Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

পিংক: সমাজের চোখে নারীকে দেখার নির্ভুল গল্প

দিল্লি শহরের দু’দিকে ছুটে চলেছে দুটো গাড়ি। এক গাড়িতে তিনজন তরুণ, তাদের মধ্যে একজন গুরুতরভাবে আহত। চোখসহ মাথার একপাশে ক্ষত, রক্ত পড়ছে। অন্য গাড়িতে তিনজন তরুণী। সবার মধ্যেই বিশেষ উত্তেজনা কাজ করছে। একটা দমবন্ধ অবস্থা!

‘পিংক’ সিনেমার পোস্টার; Image Source: imdb.com

এরপর ধীরে ধীরে পুরো চলচ্চিত্রজুড়ে এই দমবন্ধ অবস্থার পেছনের রহস্য উন্মোচিত হলো। ফালাক, মিনাল আর অ্যান্ড্রিয়া- তিনজন স্বাধীনচেতা চাকরিজীবী নারী। শহরের একটা ভাড়া বাড়িতে তারা তিনজন একসাথে থাকে। তাদের তিনজনের সাথে এক রক কনসার্টে পরিচয় হয়েছিল তিন তরুণের। শহর থেকে দূরে সুরজখন্ডের এক রিসোর্টে সেই তরুণদের সাথে তারা ঘুরতে গেলে একপর্যায়ে তরুণদের একজন রাজভীর সিং মিনালের সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনে জোর প্রয়োগ করে। মিনাল অসম্মতি জানানো সত্ত্বেও রাজভীর জোরপ্রয়োগ করায় মিনাল তাকে প্রতিহত করতে তার মাথায় মদের বোতল দিয়ে আঘাত করে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আঘাতটি মাথার একপাশে লাগে এবং তরুণটির একচোখ প্রচণ্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ঘটনার পরে ঐ তিন নারীর জীবনে সৃষ্ট সংকট নিয়েই মূলত ‘পিংক’ চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে চিন্তার সীমাবদ্ধতা এবং পুরুষের চোখে নারীর স্বরূপ এখানে নির্মোহ ভঙ্গিতে কোনো চরিত্রের অতিরঞ্জন ব্যতীত অসামান্য দক্ষতায় উন্মোচিত হয়েছে।

‘পিংক’ সিনেমার তিন নারী- ফালাক, মিনাল আর অ্যান্ড্রিয়া; Image Source: firstpost.com

অনিরুদ্ধ রায় চৌধুরী পরিচালিত ‘পিংক’ মুক্তি পেয়েছিল ২০১৬ সালের ১৬ সেপ্টেম্বরে। চলচ্চিত্রটির ট্রেলার প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই এটি বিশেষভাবে আলোচিত হতে থাকে। ট্রেলারের শুরুতেই দেখা যায় একটি কোর্টরুমে অমিতাভ বচ্চন তাপসী পান্নুকে জিজ্ঞেস করছেন, “আপনি কি কুমারী?” (পূর্বে কারো সাথে যৌন সম্পর্ক করেছেন কি না- এই অর্থে)। এত খোলামেলাভাবে নারীকে লোকসম্মুখে এই প্রশ্ন করা যায় কি না, এ নিয়ে সেই সময়ে বিতর্কের পাশাপাশি চলচ্চিত্রটির কন্টেন্ট নিয়ে মানুষের মাঝে আগ্রহ তৈরি হয়। নারীকে নিয়ে বর্তমান সময়ের সাহসী নির্মাণগুলোর মধ্যে ‘পিংক’ উল্লেখযোগ্য। বর্তমান সময়ে নারীর জীবনের সংকটগুলোর যথাযথ উপস্থাপনে এই চলচ্চিত্রটি সমসাময়িক জীবনের সাথে অতিমাত্রায় প্রাসঙ্গিক।

সুরজখন্ডের রিসোর্টে মিনালের মাধ্যমে রাজভীর কীভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হলো, তা নিয়ে ‘পিংক’ চলচ্চিত্রটি নয়। বরং এ ঘটনার পর শহরের তিন নারীর জীবন কীভাবে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে এবং সামাজিকভাবে নানাভাবে ভীতিপ্রদর্শন ও হেয় করা সত্ত্বেও স্রোতের বিপরীতে তিনজন নারীর লড়াই করার সাহসী গল্প নিয়েই ‘পিংক’ চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গেলেই আমাদের সমাজ যেভাবে নারীর মুখ চেপে ধরে এবং নারীকে হেয় প্রতিপন্ন করার নিকৃষ্ট পন্থাগুলো অবলম্বন করে তার যথার্থ রূপায়ন এই চলচ্চিত্রটিকে বিশেষ মাত্রা প্রদান করেছে।

 মিনাল চরিত্রে তাপসী পান্নু

মিনাল কর্তৃক রাজভীর আহত হওয়ার পরপরই সে ও তার বন্ধুরা প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে। ফোনে হুমকি দেওয়ার পাশাপাশি প্রতি মুহূর্তে ঐ নারীকে আতঙ্কিত করে তাদের স্বাভাবিক জীবন বিনষ্ট করার হীন প্রচেষ্টায় মেতে ওঠে রাজভীর ও তার বন্ধুরা। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গেলে রাজভীরের চাচা রঞ্জিত সিংয়ের রাজনৈতিক ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে নারী তিনজনের হয়রানি বা উত্যক্তকরণকে উপেক্ষা করা হয়। বরং পুলিশ একপর্যায়ে রাজভীরকে ‘হত্যার প্রচেষ্টা’র দায়ে মিনালকেই গ্রেফতার করে। অসহায় তিন নারীর পাশে তখন এগিয়ে আসেন তাদের বৃদ্ধ প্রতিবেশী আইনজীবী দীপক সেগাল। এরপর এই মামলার বিচার চলাকালে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয় সমাজ কীভাবে একজন নারীকে মূল্যায়ন করে এবং নারীর স্বাধীনতার সীমানা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চিন্তার সীমাবদ্ধতার জালে কত সহজেই আটকে পড়ে। নিজেদের সমাজের এমন নগ্ন উন্মোচন দর্শকদেরকে লজ্জিত করে তোলে এবং নারীর প্রতি চিন্তার সীমাবদ্ধতার এই নিখুঁত বিশ্লেষণ পুরো চলচ্চিত্রজুড়ে তাদেরকে আলোড়িত করতে থাকে।

এ চলচ্চিত্রে দীপক সেগাল চরিত্রে অভিনয় করেছেন অমিতাভ বচ্চন এবং মিনাল চরিত্রে অভিনয় করেছেন তাপসী পান্নু। দুটি চরিত্রই তাদের অভিনয় প্রতিভার সর্বোচ্চটা ঢেলে দর্শক হৃদয়ে বিশেষভাবে আঘাত করে তাদেরকে ভাবিয়ে তুলেছেন।

আইনজীবী দীপক সেগাল চরিত্রে অমিতাভ বচ্চন

পুরুষতান্ত্রিক সমাজে যেকোনো ধরনের যৌন নিপীড়ন বা সংকটে চুপ করে থেকে পুরুষের আনুগত্যই যেন নারীর নিয়তি। অথচ এর বাইরে গিয়ে যখনই কোনো নারী অন্যায়ের প্রতিবাদ জানায়, পুরো সমাজ তখন তার পাশে না থেকে কীভাবে দূরে সরে গিয়ে তার সামাজিক জীবন দুর্বিষহ করে তোলে, তার নিখুঁত রূপায়ন ঘটেছে এই চলচ্চিত্রে। দেখা যায়, রাজভীর এবং তার বন্ধুদের নানামাত্রিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালেই নানাভাবে ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে নারী তিনজনকে চুপ করে থাকার জন্য জোরপ্রয়োগ করা হয়। তারা যে বাড়িতে ভাড়া থাকত, সে বাড়ির মালিককে বাড়ি থেকে তাদের তিনজনকে বের করে দেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করা হয়। ফটোশপে এডিট করা বাজে ছবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিয়ে সম্মানহানির চেষ্টা করা হয়, ফলশ্রুতিতে ফালাক তার চাকরি পর্যন্ত হারিয়ে ফেলে। সামাজিকভাবে পর্যুদস্ত তিন নারীর অসহায় অবস্থাকে পরিচালক অত্যন্ত যত্নের সাথে এ চলচ্চিত্রে ফুটিয়ে তুলেছেন।

ধারাবাহিকভাবে বা পর্যায়ক্রমিক ঘটনাবিন্যাসের মাধ্যমে না দেখিয়ে এ চলচ্চিত্রের গল্পটি বলা হয়েছে আলাদা ভঙ্গিতে। সুরজখণ্ডের রিসোর্টে সেই রাতের ঘটনা থেকেই পরবর্তী সংকটগুলোর জন্ম হয়েছে। অথচ এই চলচ্চিত্রে নারীর দুর্বল অবস্থাকে রূপায়িত করতে সেই সংকটগুলোকেই পর্যায়ক্রমে উপস্থাপিত করা হয়েছে এবং সুরজখন্ডের রিসোর্টে সেই রাতের রহস্যটি ভেদ হয়েছে চলচ্চিত্রের একেবারে শেষ অংশে। চলচ্চিত্রের শুরু থেকে যে রহস্যগুলো দর্শকের মনে দানা বেঁধেছে তার উন্মোচন ঘটেছে চলচ্চিত্রের সমাপ্তিতে। এখানে কোনো চরিত্রকে মহিমান্বিত করার চেষ্টা হয়নি, বরং দোষ-গুণ মিলিয়েই মানুষের যে প্রকৃত রুপ তাকে অক্ষুণ্ন রেখেছেন এর চিত্রনাট্যকার।

‘গাঁ ঘেষে দাঁড়াবেন না’; Image Source: thedailystar.net

নারীর সম্মতিতে তাকে স্পর্শ করা এবং অসম্মতিতে তাকে স্পর্শ না করার মাঝে যে বিস্তর ফারাক রয়েছে, তা বিশেষভাবে নির্দেশ করেছে এই চলচ্চিত্র। বর্তমান সময়ে এসে ‘গাঁ ঘেষে দাঁড়াবেন না’র মতো সাহসী সামাজিক আন্দোলনগুলোর মর্মার্থ যখন আমাদের সমাজের মানুষ অনুভব করছে না, বা উপেক্ষা করে চলে যাচ্ছে, তখন ‘পিংক’ এই ইস্যুটিতে বিশেষভাবে আলো ফেলেছে। এ চলচ্চিত্রের একেবারে শেষ অংশে মিনালের অসম্মতিতে তাকে রাজভীরের স্পর্শ করা কতটা গর্হিত কাজ তা বোঝাতে তার আইনজীবী দীপক সেগাল বলেন,

” ‘না’ কেবল একটি শব্দ নয়, মাননীয় আদালত। এটি একটি পূর্ণ বাক্যও বটে। এর বিস্তৃত ব্যাখ্যার কোনো প্রয়োজন আমি বোধ করি না। … ‘না’ র অর্থ কেবল ‘না’-ই হয়। যদি কোনো মেয়ে ‘না’ বলে সে পরিচিত হোক, বন্ধু হোক, গার্লফ্রেন্ড হোক, পতিতা হোক, এমনকি নিজের স্ত্রী হোক- সে যৌন সম্পর্ক স্থাপনে অনিচ্ছা প্রকাশ করলে তার উপর কখনোই জোর প্রয়োগ করা উচিত না।”

‘না’ র অর্থ কেবল ‘না’-ই হয়; Image Source: cinematerial.com

বর্তমান সময়ে এসে যখন মানুষ খুব সহজেই বলে ফেলে, “এমন মেয়েদের সাথে এমনই হওয়া উচিত!”, অথবা যেকোনো সহিংস ঘটনার বিশ্লেষণের শুরুতেই পোশাক-আশাকের উদাহরণ টেনে এনে দেখার চেষ্টা করে নিপীড়ন বা হয়রানির সময়ে মেয়েটির সারা শরীর পোশাকে ঢাকা ছিল কি না কিংবা সামাজিক কোনো সহিংসতায় ঘটনার কুশীলবদেরকে ছেড়ে দিয়ে কোনো নারীর সংশ্লিষ্টতা থাকলে তার চরিত্র বিশ্লেষণ যখন সমাজের মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে, তখন ‘পিংক’ চলচ্চিত্রটি বর্তমান সময়ে আমাদের সমাজের জন্য বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।

এ চলচ্চিত্রের আরেকটি বিশেষ দিক হলো- এটি এর দর্শককে প্রথম থেকে শেষপর্যন্ত মন্ত্রমুগ্ধের মতো ধরে রাখে। এক উত্তেজনার মধ্য দিয়ে যেতে যেতে দর্শকরা সমাজের চোখে নারীকে নতুন রুপে আবিষ্কার করে। বিশেষ করে কোর্টের ভেতরের দৃশ্যগুলোতে প্রতিপক্ষের উকিলের প্রশ্ন এবং ছেলেদের কথাবার্তায় নারীর প্রতি সমাজের ভাবনার সীমাবদ্ধতা খুব জোরালোভাবে প্রকাশিত হয়।

একটু রাত করে বাড়ি ফিরলেই মেয়েদেরকে ‘পতিতা’র ট্যাগ দেওয়া বা পুরুষের সাথে একটু হেসে কথা বললে ধরে নেওয়া ‘মেয়েটি যৌন সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহ প্রকাশ করছে’– সমাজের এমন দুর্গন্ধময় চিন্তাভাবনাগুলোকে প্রত্যক্ষভাবে কটাক্ষ করেছে ‘পিংক’।

বিশেষ করে সমাজের উচ্চবিত্ত বা ক্ষমতাসীন কোনো পরিবারের মানুষের সাথে সাধারণ কোনো নারীর সহিংসতা বা নিপীড়নের খবর পেলেই অতি সহজে সেই নারীকে ‘বেশ্যা’ বা ‘পতিতা’র ট্যাগ দিয়ে উচ্চবিত্ত বা ক্ষমতাসীনের জন্য পুরো পরিস্থিতিকে হালকা করে ফেলার যে নিকৃষ্ট সামাজিক পন্থা, ‘পিংক’ তাতে কঠোরভাবে আঘাত করেছে। নারীর প্রতি সামাজের নীচ এবং হীনতম মানসিকতাগুলোকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে দর্শকের মনে চিন্তার উদ্রেক ঘটিয়েছে।

‘পিংক’ সিনেমার প্রধান চরিত্রসমূহ; Image Source: unitedpunjabfc.com

সমাজে নারীর দুর্বল এবং সংবেদনশীল অবস্থার নিখুঁত রূপায়নের জন্য ‘পিংক’ চলচ্চিত্রটি মুক্তির পর পরই বিশেষভাবে সাড়া জাগায়। ‘সামাজিক ইস্যু নিয়ে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র’ হিসেবে ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার’ পাওয়ার পাশাপাশি এটি ‘স্টার স্ক্রিন অ্যাওয়ার্ড’ এবং ‘জি সিনে অ্যাওয়ার্ডে’ এটি ‘শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রে’র সম্মান অর্জন করে। এছাড়া ভারতের রাষ্ট্রপতিভবন এবং নিউ ইয়র্কে অবস্থিত জাতিসংঘের হেড কোয়ার্টারেও ‘পিংক’ চলচ্চিত্রটির বিশেষ প্রদর্শনী হয়েছিল।

নারীর প্রতি বর্তমান সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিকে উপস্থাপন করতে ‘পিংক’ একটি অসামান্য দলিল। চিন্তার জগতের দ্বার খুলে দিয়ে ‘পিংক’ সমাজের রূঢ় রূপটি যেমন দেখায়, একইসাথে সমাজে নারীর দুর্বল অবস্থা অনুধাবন করিয়ে মস্তিষ্কে প্রবল আলোড়নের সৃষ্টি করে। নারীর জন্য সমাজকে উপযোগী করে তুলতে আমাদেরকে এখনও অনেকটা পথ হাঁটতে হবে। আমাদের চিন্তা-ভাবনাকে যথেষ্টরূপে পরিশীলিত করতে না পারলে এ সমাজ কখনও নারীর উপযোগী হয়ে উঠবে না। নারীকে ‘নারী’ হিসেবে নয়, বরং ‘মানুষ’ হিসেবে দেখার চর্চাই সমাজে আনতে পারবে এই কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন।

Pink is a 2016 Indian Hindi-language social thriller film directed by Aniruddha Roy Chowdhury, written by Ritesh Shah, and produced by Rashmi Sharma Telefilms (Pawan Kumar and Rashmi Sharma), Sheel Kumar and Shoojit Sircar. The film received widespread critical acclaim, and garnered the National Film Award for Best Film on Other Social Issues.

 

Featured Image: cinecelluloid.com 

Related Articles