল গ্যাং হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে।
ফরেস্ট টাকারের সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর ব্যাংক ডাকাতির ঘটনাটি ঘটে ১৯৮৩ সালে। সে বছরের ৭ই মার্চ তিনি এবং তার দল ম্যাসাচুসেটসের একটি কঠোর নিরাপত্তাবিশিষ্ট ব্যাংক থেকে প্রকাশ্য দিবালোকে প্রায় সাড়ে চার লাখ ডলার নিয়ে চলে যান। কয়েক সপ্তাহ ধরে ব্যাংকটির উপর নজরদারি করার ফলে তাদের জানা ছিল, ঠিক ঐ দিন ঐ সময়েই একটি ট্রাকে করে ব্যাংক থেকে টাকা চালান হওয়ার কথা ছিল। ফলে নির্ধারিত সময়ের মাত্র কয়েক মিনিট আগে তারা নিজেরাই ট্রাকের সিকিউরিটি গার্ডদের মতো পোশাক করে, তাদের ছদ্মবেশ ধরে কারো সন্দেহের উদ্রেক না ঘটিয়েই ব্যাংকের ভল্টে প্রবেশ করেন এবং আসল ট্রাক এসে পড়ার আগেই টাকা নিয়ে চম্পট দেন।
১৯৮২ সালে ফরেস্ট টাকার তৃতীয়বারের মতো বিয়ে করেছিলেন। সেবার তিনি তার পরিচয় দিয়েছিলেন স্টক মার্কেটের এজেন্ট বব ক্যালাহান হিসেবে। এবারও ম্যাসাচুসেটর ব্যাংক ডাকাতির কয়েকমাস পরে যখন ফরেস্ট পুলিশের হাতে ধরা পড়েন, তখনই কেবল তার স্ত্রী জুয়েল তার আসল পরিচয় জানতে পারেন। কিন্তু তার দ্বিতীয় স্ত্রীর মতো জুয়েল তাকে ছেড়ে যাননি। বিচার চলাকালে ফরেস্ট যখন আবারও পালানোর চেষ্টা করে ধরা পড়েন, তখন জুয়েল তাকে আশ্বাস দেন, ফরেস্ট যদি না পালিয়ে জেল খেটে বের হওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়, তাহলে তিনি তার জন্য অপেক্ষা করবেন।
স্ত্রীর অনুরোধ রক্ষা করেছিলেন ফরেস্ট টাকার। সেবার আর জেল থেকে পালানোর চেষ্টা করেননি তিনি। ১০ বছর জেল খাটার পর ১৯৯৩ সালে ৭৩ বছর বয়সে ফরেস্ট যখন ছাড়া পান, জুয়েল সত্যিই তখনও তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তারা দুজনে সমুদ্রের তীরে একটা বাড়িতে সুখে শান্তিতে বসবাস করতে থাকেন। ফরেস্ট টাকার তার নিজের জেল পালানোর কাহিনীগুলো নিয়ে আত্মজীবনী লেখায় মনোনিবেশ করেন। তিনি আশা করতে থাকেন, কোনো একদিন তার কাহিনীগুলো নিয়ে হলিউডে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হবে।
ফরেস্ট টাকারের গল্পটি এখানেই শেষ হতে পারত। সারা জীবনে তিনি কয়েক মিলিয়ন ডলার ডাকাতি করেছিলেন। শেষ জীবনে তার টাকা পয়সার কোনো অভাব ছিল না। কিন্তু ছয় বছর নিস্তরঙ্গ জীবন যাপনের পর ১৯৯৯ সালের ২২ এপ্রিল, ফরেস্টের বয়স যখন ৭৮ বছর, তখন তার রক্তে যেন আবারও তারুণ্যের উত্তেজনা ফিরে আসে। সেদিন সকালে স্ত্রীকে কিছু না জানিয়ে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন। আঙ্গুলের ছাপ ঢাকার জন্য বরাবরের মতো এবারও তিনি আঙ্গুলগুলোর উপর নেইল পালিশ লাগিয়ে নেন। তারপর ঢুকে পড়েন স্থানীয় একটি ব্যাংকে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সেখান থেকে ৫,৩০০ ডলার নিয়ে বেরিয়ে আসেন তিনি।
এরপর সেদিন একে একে তিনি হানা দেন আরও তিনটি ব্যাংকে। শেষপর্যন্ত যখন পুলিশের গাড়ি তাকে অলি-গলির ভেতর দিয়ে ধাওয়া করে একটি কানাগলির ভেতর আটকে ফেলে, তখন আচমকা তিনি গাড়ি ঘুরিয়ে ছুটে আসতে থাকেন উল্টো দিকে। পুলিশের গাড়ি দিয়ে আটকে দেওয়া রাস্তার ঠিক পাশেই একটি কাঠের বেড়া ছিল। ফরেস্ট সেই বেড়া ভেঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রাস্তা ছেড়ে মাঠের উপর দিয়ে গাড়ি নিয়ে ছুটে যেতে থাকেন। পুলিশের বর্ণনা অনুযায়ী, শেষমুহূর্তে একটি গাছের সাথে ধাক্কা খেয়ে জ্ঞান হারিয়ে তাদের হাতে ধরা পড়ার পূর্ব পর্যন্ত বৃদ্ধ লোকটির মুখে ছিল অদ্ভুত এক ধরনের হাসি!
২০০০ সালে ফরেস্ট টাকারের ১৩ বছরের কারাদণ্ড হয়। ২০০৪ সালের মে মাসের ২৯ তারিখে জেলে থেকেই মৃত্যুবরণ করেন তিনি। শেষ বছরগুলোতে সোজা হয়ে হাঁটতেও কষ্ট হতো তার। কিন্তু মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি শেষবারের মতো জেল থেকে পালানোর আশা ছাড়েননি। সারাক্ষণ তিনি পকেটে করে একটি চিরকুট নিয়ে ঘুরতেন, যেখানে তার আঠারোটি সফল পলায়নের দিন, তারিখ, জেলের নাম এবং পালানোর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা লিপিবদ্ধ ছিল। ঐ তালিকার শেষে ১৯ সংখ্যাটি তিনি লিখে রেখেছিলেন, কিন্তু সেই ঘরটি পূরণ করে যেতে পারেননি।
ফরেস্ট টাকার হলিউডের ব্যাংক ডাকাতির চলচ্চিত্রগুলোর দারুণ ভক্ত ছিলেন। বিশেষ করে এস্কেপ ফ্রম আলকাটরাজ, বনি অ্যান্ড ক্লাইড এবং আই অ্যাম এ ফিউজিটিভ ফ্রম এ চেইন গ্যাং তার খুব প্রিয় ছিল। তিনি সবসময়ই চেয়েছিলেন তার জীবনের কাহিনীগুলো নিয়ে হলিউডে সিনেমা নির্মিত হোক। এ উদ্দেশ্যে তিনি অস্কারজয়ী চিত্র পরিচালক ক্লিন্ট ইস্টউডের সহকারীর সাথেও যোগাযোগ করেছিলেন। কিন্তু নিজের এজেন্ট না থাকায় ইস্টউডের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হননি তিনি।
ফরেস্ট টাকারের মৃত্যুর কয়েক মাস আগে নিউ ইয়র্কার ম্যাগাজিনে তার জীবনী প্রকাশিত হয়। গত বছর পরিচালক ডেভিড লৌরি তার সেই প্রবন্ধ থেকে নির্বাচিত অংশের উপর ভিত্তি করে একই নাম দিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। The Old Man and the Gun নামের ঐ চলচ্চিত্রে ফরেস্ট টাকার চরিত্রে অভিনয় করেন অস্কার জয়ী অভিনেতা রবার্ট রেডফোর্ড। ফরেস্ট টাকারের জীবনের শেষ ইচ্ছাটি অবশেষে পূরণ হয়েছে, কিন্তু তিনি নিজে তা দেখে যেতে পারেননি।