চলচ্চিত্র নিয়ে সারা বিশ্বে যে কয়টি নামকরা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তাদের মধ্যে ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট অন্যতম। ১৯৩৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থার আর্কাইভ বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফিল্ম আর্কাইভ, যাদের সংগ্রহে আছে ৬০,০০০ এর অধিক সিনেমা। প্রতিবছর ‘লন্ডন চলচ্চিত্র উৎসব’ এর আয়োজন করা ছাড়াও তারা নিয়মিত জার্নাল প্রকাশ করে থাকে।
ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট ২০০২ সালে ‘A Guide to South Asian Cinema’ নামে একটি গবেষণা প্রকল্প হাতে নেয়, যার উদ্দেশ্য ছিল দক্ষিণ এশিয়ার চারটি দেশের (বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা) এবং দক্ষিণ এশিয়ার বংশোদ্ভূত পরিচালক বা এই অঞ্চলের কাহিনী নিয়ে নির্মিত সেরা ১০টি করে সর্বমোট ৫০টি সিনেমা বাছাই করা। প্রাথমিক তালিকা প্রস্তত করার সময় তারা ২০০১ সাল পর্যন্ত নির্মিত দক্ষিণ এশিয়ার ৪৫০টি চলচ্চিত্রকে বেছে নিয়েছিলো, যার মধ্যে বাংলাদেশের সিনেমা ছিলো ৪১টি।
তারা মূলত দুটি ক্যাটাগরিতে প্রতিটি দেশের সেরা ১০টি সিনেমার তালিকা প্রকাশ করেছিলো। একটি ক্যাটাগরিতে ছিলো চলচ্চিত্রবোদ্ধা ও সমালোচকদের দৃষ্টিতে সেরা ১০টি সিনেমা, অন্য ক্যাটাগরিতে ছিলো দর্শকদের ভোটে নির্বাচিত ১০টি সিনেমা। চলুন আজ জেনে নেওয়া যাক ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের চলচ্চিত্রবোদ্ধা-সমালোচকদের দৃষ্টিতে ২০০১ সাল পর্যন্ত মুক্তিপ্রাপ্ত বাংলাদেশের সেরা ১০ চলচ্চিত্রের নাম।
১০. সাত ভাই চম্পা (১৯৬৮)
বাংলাদেশে অসংখ্য লোককাহিনী-ভিত্তিক সিনেমা নির্মাণ হয়েছে, যার অধিকাংশই আবার ব্যবসাসফল। এসব ফোক-ফ্যান্টাসি সিনেমার পথিকৃৎ বলা যায় ১৯৬৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা ‘সাত ভাই চম্পা’কে। সিনেমাটি পরিচালনা করেছেন দীলিপ সোম আর চিত্রনাট্য ও সংলাপ রচনা করেছেন খান আতাউর রহমান (খান আতা)। সাত ভাই চম্পা মূলত দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার সংকলিত-রচিত বিখ্যাত রুপকথার গল্প, যা ১৯০৭ সালে ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ গল্পগ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিলো। আমরা প্রায় সবাই এই গল্পটির সাথে কম-বেশি পরিচিত আছি। সিনেমাটিতে সাত ভাইয়ের একমাত্র বোন পারুলের ভূমিকায় কবরী সারোয়ার আর সওদাগরের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন সেসময়ের জনপ্রিয় নায়ক আজিম। এরপর ১৯৭৮ সালে পশ্চিমবঙ্গে এবং ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশে চলচ্চিত্রটি পুনর্নির্মিত হয়েছে।
৯. শ্রাবণ মেঘের দিন (১৯৯৯)
বাংলাদেশের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের পরিচালনায় দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’। তারই লেখা ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত এই সিনেমাটি সাতটি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতেছিলো। গুরুত্বপূর্ণ কিছু চরিত্রে অভিনয় করেছেন জাহিদ হাসান, শাওন, মাহফুজ আহমেদ, আনোয়ারা ও গোলাম মোস্তফা। পরিচালক সিনেমাটিতে ভাটি অঞ্চলের কথা বলেছেন, ভাটির গায়ক জীবনের কথা তুলে ধরেছেন। সংসার জীবনে অভ্যস্ত না হয়ে গানের সাধনা এবং তার সাথে জড়িয়ে পড়া এক গানপাগল মেয়ের জীবনের নানা সংকটের কথা এই সিনেমায় তুলে ধরা হয়েছে। ‘সোয়াচান পাখি’, ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়’ এর মতো জনপ্রিয় গানের সৃষ্টি হয়েছিলো এই সিনেমা থেকেই, যাতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন বারী সিদ্দিকী।
৮. রূপালী সৈকতে (১৯৭৯)
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা, খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবির নির্মিত ‘রূপালী সৈকতে’র গল্প এগিয়েছে উত্তাল ষাটের দশক, বিশেষ করে সত্তর পূর্ববর্তী সময়কে কেন্দ্র করে। পাকিস্তানি আমলে বাঙালীদের উপর দমন-পীড়ন আর সেসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকে সিনেমায় তুলে ধরা হয়েছে। সিনেমাটিতে অভিনয় করেছেন বুলবুল আহমেদ, জয়শ্রী কবির, শর্মিলী আহমেদ, আনোয়ার হোসেন, অঞ্জনা রহমান, রোজী সামাদের মতো তারকারা। আইয়ুব খানের স্বৈরচারী শাসনামলে কারাবরণকারী অসংখ্য দেশপ্রেমিকের আত্মত্যাগকে সম্মান জানাতে পরিচালক তার এই সিনেমাটি তাঁদের প্রতি উৎসর্গ করেছিলেন।
৭. ধীরে বহে মেঘনা (১৯৭৩)
ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের করা এই তালিকায় আলমগীর কবির নির্মিত একাধিক সিনেমা স্থান পেয়েছে। ‘ধীরে বহে মেঘনা’ আলমগীর কবিরের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট নিয়ে নির্মিত এই সিনেমায় অভিনয় করেছেন বুলবুল আহমেদ, ববিতা, গোলাম মুস্তাফা, আনোয়ার হোসেন, খলিল উল্লাহ খান সহ আরো অনেকে। প্রাথমিকভাবে এই চলচ্চিত্রের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন জহির রায়হান। এই সিনেমায় গান গেয়েছিলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত দুই শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।
৬. সূর্য দীঘল বাড়ী (১৯৭৯)
বাংলাদেশের প্রথম সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’। কথাসাহিত্যিক আবু ইসহাকের উপন্যাস অবলম্বনে সিনেমাটি যৌথভাবে পরিচালনা করেছিলেন শেখ নিয়ামত আলী ও মসিহউদ্দিন শাকের। সিনেমার মূল বিষয়বস্তু ছিলো ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ এবং ১৯৪৭ এর দেশভাগ পরবর্তী সময়কালে বাংলার গ্রামীণ সমাজের কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামি, পুরুষতন্ত্রের নির্যাতন ও ধনীদের শোষণে পিষ্ট এক নারীর জীবন সংগ্রামের গল্প। এই সিনেমাতে প্রধান চরিত্রগুলোতে অভিনয় করেছেন ডলি আনোয়ার, রওশন জামিল এবং এ টি এম শামসুজ্জামান।
৫. বেদের মেয়ে জোসনা (১৯৮৯)
‘বেদের মেয়ে জোসনা’ বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যবসাসফল সিনেমা। তোজাম্মেল হক বকুলের কাহিনী, চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় ছবিটি মোট ১,২০০ সিনেমা হলে মুক্তি পেয়েছিলো। বেশ কিছু সিনেমা হলে একটানা ৬ মাস হাউসফুল ছিলো। মোট ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই সিনেমা আয় করেছিলো ২০ কোটি টাকা। শোনা যায়, হলের টিকিট না পেয়ে নাকি একজন আত্মহত্যাও করেছিলো। সিনেমাতে মূল ভূমিকায় অভিনয় করে অঞ্জু ঘোষ এবং ইলিয়াস কাঞ্চন রাতারাতি বড় তারকা হয়ে যান। আর ‘বেদের মেয়ে জোসনা আমায় কথা দিয়েছে’ গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। এরপর পশ্চিমবঙ্গে সিনেমাটি রিমেক করে মুক্তি দেওয়া হয়েছিলো, সেখানেও মূল ভূমিকায় অভিনয় করেন অঞ্জু ঘোষ।
৪. সীমানা পেরিয়ে (১৯৭৭)
‘সীমানা পেরিয়ে’ চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছে ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানা ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে। সিনেমাতে দেখা যায় একজন গ্রাম্য তরুণ আর এক শহুরে তরুণী ভাসতে ভাসতে এক অজানা দ্বীপে এসে পড়েছে যেখানে কোনো মানুষ বাস করে না। তাদের বেঁচে থাকার সংগ্রাম নিয়েই সীমানা পেরিয়ে সিনেমার কাহিনী এগিয়ে গেছে। বেঁচে থাকার তাড়নায় একেবারে বিপরীতমনা মানুষের মধ্যেও যে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে- সেটাই এই সিনেমার বিষয়বস্তু। সিনেমাটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ অভিনেতাসহ মোট তিনটি বিভাগে পুরস্কার পেয়েছিলো, মূল ভূমিকায় অভিনয় করেছেন বুলবুল আহমেদ ও জয়শ্রী কবির।
৩. নদীর নাম মধুমতি (১৯৯৪)
তানভীর মোকাম্মেল পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘নদীর নাম মধুমতি’ মুক্তি পায় ১৯৯৪ সালে। সিনেমাতে অভিনয় করেছেন তৌকীর আহমেদ, আলী যাকের, রাইসুল ইসলাম আসাদ, সারা জাকের, আফসানা মিমি সহ আরও অনেকে। কাহিনী ও সংলাপ রচনার জন্য তানভীর মোকাম্মেল শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার ও শ্রেষ্ঠ সংলাপ রচয়িতা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জেতেন। সিনেমাতে দেখানো হয়েছে মধুমতি পাড়ে এক গ্রামের স্থানীয় মুসলিম নেতা মোতালেব মোল্লা আর তার দ্বিতীয় স্ত্রীর ছেলে বাচ্চুর মুক্তিযুদ্ধের সময় বিপরীত মেরুতে অবস্থান নেওয়ায় কাহিনী।
২. চিত্রা নদীর পারে (১৯৯৯)
১৯৪৭ সালের দেশবিভাগ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুদের জীবনে যে ধরনের প্রভাব ফেলেছিল, সেগুলো এই সিনেমাতে দেখানো হয়েছে। কাহিনীর শুরু হয়েছে ১৯৪৭ সাল থেকে এবং শেষ হয়েছে ‘৬০ এর দশকে। সামরিক আইনবিরোধী আন্দোলনের প্ল্যাকার্ড, উত্তম-সুচিত্রার সিনেমার রিকশাযোগে প্রচার, চিত্রা নদীতে পালতোলা নৌকা, প্রতিমা বিসর্জন- সিনেমায় এসব দৃশ্য দেশভাগের পরের তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সময়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। এই সিনেমায় প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন মমতাজউদ্দীন আহমেদ, তৌকির আহমেদ, আফসানা মিমি ও রওশন জামিল। পরিচালকের মুন্সিয়ানায় চলচ্চিত্রটি ৭টি ক্যাটাগরিতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে।
১. তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৭৩)
তালিকায় সবার উপরে আছে বিশ্বচলচ্চিত্রের অন্যতম সেরা পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের সিনেমা ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। অদ্বৈত মল্লবর্মণের উপন্যাসের কাহিনীকে উপজীব্য করে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করা হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রযোজনা শিল্পের অন্যতম পথিকৃৎ হাবিবুর রহমান খান মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে এসে জড়িয়ে পড়েন চলচ্চিত্র প্রযোজনা ব্যবসায়। তিনি পরিকল্পনা করলেন সত্যজিৎ অথবা ঋত্বিককে দিয়ে বাংলাদেশের জন্য একটি সিনেমা বানাবেন। তিনি প্রথমে সত্যজিৎ রায়ের কাছে গেলেন, কিন্তু সত্যজিৎ সরাসরি তাকে বলেছিলেন, ‘‘এই ছবিটি নির্মাণ করার ক্ষমতা আমি রাখি না। একমাত্র ঋত্বিক ঘটকই এটি সম্ভব করতে পারেন।’’ সিনেমাটিতে মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন প্রবীর মিত্র, রোজী আফসারী, গোলাম মোস্তফা ও রওশন জামিল। অবশ্য ঋত্বিকের ভাষায় ‘‘আমার ছবিতে গ্রাম নায়ক, তিতাস নায়িকা।’’