১.
১৯৯৯ সালের ঘটনা। হরিয়ানার প্রভাবশালী নেতা বিনোদ শর্মার ‘সুপুত্র’ মানু শর্মার হাতে খুন হলেন নয়াদিল্লীর ডাকসাইটে মডেল জেসিকা লাল। ঘটনার শুরু পানশালা থেকে। জেসিকা ও তার সহকর্মী বিক্রম জাই সিং পানশালা বন্ধ করছিলেন। এমন সময় দুই বন্ধুসহ হাজির হলেন মানু শর্মা। মদ্যপান করতে চান বলে জানালেন জেসিকাকে। জেসিকা জানিয়ে দিলেন, আজকের মতো সময় শেষ।
এহেন কথা শুনে মাথায় রক্ত চড়ে গেল মানু শর্মার। মুখ্যমন্ত্রীর ছেলেকে ‘না’ বলে দেয়! এত বড় ক্ষমতা! জেসিকার ‘বেয়াদবি’র অপরাধে মানু শর্মা সেখানে দাঁড়িয়ে গুলি করে হত্যা করলেন জেসিকাকে। ব্যস! সব শেষ।
খুন হওয়ার পর থেকে জেসিকার পরিবার তার ন্যায়বিচারের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরতে লাগলো। সাক্ষীও ছিল অনেক। কিন্তু মানু শর্মার ক্ষমতার দাপটে কেউ আর সাক্ষী দিতে এলো না। জেসিকার বোন সাবরিনা অনেক চেষ্টা চালিয়েছিলেন, কিন্তু কাজ হয়নি।
২০০৬ সাল। ৭ বছর মামলা চালিয়ে যাওয়ার পর রায় দিল হরিয়ানার আদালত। কেউ সাক্ষী দিতে না আসায় বেকসুর খালাস পেয়ে গেল খুনি মানু শর্মা।
পরবর্তীতে ওই রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে হরিয়ানার সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমেছিলো। যার ফলাফলস্বরূপ আবারও মামলা চালু হলো। এবার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলো মানু শর্মারা। তবে হ্যাঁ, কেউ সাক্ষী দিতে না আসায় সাধারণ মানুষ যে কথাটা বলে আলোড়ন তুলেছিলো, তা হলো ‘নো ওয়ান কিলড জেসিকা’। অর্থাৎ জেসিকাকে কেউ মারেনি। এই নামে পরে সিনেমাও হয়েছে, যার শ্রেষ্ঠাংশে ছিলেন বিদ্যা বালান এবং রানী মুখার্জীর মতো শক্তিশালী দুই অভিনেত্রী।
২.
প্রশ্ন উঠতে পারে, জেসিকার সাথে বাংলাদেশের ক্রিকেটার সাব্বির রহমানের যোগসূত্র কোথায়?
যোগ আছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের ক্রিকেটে চায়ের কাপে ঝড় উঠছে কেবলই সাব্বির ইস্যুতে। নিউজিল্যান্ড সিরিজে তাকে দলে নেওয়া হয়েছে। অথচ খাতাকলমে সাব্বির জাতীয় দলে আপাতত নিষিদ্ধ ছিলেন। প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন নান্নু যদিও জানিয়েছেন, সাব্বিরের নিষেধাজ্ঞা এক মাস কমানো হয়েছে। কিন্তু সেই কমানোর কথা কেউ জানে না।
সাব্বির যদি নিষিদ্ধই হন, তাহলে তিনি কী করে দলে জায়গা পেলেন? নির্বাচক দায় দেন অধিনায়কের। অথচ নির্বাচকের মন্তব্যে অবাক হয়েছেন অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা। তিনি সাব্বিরকে সরাসরি কখনোই নিতে বলেননি। আবার বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন দিচ্ছেন আরও চমকপ্রদ তথ্য। তিনি নাকি জানেনই না যে, সাব্বিরের নিষেধাজ্ঞা শেষ হয়েছে। অথচ দল ঘোষণার আগে দলের তালিকা তার সাক্ষর হয়ে আসে। সেখানে নাকি কে বা কারা তাকে জানিয়েছে, সাব্বিরের নিষেধাজ্ঞা শেষ হয়ে গেছে।
সাব্বিরের দলে নেওয়ার ব্যাপারে এমন পাল্টাপাল্টি দোষ দেওয়ানেওয়ার ঘটনার সঙ্গে ‘নো ওয়ান কিলড জেসিকা’ ছাড়া আর কোনো যথার্থ উদাহরণ হতে পারে না।
মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে দল ঘোষণার পর সাব্বির ইস্যুতে নান্নু বলেন,
‘সাব্বিরের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আমাদের অধিনায়কের পছন্দের। ও খুব জোরালোভাবে আমাদের কাছে দাবি জানিয়েছে। আমরাও মত দিয়েছি। অধিনায়ক এমন একজনকে চাচ্ছে, যে লোয়ার অর্ডারে ফাস্ট বোলারকে সামলাতে পারবে। বিশ্বকাপের জন্য পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ওকে নিউজিল্যান্ড সিরিজে নেওয়া হয়েছে। দেখা যাক, অধিনায়ক তার ব্যাপারে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী। আমিও আশাবাদী, সাব্বির ফিরে আসবে।’
মাঠে ও মাঠের বাইরের একাধিক শৃঙ্খলা-বহির্ভূত কর্মকাণ্ড দুই দফা নিষেধাজ্ঞার খড়্গে ফেলেছে সাব্বিরকে। কিন্তু তারপরও তিনি নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দলে জায়গা পেলেন। পারফরম্যান্স নয়, বরং নিষিদ্ধ থাকার পরও একজন ক্রিকেটার কী করে দলে ফিরতে পারেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে বোর্ডের দায়বদ্ধতা ও দায়িত্বজ্ঞান নিয়ে।
৩.
সাব্বির প্রসঙ্গে পাল্টাপাল্টি মন্তব্য ‘ছোড়াছুঁড়ি’ চালিয়ে যাচ্ছেন নির্বাচক-অধিনায়ক-সভাপতি।
‘সাব্বিরকে নিষিদ্ধ করার পর তাকে দলে ফেরানোর জন্য অনেক অনুরোধ পেয়েছিলাম। কিন্তু আমি তা হতে দেইনি। কিন্তু একটা সময়ে যখন ক্রিকেটার তার নিজের ভুল বুঝতে পারে, যখন তার আচরণে পরিবর্তন আসে, তখন হয়তো এই ধরণের অনুরোধ আসতেই পারে। আমিও সেক্ষেত্রে ভেবে দেখতে পারি। সাব্বিরের জন্য এটা শেষ সুযোগ। এটা কোনো কথা নয় যে, তার নিষেধাজ্ঞা কেটে যাওয়ার ১৫-২০ দিন আগে দলে ফিরছে। কথা হলো, আবারও যদি সে এমন কিছু করে, তাহলে তাকে আজীবন নিষিদ্ধ করা হবে।’
সাব্বির ইস্যুতে নির্বাচক ও অধিনায়ক প্রসঙ্গে পাপন বলেছেন,
‘সাব্বিরের ব্যাপারে তারা (নির্বাচক ও অধিনায়ক) যা করেছে, আমি সেখানে কোনোরকমের মতামত দিতে যাইনি। আমার কাছে মনে হয়েছিলো, সে দলে ফিরেছে, কারণ তাকে কোচ ও অধিনায়ক চায়।’
নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার আগে সাব্বিরকে দলে ভেড়ানোর ব্যাপারে খানিকটা পক্ষপাতিত্বও করলেন বলে মনে হয়।বললেন,
‘আসলে ওরা সাব্বিরকে বিশ্বকাপের জন্য চেয়েছিলো। এছাড়া তাকে নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার ১৫-২০ দিন আগেই দলে নেওয়ার আর কোনো কারণ দেখছি না। হ্যাঁ, বিপিএলে তার পারফরম্যান্স অবশ্যই একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে।’
চলতি বিপিএলে কতটা সফল সাব্বির? সিলেট সিক্সার্সের এই টি-টোয়েন্টি স্পেশালিস্ট এবারের আসরে আলোচনায় আসেন মাশরাফির রংপুর রাইডার্সের বিপক্ষে ৮৫ রানের এক ঝড় তোলা ইনিংস খেলার পর। এখন পর্যন্ত নিজের শেষ দুই ম্যাচেও সাব্বির ছিলেন সহজাত, খেলেছেন যথাক্রমে অপরাজিত ৪৪ ও ৪৫ রানের ইনিংস। এখন পর্যন্ত ১১ ম্যাচে রান তুলেছেন ২৪৪। সবচেয়ে বেশি রান সংগ্রাহকের তালিকায় তার অবস্থান এই মুহূর্তে ১২ নম্বরে। অর্থাৎ খুব যে ঝলমলে, তা বলা যায় না। তাহলে এই অবস্থায় সাব্বির কেন দলে?
প্রধান নির্বাচক এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বলেছেন,
‘কিছু কিছু ব্যাপার আছে, যারা আগে পারফর্ম করেছে, ঘরোয়াতে খেলে যাচ্ছে। বিপিএল একটা আন্তর্জাতিক মানের টুর্নামেন্টের মতোই। এখানে অনেক বিদেশি ক্রিকেটার খেলছে। এখানে ওর পারফরম্যান্স একটু গণনা করা যায়। এমন না যে, একদম ফেলে দেওয়া যায়। এই জায়গা থেকে ক্যাপ্টেন টিম ম্যানেজমেন্টের প্ল্যান থাকে, তখন নির্বাচকদের সেই প্ল্যানের সাথে অবশ্যই যেতে হয়। সেই হিসেবে ক্যাপ্টেন কোচ যখন জানিয়েছে তখন আমাদের সেই অনুযায়ী যেতে হয়েছে।’
বারবার যখন অধিনায়কের প্রসঙ্গ আসছে, তখন সেই অধিনায়ক কী ভাবছেন? উত্তর খুঁজতে গিয়ে কেবল পাওয়া গেল হতাশা। ক্ষুব্ধ মাশরাফি, অভিমানী মাশরাফি অনেকটা জোর করেই সাব্বিরের দলে জায়গা করার ‘দায়’ মাথা পেতে নিলেন। তবে প্রধান নির্বাচকের মন্তব্য তাকে আঘাত করেছে।
মাশরাফি বলেছেন,
‘আমার তো মতামত দেওয়ার চেয়ে বেশি কিছু করার নেই। অন্য অনেক দেশের নির্বাচক প্যানেলে অধিনায়ক থাকেন। আমাদের দেশে তা নেই। সাব্বিরকে আমি একক সিদ্ধান্তে দলে নিয়ে নেবো, সে প্রশ্নই ওঠে না। আমি শুধু নিজের মতামত জানিয়েছিলাম।’
তিনি আরও বলেন,
‘সাব্বিরের ওপর আমি আস্থা দেখিয়েছি এ কারণে না যে, তাকে নিতেই হবে। আসলে নিউজিল্যান্ড সফরের জন্য স্কোয়াডের ১৪ জনের নাম ঠিক হয়ে গেছে। এরপর ১৫ নম্বর সদস্যের জন্য যে নামগুলো দেখেছি, তখন মনে হয়েছে সাব্বিরকে নেওয়া যায়। কারণ, বিশ্বকাপে সাত নম্বরে প্রতিপক্ষের সেরা পেস বোলারদের সামলানোর সামর্থ্য আমাদের অন্য ব্যাটসম্যানদের তুলনায় ওর বেশি। আমি তাই সামর্থ্যের কথা চিন্তা করে সাব্বিরের কথা বলেছি। যদি তা ভালো না লাগে, তাহলে নেবেন না। ও না থাকার পরও আমরা এশিয়া কাপ ফাইনাল খেলেছি, জিম্বাবুয়ে-ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজ জিতেছি। সাব্বিরকে ছাড়া চলেছে না? চলেছে তো। আর এর আগেও তো অনেককে নেওয়ার মত দিয়েছি, কিন্তু নির্বাচকরা নেননি।’
৪.
নির্বাচক, অধিনায়ক এমনকি বোর্ড – কেউ সাব্বিরকে নেননি। তাহলে সাব্বির কী করে জায়গা পেলেন? আবারও ফিরে আসে নয়াদিল্লীর মতো ঘটনা। ‘নো ওয়ান কিলড জেসিকা’, কিংবা এক্ষেত্রে ‘নো ওয়ান ইনক্লুডেড সাব্বির’!
তবে এত যে বিতর্ক, তার জবাবটা সাব্বিরকে দিতে হবে মাঠে; নিজের পারফরম্যান্স দিয়ে। সাব্বিরও সে পথেই হাঁটছেন।
তার ভাষায়,
‘মাঝখানে আমার শৃঙ্খলা নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। এজন্য আমি শাস্তি পেয়েছি। আমার ভুল নিজেই উপলব্ধি করতে পেরেছি। গত এক বছরে আমি বুঝেছি, কিছু কিছু কাজ করা আমার উচিত হয়নি। অনেকের কাছে আমি একজন আইকন। অনেক শিশু-কিশোর আমাকে অনুসরণ করে। তো সব মিলিয়ে আমি বুঝতে পেরেছি, সেসব কাজ করা আমার মোটেও উচিত হয়নি। যে কাজগুলো করেছি, সেগুলো আর কখনও আমি করব না, তার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি আবারও। এমনকি কাউকে আমাকে নিয়ে কথা বলারও কোনো সুযোগ করে দেব না, তার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।’
সাব্বির কতটা ‘ঠিক’ হবেন, তা সময়ই বলে দেবে। কিন্তু তার আগে সব বিতর্ক ঝেড়ে ফেলে ব্যাটে রান তুলতে হবে; দলের জন্য, দেশের জন্য।