পরিশ্রম, আত্মবিশ্বাসে স্বপ্নের নাগাল পাওয়া সম্ভব। আমাদের চারপাশেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে স্বপ্নকে হাতের মুঠোয় পাওয়া কীর্তিমানদের বসবাস।
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। ক্রিকেটার এবাদত হোসেন চৌধুরীর অগ্রযাত্রার দিকে তাকালে এ বাক্যের সত্যতা আরেকবার ভেসে উঠবে সবার চোখের সামনে।
এই তো, ২০১৬ সালে মুঠোফোন কোম্পানি রবি আয়োজিত পেসার হান্ট প্রতিযোগিতা জয়ের পর গোটা বাংলাদেশ জেনেছিলো এই তরুণের নাম। বিমানবাহিনীর সৈনিক থেকে ২২ গজের সঙ্গে পুরোপুরি জড়িয়ে যায় তার জীবন। কয়েক মাসের মধ্যেই বদলে যেতে থাকে তার জীবনের পট। বিসিবির হাই পারফরম্যান্স (এইচপি) ক্যাম্পে ডাক পাওয়া, বছরের শেষ দিকে ডেভেলপমেন্ট স্কোয়াডের অংশ হিসেবে নিউজিল্যান্ড সফর করা, যেন ভোজবাজির মতো রঙিন আলোর দুনিয়ায় প্রবেশ হলো এবাদতের।
অনেক চড়াই-উতরাই পাড়ি দিলেও বুকের ভেতর স্বপ্নটা বয়ে বেড়িয়েছেন। প্রতিনিয়ত কঠোর পরিশ্রম করেছেন, বিন্দু বিন্দু করে শিখেছেন, উন্নতি করেছেন বোলার হিসেবে। এই সময়টুকুতে ঘরোয়া ক্রিকেটে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ, বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) দল পেলেও ম্যাচের পর ম্যাচ সাইডবেঞ্চে বসে থাকতে হয়েছে। ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছেন খুব কমই। দুই বছর পর সেই নিউজিল্যান্ড সফরের জন্য বাংলাদেশের টেস্ট দলে ডাক পেলেন এবাদত। ইনজুরিতে পড়া তাসকিন আহমেদের বদলি হিসেবে সুযোগ পেলেন ২৫ বছর বয়সী এই ডানহাতি পেসার।
স্বপ্নপূরণের এই মাহেন্দ্রক্ষণটা এবাদতের হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগের (বিসিএল) পারফরম্যান্স। পাঁচ ম্যাচে ২১ উইকেট নিয়ে পেসারদের মধ্যে সেরা ছিলেন। নির্বাচক, সতীর্থরা তার বোলিংয়ের প্রশংসা করেছিলেন। এবার সর্বশেষ বিপিএলে নিজের বিভাগীয় দল সিলেট সিক্সার্সের হয়েও শুরুর দিকে ম্যাচ পাননি। শেষ দিকে ম্যাচ পেয়ে নিজের জাতটা তুলে ধরেছেন। শেষ ম্যাচে ১৭ রানে চার উইকেট নিয়ে সিলেটের জয়ের নায়কও ছিলেন এবাদত। বিপিএলে দেশীয় পেসারদের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুতগতির বোলার ছিলেন তিনি। ১৪৭ কিমি. গতিতে বল ছুঁড়েছেন বিপিএলের ষষ্ঠ আসরে। সব মিলিয়ে নির্বাচকরা সাদা পোশাকের ক্রিকেটে তাসকিনের বদলি হিসেবে ঝুঁকেছেন এবাদতের দিকেই।
ক্রিকেটার এবাদতের বেড়ে ওঠা…
মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলার কাঁঠালতলী গ্রামের তরুণ এবাদত। আগে পাড়ার মাঠে মাঝেমধ্যে ক্রিকেট খেলেছেন। বাবা বিজিবিতে চাকরি করতেন। বাবার দেখানো পথেই হাঁটলেন এবাদত। শৃঙ্খলিত জীবন গড়বেন বলে যোগ দিলেন বিমান বাহিনীতে। ছকে বাঁধা জীবনে চাকরির পাশাপাশি চলছিল খেলাধুলাও; ভলিবল, হ্যান্ডবল, বাস্কেটবল ইত্যাদি। বিমানবাহিনীর নিয়মিত ভলিবল খেলোয়াড় হয়ে যান।
তবে ছেলেবেলা থেকে ক্রিকেটও খেলতেন। জোরে বোলিং করতে পারতেন বলে আশপাশের অঞ্চল থেকে খেলার ডাক আসতো। বিমানবাহিনীতে যোগ দেয়ার পর ক্রিকেট খেলার সুযোগ কমে যায়। তাই বলে বিমানবাহিনী তার ক্রিকেট খেলার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। মনের অন্তরালে বয়ে চলা ক্রিকেটের পোকাকে দূরে সরাতে পারেননি। ২০১৪ সালে সিটি ক্লাবের হয়ে ঢাকায় প্রথম বিভাগে ক্রিকেট লিগে খেলেন তিনি। ২০১৬ সালে রবি পেসার হান্টের শেষ রাউন্ডে ১৩৯.০৯ কিলোমিটার গতিতে বল করে সবাইকে চমকে দেন এবাদত। তারপরই বড়লেখার এই তরুণের ক্রিকেট স্বপ্নের পরিধি বড় হতে থাকে।
বিসিবির এইচপি ক্যাম্পে সুযোগ পান। তারপর নিউজিল্যান্ড সফরে যান ডেভলপমেন্ট স্কোয়াডের অংশ হয়ে। তখন পর্যন্ত জোরে বোলিংয়ের স্কিল নিয়েই ঘোরের মাঝে ছিলেন এবাদত। ওই সফরেই চোখ খুলে যায় তার। দেশে ফিরে বোলিং নিয়ে আরও কঠোর পরিশ্রম শুরু করেন। অ্যাকশনে কিছুটা পরিবর্তন আনেন। বলা চলে তখনই বোলিংয়ের কঠিন অধ্যায়ের সঙ্গে পরিচয় ঘটে তার। এসময় বিভিন্ন ক্লাব, দলে সুযোগ পেলেও ম্যাচ খেলতে পারেননি খুব একটা। যা কিছু সুযোগ পেয়েছিলেন নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি। তবে পরিশ্রমটা চালিয়ে গেছেন এইচপি ক্যাম্পে।
অতঃপর শেষ দুটি ঘরোয়া টুর্নামেন্টে নিজের ছন্দ খুঁজে পেয়েই বাজিমাত করলেন। স্বপ্ন স্পর্শ করার মুহূর্ত হাজির হলো এবাদতের ক্যারিয়ারে। ১৯টি প্রথম শ্রেনির ম্যাচে ৫৯ উইকেট নেয়া এই পেসার ডাক পেলেন বাংলাদেশের টেস্ট দলে।
স্বপ্নপূরণ ও বিমানবাহিনীর প্রতি কৃতজ্ঞতা
বিপিএল শেষে ছুটি মিলেছে। এবাদত ফিরে গেছেন নিজের বাড়ি মৌলভীবাজারে। টেস্ট দলে ডাক পাওয়ার খবরটা পেয়ে গিয়েছিলেন আগেই। ডাক পেয়ে যারপরনাই খুশি এই তরুণ। মুঠোফোনে নিজের প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন,
‘অবশ্যই ভালো লাগছে। আমার আশা ছিল প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট যেহেতু ভালো করেছিলাম, হয়তো টেস্টে সুযোগ পাবো। আলহামদুলিল্লাহ টেস্টে সুযোগ পেয়েছি। এখন সুযোগটা কাজে লাগানো বড় বিষয়। চেষ্টা করবো আমি আমার সর্বোচ্চটা দিয়ে, ভালো কিছু যাতে করতে পারি। খুব ভালো লাগতেছে। আমি চাই যে আমি টেস্ট খেলি। আমার মানসিকতা আমি ওইভাবে তৈরি করেছি যে, আমি টেস্ট খেলবো।’
নিজের স্বপ্নপূরণের এই মাহেন্দ্রক্ষণে এবাদত কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রতি। যাদের অমূল্য সহযোগিতায় তার ক্রিকেট ক্যারিয়ার ক্রমাগত সমৃদ্ধির পথে এগিয়েছে। ডানহাতি এই ফাস্ট বোলার বলছিলেন,
‘হ্যাঁ, অবশ্যই স্বপ্নপূরণ। এটা বড় একটা স্বপ্ন আমার। বিমানবাহিনী থেকে আসা… শুধু বিমানবাহিনী কেন? আমাদের সেনা, নৌ… মানে সশস্ত্র বাহিনী থেকে জাতীয় ক্রিকেট খেলা কেউ নেই। আলহামদুলিল্লাহ, আমি প্রথমে ধন্যবাদ দিতে চাই আমাদের বিমানবাহিনী কর্তৃপক্ষকে, যারা আমাকে এত বড় একটা সুযোগ করে দিয়েছেন। ওনাদের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ। আমাকে অনেক সুন্দর জীবনের সুযোগ দিয়েছেন। আমি ক্রিকেট বোর্ডকে ধন্যবাদ দিতে চাই। যারা আমার প্রতি বিশ্বাস রেখেছেন। আমি তাদের বিশ্বাসের প্রতিদান দিতে চাই।’
চম্পকার পরামর্শে এবাদতের মিশন টেস্ট ক্রিকেট
এইচপি ক্যাম্পে ২০১৭ সালে পাকিস্তানের সাবেক গ্রেট ফাস্ট বোলার আকিব জাভেদের সঙ্গে কাজ করেছিলেন এবাদত। তার কাছ থেকে নতুন বলে গতি বাড়ানো, পুরনো বলে রিভার্স সুইংটা নিখুঁত করার তালিম নিয়েছিলেন তিনি। পরে বিসিবির পেস বোলিং কোচ চম্পকা রমানায়েকের সঙ্গে কাজ করেন এই তরুণ।
বলছিলেন,
‘আসলে এই দুই বছরে বোলিংয়ে উন্নতি বলতে প্রথমে আমি বলবো, আমি যখন হাই পারফরম্যান্স স্কোয়াডে আসি, আমি তিন বছর ধরে এখানে কাজ করছি। সবচেয়ে বড় উন্নতির জায়গা এটা যে, আমি হাই পারফরম্যান্সে টানা কাজ করেছি। এবং আরেকটা জিনিস বলতে চাই যে, আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছেন চম্পকা রমানায়েকে। উনি আমাকে প্রথমে দেখার পরই বলছে যে, এবাদত তুমি ভালো একজন টেস্ট বোলার হতে পারবা। কারণ তোমার রিস্ট পজিশন, অ্যাক্যুরেসি ভালো আছে। তুমি যদি লাল বল নিয়ে কাজ করো, তাহলে ভালো একজন টেস্ট বোলার হতে পারবা। ওনারও টার্গেট ছিল। আমিও উনার কথা শুনে মানসিকতা তৈরি করেছিলাম। উৎসাহ পেয়েছি। আমি মানসিকভাবে তৈরি হয়েছি যে, আমি টেস্ট খেলতে চাই।’
ঠিক কী ধরনের কাজ হয়েছে রমানায়েকের সঙ্গে? এবাদতের জবাব,
‘বল ডেলিভারির সময় আমার মাথা বাঁ-দিকে ঝুঁকে যেত, যেটা চম্পকা সোজা করে দিতে সাহায্য করেছে। মাথাটা স্ট্রেইট করে দেয়াতেই আমার বোলিং ভালো হয়েছে এবং এখন সিম পজিশন খুব সুন্দর যায়।’
‘বিপিএলেও সিমে বল ফেলতে পেরেছি খুব ভালোভাবে। এছাড়া মানসিকভাবে শক্ত হওয়ার কথা বলেছে। আরও বলেছে, দুই-এক ওভার খারাপ হতেই পারে; টেস্টে কিন্তু রিকভারির সময় আছে। তাকে ধন্যবাদ দিতে চাই। প্রচুর পরিশ্রম করেছে। আমি তাকে খুব বিরক্ত করেছি। মিরপুরে ৬-৭ দিন তার সঙ্গে একাই কাজ করেছিলাম একাডেমি ভবনে থেকে।’
অতীতের তুলনায় বোলার হিসেবে এখন অনেক আত্মবিশ্বাসী এবাদত। দুই বছর আগে নিউজিল্যান্ড সফরের অনুশীলনের অভিজ্ঞতা রয়েছে তার ঝুলিতে। এবার ব্ল্যাক ক্যাপসদের বিরুদ্ধে তিনটি টেস্ট খেলবে বাংলাদেশ দল। একাদশে সুযোগ পেলে নিজের সেরাটা উজাড় করে দিতে চান এবাদত। বলেছেন,
‘আমি যখন ২০১৬ সালে গেছিলাম তখন আমাদের কোর্টনি ওয়ালশ স্যার আমাকে অনেক সহযোগিতা করেছেন। তখন আমি শিক্ষানবীশ হিসেবে গিয়েছিলাম। তখন দেখেছিলাম ওই কন্ডিশন, উইকেট পেসারদের জন্য অনেক ভালো। যেহেতু আমার ২০১৬ সালে ওখানে অনুশীলনের কিছুটা অভিজ্ঞতা আছে আমার, চেষ্টা করবো আমার সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আমি যেন টেস্ট দলের হয়ে বাংলাদেশের জন্য ভালো কিছু করতে পারি।’
এবাদতরা আসলে স্বপ্নের ফেরিওয়ালা। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত তাড়া করে গেছেন নিজের স্বপ্নকে। অবশেষে স্বপ্ন জয়ের তৃপ্তিও সঙ্গী হয়েছে তার।