“আজকালকার ছেলে-মেয়েগুলো বাংলা গান শোনে না; বিয়ে-থা, আচার-অনুষ্ঠান সব খানে কেবল হিন্দি গানের ছড়াছড়ি; এরা বাঙালি সন্তান হয়েও কেবল সারাদিন হিন্দি-ইংরেজি আর পপ গানের মতো বিদেশি গানের তালে ভেসে যাচ্ছে”- এমন সব অভিযোগ নিশ্চয়ই হরহামেশাই আমরা শুনে থাকি। এই প্রজন্মের তরুণদের মধ্যে বিদেশি, পাশ্চাত্য ধাচের গানের প্রতি যে মোহগ্রস্ততা আছে তা ঠিক বটে। তবে পাশ্চাত্য গানের প্রতি আকর্ষণ কিংবা পাশ্চাত্যের সংগীতের অনুকরণ মানেই নিজের শেকড়কে ভুলে যাওয়া- এমন ঢালাও অভিযোগের বিপরীতে মোক্ষম জবাব বোধহয় আমাদের কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিদেশি গানের সুর ও রীতি অবলম্বনে রচিত অজস্র কালজয়ী সব গান।
বাংলা সঙ্গীতের ধারায় সবচেয়ে শক্তিমান হিসেবে যদি একক কোনো ব্যক্তির কথা বলতে হয়, তবে নিঃসন্দেহে তিনি আমাদের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথের অনন্যসাধারণ সৃষ্টিশীল হাতের ছোঁয়ায় বিশ্ব সঙ্গীতের উপাদান সম্বলিত এ গানগুলো বাংলা গানের মূল ধারার গান হিসেবেই বিবেচিত। আজকের লেখায় আমরা বাংলার লোকজ ঘরানার বাইরে ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলের গান ও বিশ্ব সংগীতের নানান উপাদানকে উপজীব্য করে রচিত রবীন্দ্রনাথের কিছু গান নিয়ে আলোচনা করবো।
রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভূবন
রবীন্দ্রসঙ্গীত রবীন্দ্রনাথের এক অপার সৃষ্টিশীল প্রতিভার এক অনুপম সম্ভার। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১২ কি ১৪ বছর বয়সে প্রথম গান রচনা করেন, আর তাঁর জীবনের শেষ গানটি ছিলো তাঁর নিজের জীবনেরই শেষ জন্মদিন উপলক্ষে লেখা, ‘হে নূতন, দেখা দিক’ গানটি। সেটি ছিলো ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাস। রবীন্দ্রনাথ আয়ু পেয়েছিলেন প্রায় ৮১ বছর; আর হিসেব করে দেখতে পাচ্ছি, জীবনের ৬৮টি বছরই তিনি নিবিষ্ট ছিলেন সংগীত রচনায়! তাঁর রচিত গানের সংখ্যা ২,২৩২টি। ভাব ও ভাষায়, গুণে ও মানে এবং জনপ্রিয়তায় রবীন্দ্রসঙ্গীত অতুলনীয়।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখা অধিকাংশ গানে নিজেই সুরারোপ করেছেন। তবে, এমন আরো অনেক গান আছে, যেগুলোর গীতিকার তিনি, তবে সুরকার তিনি নিজে নন। বলে রাখা ভালো, রবীন্দ্রনাথের রচিত গান মাত্রই রবীন্দ্রসঙ্গীত নয়; রবীন্দ্রসঙ্গীত হতে হলে সেই গানকে রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক সুরারোপিত হতে হবে। এছাড়া, রবীন্দ্রনাথের নতুন দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক সুরারোপিত (এবং অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক রচিত) কিছু গানকেও রবীন্দ্রসঙ্গীতের পর্যায়ভুক্ত করা হয়। এর বাইরে আর কারো সুরারোপিত গান রবীন্দ্রসঙ্গীত বলে বিবেচিত হয় না।
এ কারণেই পঙ্কজকুমার মল্লিক, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কিংবা হাল আমলের এ আর রাহমানের সুরারোপ করা রবীন্দ্রনাথের কবিতাগুলো রবীন্দ্রসঙ্গীত হিসেবে গণ্য হয়নি।
রবীন্দ্রসঙ্গীতে বিদেশি ভাষা ও সুরের প্রভাব
রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য জীবনের একেবারে প্রায় শুরু থেকেই তাঁর সঙ্গীতজীবনেরও সূচনা। রবীন্দ্রনাথের লেখা প্রথম গান কোনটি তা নিয়ে অবশ্য নানা মত আছে। এর মধ্যে একটি হলো, ‘গগনের থালে রবি চন্দ্র দীপক জ্বলে’ গানটি রবীন্দ্রনাথের লেখা প্রথম গান। যদি তা-ই হয়, তবে সে হিসেবে বলতে হয়, রবীন্দ্রনাথের জীবনের প্রথম গানটিই বিদেশি ভাষায় রচিত কোনো গানের ভাব ও সুরাশ্রিত। কেননা, এই গানটি শিখ ধর্মের প্রবক্তা গুরু নানক দেব রচিত ‘গগন মে থাল রবি চন্দ্র দীপক বনে’ ভজনটির বেশ কিছু অংশের হবহু অনুবাদ। ২০১৮ সালে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘নানক শাহ ফকির’ এ ব্যবহৃত এই ভজনটি শুনতে পারেন এখান থেকে।
কথা হলো, পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষী রবীন্দ্রনাথ গুরু নানকের ওই গানটি শুনলেন কোত্থেকে? ১৮৭৩ সনেই রবীন্দ্রনাথ এগারো বছর বয়সে পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে দেশভ্রমণে বের হন। উল্লেখ্য, দেবেন্দ্রনাথের আবার দেশভ্রমণের বাতিক ছিলো। সেই সময় রবীন্দ্রনাথ কলকাতা প্রথমে শান্তিনিকেতনে আসেন। এরপর তিনি যান পাঞ্জাবের অমৃতসরে। সেখানে আছে শিখদের পবিত্র স্বর্ণমন্দির। এখানে কিছুকাল অতিবাহিত করেই রবীন্দ্রনাথ শিখদের উপাসনা পদ্ধতি সম্বন্ধে ধারণা লাভ করেন। তিনি শিখদের ভজন সঙ্গীত দ্বারা প্রভাবিত হন এবং বিশিষ্ট গবেষক প্রশান্তকুমার পালের মতে, এখান থেকেই তিনি হয়তো উক্ত ভজনটি বাংলায় অনুবাদ করার প্রেরণা লাভ করেন।
ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশের গানের উপকরণ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের গান
বাংলা অঞ্চলের ও বাংলা গানের প্রচলিত নানান উপাদান নিয়ে অসংখ্য গান রচনা করেছেন কবিগুরু। বাউল গান, সারি গান, শ্যামা সঙ্গীত প্রভৃতি নানান ঢঙে গান রচনা করে বাংলা গানের জগতকে করেছেন সমৃদ্ধ। এর পাশাপাশি ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে প্রচলিত গানের ভাব, বাণি ও সুর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বাংলায় রচনা করেছেন অসামান্য সব গান। যদিও এই গানগুলোকে ঠিক ‘বিদেশি গান’ বলা যায় না; তথাপি এসব গানের ভাষা যেহেতু বাংলা নয়, কিংবা সুর যেহেতু বাংলা গানে প্রচলিত ছিলো না, তাই ‘বিদেশি সুর বা ভাব আশ্রয়ী গান’ এই শিরোনামের আওতায় এসব গান নিয়ে খানিকটা আলোচনা করা যেতেই পারে।
মুম্বাই প্রদেশের কানাড়ি গান ‘সখী বা বা’ এর মতো করে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘বড়ো আশা করে এসেছি গো, কাছে ডেকে লও’ গানটি। কবিগুরুর ‘কোথা আছ প্রভু’ গানে গুজরাটি সুর স্পষ্টরূপেই শ্রুত হয়। মাদ্রাজি গান ‘নিতু চরণমূল’ এর ধাঁচে লিখলেন, ‘বাসন্তী হে ভূবন মোহিনী’; তামিল সুরে লিখলেন, ‘বাজে করুণ সুরে’; দক্ষিণী গান ‘বৃন্দাবন লোলা’ অবলম্বনে ‘নীলাঞ্জন ছায়া’; মারাঠী গান ‘নাদবিদ্যা পরব্রহ্মা’ অনুসরণে ‘বিশ্ববীণা রবে’ ইত্যাদি।
তিনি মাদ্রাজি সুরে লিখলেন ‘এ কী লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ’ গানটি। শাকিলা জাফরের কণ্ঠে শুনতে পারেন গানটি-
রবীন্দ্রনাথ এছাড়াও মহীশূরের গানের ঢঙে লিখলেন বিখ্যাত প্রার্থনা সঙ্গীত ‘আনন্দলোকে মঙ্গলোলোকে’। নিঃসন্দেহে, এই গানগুলো বাংলা গানের সম্ভার আরো ঋদ্ধ করেছে।
তারানা সুরে ‘দারাদিম দারাদিম’ ও ‘তোম তানা নানা’ অনুসরণে কবির দুটি বিখ্যাত গান হলো যথাক্রমে ‘সুখহীন নিশিদিন পরাধীন হয়ে’ ও ‘ওই পোহাইল তিমিররাতি’।
দারাদিম দারাদিম ও সুখহীন নিশিদিন গান দুটি প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে শুনতে পারেন এখান থেকে।
‘রিমঝিম ঘন ঘন রে বরষে’ গানটি রবীন্দ্রনাথের বহুল শ্রুত গানগুলোর একটি। এটি মূলত হিন্দি গান ‘রিমিঝিমি রিমিঝিমি’ গানটি ভেঙে রচিত। রবীন্দ্রনাথের প্রথম নাটক ‘বাল্মীকি প্রতিভা’য় গানটি বনদেবীর গান হিসেবে ব্যবহৃত। স্মর্তব্য যে, গানটি আদতে ‘বিবাহ উৎসব’ নাটিকার একটি গান ছিলো যা সখীদের সমবেত কণ্ঠে পরিবেশিতব্য।
পাশ্চাত্য সঙ্গীতের আদলে রচিত রবীন্দ্রসঙ্গীত
রবীন্দ্রনাথের পরিবার বংশগতভাবেই আধুনিকমনা। রবীন্দ্রনাথের পিতামহ শ্রী দ্বারকানাথ ঠাকুর পাশ্চাত্য সঙ্গীতের তালিম নিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের বড় ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাসাতেও পাশ্চাত্য সঙ্গীতের চর্চা হতো। সেই সূত্রেই রবীন্দ্রনাথ ছোটবেলা থেকেই সংগীতের পাশ্চাত্য ধারার সাথে পরিচিত ছিলেন। পাশ্চাত্য ধারা অবলম্বন করে গান লেখার ক্ষেত্রে এ বিষয়টি অন্যতম অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। ‘বিলাতি সঙ্গীত’; জীবনস্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতি দিচ্ছি,
আমি যথার্থই য়ুরোপীয় সঙ্গীতের রসভোগ করিয়াছি তখনই বারম্বার মনের মধ্যে বলিয়াছি ইহা রোমান্টিক ইহা মানবজীবনের বিচিত্রতাকে গানের সুরে অনুবাদ করিয়া প্রকাশ করিতেছে। আমাদের সংগীতে কোথাও কোথাও সে চেষ্টা নাই যে তাহা নহে, কিন্তু সে চেষ্টা প্রবল ও সফল হইতে পারে নাই।
কেবল পাশ্চাত্য সঙ্গীত নয়; বরং পাশ্চাত্য যন্ত্রানুষঙ্গের সাথেও রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ঘটে পারিবারিকভাবেই। এক্ষেত্রে, রবীন্দ্রনাথ মূলত দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকেই অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ নিজেই এ প্রসঙ্গে বলেছেন,
… পিয়ানো বাজাইয়া জ্যোতিদাদা নতুন নতুন সুর তৈরি করায় মাতিয়াছিলেন। প্রত্যহই তাহার অঙ্গুলি নৃত্যের সঙ্গে সঙ্গে সুরবর্ষণ হইতে থাকিত। … তাহার সেই সদ্যোজাত সুরগুলিকে কথা দিয়া বাঁধিয়া রাখিবার চেষ্টায় নিযুক্ত ছিলাম।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেও পিয়ানো ও বেহালাজাতীয় যন্ত্রের সুরে মোহগ্রস্থ ছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের বিশ্ব যাত্রা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সতেরো বছর বয়সে বিলেত যান ব্যারিস্টারি পড়তে। অভিভাবক হিসেবে তার মেজ দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর তার সাথে ছিলেন। ১৮৭৮ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে ১৮৮০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেড় বছর তিনি ইংল্যান্ডে ছিলেন। পরে উচ্চশিক্ষা শেষ না করেই তিনি দেশে ফিরে এসেছিলেন। যে উদ্দেশ্যে এসেছিলেন, সেটি খুব একটা সিদ্ধি না হলেও এই সময় রবীন্দ্রনাথ পাশ্চাত্যের সাহিত্যিকদের দ্বারা যে গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন, তা ছিলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ে তিনি শেক্সপিয়রসহ পাশ্চাত্যের সাহিত্যিকদের সাহিত্যকর্ম অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে অধ্যয়ন করেন, যেগুলো পরবর্তীকালে তাঁর গান রচনায় ব্যাপক ভূমিকা রাখে।
বিলেত থেকে ফেরত এসে ১৮৮০ সনে বড় ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথের অনুপ্রেরণায় রবীন্দ্রনাথ বাল্মীকি প্রতিভা নাটকটি রচনা করেন। এটি মূলত একটি ‘Musical Drama’ বা গীতিনাট্য। এখানে কবিগুরু নাটকের চেয়েও সংগীতকে গুরুত্ব দিয়েছেন এবং লোকজ ধাচের গানের পাশাপাশি পাশ্চাত্য ধারার ঢঙে তিনটি গান সংযোজন করেছেন। এই নাটকটি নিয়ে মূলত রবীন্দ্রনাথ বাংলা গানে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিশ্রণ নিয়ে একটি এক্সপেরিমেন্ট করতে চেয়েছেন। বলা বাহুল্য, এই এক্সপেরিমেন্টে তিনি সফল হয়েছিলেন। বাল্মীকি প্রতিভা বাংলা সাহিত্যের প্রথম গীতিনাট্য।
‘বাল্মীকি প্রতিভা’ নাটকের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ আরো একটি গীতিনাট্য রচনা করলেন: ‘কাল-মৃগয়া’। এই নাটকে তিনি প্রথম সংস্করণে ৬টি বিদেশি ভাব ও সুরে রচনা করলেন।
রবীন্দ্রনাথ ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর তিনি বিশ্বের কাছে সমাদৃত হয়ে ওঠেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমন্ত্রণ আসে। তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের নানা দেশ ভ্রমণ করেন আর সংগ্রহ করেন বিশ্ব সভ্যতা ও সংস্কৃতির অসামান্য সম্ভার। রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্ভারের একটি বিশাল অংশে এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। পাশ্চাত্য বিশেষত স্কটিশ, আইরিশ ও ইংলিশ গান অনুসরণপূর্বক বিভিন্ন গান রচনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ।
আমরা এ পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথের বহুলশ্রুত বিদেশি সুরাশ্রিত বা ভাবাশ্রয়ী কিছু গান কিংবা বিদেশি কোন অনুষঙ্গ জড়িত এমন কিছু গান নিয়ে আলোচনা করবো এবং জানার চেষ্টা করবো এগুলো রচনার কিছু প্রেক্ষাপট।
ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো, রবীন্দ্রনাথ ও ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে’
প্রথমেই আমরা যে গানটি নিয়ে আলোচনা করছি, সেটি আদতে কোনো বিদেশি সুরাশ্রয়ী গান নয়। তবে, গানটির সাথে জড়িয়ে আছেন কোনো এক বিদেশিনী।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনে যত নারী এসেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। তিনি একজন আর্জেন্টাইন কবি, নারীবাদী কর্মী। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পাবার পর তাঁর ‘গীতাঞ্জলি’র ফরাসি অনুবাদ পড়ে রবীন্দ্রভক্ত হয়ে যান ওকাম্পো। তবে, না, তাদের প্রথম সাক্ষাৎটি কিন্তু নেমতন্ন করে আনুষ্ঠানিকভাবে হয়নি। এটি ছিলো নিতান্তই কাকতালীয়।
বিশ্বভ্রমণে বেরিয়ে ১৯২৪ সালে রবীন্দ্রনাথ পেরু ও মেক্সিকো ভ্রমণ করছিলেন। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে রবীন্দ্রনাথ আর্জেন্টিনার বুয়েনোস আইরেসে অবস্থান করেন। কবির এ অবস্থার খবর শুনে তাকে একনজর দেখতে ছুটে আসেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। রবীন্দ্রনাথের অসুস্থতার কথা জানতে পেরে তিনি তাকে তার বাড়িতে থাকার আমন্ত্রণ জানান। সে আহ্বানে সাড়া দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ভিক্টোরিয়ার আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। প্রথম দর্শনেই শিহরিত হন উভয়ে। যে কয় দিন রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তার বাড়িতে, সেবা-শুশ্রুষা আর আতিথেয়তার কমতি দেখেননি।
ভিক্টোরিয়া নামটিকে বাংলায় অনুবাদ করে রবীন্দ্রনাথ ভিক্টোরিয়াকে ডাকেন ‘বিজয়া’ নামে। এ সময় রবীন্দ্রনাথ তাঁর আপ্যায়নে প্রসন্ন হয়ে তাঁকে ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে’ গানটির অনুবাদ উপহার দেন।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনে কোনো এক বিদেশিনীর অপেক্ষায় প্রহর গুণে গানটি লিখেছিলেন শিলাইদহে বসে অনেক আগে ১৮৯৫ সালে। আর ১৯২৪ সালে ভিক্টোরিয়ার হাতে এই গানের অনুবাদ তুলে দেয়ার মধ্য দিয়ে মনে হয় রবীন্দ্রনাথ বুঝি তাঁর সেই ‘বিদেশিনী’কে খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁর ‘বিজয়া’ ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর মাঝে।
পুরানো সেই দিনের কথা
রচনাকাল: ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দ
রবীন্দ্রনাথ জীবনের প্রথমভাগেই যখন ইউরোপে পড়তে গেলেন, তখন থেকে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হলেন। স্কটল্যান্ডের বিখ্যাত কবি রবার্ট বার্নস রচিত বিখ্যাত গান Auld Lang Syne রবীন্দ্রনাথের মানসপটে দাগ কাটল দারুণভাবে। এই গানটি এতটাই জনপ্রিয় যে, কেবল স্কটিশ ভাষীরা নন, বরং ইংরেজি-ভাষী দেশগুলোর নাগরিকরা মৃত্যুতে কিংবা সমাবর্তন অনুষ্ঠানে কিংবা যেকোনো বিদায়ে গানটি গেয়ে থাকেন। নস্টালজিয়ার স্মৃতি বিজড়িত এই গান বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিতও হয়েছে বটে।
গানটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর এই অনুবাদ এতটাই প্রাঞ্জল হয়ে উঠেছে যে, একে কোনোভাবেই অমৌলিক গান রূপে আলাদা করা যায় না! তিনি যেভাবে ‘মোরা ভোরের বেলায় ফুল তুলেছি’ কিংবা ‘দুলেছি দোলায়’ কিংবা ‘বাজিয়ে বাঁশি’ প্রভৃতি অনুষঙ্গ ব্যবহার করে গানটি অনুবাদ করেছেন, তাতে এটি কোনোভাবেই বোঝার জো নেই যে, এটি কোনো বিদেশি ভাবাশ্রয়ী গান; বরঞ্চ এ গানে বাঙালির প্রাণের আত্মিক অনুভূতিই অকৃত্রিমভাবে অণুরণিত হয়েছে।
ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে
রবীন্দ্রনাথের এই বিখ্যাত গানটিও কিন্তু স্কটিশ কবি বার্নসের রচিত Ye Banks and Braes এর সুরের আদলে নির্মিত হয়েছে। উল্লেখ্য, মূল গানটি কবি বার্নস তিনটি সংস্করণে রচনা করেছিলেন এবং তিনটি সংস্করণই ১৭৯১ সালে প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ‘বিলাতি ভাঙা’ রাগে এই গানটি রচনা করেছেন ১৮৮২ সালে।
মূল স্কটিশ গানে কবি বার্নস নস্টালজিয়া ও প্রেমের আবেগ-অনুভূতি ব্যক্ত করলেও রবীন্দ্রনাথের অনুবাদে প্রাকৃতিক নিসর্গের সৌন্দর্যের মধ্য দিয়ে ভালোবাসার গাঁথা বর্ণিত হয়েছে। “The Caledonian Hunt’s delight” এর সুরে সুরারোপিত এই গানটি সুর হবহু বাংলা সংস্করণে বজায় রেখেছেন কবি গুরু।
কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া
এই গানটি রচিত হয়েছে বিখ্যাত ইংরেজ নাট্যকার বেন জনসনের ‘Song: to Celia’ কবিতা অবলম্বনে রচিত ‘Drink to me only with thine eyes’ গানটির সুর ও ভাব অবলম্বনে। মূল গানটি ১৬১৬ সনে রচনা করা হয়। মূল গানটির প্রথম কিছু চরণ এরকম-
Drink to me only with thine eyes,
And I will pledge with mine;
Or leave a kiss within the cup,
And I’ll not ask for wine.
মূল এই গানটি অপরাপর ইউরোপীয় কবি-সাহিত্যিকরাও তাদের বিভিন্ন সাহিত্যকর্মে ব্যবহার করেছেন। গানটি গেয়েছেন বিশ্বের নানা প্রান্তের খ্যাতিমান শিল্পী ও ব্যান্ডদল। গানটির মাঝে প্রিয়তমের প্রতি নিজেকে সঁপে দেওয়ার যে তীব্র বাসনা ও গভীর ভাবাবেগ, তা বাংলাতেও রবীন্দ্রনাথের গানে রক্ষিত হয়েছে অপূর্ব ব্যঞ্জনায়।
আহা আজি এ বসন্তে
বিখ্যাত আইরিশ কবি থমাস মূরের “Go Where Glory Waits Thee” (১৮০৭) অনুকরণে রচিত হয়েছে বিখ্যাত এ গান ‘আহা আজি এ বসন্তে’ । প্রতি বছর যখন বসন্ত আসে, তখন চির-রোমান্টিক বাঙালির মনের অজান্তেই গীত হয়ে ওঠে এ গানটি । বাংলায় ‘আহা আজি এ বসন্তে’ গানটি রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছেন ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে। এটি রবীন্দ্রনাথের ‘মায়ার খেলা’ নাটকের সপ্তম দৃশ্যে পরিবেশিত হয়েছে।
মূল গানটি ‘Maid of the Valley’ এর ভিত্তিতে সুরারোপিত। এই সুরে ‘আহা আজি এ বসন্তে’র পাশাপাশি একই সুরে রবীন্দ্রনাথের ‘ওহে দয়াময়’ গানটিও রচিত হয়েছে। ‘কাল-মৃগয়া’ নাটকে ‘মানা না মানিলে’ গানেও এই সুর অনুকৃত হয়েছে বলে মনে হয়।
সংকোচেরই বিহ্ববলতা
রবীন্দ্রনাথ কানাডা থেকে ফেরার পথে বেশ কিছু দিন জাপানে অবস্থান করেন। এ সময় তিনি জাপানী জুজুৎসু (জুডো) ও কুচকাওয়াজ বিশেষভাবে দেখবার সুযোগ পান।
এ থেকে পরে তাঁর শান্তিনিকেতনেও এই ক্রীড়া শেখাবার মনস্থির করেন। তিনি নেকুজো তাকাগাকি নামে একজন জাপানী জুজুৎসু শিক্ষককে নিয়োগ দেন। ১৯২৯ সালে শান্তিনিকেতনে তিনি যোগদান করেন। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্র জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের বর্ণনা প্রণিধানযোগ্য,
তাকাগাকি আসিবেন স্থির হইলে জুজুৎসু ক্রীড়ার জন্য একটি টিনের ঘর নির্মিত হইল। কত বড়ো ঘর, কত দৈর্ঘ্য প্রস্থ প্রয়োজন সে সব তথ্য না জানিয়াই ঘর তৈয়ারী হইল। তাকাগাকি আসিয়াই সে ঘর নাকচ করিয়া দিলেন। … তাকাগাকি শান্তিনিকেতনে দু’বছর ছিলেন।
১৯৩১ সালের ১৬ মার্চে কলকাতার নিউ এম্পায়ারে শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রীরা জুজুৎসু ক্রীড়া ও কসরতের প্রদর্শনী দেখায়।
এ অনুষ্ঠানটির সূচনা সংগীত হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ‘সংকোচেরই বিহ্বলতা’ গানটি রচনা করেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে রবীন্দ্রনাথ নিজে ঐ গানের ভাষা ও বাণী ব্যাখ্যা করেন।
দেবব্রত বিশ্বাসের কণ্ঠে গীত গানটির আদি রেকর্ড সংযুক্ত করা হলো।
এনেছি মোরা এনেছি মোরা
রবীন্দ্রনাথের ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ নাটকে ব্যবহৃত এই গানটি পাশ্চাত্য সঙ্গীতকে ভেঙে রচিত হয়েছে বলে বিদগ্ধজনেরা বলে থাকেন। গানটির রচনাকাল ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দ। সে ক্ষেত্রে গানটি যে বহুল শ্রুত ও তুমুল জনপ্রিয় “For He’s a Jolly Good Fellow” এর অনুকরণে এমন ভাবাটা কিছু অমূলক নয়। ইংরেজি এই গানটি বিয়ে, জন্মদিন বা অন্য যেকোনো আয়োজনে প্রিয়জনকে অভিনন্দন জানাতে গাওয়া হয়ে থাকে।
ইংরেজি গানটির একটি ব্রিটিশ সংস্করণ ও একটি আমেরিকান সংস্করণও আছে। মূল ইংরেজি গানটি একটি ফরাসি গান থেকে জনপ্রিয়তা লাভ করে ইংরেজি ভাষাতেও জায়গা করে নিয়েছে। শোনা যায়, ফ্রান্সের রানি মারি এন্তোনে একদা তার এক দাসীকে এই গানটি গাইতে শোনেন। তখন গানটি রানির খুব ভালো লেগে যায় এবং তার মাধ্যমেই গানটি জনসমাজে পরিচিতি পায় ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। অষ্টাদশ শতকে রচিত এ গানটি রবীন্দ্রনাথের আমলে যেমন জনপ্রিয় ছিলো, আজ পর্যন্ত তেমন জনপ্রিয়ই আছে। গিনেজ বুক রেকর্ড অনুযায়ী, এটি ইংরেজি ভাষায় গাওয়া সঙ্গীতগুলোর মধ্যে জনপ্রিয়তার দিক থেকে দ্বিতীয়! উল্লেখ্য, এ ধারায় প্রথম অবস্থানে, ‘Happy Birth Day to You’ এবং তৃতীয় অবস্থানে আছে ‘Auld Lang Syne’। ইংল্যান্ডের শীর্ষ তিন জনপ্রিয় গানের দুটির সুরে রচিত বাংলা সংস্করণ আমরা পেলাম রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে। ব্যাপারটা আসলেই খুব আনন্দের।
উভয় সংস্করণের কিছুটা শুনে নিতে পারেন এখান থেকে।
প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে
অসম্ভব জনপ্রিয় এই গানটির বাণী বা সুরের সাথে পাশ্চাত্যের যোগসূত্র না থাকলেও পাশ্চাত্যের সাথে কিছুটা জড়িত। রবীন্দ্রনাথ এই গানটি ৩রা জুন, ১৯১২ সালে রচনা করেন, এ সময় তিনি লোহিত সাগর হয়ে ইউরোপ যাচ্ছিলেন। সমুদ্র ও আকাশের মিলিত অপরূপ শোভায় মুগ্ধ হয়ে কবি গানটি রচনা করেছিলেন। এটি ছিলো সেই যাত্রা, যে যাত্রায় করে তিনি তাঁর গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদের পাণ্ডুলিপি ইউরোপীয় বিদগ্ধ সাহিত্যিকদের কাছে উপস্থাপন করেন, যেখান থেকেই তিনি নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন এবং পরের বছর ১৯১৩ সালে এশিয়ার প্রথম ব্যক্তি হিসেবে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান।
ও দেখবি রে ভাই আয় রে ছুটে
কাল-মৃগয়া নাটকের প্রথম দৃশ্যে লীলার কণ্ঠে গীত হয় এ গানটি। গানটি কবিগুরু রচনা করেছেন মূল আইরিশ গান ‘The Vicar of Bray অবলম্বনে। মূল এই গানটি একটি ব্যাঙ্গাত্মক গান। গানটি সপ্তদশ শতক থেকে ইংল্যান্ডে প্রচলিত।
বাংলা গানে অবশ্য রবীন্দ্রনাথ কেবল সুরটিই গ্রহণ করেছেন, অনূদিত গানের ভাব ও বাণী মূল গানের অনুগামী নয়। এবার শিল্পী সুবীর সেনের কণ্ঠে শুনে নিন এই সুর অনুকরণে লেখা রবীন্দ্রনাথের বাংলা গানটি।
কালী কালী বলো রে আজ
এই গানটি ব্রিটিশ গান Nancy Lee গানের ছায়া অবলম্বনে রচিত হয়েছে। ফ্রেডেরিস ওয়েদারলির লেখা ও স্টিফেন অ্যাডামসের সুরারোপিত এ গানটি বিখ্যাত গীতিনাট্য বাল্মীকি প্রতিভায় রবীন্দ্রনাথ ব্যবহার করেছিলেন। গানটি তাঁর বিখ্যাত নাটক ‘বাল্মীকি প্রতিভা’য় প্রথম দৃশ্য পরিবেশিত হয়েছে।
সকলি ফুরালো, স্বপনপ্রায়
‘কালমৃগয়া’ নাটকের ষষ্ঠ দৃশ্যে ‘সকলি ফুরালো স্বপনপ্রায়’ গানটি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এই গানটি লেডি ক্যারোলিন কেপেল রচিত আইরিশ (বা কেউ কেউ বলেন স্কটিশ) গান ‘Robin Adair’ অবলম্বনে রচিত হয়েছে। গানটি কবি ক্যারোল ডালির বিখ্যাত Eileen Aroon গানের সুর অবলম্বনে রচিত। মূল গানটি জেন অস্টেনের উপন্যাস Emma-তে ১৮১৫ সালে ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়াও, নানা জায়গায় এই গানটি গীত হয়েছে।
লেডি কেপেল গানটি তাঁর স্বামী রবিন এডেইরকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন। রবিন ছিলেন নিচু বংশের। পারিবারিক বিরোধিতা সত্ত্বেও লেডি কেপেল রবিনকে বিয়ে করেন। স্বামীকে নিয়েই এই গানটি তিনি রচনা করেন ১৭৫০ এর দশকে।
বিখ্যাত এই গানটিকে অবলম্বন করে রবীন্দ্রনাথও লিখে ফেললেন এই গভীর বিষাদ জাগানিয়া গান ‘সকলি ফুরালো, স্বপনপ্রায়’।
তবে আয় সবে আয়
এই গানটি বিখ্যাত ইংরেজ কবি জন পীলে রচিত ‘The English Hunting Song” অবলম্বনে রচিত। ‘তবে আয় সবে আয়‘ গানটি কালমৃগয়া নাটকে ব্যবহৃত হয়েছে। বাংলা এ গানটির রচনাকাল ১৮৮০। দল বেঁধে শিকারে যাওয়াকালীন এ গানটি সমস্বরে গীত হয়ে থাকে। বাংলাতেও এই ভাবটিই কবি ধারণ করেছেন, সেখানেও ঢাল-তলোয়ার প্রভৃতি অনুষঙ্গের কথা বলা হয়েছে।
ও ভাই দেখে যা
রবীন্দ্রনাথের আরেকটি অনবদ্য সৃষ্টি ‘ও ভাই দেখে যা‘ গানটি। ১৮৮২ সালে রচিত এ গানটি ‘কাল-মৃগয়া’ নাটকের প্রথম অঙ্কের প্রথম দৃশ্যে সন্নিবেশিত হয়েছে। গানটির সুর সংগ্রহ করা হয়েছে বিখ্যাত The British Grenadiers শিরোনামের গানটি হতে। এই গানটি ব্রিটিশ ও কানাডার সেনাবাহিনীর রণ সংগীত হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। গানটির প্রকৃত রচয়িতা কে তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। গানটি সপ্তদশ শতকে এলিজাবেথান পিরিয়ডে রচিত হয়েছে বলে গবেষকদের ধারণা। মূল গানটি শুনতে পারেন এখান থেকে।
বাংলা গানটি শুনে নিতে পারেন এখানে।
রবীন্দ্রনাথের আরো বেশকিছু বিখ্যাত বিদেশি সুর বা ভাবাশ্রয়ী গানের মধ্যে আছে ‘তোমার হলো শুরু, আমার হলো সারা’, ‘ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু’, ‘প্রাণ চায় চক্ষু না চায়’ ইত্যাদি।
প্রকৃতপক্ষে, রবীন্দ্রনাথ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সঙ্গীতের মধ্যকার ব্যবধান ঘুচিয়ে একের ঐশ্বর্য দ্বারা অন্যটিকে ঐশ্বর্যমণ্ডিত করার প্রয়াস পেয়েছেন। তিনি চেয়েছেন উভয় সঙ্গীতের এ ধারা পরস্পর ‘মিলিবে ও মিলাবে’। সাহিত্যের অন্যান্য অঙ্গনে গীতিনাট্য, উপন্যাসের আধুনিক স্বরূপ কিংবা বাংলা ছোটগল্প ইত্যাদি ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য সাহিত্যের উপাদান গ্রহণ করে নতুন ধারার সৃষ্টি করেছেন রবীন্দ্রনাথ। বাংলা গানেও এই সংমিশ্রণের বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ইতিবাচকভাবে উদগ্রীব। তাঁর মতে,
এশিয়ার প্রায় সকল দেশেই আজ পাশ্চাত্য ভাবের সঙ্গে প্রাচ্যভাবের মিশ্রণ চলছে। এই মিশ্রণে নূতন সৃষ্টির সম্ভাবনা। … আমাদের সাহিত্যে এটা ঘটেছে, সঙ্গীতেও কেন ঘটবে না বুঝি না।
তাল-লয়-সুরের ভারে নীত বাংলা গানকে ভেঙে সহজ, সুন্দর ও সাবলীল সব গান রচনা করে রবীন্দ্রনাথ এই বাংলা গানকে সাধারণের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। সুরের দুস্তর পারাবারকে এড়িয়ে বাংলা গানকে ‘বাণীপ্রধান’ করে আমাদেরকে অভিনব সব গান উপহার দিয়ে গেছেন। তাই তো সুখে-শোকে, প্রাতে-রাতে, জীবনের সব উপলক্ষ্যে– কখনো হালকা মেজাজের, কখনো বা গভীর দার্শনিক জীবনবোধ সম্পন্ন অনবদ্য সব গান রচনা করে চির-ভাস্বর হয়ে আছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।