লেখাটা শুরু করার আগে একটা গল্প বলা যাক।
মারাকানা নামের ফুটবল তীর্থে হোম আর অ্যাওয়ে দুই দলের জন্য দু’টো ড্রেসিংরুম আছে। দুই ড্রেসিংরুমের নামই দুজন বিখ্যাত ফুটবলারের নামে। অ্যাওয়ে টিমের ড্রেসিংরুমের নাম, ‘পেলে’। তাহলে হোম টিমের ড্রেসিংরুমের নাম কী?
‘গ্যারিঞ্চা’।
গল্পটা কেন বলা হলো, তা পাঠক একটু পরই বুঝতে পারবেন। আপাতত অন্য একটা বিষয়ে কথা বলা যাক।
১.
সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান কে? এ প্রশ্ন শুনে অনেকেই ভ্রূ কুঁচকাবেন। আরে, এটা আবার একটা প্রশ্ন হলো নাকি? এ তো সবাই-ই জানে। সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান স্যার ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যান। পরিসংখ্যানও তার পক্ষে কথা বলছে। ৯৯.৯৪ গড় নিয়ে আছেন সবার উপরে, সবচেয়ে কাছাকাছি আছেন ব্র্যাডম্যানেরই স্বদেশী অ্যাডাম ভোজেস, তার গড় ৬১.৮৭। ব্র্যাডম্যানের সাথে তার গড়ের পার্থক্য ‘মাত্র’ ৩৮ রানের মতো।
কিন্তু তারপরেও খোদ অস্ট্রেলিয়াতেই এমন অনেকে আছেন এবং ছিলেন, যারা ব্র্যাডম্যানকে সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান মানেন না। তাদের কাছে সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যানের নাম – ভিক্টর ট্রাম্পার। কে এই ভিক্টর ট্রাম্পার?
পুরো নাম ভিক্টর টমাস ট্রাম্পার। জন্ম ১৮৭৭ সালের ২রা নভেম্বর। অস্ট্রেলিয়া জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন ৪৮ টেস্ট; ৮ সেঞ্চুরি আর ১৩ হাফ সেঞ্চুরিতে করেছেন ৩১৬৩ রান। গড় ৩৯.০৪।
এ পর্যন্ত পড়ে হয়তো আরেক দফা ভ্রূ কোঁচকাবেন কেউ কেউ। প্রায় ১০০ গড়ের একজন ব্যাটসম্যানের সাথে ৩৯ গড়ের একজন ব্যাটসম্যানের তুলনা? মাথা ঠিক আছে?
সমস্যা হচ্ছে, পরিসংখ্যান অনেক কিছুই বলে, আবার অনেক কিছুই বলে না। এজন্যই বলা হয়ে থাকে, মিথ্যা ৩ রকম। মিথ্যা, ডাহা মিথ্যা আর পরিসংখ্যান।
পরিসংখ্যান বলছে, ব্র্যাডম্যান সেরা। যারা ব্র্যাডম্যানের খেলা দেখেছেন, তারাও বলেন, ব্র্যাডম্যানই সেরা। কিন্তু ব্র্যাডম্যান ও ট্রাম্পার দুজনের খেলাই দেখেছেন, এরকম প্রায় সবাই বলেন, ট্রাম্পারই সর্বকালের সেরা।
সিডনি মিউজিশিয়ান ক্লাবের প্রেসিডেন্ট ছিলেন লক ওয়ামসলেই। ১৯৪৭ সালের জানুয়ারি মাসে মারা যান তিনি। ক্রিকেটের প্রতি গভীর অনুরক্তি ছিল তাঁর। মারা যাওয়ার আগে শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী গ্রামোফোনের ডিস্কে তার কথা রেকর্ড করা হয়। তার কথাগুলো ছিল,
‘ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য আমি আমার কথা রেকর্ড করে রেখে যাচ্ছি। আমি তাদেরকে বলতে চাই, ভিক্টর ট্রাম্পার ছিলেন সবার থেকে সেরা ব্যাটসম্যান।’
সি. বি. ফ্রাই দম্পতির কথা ধরা যাক। এই দম্পতি খুব ভক্ত ছিলেন ট্রাম্পারের, তাঁর একটা ছবিও ঝোলানো ছিল তাদের ঘরে। সি. বি. ফ্রাই ইংল্যান্ডের হয়ে খেলেছেন ২৬ টেস্ট, নেতৃত্ব দিয়েছেন ৬ টেস্টে। জন্ম ১৮৭২ সালে, মৃত্যু ১৯৫৬ সালে। ট্রাম্পার এবং ব্র্যাডম্যান দুজনের ব্যাটিংই তিনি দেখেছেন। বিশেষ করে ১৯৩০ সালের অ্যাশেজে ব্র্যাডম্যানের অতিমানবীয় ৯৭৪ রানের সাক্ষী তিনি।
তারপরও তিনি বলেছেন,
‘ব্র্যাডম্যান যত রানই করুন না কেন, মহাকালের বিচারে আগে আসবে ট্রাম্পারের নাম। এমনকি চিরশত্রু ইংল্যান্ডের মানুষের মনেও একটা বিশেষ জায়গা দখল করে আছেন এই ব্যাটসম্যান।’
আর তার স্ত্রী বলেছেন,
‘ট্রাম্পার আসলে প্যাগানিনির মতো একজন বেহালাবাদক, যার হাতে ব্যাট হয়ে ওঠে এক সুরেলা ভায়োলিন।’
যে টেস্টে ট্রাম্পারের অভিষেক হয়, সেই একই টেস্টে ইংল্যান্ডের হয়ে অভিষেক হয় ইংলিশ কিংবদন্তী উইলফ্রেড রোডসেরও। ১১ নাম্বারে ব্যাট করতে নেমেছিলেন, পরে ব্যাটিং অর্ডারে প্রমোশন পেতে পেতে ওপেনিংয়ে স্যার জ্যাক হবসের পার্টনার হয়ে যান। একবার রোডসকে জিজ্ঞেস করা হয়, তার দেখা সেরা ব্যাটসম্যান কে? তার উত্তর ছিল,
‘দেয়ার ওয়াজ অনলি ওয়ান। ভিক্টর ট্রাম্পার।’
২.
ট্রাম্পারের অভিষেক টেস্ট ছিল বিখ্যাত ইংলিশ বুড়ো ডব্লিউ. জি. গ্রেসের শেষ টেস্ট। সহজে কারো প্রশংসা করতে চাইতেন না এই বুড়ো, প্রশংসার ব্যাপারে কৃপণ ছিলেন রীতিমতো। কিন্তু ট্রাম্পার তাকে এমনই মুগ্ধ করলেন যে…
সময়টা ১৮৯৯ সাল। বিমান আবিষ্কার করে ফেলেছেন রাইট ব্রাদার্স, বুনো পশ্চিমের কাউবয়দের দিন শেষ হয়ে এলো বলে। দুনিয়ার আরেক প্রান্তে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামের এক চরম প্রতিভাবান কবির কলম থেকে বের হয়ে আসছে গান, কবিতা, গল্প; একের পর এক। ফেলিক্স হফম্যান নামের এক জার্মান কেমিস্ট আবিষ্কার করে ফেলেছেন অ্যাসপিরিনের ফর্মুলা, আর কিছুদিনের মধ্যেই অন্ধকারাচ্ছন্ন মহাদেশ আফ্রিকায় শুরু হতে যাচ্ছে দ্বিতীয় বোয়ের যুদ্ধ।
অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড সিরিজ ততদিনে পরিচিতি পেয়ে গেছে অ্যাশেজ নামে। প্রথম টেস্টে দুঃস্বপ্নের মতো অভিষেক হলো ট্রাম্পারের, দুই ইনিংসে করলেন যথাক্রমে ০ আর ১১। তবে দ্বিতীয় টেস্টে পুষিয়ে দিলেন সুদে-আসলে। সেই টেস্টের প্রথম ইনিংসে ইংল্যান্ড করল ২০৬ রান। জবাবটা দারুণভাবে দিতে লাগল অস্ট্রেলিয়া, শুরুটা করলেন ক্লেম হিল। ১৩৫ রান করে যখন সাজঘরে ফিরছেন, তখন স্কোর ২৭১/৫।
ট্রাম্পার নেমেছিলেন মন্টি নোবেল আউট হওয়ার পর, স্কোর তখন চার উইকেটে ১৮৯। ক্লেম হিল আউট হওয়ার পরও যে অস্ট্রেলিয়া ৪২১ পর্যন্ত যেতে পারলো, তার কৃতিত্ব প্রায় পুরোটাই ট্রাম্পারকে দিয়ে দেয়া যায়। দলের বাকি ৫ জন মিলে করলো ৫০, ট্রাম্পার একাই করলেন ১০০। লর্ডসের মাঠে খেললেন নিজের ইচ্ছেমতো, ড্রেসিংরুমে যখন ফিরছেন তখন তার নামের পাশে অপরাজিত ১৩৫। সি. বি. ফ্রাই পরে বলেছিলেন,
‘He had no style, yet he had all the styles. The minimum of effort, the maximum of effect.’
এই ইনিংস খেলার পরে কোন কথাবার্তা ছাড়াই অস্ট্রেলিয়ান ড্রেসিংরুমে হাজির হলেন আগের টেস্টে অবসর নেয়া ডব্লিউ. জি. গ্রেস। একটা আবদার নিয়ে এসেছেন তিনি। ট্রাম্পার যে ব্যাট দিয়ে খেলেছেন, সেই ব্যাটটা যেন তাকে উপহার হিসেবে দেয়া হয় এবং ট্রাম্পার যেন তাতে সই করে দেন। প্রথমে রাজি হলেন না ট্রাম্পার, কিন্তু গ্রেসও নাছোড়বান্দা। অনেক গাঁইগুঁই করার পর ট্রাম্পার রাজি হলেন বটে, তবে একটা শর্তে। তিনিও গ্রেসের একটা ব্যাট চান।
ট্রাম্পার ব্যাট দিলেন গ্রেসকে, গ্রেস দিলেন ট্রাম্পারকে। ট্রাম্পারের হাতে যখন ব্যাট তুলে দিচ্ছেন, তখনই তার সেই অমর উক্তি ছাড়লেন গ্রেস,
‘ফ্রম টুডে’স চ্যাম্পিয়ন টু দ্য চ্যাম্পিয়ন অফ টুমরো।’
৩.
ট্রাম্পার তার সেরা সময়টা কাটিয়েছিলেন ১৯০২ সালে। ঘরোয়া ক্রিকেটে রানের বন্যা বইয়ে দেয়ার পর সুযোগ মিললো আবার ইংল্যান্ডগামী অ্যাশেজ দলে। ৫ টেস্ট মিলিয়ে করলেন মাত্র ২৪৭ রান, কিন্তু এমনভাবে করলেন যে তার সমসাময়িক প্রায় সবাই মেনে নিলেন ট্রাম্পারই সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান।
তখনকার দিনে উইকেট ঢাকার বালাই ছিল না, বৃষ্টি হলে খোলা পড়ে থাকত পিচ। একপশলা বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার পরে যখন রোদ উঠত, সেই পিচ হয়ে উঠতো ব্যাটসম্যানদের বধ্যভূমি।
সেই বধ্যভূমি দেখেও টসে জিতে ব্যাটিং নিলেন অস্ট্রেলিয়ান ক্যাপ্টেন জো ডার্লিং। ১৯০২ সালের অ্যাশেজের চতুর্থ টেস্ট। স্ট্যানলি জ্যাকসন, বিল লকউড আর ফ্রেড টেটকে লেলিয়ে দিতে পারবেন ভেবে নেচে উঠল ইংলিশ ক্যাপ্টেন আর্চি ম্যাকলারেনের মন। বাকিটা যা হলো, তা ইতিহাস।
ওপেনিংয়ে নামলেন ট্রাম্পার আর রেজিনাল্ড ডাফ। ওল্ড ট্রাফোর্ডের সেই স্টিকি উইকেটে ট্রাম্পার ১১৫ মিনিটে করলেন ১০৪ রান। বর্তমান সময়ের টি-টোয়েন্টির কথা চিন্তা করলে ট্রাম্পার কতটা বিধ্বংসী ছিলেন, সে সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়।
লাঞ্চের আগেই সেঞ্চুরি করার প্রথম রেকর্ড এলো ট্রাম্পারের হাত ধরে। সেই টেস্টে অস্ট্রেলিয়া জিতেছিল মাত্র ৩ রানে।
৪.
১৯১৫ সালের ২৮শে জুন মারা যান ভিক্টর ট্রাম্পার। শরীরটা এমনিতেই শেষ কয়েক বছর ভালো যাচ্ছিলো না, তার উপর কিডনীর সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি। মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিলো মাত্র ৩৭ বছর।
ট্রাম্পারের মৃত্যুর খবর সবাইকে বিমূঢ় করে দেয়। অস্ট্রেলিয়া তো বটেই, ইংল্যান্ড পর্যন্ত স্তব্ধ হয়ে যায় এ খবর শুনে। তার লাশবাহী গাড়ির পাশে কাঁদতেও দেখা গেছে অনেককে।
আজ থেকে ১৪১ বছর আগে আজকের দিনে জন্মেছিলেন এই ব্যাটসম্যান।
শুভ জন্মদিন, ভিক্টর ট্রাম্পার।
৫.
লেখাটা শেষ করার আগে শুরুর গল্পে ফিরে যাওয়া যাক।
ব্রাজিলের হয়ে ৩ বার বিশ্বকাপ জিতেছেন পেলে, সর্বকালের সেরা ফুটবলার তকমাটাও এঁটে গেছে গায়ের সাথে। কিন্তু তারপরও মারাকানায় হোম টিমের ড্রেসিংরুমের নামকরণ তার নামে করা হয়নি, সে গৌরবের অধিকারী হয়েছেন গ্যারিঞ্চা।
তিন বিশ্বকাপজয়ী পেলেকে ব্রাজিলিয়ানরা মাথায় করে রেখেছে নিশ্চয়, কিন্তু গ্যারিঞ্চা আছেন তাদের হৃদয়ে। ঠিক তেমনিভাবেই ব্র্যাডম্যানকে অস্ট্রেলিয়ানরা মাথায় করে রাখলেও ট্রাম্পার তাদের হৃদয়েই রয়ে গেছেন।