হলিউডের অ্যাকশন মুভিপ্রেমী মাত্রই স্ট্যান লির সাথে পরিচিত। কেননা মার্ভেলের প্রায় প্রতিটি মুভিতেই তাকে ক্ষণিকের জন্য এক ঝলক দেখা যায়। আবার কমিক বইপ্রেমীদের কাছে তিনি বহুল পরিচিত স্পাইডারম্যান, হাল্ক, ফ্যান্টাস্টিক ফোরের মতো বহু চরিত্রের জনক হিসেবে। মার্ভেল কমিকের বিপুল জনপ্রিয়তার পেছনে তিনিই মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছেন। আজকের দিনের সুপারহিরো এবং সায়েন্স ফিকশন পাগল যে পপ কালচার, তার হোতা তিনি। এটা বললেও খুব বেশি অত্যুক্তি হবে না যে, কমিক বুক কিংবদন্তী স্ট্যান লি হলিউডের ভিত্তি বদলে দিয়েছেন।
স্ট্যানলি লিবার ওরফে স্ট্যান লি গল্প বলার এক বিশেষ পন্থার সূচনা করেছিলেন। তার গল্পগুলোর গাঁথুনী গড়ে উঠতো মানুষের আবেগকে কেন্দ্র করে। দুর্দান্ত অ্যাকশন, কিংবা প্লট টুইস্টকে ছাপিয়ে মানুষের মন ছুঁয়ে যেতো সেই মেলোড্রামাগুলোই। সেই ড্রামার সাথে ভারসাম্য দিয়ে থাকতো মজার মজার পাঞ্চলাইন। যারা নতুন নতুন মার্ভেলের কাহিনীর সাথে পরিচিত, তারাও হয়তো খেয়াল করবেন, কীভাবে সিরিয়াস কোনো দৃশ্যের পরই মেজাজ হালকা করে দেবার মতো ঘটনা ঘটতে থাকতে। পাঠকরা তাই মনের ওপর চাপ না নিয়েই বেশ স্বচ্ছন্দে উপভোগ করতে পারতেন কমিকগুলোকে।
তারপরও হয়তো আমরা এখনকার সায়েন্স ফিকশন কিংবা সুপারহিরো কেন্দ্রিক পপ কালচারের ওপর স্ট্যান লির প্রভাব পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারি না। লি এবং তার মার্ভেল কমিকসের দলবল মিলে শিশুতোষ কাহিনীর ছাঁদে ফেলে সৃষ্টি করেছেন এমন সব গল্প, যার গুরুত্ব প্রাপ্তবয়স্ক হবার আগে বুঝে ওঠা দায়। নির্দিষ্ট কোনো জনরায় কাহিনীকে সীমাবদ্ধ না রাখার বুদ্ধিটাও প্রথমে তার কাছ থেকেই এসেছিল, যা ষাটের দশক থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত বিনোদন ব্যবসাকে প্রভাবিত করে আসছে।
কেবলমাত্র মার্ভেল কিংবা ডিসির সুপারহিরো মুভিগুলোতে অবদান রেখেই স্ট্যান লির কাজ শেষ হয়নি। তার প্রভাব অনুভব করা যায় স্টার ওয়ারস, স্টার ট্রেক, ইন্ডিয়ানা জোন্সের মতো আরো ডজনখানেক ব্লকবাস্টার ফ্র্যাঞ্চাইজে। কেবল এই ২০১৮ সালের বক্স অফিসের দিকে তাকালেই জমজমাট অ্যাকশনধর্মী মুভিগুলোর রাজত্ব টের পাওয়া যায়। এর পাশাপাশি নেটফ্লিক্স এবং টিভি মিডিয়াও বছরের পর বছর দর্শককে বিনোদন দিয়ে আসছে স্ট্যান লির এই সাফল্যের সমীকরণকে পুঁজি করেই। সেই ষাটের দশকেই লি তার কমিক কোম্পানির নাম দিয়েছিলেন ‘মার্ভেল পপ আর্ট প্রোডাকশন’, যদিও তার স্বপ্ন পুরোপুরি বাস্তবায়ন হতে আরো প্রায় তিন দশক লেগে গেছে।
কমিক বইয়ের লেখক এবং সম্পাদক থাকা অবস্থাতেই ষাটের দশকের মাঝামাঝি দ্য মার্ভেল সুপারহিরো অ্যানিমেটেড সিরিজে কাজ করা শুরু করেন তিনি। কমিক বইয়ের গল্পগুলোই নতুনভাবে সাজাতে থাকেন তিনি। সিরিজটা ছিল ক্যাপ্টেন আমেরিকা, দ্য ইনক্রেডিবল হাল্ক, আয়রন ম্যান, থর এবং ন্যামরকে কেন্দ্র করে। বিভিন্ন কমিক বইয়ের নতুন ইস্যুগুলোর পৃষ্ঠা ফটোকপি করে তার সাথে সামান্য লিপ-সিংক ব্যবহার করে সিরিজটির অ্যানিমেশন করা হতো।
এমনকি সেখানে ‘অ্যাভেঞ্জার’ সিরিজের প্রথম দিককার বইগুলোর থেকেও কাহিনী নেওয়া হতো। টেকনিক্যাল দিক দিয়ে কমতি থাকলেও এই সিরিজটি দেশ জুড়ে ব্যাপকভাবে সাড়া পায় এবং অনেকেই আজীবন মার্ভেলের ভক্ত হয়ে যান। থর, ক্যাপ্টেন আমেরিকা এবং আয়রন ম্যানের থিম সংগুলো সবার মুখে মুখে ফিরতে থাকে। পরবর্তীতে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে লি বলেন, এই গানগুলো তার লেখা না। কিন্তু চমৎকার সুরগুলোর পেছনে অবদান রাখতে পারলে তিনি খুশিই হতেন।
১৯৬৭ সালে প্রচারিত ফ্যান্টাস্টিক ফোর টিভি সিরিজের সাথে সরাসরি জড়িত না থাকলেও এর ওপর তার প্রভাব ছিল অনেক। হ্যানা-বারবারা প্রযোজিত এই সিরিজে গ্যালাক্টাস, ডক্টর ডুম, মোল-ম্যানের মতো ভিলেনগুলোকে ঘিরে পর্ব নির্মিত হয়। স্ক্রাল এবং সিলভার সার্ফার চরিত্রগুলোরও দেখা পাওয়া যায়। কমিক কিংবদন্তী অ্যালেক্স টথই মূলত কাহিনীগুলো সাজিয়েছিলেন। এর কিছু পরই দ্য মার্ভেল সুপার হিরোজ সিরিজের মাধ্যমে এক্স ম্যানেরা প্রথম ছোট পর্দায় আসে। ফ্যান্টাস্টিক ফোর সিরিজের ষষ্ঠ ইস্যু থেকে কাহিনী অনুসরণ করলেও সেখানে ফ্যান্টাস্টিক ফোরের কোনো সদস্যকে দেখা যায়নি। কারণ চরিত্রগুলোর স্বত্ব ছিল হ্যানা-বারবারা কোম্পানির কাছে।
সত্তরের দশক থেকেই লেখালেখি থেকে অনেকখানি দূরে সরে এসে মনোযোগ দিয়েছিলেন মুভি এবং টিভি সিরিজ বানানোর কাজে। নিজের প্রতিপত্তি খাটিয়ে খুব দ্রুত উন্নতি করছিলেন তিনি, তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে পড়েন তার লেখার সঙ্গী জ্যাক কিরবি। তিনি অভিযোগ করেন, মার্ভেল তাকে যোগ্য সম্মান দিতে পারছে না। কিছুদিন পরই কিরবি প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানি ডিসিতে যোগ দেন আর তার উকিলেরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন আইনী লড়াইয়ে।
এখনো পর্যন্ত মার্ভেলের মূল অংশীদার হিসেবে লি এবং কারবির ভূমিকা গবেষণার বিষয় হয়ে আছে। লি পরবর্তীতে লেখায় ফিরলেও কিরবি এবং ডিটকোর সাথে জুটি বেঁধে যেরকম সাফল্যের মুখ দেখেছিল, সেরকমটা আর হয়নি কখনো।
১৯৭২ সালে তিনি প্রকাশক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার পর নতুন প্রজন্মের অনেক লেখক যোগ দেন এই কোম্পানিতে। এরপর দ্য ইনক্রেডিবল হাল্ক দিয়ে প্রথম লাইভ অ্যাকশন টিভি সিরিজ পায় মার্ভেলের কোনো চরিত্র। ১৯৭৭ সালের এই সিরিজে ডক্টর ব্রুস ব্যানার ওরফে হাল্কের ভূমিকায় অভিনয় করেন বিলি বিক্সবি। সিরিজটি এবিসি চ্যানেলের হিট সিরিজ ‘দ্য ফিউজিটিভ’ এর ফরম্যাটকে অনুসরণ করে চলতো। প্রতি পর্বে ব্রুস নিত্যনতুন শহরে গিয়ে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করে আসতেন। কিন্তু হাল্ক নামক দানবটির কথা ছড়িয়ে পড়ায় এক তদন্ত কর্মকর্তা তার পিছু নেন। ফলে ব্রুস আত্মগোপন করতে বাধ্য হন। সিরিজটি পাঁচ সিজন ধরে চলেছিল।
কাছাকাছি সময়ে সিবিএস চ্যানেলের কাছে দ্য অ্যামেজিং স্পাইডারম্যানের স্বত্ত্ব বেচে দিয়েছিলেন তিনি। তবে এই সিরিজটি বেশি জনপ্রিয় হয়নি, মাত্র ১৩টি পর্ব প্রচারিত হয়েছিল। টেকনিক্যাল দিক থেকে সিরিজটির প্রশংসা করলেও চরিত্রায়ন এবং একঘেয়ে কাহিনীর কারণে এর তীব্র সমালোচনা করেছিলেন লি। পরে অবশ্য এই চ্যানেলটি ক্যাপ্টেন আমেরিকা টিভি মুভি এবং ডক্টর স্ট্রেঞ্জ সিরিজ দিয়ে জনপ্রিয় হবার চেষ্টা করেছিল।
কিন্তু ২০১৩ সালে শুরু হওয়া ‘এজেন্ট অফ শিল্ড’ এর আগে মার্ভেলের কোনো লাইভ অ্যাকশন সিরিজই সাফল্যের মুখ দেখেনি। তবে অ্যানিমেটেড সিরিজগুলো চলেছে পুরোদমেই। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল স্পাইডারম্যান (১৯৯৪-১৯৯৮), আল্টিমেট স্পাইডারম্যান (২০১২-২০১৭), অ্যাভেঞ্জারস অ্যাসেমবল (২০১৩-বর্তমান) ইত্যাদি।
একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে এসে স্ট্যান লির সৃষ্ট চরিত্রগুলো বক্স অফিসে ঝড় তুলতে শুরু করে। ২০০০ সালের এক্স মেন মুভি এবং এর পরের সিক্যুয়েলগুলোতে দেখা যায় লি এবং কারবির সৃষ্ট চরিত্র প্রফেসর এক্স, ম্যাগনেটো, সাইক্লপস, জ্যঁ গ্রে কে। ২০০২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত স্যাম রাইমির স্পাইডারম্যান মুভি সুপার হিরো চলচ্চিত্রের জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রে নতুন মোড় এনে দেয়। এর পাশাপাশি ডেয়ারডেভিল (২০০৩), ফ্যান্টাস্টিক ফোর (২০০৫), ফ্যান্টাস্টিক ফোর ২ (২০০৭), ব্লেড ট্রিলজি ইত্যাদি মুভিগুলোও আশানুরূপ ব্যবসা করে। তবে এগুলোর জনপ্রিয়তা মার্ভেলকে পুরোপুরি সন্তুষ্ট করতে পারেনি।
এক্স-ম্যান এবং স্পাইডারম্যান ফ্র্যাঞ্চাইজের চলচ্চিত্রগুলো ছিল টুয়েন্টিথ সেঞ্চুরি ফক্স এবং সনির অধীনে। এর কয়েক বছর পরের আয়রন ম্যান (২০০৮) দিয়ে মার্ভেল আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের সিনেম্যাটিক ইউনিভার্সের উদ্বোধন করে, যার সাফল্যের ইতিহাস অনেক চলচ্চিত্রপ্রেমীরই জানা। সুপারহিরো চলচ্চিত্রের ইতিহাসের শক্তিশালী সংযোজন এই ইউনিভার্সের এখন পর্যন্ত মুক্তি পাওয়া ১৯টি ছবি।
২০১৮ সালে হলিউডের চলচ্চিত্রগুলো রেকর্ড ৪১ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে, যার পেছনে কৃতিত্ব রেখেছে অ্যাভেঞ্জারস: ইনফিনিটি ওয়ার (২.১ বিলিয়ন) এবং ব্ল্যাক প্যান্থার (১.৩ বিলিয়ন)। এছাড়াও এখন এজেন্ট অফ শিল্ড, এজেন্ট কার্টার সহ বিভিন্ন সিরিজ প্রাইম টাইম টিভিতে সম্প্রচারিত হয়েছে। স্ট্যান লি এবং বিলি এভারেটের সৃষ্ট চরিত্র ডেয়ারডেভিল থেকে কেন্দ্র করে নির্মিত নেটফ্লিক্সের সিরিজটিও সুপারহিরো টিভি সিরিজের ইতিহাসে নতুন মাইলফলক।
স্ট্যান লির আরেকটি মজার কাজ ছিল মার্ভেলের বিভিন্ন মুভি এবং টিভি সিরিজে এক ঝলক করে নিজের চেহারা দেখানো। আলফ্রেড হিচককের কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯৮৯ সালের ইনক্রেডিবল হাল্ক টিভি মুভির মাধ্যমে তিনি এই কাজ শুরু করেন। তার পরিচিত চেহারা নিয়ে ভারি গলায় ডায়লগ দিতে দিতে উপস্থিত হয়েছেন বহু প্রজেক্টে। বাস ড্রাইভার, লাইব্রেরিয়ান, ডাকপিয়ন, কোটিপতিসহ হেন চরিত্র নেই, যাতে ক্যামিও দিতে দেখা যায়নি তাকে। এমনকি নিজের প্রজেক্ট না হলেও ডেডপুল কিংবা টিন টাইটান্স গো মুভিতে মজা করে ক্যামিও দিয়েছেন তিনি। ভবিষ্যতের চলচ্চিত্রগুলোতে টের পাওয়া যাবে তার অভাব।
সব মিলিয়ে শ’খানেকেরও বেশি কমিক চরিত্র সৃষ্টির পেছনে অবদান রেখেছিলেন তিনি। লেখক হিসেবে অবশ্য কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল তার। মাঝে মাঝেই কিছু আইডিয়ার পুনরাবৃত্তি হতে দেখা যেতো, নারী চরিত্রগুলোকেও প্রায়ই ভালোমতো বিকশিত না করে কেবল আকর্ষণ বাড়ানোর জন্য ব্যবহার করেছেন, এমন উদাহরণও অনেক। কিন্তু তার মাথা দিয়েই বেরিয়েছে ব্ল্যাক প্যান্থারের মতো কৃষ্ণাঙ্গ সুপারহিরো বানানোর ফর্মুলা। বেশিরভাগ সময়েই বর্বর কিংবা অভুক্ত হিসেবে উপস্থাপন করা হয় যে আফ্রিকানদের, তাদের হাত দিয়েই তিনি উদ্ভাবন করিয়েছেন অত্যাধুনিক টেকনোলজি। তার সাথে তাদের সংস্কৃতির মূল্যায়ন করতেও ভোলেননি।
মার্ভেলের সাফল্যের মূলে ছিল এর চরিত্রগুলোর মানবীয়তা, যদিও তাদের বেশিরভাগই ছিল অতিমানব। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ডিসি কমিক্সের মতো সদা ন্যায়পরায়ণ সুপারহিরো চরিত্র সৃষ্টির পথে হাঁটেনি মার্ভেল। তাদের মূল চরিত্রগুলো দোষে-গুণে ভরা মানুষ, পদে পদে ভুল করে আবার উঠে দাঁড়ানোই যাদের কাজ। আধুনিক মার্ভেল ইউনিভার্সের প্রথম কমিক বই ছিল ফ্যান্টাস্টিক ফোর, যার কাহিনী শুরুই হয়েছিল পারিবারিক খুনসুটি দিয়ে!
৫৭ বছর পরও তাদের স্বভাব কিন্তু বদলায়নি এতটুকু। হঠাৎ করেই অদ্ভুত সব ক্ষমতার অধিকারী হয়ে যাওয়া মিস্টার ইলাস্টিক কিংবা হিউম্যান টর্চের সাথে মিশে যেতে তাই পাঠকদের একেবারেই সময় লাগে না। আবার এক্স মেন দিয়ে বুঝিয়েছেন, সমাজচ্যুত কিংবা নিগৃহীত মানুষদের ভেতরেও থাকতে পারে অপরিসীম ক্ষমতা। জাতিবিদ্বেষ কিংবা বৈষম্যকেই রূপকার্থে ফুটিয়ে তুলেছেন তার মিউট্যান্ট হিরোগুলোর মাধ্যমে। একারণেই তার সৃষ্ট কাহিনীগুলো হয়ে উঠেছে কালজয়ী। স্ট্যান লিকে আমরা আর কখনোই ফিরে পাবো না, কিন্তু তার সৃষ্টিকর্মগুলো আমাদের সাথে থেকে যাবে আজীবন।
সিনেমা সম্পর্কে আরও জানতে আজই পড়ুন এই বইগুলো