ডব্লু জি গ্রেস নাকি আম্পায়ারের আঙুল নামিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, “মাঠে কেউ তোমার আঙুল দেখতে আসেনি; আমার খেলা দেখতে এসেছে।“
এটা গল্প কথা হলেও আজকের টি-টোয়েন্টির যুগে কথাটা প্রায় সত্যি হয়ে গেছে। আজকাল লোকে মাঠে আম্পায়ারের আঙুল তো বটেই, বোলিং-ফিল্ডিং দেখতেও যায় না। যায় কেবল চার-ছক্কার উৎসব দেখতে। টি-টোয়েন্টির এই যুগে রান উৎসবের জোয়ার এসেছে সব ফরম্যাটেই। আগে যেসব রান কল্পনা করা যেত না, এখন সেই সব বিশাল বিশাল স্কোর হচ্ছে ক্রিকেট মাঠে।
এই সেদিন ইংল্যান্ড ৪৮১ রান করে ফেললো ওয়ানডে ক্রিকেটে!
এর আগে ৫০ ওভারের আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটে কোনো দল কখনো ৪৫০ রান পার করতে পারেনি, সেখানে ইংল্যান্ড আরেকটু হলে ৫০০ রান করে ফেলতো। রান উৎসবের এই জোয়ারটা কিন্তু খুব বেশিদিনের ব্যাপার নয়। ওয়ানডে ইতিহাসের ৪৭ বছরে চারশ পার করা ইনিংস ক্রিকেট দেখেছে ১৯ বার। এর মধ্যে প্রথম এই ঘটনা ঘটে এসে ২০০৬ সালে। মানে, ইতিহাসের প্রথম ৩৫ বছরে এই ঘটনা ঘটেনি। এরপরের ১২ বছরে ১৯ বার ঘটেছে। তার চেয়েও বড় ব্যাপার হলো, গত ৩ বছরে এই ঘটনা ঘটেছে ৮ বার। তার মানে, টি-টোয়েন্টির প্রভাব এখানে পরিষ্কার।
আমরা বরং রান উৎসবের সেরা ম্যাচগুলো দেখে নিই এ সুযোগে।
৪৮১: ইংল্যান্ড (প্রতিপক্ষ-অস্ট্রেলিয়া; ১৯ জুন, ২০১৮)
নটিংহ্যামে সেদিন ইংলিশ ব্যাটসম্যানদের ওপর আক্ষরিক অর্থেই দানব ভর করেছিলো। বিনা উইকেটে ১৯.৩ ওভারে তারা ১৫৯ রান তুলে ফেলেছিলো। এক ওপেনার জেসন রয় ৬১ বলে ৭টি চার ও ৪টি ছয়ে সাজানো ৮২ রান করে আউট হয়ে যান। কিন্তু জনি বারিস্তো ও অ্যালেক্স হেলসকে আটকানোর মতো কেউ অস্ট্রেলিয়ান শিবিরে আছে বলে মনে হচ্ছিলো না। বারিস্তো ৯২ বলে খেলেন ১৩৯ রানের ইনিংস; ১৫টি চার ও ৫টি ছক্কা মারেন তিনি। হেলসও ৯২ বল খেলেন। তবে তার ইনিংস ছিলো ১৪৭ রানের। ১৬টি চার ও ৫টি ছক্কা মারেন তিনি। একটা সময় মনে হচ্ছিলো, বলগুলোর কাজই ইংলিশ ব্যাটসম্যানদের কাছে এসে পিটুনি খেয়ে মাঠের বাইরে চলে যাওয়া। শেষের দিকে এসে অধিনায়ক এউইন মরগ্যান করেন ৩০ বলে ৬৭ রান; তার ইনিংসে ৩টি চার ও ৬টি ছক্কা।
ইংল্যান্ড অনায়াসে ৫০০ রান পার করে ফেলবে বলেই মনে হচ্ছিলো। ৪৬ ওভারে ইংল্যান্ডের রান ছিলো ৪৫০। বাকী ৪ ওভারে ৫০ রান তখন খুব কষ্ট কল্পনা নয়। কিন্তু শেষ ৪ ওভারে আর কোনো বাউন্ডারি না আসায় ইংলিশরা বিশ্বের প্রথম ৫০০ রানের স্কোর করা থেকে এবারের মতো বঞ্চিত থাকলো।
জবাবে অস্ট্রেলিয়া ২৩৯ রানে অলআউট হয়।
৪৪৪: ইংল্যান্ড (প্রতিপক্ষ-পাকিস্তান; ৩০ আগস্ট, ২০১৬)
ওয়ানডে ক্রিকেটে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডটা এর আগেও ইংল্যান্ডের দখলে ছিলো। সেটাও ছিলো এই নটিংহ্যামে। দুই বছর আগে সেই কীর্তিরও প্রধান নায়ক ছিলেন অ্যালেক্স হেলস। সেদিন অবশ্য শুরুটা এমন কোনো ইঙ্গিত দেয়নি। ৫.২ ওভারে দলীয় মাত্র ৩৩ রানে প্রথম উইকেট হারিয়েছিলো ইংল্যান্ড। আর এখান থেকেই শুরু হয়েছিলো ধ্বংসযজ্ঞ।
হেলস এখান থেকে ১৭১ রানের দানবীয় এক ইনিংস খেলেন। ১২২ বলে ২২টি চার ও ৪টি ছক্কায় সাজানো এই ইনিংস খেলে যখন তিনি আউট হন, তখন দলের রান ২৮১ হয়ে গেছে। তবে হেলসেই শেষ নয়। শেষটা আসলে করেছিলেন তিনজনে- জো রুট, জস বাটলার ও মরগ্যান।
রুট এসে তুলনামূলক ধীরগতির একটি ইনিংস খেলেন। তিনি ৮৬ বলে করেন ৮৫ রান। আর শেষ দুজন নাভিশ্বাস তুলে ফেলেন পাকিস্তানের বোলারদের। বাটলার ৫১ বলে ৭টি করে চার ও ছক্কায় ৯০ রান করে অপরাজিত থাকেন। আরও ভয়ঙ্কর ছিলেন মরগ্যান। তিনি ২৭ বলে ৩টি চার ও ৫টি ছক্কায় ৫৭ রান করে অপরাজিত থাকেন।
ইংল্যান্ডের ৩ উইকেটে ৪৪৪ রানের এই স্কোরের জবাবে পাকিস্তান করতে পেরেছিলো ২৭৫ রান।
৪৪৩-৯: শ্রীলঙ্কা (প্রতিপক্ষ-নেদারল্যান্ড; ৪ জুলাই, ২০০৬)
খেলাটার নেদারল্যান্ডের বিপক্ষে হলেও শ্রীলঙ্কার এই ইনিংসটার আলাদা একটা মাহাত্ম আছে। এই ইনিংসটা তারা খেলেছিলো টি-টোয়েন্টির রমরমা অবস্থা শুরুর আগেই। ২০০৬ সালে। এই বছরই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট প্রথম চারশ রানের ইনিংস দেখেছিলো দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ার কাছ থেকে।
শ্রীলঙ্কার এই ইনিংসের ভিত্তি ছিলেন নব্বই দশকের মারকাটারি ব্যাটসম্যান সনাৎ জয়াসুরিয়া। তিনি তখন ক্যারিয়ারের শেষ প্রান্তে। তারপরও বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, অভ্যেসটা নষ্ট হয়নি। জয়াসুরিয়া ও উপল থারাঙ্গা ইনিংস শুরু করতে এসেছিলেন। দলীয় ২৮ রানে থারাঙ্গা ফেরত আসেন। কিন্তু জয়াসুরিয়ার ঝড় থেকে নেদারল্যান্ড বাঁচতে পারেনি। তিনি ১০৪ বলে ১৫৭ রানের এক ইনিংস খেলেন। মজার ব্যাপার হলো, এই ইনিংসে তার ছক্কা ছিলো মাত্র ১টি। বিপরীতে ২৪টি চার মেরেছিলেন তিনি। মাঝে সাঙ্গাকারা এসে ৪৩ বলে ৪৬ রানের এক ইনিংস খেলেন। আর মূল রানটাকে এত বড় পাহাড়ের উপরে তুলে দেন তিলকরত্নে দিলশান। তিনি ৭৮ বলে ১৫টি চার ও ২টি ছক্কায় ১১৭ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেন।
একটি ব্যাপার খুব বিস্ময়ের ছিলো, একসময়ের রেকর্ড এই ৪৪৩ রানের ইনিংসে ছক্কা ছিলো মাত্র ৩টি।
এই বিশাল স্কোরের জবাবে ২৪৮ রানে অলআউট হয়েছিলো নেদারল্যান্ড।
৪৩৯: দক্ষিণ আফ্রিকা (প্রতিপক্ষ-ওয়েস্ট ইন্ডিজ; ১৮ জানুয়ারি, ২০১৫)
দক্ষিণ আফ্রিকা আফসোস করতে পারে, এটা কেন আরও বেশি কিছু ওভারের ম্যাচ হলো না। তাদের মাত্র তিনজন ব্যাটসম্যান ব্যাট করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনজনই তিনটি দানবীয় সেঞ্চুরি করেছিলেন এই ম্যাচে।
শুরুটা করেছিলেন হাশিম আমলা ও রিলি রুশো। দুজনে ২৪৭ রানের জুটি করেছিলেন। আমলা এক প্রান্তে ১৪২ বলে ১৫৩ রান করে অপরাজিত থাকেন। তার ইনিংসে ছিলো ১৪টি চার। অন্যপ্রান্তে রুশো ১১৫ বলে ১১টি চার ও ২টি ছক্কায় ১২৮ রান করে ফেরেন। তবে আসল ভেল্কিটা তো বাকি ছিলো। তখনই মাঠে নামেন মিস্টার ৩৬০ ডিগ্রি এবি ডি ভিলিয়ার্স। মাত্র ৪৪ বলে ৯টি চার ও গুনে গুনে ১৬টি ছক্কায় ১৪৯ রানের এক ইনিংস খেলেন।
হ্যাঁ, ডেভিড মিলার নেমেছিলেন বটে; ভাগ্যিস ব্যাট করার সুযোগ পাননি!
৪৩৮: দক্ষিণ আফ্রিকা (প্রতিপক্ষ-অস্ট্রেলিয়া; ১২ মার্চ, ২০০৬)
জোহানেসবার্গের এই ম্যাচটিকে বলা চলে ওয়ানডে ক্রিকেটের বাঁক বদল করা ম্যাচ। এই ম্যাচে একটার পর একটা ইতিহাস তৈরি হয়েছে, রেকর্ড তৈরি হয়েছে এবং ভেঙেছে।
এই ম্যাচে মোট রান হয়েছিলো ৮৭২! দুই দলই প্রায় ৯ করে ওভারপ্রতি রান তুলেছিলো।
প্রথম কাজটা করেছিলো অস্ট্রেলিয়া। গিলক্রিস্টের ৪৪ বলে ৫৫ ও সায়মন ক্যাটিচের ৯০ বলে ৭৯ রানে শুরু করেছিলো তারা। এরপর রিকি পন্টিং এসে ১০৫ বলে ১৬৪ রানের ইনিংস খেলেন। আর মাইক হাসি ৫১ বলে করেন ৮১ রান। ফলে অস্ট্রেলিয়া করে ৪৩৪ রান।
সেটা ছিলো কয়েক মুহুর্তের জন্য বিশ্বরেকর্ড করা ইনিংস। প্রথমবারের মতো কোনো দল চারশ পার করলো। এই ইনিংস দেখে বেশিরভাগ দর্শক মাঠ ছেড়ে বের হয়ে গিয়েছিলেন। তারা ফল ‘অনুমান’ করে ফেলেছিলেন। কিন্তু তারা কল্পনাও করতে পারেননি, এই ম্যাচ কি বিস্ময় জমিয়ে রেখেছে।
বিস্ময়ের শুরুটা হয়েছিলো যাচ্ছেতাই। দলীয় ৩ রানেই দক্ষিণ আফ্রিকা প্রথম উইকেট হারিয়েছিলো। আর এখান থেকেই গ্রায়েম স্মিথ ৫৫ বলে ৯০ ও হার্শেল গিবস ১১১ বলে ১৭৫ রানের ইনিংস খেলে দলকে পথে তুলে দেন। আফ্রিকান ব্যাটসম্যানরা এরপর এসেছেন, মেরেছেন এবং আউট হয়েছেন। আউট হওয়াতে অস্ট্রেলিয়ার খুব একটা লাভ হয়নি। শেষ অবধি এক বল হাতে রেখে এই পর্বত টপকে গেছে দক্ষিণ আফ্রিকা।
এই ম্যাচেই তৈরি হলো এখন অবধি ওয়ানডে ইতিহাসের সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জয়ের রেকর্ড।
এখানে উল্লেখ করে রাখা দরকার, ২০১৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা ভারতের বিপক্ষেও একবার ৪৩৮ রানের ইনিংস খেলেছিলো।