২৮ অক্টোবর, ১৯৭১। দুপুর ১২টায় ঢাকার পাকিস্তান টেলিভিশন অফিস কেঁপে উঠলো। ছাঁদে বসানো রিলে অ্যান্টেনা এবং সাত তলার দেয়ালের একাংশ ধসে পড়েছে। ছুটে আসে ফায়ার সার্ভিস। কড়া নিরাপত্তায় ঘেরা এই অফিসে মুক্তিরা আসলো কীভাবে? উত্তর পায় না পাক বাহিনী। জেনে আসা যাক সেই গল্প।
মুক্তিযোদ্ধারা চাইছিল তাদের পরিচালিত অভিযানগুলোর কথা বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দিতে। পাক সরকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক বোঝাতে এবং স্বাধীনতা যুদ্ধকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে উপস্থাপন করতে ব্যাপক প্রোপাগান্ডা চালিয়ে যাচ্ছিল। ইতোমধ্যে হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল এবং বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে হামলা চালায় ঢাকার গেরিলারা। নতুন লক্ষ্য ডিআইটি ভবনের (বর্তমান রাজউক ভবন) পাকিস্তান টেলিভিশন অফিস। ঢাকায় নিজেদের সক্ষমতা জানান দেয়া এবং বিশ্ববাসীর কাছে হাঁটে হাঁড়ি ভেঙে দেয়া- এই দুই-ই ছিল উদ্দেশ্য। সাথে টেলিভিশন সম্প্রচারে বিঘ্ন ঘটিয়ে প্রোপাগান্ডা প্রচার বাধাগ্রস্ত করা।
ডিআইটি ভবনের প্রহরায় প্রায় শতাধিক পাক সেনা ছিল এবং ২টি চেক পয়েন্ট পার হয়ে ভবনে ঢুকতে হতো। এছাড়াও ঢাকায় কয়েকটি গেরিলা অপারেশন, বিশেষ করে বায়তুল মোকাররম অভিযানের পর, নিরাপত্তা বাড়ানো হয়। কাজটা খুবই চ্যালেঞ্জিং ছিল। টেলিভিশন ভবনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পাকিস্তানি হলেও বাকি সবাই বাংলাদেশি ছিল। দেশের জন্য একটা টান সবারই ছিল। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা এতটাই গোপনীয় ছিল যে, তারা কেউই মুক্তিবাহিনী পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি।
এরকমই একজন সৈয়দ মাহাবুব আলী। সহকারী কেরানি হিসেবে কাজ করা এই ব্যক্তির প্রতিবেশি ছিল নজিবুল্লাহ জন এবং নাজমি (সাঈদ ইকবাল নাজমী ওরফে ফেরদৌস নাজমি)। তারা দুজনেই ছিল মুক্তিবাহিনীর গেরিলা। ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলা বাচ্চুকে (নাসিরুদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু) মাহাবুব সম্পর্কে অবগত করেন তারা। মাহাবুব আলী একসময় রাজনীতি করায় তার দেশপ্রেম ছিল প্রশ্নের ঊর্ধ্বে। গেরিলা বাচ্চু মাহাবুব আলীর সাথে অভিযান বিষয়ে কথা বলতে সম্মতি প্রদান করেন।
জন এতদিন তার মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় মাহাবুব আলীর কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছিলেন। একদিন তিনি হঠাৎ করেই তার পরিচয় দেন মাহাবুব আলীকে। অনুরোধ করেন ডিআইটি ভবনে বেশ কিছু জিনিস নিয়ে যেতে হবে। মাহাবুব আলী যে সম্মত হবেন এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না। জিনিসগুলো ছিল আসলে প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ। নমুনা হিসেবে কয়েকটি বিস্ফোরক এনে দেখানো হয় তাকে। কিন্তু কীভাবে সেটা বয়ে নিয়ে যাবেন তিনি?
পরদিন আরেক গেরিলার সাথে দেখা করতে জন মাহাবুব আলীকে রমনা পাঠান। গিয়ে দেখেন, সেই আরেক গেরিলা তারই প্রতিবেশি নাজমি (ফেরদৌস নাজমি)। ফেরার পথে হঠাৎ বাটা স্টোরের দিকে তাকিয়ে মাথা খুলে যায় মাহাবুব আলীর। জিন্নাহ অ্যাভিনিউয়ের বাটা স্টোর থেকে কিনে ফেলেন কনভাস জুতা আর মোজা।
হাঁটুর ১/২ ইঞ্চি নিচ পর্যন্ত ব্যান্ডেজ নিয়ে বিস্ফোরক বাঁধা হলো। তার উপর নতুন মোজা পরলেন মাহাবুব আলী। তারপর নতুন জুতা পরলেন। কয়েকবার হেঁটে অভ্যাসও করে নিলেন। পাক সেনারা হাঁটুর নিচে হাত দিয়ে দেখে না। অফিসের দিকে ছুটলেন তিনি। আসার সময় জন একটি ফোন নাম্বার ধরিয়ে দেন। ঠিকমতো পৌঁছে যেন ফোন দেন। ফোন না দিলে সবাই ধরে নিবে তিনি ধরা পড়েছেন এবং বাকিরা গা ঢাকা দেবে।
দুটি চেক পোস্ট সহজেই পার হলেন। পাক প্রহরি পকেট, ব্যাগ সব দেখলেও জুতার দিকটা দেখে না। কিন্তু বিপত্তি হলো অন্য জায়গায়। বিস্ফোরক লুকিয়ে ফোন দিতে গিয়ে দেখেন ফোন যাচ্ছে না। এদিকে তার ফোন না দেয়ার অর্থ তিনি ধরা পড়েছেন। গেরিলারা পালিয়ে গেলে পুরো অভিযান ভেস্তে যাবে। সচিব সাহেবের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে আবার সাইকেল চালিয়ে চলে যান নারিন্দার বাড়িতে। জন ভুল নম্বর দিয়েছিল!
১২ দিনে এভাবে ১৪ পাউন্ড প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ নেয়া হয় ডিআইটি ভবনে। এরপর আরো কিছু উপকরণ নেয়ার প্রয়োজন পড়ে- কর্টেক্স, ৩ ফুট তারসহ ফিউজ এবং ডেটোনেটর। একটা চাইনিজ ইয়ুথ ফাউন্টেন পেনের মধ্যে ডেটোনেটর নিয়ে যাওয়া হয়। জুতার মধ্যে ফিউজ রেখে ৩ ফুট তার পায়ে পেঁচিয়ে মোজা পরেন তিনি। কিন্তু তার বাইরে থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। পাক গার্ড একবার পায়ের দিকে তাকালেই পুরো অপারেশন পণ্ড। কিন্তু ঝুঁকি নিতেই হবে। সংগ্রামটা যখন মাতৃভূমি রক্ষার, তখন ধরা পড়লে কী হবে সেটা না ভেবে মাহাবুব আলী রওনা নেন।
সাধারণত প্রহরি হাঁটুর নিচে হাত দিয়ে দেখত না। কিন্তু কী মনে করে সেদিনই হাঁটু পর্যন্ত চেক করার পর হাঁটুর নিচে হাত দিতে শুরু করে গার্ড। কিছু করতে হবে! এবং সেটা কয়েক মুহূর্তের মধ্যে। মাহাবুব আলীর ঘাম ঝরছে তখন, চোখে ভয়ের ছাপ। হঠাৎই হাসতে শুরু করেন তিনি। যেন হাঁটুর নিচে হাত দেয়ার সুড়সুড়িতে তিবি হাসছেন। বিরক্ত হয়ে পাক সেনা ছেড়ে দেয় তাকে। তাড়াতাড়ি অফিসে গিয়ে সব লুকিয়ে ফেলেন তিনি।
এরই মধ্যে ভুয়া পরিচয়পত্র বানিয়ে জন একদিন ঘুরে এসেছেন ডিআইটি ভবন। রিলে অ্যান্টেনার কোথায় বোমা বসালে সর্বোচ্চ ক্ষতি করা যায় সেটা দেখে আসেন তিনি। এছাড়াও কর্মীদের যেন ক্ষতি না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। বেশিরভাগ কর্মীই বাঙালি এবং তাদের জোর করে কাজ করানো হচ্ছে। রেকি শেষে জন রিপোর্ট করেন গেরিলা বাচ্চুকে। ঠিক হলো- ২৮ তারিখ অপারেশন হবে। জন ভুয়া পরিচয়পত্র ব্যবহার করে নিজেই যেতে চাইলেন। বোমা বসানোর কাজটা বেশ ঝুঁকির। কিন্তু মাহাবুব আলী বেঁকে বসেন। বোমা বিস্ফোরণের পর তাণ্ডব চালাতে পারে পাক বাহিনী। জন খুব সহজেই ধরা পড়ে যেতে পারেন। মাহাবুব আলীকে নামমাত্র বোমা পাতার প্রশিক্ষণ দেয়া হলো। কোনোরকম মুখে বলে তাকে বুঝিয়ে দেয়া হয়। আরেকটি বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে যে তাকে শেখানো হবে সেই উপকরণ বা সুযোগ কোনোটাই ছিল না।
২৮ অক্টোবর; প্রতিদিনের মতো অফিসে ঢুকে কিছুক্ষণ পরেই ছাঁদের ক্লক রুমে চলে যান তিনি। সাথে ফাইলের স্তুপে লুকিয়ে রাখা প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ এবং বাকি সব উপকরণ নিয়ে যান। প্রথমে তালগোল পাকাতে শুরু করলেও ঠিকঠাক মতোই কাজ শেষ করেন তিনি। ডেটোনেটরে আগুন ধরিয়েই নিচে নেমে পড়েন। সচিবের সহকারীর সামনে বসে পড়েন। সাধারণত তাকে ফুটফরমায়েশের কাজের জন্য এখানেই বসে থাকতে হয়। আর বোমা বিস্ফোরণের আগে অফিস থেকে বের হলে সবাই সন্দেহ করবে।
১০ মিনিট পরেই বিকট শব্দ। সাড়া অফিসে হইচই পড়ে গেল। মুক্তিবাহিনী কি ঢুকে পড়েছে তাদের অফিসে? আতঙ্কিত সবাই। সেই আতঙ্কের মাঝেই যেন সব বাঙ্গালিরা স্বস্তির অনুভূতি পাচ্ছে।
ডিআইটি ভবনের পাশেই ছিল তখনকার গভর্নর হাউজ, যেটা এখন বঙ্গভবন নামে পরিচিত। মাত্র ৩০ গজ দূরত্বে বোমা বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গেই পুরো বিশ্বে খবর ছড়িয়ে যায়। টেলিভিশন সম্প্রচার বন্ধ হয়ে পড়ে।
ডিআইটি ভবন থেকে কাউকে বের হতে দেয় না পাক বাহিনী। প্রত্যেক বিভাগ থেকে ১০ জন করে বাঙালি নিয়ে হত্যা করার হুকুম দেয় তারা। সচিব কর্নেল আল্লাওয়ার্দি সেনাদের জানান, তার বিভাগের সবাই খুব বিশ্বস্ত। তারা এই কাজ করতেই পারে না। বেঁচে যান মাহাবুব আলী।
তিনি বেঁচে গেলেও সেদিন ডিআইটি ভবনেই হত্যা করা হয় অন্তত ৩০/৪০ জনকে। পাক বাহিনী রক্তের বন্যা বইয়ে দেয়, যেটায় পরে তাদেরই ভেসে যেতে হয়।