উপন্যাস হলো শব্দে শব্দে মানুষের জীবন আঁকা। আরও সহজ করে বলা হয়তো সম্ভব না, কারণ আমাদের জীবনের পাওয়া-না পাওয়া, জয়-পরাজয় সব নিয়েই এর সৃষ্টি! আর এতকিছু নিয়ে যার জন্ম, তাকে খুব সহজে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। এসব একপাশে রেখেই বাংলাদেশের উপন্যাস নিয়ে কথা বলতে গেলে শুরুতেই চলে আসে নানারকম আলোচনা-সমালোচনা, তবে দিনশেষে সাহিত্যই তো আমাদের মূল্যবান সম্পদের একটি, কারণ আমাদের কথা ও ইতিহাস তো নিখুঁতভাবে শুধু আমাদের ভাষাতেই বলা সম্ভব, এবং নিজেদের গল্পগুলো ইতিহাসে বাঁচিয়ে রাখার যুদ্ধে এটা সবচেয়ে ভালো উপায়ও বটে!
নাম ধরে ধরে বাংলাদেশের উপন্যাস নিয়ে আলোচনা করতে গেলে যে অল্প কিছু বইয়ের কথা অবশ্যই উঠে আসবে, তার মধ্যে মাহমুদুল হকের ‘কালো বরফ’ অন্যতম। বইটি ১৯৭৭ সালে লেখা হলেও প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালে! ৬৭ বছরের জীবনে লেখক লিখেছেন অনেক কম, মাত্র কয়েকটি উপন্যাস আর ছোটগল্পের বই। অবশ্য অল্প লেখার অভ্যাস লেখকের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়নি, বরং তিনি হয়েছেন কালজয়ী। নীরবে লিখে গেলেও ১৯৯৭ সালে সাহিত্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়ার পর তিনি নতুন করে পাঠকের সামনে হাজির হন, যদিও ততদিনে তার লেখালেখির জীবন প্রায় সমাপ্তির পথে।
এবার তাহলে ‘কালো বরফ’ নিয়ে বিস্তারিত বলা যাক। উপন্যাসের প্রেক্ষাপট দেশভাগ নিয়ে হলেও সেখানে যুদ্ধ-দাঙ্গার অস্তিত্ব তেমন নেই বললেই চলে। কারণ হিসেবে বলা যায়- লেখক রক্ত নয়, মানুষের দীর্ঘশ্বাস আর হাহাকারের গল্প বলতে চেয়েছেন। পুরো উপন্যাস জুড়েই তাই চোখে পড়বে গল্পের মূল চরিত্রের শৈশবের কথা, আমাদের দেখা হবে শেকড়ের সাথে জুড়ে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছের সাথে। হিন্দু মুসলিম বিরোধ, মারামারি, জয়-পরাজয় সব পাশ কাটিয়ে লেখক দেখাতে চেয়েছেন অস্থির সময় কীভাবে মানুষের জীবনের গল্প ছিনিয়ে নিয়ে শুধু বেঁচে থাকার এক ঠুনকো জীবন দান করে। নিঃসন্দেহে পাঠকের জন্য এটি এক অন্যরকম যাত্রা।
‘কালো বরফ’ উপন্যাসের মূল চরিত্র আব্দুল খালেক, শৈশবে যাকে আদর করে ‘পোকা’ ডাকা হতো। পুরো উপন্যাসে নিয়মিত বিরতিতে এমনভাবে শৈশব ফিরে ফিরে আসে যে পাঠকের মনেও বারবার সেই সময়ে ফেরার ইচ্ছে জাগবে। আসলে জীবনের চরম সুন্দর সময় তো আমরা ওখানেই ফেলে আসি! আর এই সৌন্দর্যের কারণ অবশ্য লেখক খুব সহজ করে বলে দিয়েছেন,
“তখন ভালোলাগা বা মন্দলাগা এসবের কোনো ঝক্কি ছিল না!”
সেজন্যই হয়তো সে সময়টায় থাকে শুধু সরলতা আর আনন্দ, গল্পের মূল চরিত্রের বাল্যকালও সেভাবেই এগোতে থাকে চূড়ান্ত গন্তব্যের দিকে!
আব্দুল খালেক মফস্বলের একজন কলেজশিক্ষক, যার পুরো জীবনের সাথে জড়িয়ে থাকে শৈশবের স্মৃতি। বলা যায়, তার জীবন ছিল অর্ধেক বর্তমান আর বাকিটুকু শৈশব! কী যেন ফেলে এসেছে সেখানে, তাই ফিরে যাওয়ার ভীষণ তাড়া অনুভব করেন। তিনি নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যাওয়া জীবনে পূর্ণতা পেতে চান স্ত্রী রেখার হাত ধরে। আনন্দ-বেদনা, ক্রোধ সব মিলিয়েই ছিল তাদের সংসার। তবে দৃশ্যত বেদনার দিকেই তিনি এগোচ্ছিলেন বেশি। অনুভূতির এসব মিশ্রণ অবশ্য তাকে ভয় দেখাতে পারেনি কখনো। এসব একপাশে ফেলে রেখেই বন্ধুর পরামর্শে ডায়েরি লেখা শুরু করেন, যেখানে তার অবাধ্য বাল্যকাল আর জীবন দেখার অকুতোভয় সাহস মিলেমিশে একাকার হতে থাকে। টাকার বিষয়টা থাকলেও সেটাকে খুব একটা পাত্তা দেন না, কারণ তার ইচ্ছেই হলো জীবনকে খুব সামনে থেকে দেখা! যেমন করে মানুষ কোনো মূল্যবান পাথর পেলে খুব কাছ থেকে চোখ আর মন ভরে দেখে।
তারপর শুরু হয় আব্দুল খালেকের সারারাত লেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকা, অন্যদিকে পাঠকের জন্য আসতে থাকে নতুন নতুন ঘটনা। মোটামুটি মানের একটা মধ্যবিত্ত জীবন প্রত্যাশা করা রেখার সাথে এসব নিয়ে চলতে থাকে প্রচন্ড মান- অভিমান। ঘরের বউকেই বা কী দোষ দেয়া যাবে! তার তো চাহিদা বলতে শুধু বেঁচে থাকার জন্য একটা সহজ জীবন! অথচ গল্পের মূল চরিত্রের কাছে লেখালেখি হয়ে ওঠে নিজেকে আড়াল করার কৌশল এবং জীবনের ক্ষুধা-চাহিদা সব পাশ কাটিয়ে একটা অন্যরকম জীবন পাওয়ার বাহানা! আর তাই সংসার গুছিয়ে রাখতে রেখার নানা সংগ্রাম পাঠকের চোখ এড়িয়ে যাবে না। আমরা এই পরিবারের ভেতর দিয়ে হাজারো পরিবারের কথা জেনে যাব। পাঠক হিসেবে পারিবারিক ঘটনাগুলোর মানসিক দিক আমাদের ছুঁয়ে দেবে। হয়তো লেখকও সেটাই চেয়েছিলেন। তাই তো একটু একটু করে নানা দিক আমাদের সামনে মেলে ধরতে থাকেন।
একে একে গল্পে চলে আসে অনেক চরিত্র! বড় ভাই টিপু যাকে জড়িয়ে ঘুমিয়েছিল বহুদিন, অথচ তাকে ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছে হলেও পারে না। এই না পারাই আমাদের জানিয়ে দেবে মানুষের সীমাবদ্ধতার কথা, অথবা বলা যায় অসহায়ত্বের বিষয় ফুটে উঠবে। শৈশবে গিরিবালা নামের একজনের অসীম ভালবাসার গল্পে মুগ্ধ হয়েছিল আব্দুল খালেক। আর তাই নিজের ভালবাসাকে সেই উচ্চতায় দেখতে স্ত্রীকে গিরিবালা ডাকতে গিয়েও ভীষণ বিপাকে পড়ে সে! একবার ভেবেছিল, তার মনে দাগ কেটে যাওয়া গল্প রেখাকে বলা উচিত, কিন্তু তা আর হয়ে ওঠে না। সবকিছু নীরবে হজম করে হলেও সে যেন বারবার তার ছুটে যাওয়া অতীতকেই ফিরিয়ে আনতে চেয়েছে, যেভাবে ঘর ছেড়ে যাওয়া সন্তানকে বাবা-মা যেকোনো মূল্যে ফিরিয়ে আনতে চায়। তবে পাঠকের জন্য গিরিবালার জীবনও বিস্ময় হিসেবেই হাজির হবে। এখানে এসে পাঠক হিসেবে আমরা যেন একটু থমকে দাঁড়াব! লেখক চট করেই এক অন্যরকম জীবন আমাদের সামনে নিয়ে আসবেন।
গল্পের মাঝপথে আব্দুল খালেকের মনে পড়ে যায় সেসব বৃষ্টির দিনের কথা, যখন কাগজের নৌকা বানানোর ধুম পড়ে যেত। তারা রানিবুবুর বিড়ালের সাথে কত খেলা করত! একবার এক শালিকের সাথে বন্ধুত্ব হওয়ায় শিশুমনে মেনে নিয়েছিল যে পাখিটি তাদের হারিয়ে যাওয়া বোন! সেই নির্দোষ অতীতে ছিল নগেন আর মাধু নামের দুজন, সমাজের চোখে যাদের দোষী জীবনও তাকে টেনেছিল খুব! একদিন অশ্রুর সাগরে সমাজের সব সংজ্ঞা ওলট-পালট হয়ে যেতে চেয়েছিল আর ছোট পোকা যেন দোষ-নির্দোষের সীমানাটা ধরতে পারছিল না! তবে নিশ্চিতভাবেই পাঠক সেটা ধরতে পারবেন, সেসময় যে প্রশ্ন পোকার মনে উদয় হয়েছিল তার উত্তর পাঠকের মনে ঠিকই উঁকি দেবে, কারণ লেখক এটার জন্যই আমাদের প্রস্তুত করে যাচ্ছিলেন। একের পর এক এভাবে নানা চিত্র আমাদের সামনে মেলে ধরা হবে, ঠিক যেভাবে বায়োস্কোপে দেখানো হয়।
অনেক গল্পের ভীড়ে একদিন দেশভাগ হয়ে যায়। হুট করেই যেন ঘুড়িটা নাটাই থেকে ছিড়ে যায়। মানুষগুলো আলাদা হতে শুরু করে, মানুষে মানুষে নতুন গল্প আসে! যে গল্পগুলো কখনো পোকার চোখে পড়েনি, সেসব হঠাৎ করেই তার সামনে প্রকাশিত হতে থাকে। অবাক বিস্ময়ে সে শুধু ঘটনাগুলোর নিশ্চুপ দর্শক হয়ে থাকে, তবে এখানেই পাঠক হিসেবে আমরা আরও সজাগ হয়ে যাব; প্রতিটি ঘটনা আরও মনোযোগ দিয়ে দেখার জন্য নড়েচড়ে বসব, কারণ আড়াল থেকে লেখক এটাই চেয়েছেন।
এভাবেই একটু একটু করে জীবন এগোতে থাকে। আব্দুল খালেকের ভাবনাগুলো আর সমস্ত হাহাকার শোনার মতো একজন বন্ধু হিসেবে হাজির হয় নরহরি ডাক্তার। পেশাগত কারণেই তার কাছে কম-বেশি সবার কথাই জমা থাকত। সেসব টুকটাক জীবনের কথা আব্দুল খালেকও শুনত, তবে নিজের কথাগুলো বলতে পারার আনন্দই বেশি ছিল, আর ফেরার পথে নিশ্চুপ পরিবেশ তার ভালো লাগত খুব। মনে হতো পুরো প্রকৃতি চুপ করে আছে তার কথা শোনার জন্য।
সাদামাটা জীবনে অসুস্থতা, দারিদ্র্য সবই দেখতে হয় আব্দুল খালেককে। কলেজের চাকরিরও কোনো ঠিক-ঠিকানা ছিল না। ফান্ডের অভাবে এই আছে এই নেই অবস্থা! সাংসারিক টানাপোড়ন তো আছেই। একমাত্র স্ত্রী আর সন্তানের দায়িত্ব পালনের ব্যর্থতা যেমন পোড়াত, তেমনি নিজের ভালবাসার মানুষের ধারাল কথাগুলো আরো বেশি করে পোড়াত! না চাইলেও সেই কথাগুলো পাঠকের কানেও ঝড় তুলবে! পড়তে পড়তে মান-অভিমানের অনুভবগুলো তাই আমাদেরও ছুঁয়ে যাবে। আশা-হতাশা মিলিয়ে সম্পর্কের প্রদীপ নিভে যাওয়ার আগমুহূর্তেই যেন আব্দুল খালেক জেগে ওঠে। নিজেদের নিয়ে আরও একবার বাঁচতে চায় সে। তবে এই জেগে ওঠাও ভীষণ নাটকীয়তার ছোঁয়া পায়, যেন আরও একটা কাঁটা বিঁধে যায় তার গলায়! এভাবেই হুট করে নতুন কিছু ঘটনা পাঠককে ভীষণ ধাক্কা দেবে, যেভাবে হালকা তন্দ্রা ভাঙানোর জন্য আমরা অন্যকে আলতো করে ধাক্কা দেই।
এতসব গল্প পেছনে ফেলে একদিন তারা নৌকাভ্রমণে বের হয়, সব ছেড়েছুড়ে এমনভাবে বের হয়ে যায় যে পাঠকের মনে হবে তারা দুজন নিজেদের কাছেই নিজেদের জমা রাখতে চাচ্ছে! তারপর আসতে থাকে নতুন দৃশ্যপট! আব্দুল খালেকের মনে যে বরফ জমতে শুরু করেছিল তা অন্যরকম ব্যাকুলতার হাওয়ায় কি গলতে শুরু করবে? তার কি মনে হতে থাকবে এই তো, এই জীবনটাই সে দেখতে চায়, আর এসবের অস্তিত্ব তার হাতের কাছেই আছে হয়তো! দেশভাগ আর পরিবারের সাথে হওয়া দূরত্বে দাঁড়িয়েও কি সে আরও এক গল্পের সন্ধান পাবে? সে কি এই যাত্রায় বরফ গলিয়ে সবগুলো গল্প বের করে এনে নিজেকে পালতোলা নৌকার মতো মেলে ধরতে পারবে? নাকি ফিরে যাবে নিজের নীরবতার কাছেই? আবারো ঘরে ফিরে ব্যথা-বেদনার কাছেই কি নিজেকে সঁপে দেবে? গল্পের এই শেষদিকটাই আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, কারণ এখানেই একটা সম্পর্ক বিশ্লেষণ করেন মাহমুদুল হক, তার ফলাফল জানতে অবশ্য আমাদের কালো বরফের কাছেই যেতে হবে!
পুরো উপন্যাস আসলে এভাবেই দেশভাগের ছায়ায় জীবনের গভীরতম গল্প তুলে ধরে। লেখক মাহমুদুল হকের লেখালেখির বিষয়টাই এমন! আমাদের আশেপাশে যে জীবন ডালপালা বিস্তার করে আছে, সেই জীবনকেই লেখক এমন এক দৃষ্টিকোণ থেকে সামনে নিয়ে আসেন যে আমরা ভাবতে বাধ্য হই; কখনো প্রশ্ন করি, আবার কখনো আমরাই উত্তর আবিষ্কার করি! ‘কালো বরফ’ লেখকের তেমনি একটি উপন্যাস যা আমাদের জীবনের খুব কাছে নিয়ে যাবে, গল্পের ভেতরের গল্পে নিয়ে যাবে। খুব অল্প কথায় উপন্যাসটির মূল্যায়ন অসম্ভব! তবুও যদি একবাক্যে বলতে বলা হয়, তবে বলা যায়, ক্ষুধা-দারিদ্র্য সব ছাপিয়ে জীবন দেখতে চাওয়ার এক দুঃসাহসিক অভিযানের নামই ‘কালো বরফ’।