কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্রের ইচ্ছার অনেকটা অমতেই জন্ম পথের দাবীর। বিতর্কের মধ্য দিয়ে পথ চলা শুরু হলেও সাধারণ পাঠকের কাছে গ্রহণ মান কমেনি উপন্যাসটির। বরং তা তরুণ প্রাণের মধ্যে জাগ্রত চেতনা তৈরি করেছিল, দিয়েছিল কিছু চিন্তার খোরাক।
সৃষ্টিকথা
বঙ্গবাণী পত্রিকার মালিক কাগজে ছাপার জন্যে নতুন লেখার সন্ধানে আসেন শরৎচন্দ্রের কাছে। কিন্তু লেখক নতুন কোনো লেখা নেই বলে বিদায় করে দেন। একপর্যায়ে নাছোড়বান্দা মালিকের চোখে পড়ে পাণ্ডুলিপি করা পথের দাবীর ওপর, কিন্তু লেখক তা প্রকাশ করতে নারাজ। অবশেষে ১৯২৬ সালের ৩রা মার্চ প্রকাশিত হয় উপন্যাসটি, অনেকটা পথে পেরিয়ে একরকম বিদ্রোহের মধ্য দিয়েই জন্ম পথের দাবীর।
কী আছে বইটিতে?
“আমরা সবাই পথিক। মানুষের মন্যুষত্বের পথে চলবার সর্বপ্রকার দাবি অঙ্গীকার করে আমরা সকল বাধা ভেঙ্গেচুরে চলব”
এই হল পথের দাবীর মূলমন্ত্র। সাদা চামড়া না হওয়ার অপরাধে যখন কাউকে বেঞ্চে বসতে দেয়া হয় না, আইনের কাছে যখন নিপীড়ক পার পেয়ে যায়, শাস্তি পায় নিপীড়িতরা, তখন বোঝা যায় স্বাধীনতা কী চরমভাবে অবহেলিত হচ্ছে, কী ভীষণ রকমের দরকার হয়ে উঠেছে স্বাধীনতার ছোঁয়া। স্বাধীনতা মানে তো কেবল শুধুমাত্র দু’বেলা ভরপেট খাবার খাওয়া নয়, স্বাধীনতার ব্যাপ্তি আরো অনেক বেশি বিস্তৃত।
শরৎচন্দ্রের সময়টা ছিল বৃটিশ শাসিত। পরাধীনতার শেকল ভেঙে এক নতুন জাগ্রত সমাজ তৈরির স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। তারই তো প্রতিচ্ছবি পথের দাবী। সব্যসাচী চরিত্রটি তো তারই চিত্র বহন করে। সব ভেঙেচুরে নতুন স্বাধীন সমাজ গড়ে তোলার প্রত্যয় ফুটে ওঠে। গান্ধীর অহিংস আন্দোলনে সমাজের এতদিনের পুরনো শেকল ভেঙে ফেলা সম্ভব, এতে বিশ্বাস ছিল না শরৎচন্দ্রের। তিনি মনে করতেন, আঘাতে আঘাতে সমাজকে পরিবর্তন করতে হবে আগামীর জন্য। শরৎচন্দ্র বলেছিলেন,
“পথের দাবীর বাস্তব প্রতিফলন ঘটাচ্ছে সূর্যসেন। আমার আশীর্বাদ রইলো তার সাথে।”
শরৎচন্দ্রের এই ভাবমূর্তি দেখা যায় মূল চরিত্র সব্যসাচীর মাধ্যে। তিনিই এই বিপ্লবের নায়ক। আবার অন্যদিকে এর মধ্যে পাওয়া যায় সনাতনী চেহারা। পরিবর্তন চায়, কিন্তু পুরাতন শেকল ভেঙে ফেলার জন্য যে বিপ্লবের দরকার, তাতে ভয় হয়। ভবিষ্যতের জন্য কেন আজকের সময়গুলো নষ্ট, কেন আজকের মানুষগুলোর ওপর অন্যায়, কেন শুধু তথাকথিত এলিট ক্লাস নিয়েই চিন্তা, কেন প্রান্তিক মানুষগুলো জানতেও পারবে না স্বাধীনতা কী, কেন তারাও অংশগ্রহণ করবে না?- ইত্যাদি নানা প্রশ্ন মাথায় ঘোরে সব্যসাচীর মাথায়। অন্যদিকে গল্পের আরেক চরিত্র অপূর্ব। সাধারণ জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে সে। সবচেয়ে খারাপ অবস্থান এই সাধারণ জনগণেরই। পরাধীনতা এদের অস্থিমজ্জায় এমনভাবে আছে যে তাদের আর কিছু বোধ হয় না স্বাধীনতা-পরাধীনতা নিয়ে। হয়তো কখনো কখনো খারাপ লাগে, কিন্তু এত কঠিন বিষয় নিয়ে মাথা ঘামিয়ে সময় নষ্ট ছাড়া আর কী? তাই নিজের স্বার্থ বাচাতে অপূর্বের দলের বাকিদের সাথে বেইমানি করতেও বাধেনি।
সমাজের নানা অসঙ্গতি লেখনীর মাধ্যমে তুলে ধরার পাশাপাশি রাজনীতিতেও ছিলেন সক্রিয়। স্বাধীনতা সংগ্রামে যেসব নারীরা যোগ দেন তাদের মধ্যে অনেকেই এসেছিল বারাঙ্গনা পল্লী থেকে। সেখানে একটি মেয়ে ছিল বিমলা নামে। অসম্ভব সাহসী, বুদ্ধিমতী, চৌকস একজন নারী। পরবর্তীতে শরৎচন্দ্রকে জিজ্ঞেস করা হয়, পথের দাবীর সুমিত্রাই কি বিমলা? এর জবাবে তিনি বলেন,
“হতেও পারে, আবার না-ও হতে পারে, মেয়েটা কিন্তু সত্যিকার প্যাট্রিয়ট৷ যেখানেই থাকুক, যা-ই করুক, স্বদেশকে ও চিরকাল ভালবাসবে৷”
বইয়ের প্রতিটি পাতায় আছে মানুষকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলার এক প্রেরণা। শুধুমাত্র শান্তিতে জীবন পার করাই জীবনের স্বার্থকতা নয়। মানুষ তার নিজের ইচ্ছানুযায়ী চলবে, কিন্তু অপরের ইচ্ছা যখন তার ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়, তখন ব্যক্তিস্বাধীনতা কোথায় আর থাকে? শাসক যখন হয় শুধুমাত্র শোষণের জন্য, তখন সেই শাসনরূপী শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পথের দাবীর দরকার অবশ্যই আছে।
কিন্তু পথের দাবীর এই পথচলা সহজ কেন হবে! জীবন যাত্রায় মানুষের পথচলার এই অধিকার যে কতখানি বিশাল, তা যেন মানুষ ভুলে গেছে। নানা বন্ধুর পথ পেরিয়ে চলা পথের দাবীর। তার মধ্যে আসে নানা বাধা বিপত্তি, কিন্তু তা-ই বলে তো থেমে গেলে তো হবে না। বহুদিনের চলতে থাকা সমাজের সংস্কারকে সরিয়ে নতুন জায়গা দিতে সংগ্রাম তো চালিতে যেতেই হয়। তবে শেষ পর্যন্ত পথের দাবী কতটুকু সফল, তা নাহয় পাঠকেরাই নির্ধারণ করবে।
শাসকের রোষানলে পথের দাবী
পথের দাবীকে নিয়ে সে বছরের বর্ষপঞ্জিতে বলা হয়, বইটির প্রতিটি পৃষ্ঠায় রয়েছে রাষ্ট্রদ্রোহের উপাদান। কলকাতার তৎকালীন পুলিশ কমিশনার এ সম্পর্কে সরকারের চিফ সেক্রেটারিকে জানান। চিফ সেক্রেটারি বইটিকে ‘বিষময়’ বলে উল্লেখ করেন। কলকাতার পাবলিক প্রসিকিউটরও বইটিকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ‘উস্কানিমূলক’ বলে আখ্যা দেন। এই তিনজনের সুপারিশের উপর ভিত্তি করে করে অবশেষে ১৯২৭ সালের ৪ জানুয়ারি পথের দাবীকে বাজেয়াপ্ত করার ঘোষণা দেয়া হয়।
কিন্তু ততদিনে প্রায় তিন হাজার বই পাঠকের কাছে পৌঁছে গিয়েছে। সর্বত্র বই বাজেয়াপ্ত করার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এমনকি আইনসভাতেও বই বাজেয়াপ্ত করা নিয়ে হয় বাকবিতণ্ডা। আইনসভায় বই কেন বাজেয়াপ্ত করা হবে, এ নিয়ে কথা বলেন যারা, তাদের মধ্যে হরেন্দ্রনাথ চৌধুরী ও সুভাষচন্দ্র বসুর নাম উল্লেখযোগ্য। অনেকে শরৎচন্দ্রকে বইয়ের কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তনের কথা বললে তিনি বলেন যে এক শব্দও পরিবর্তন তিনি করবেন না।
রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্র; পথের দাবীর দুই প্রান্ত
পথের দাবীর ওপর ইংরেজরা যাতে নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেয়, তাই রবীন্দ্রনাথ যেন তাদের ওপর চাপ দেন, এ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কাছে চিঠি লিখেছিলেন শরৎচন্দ্র। তার প্রতিউত্তরে রবীন্দ্রনাথের জবাব নিচে কিছুটা তুলে ধরা হল-
“তোমার পথের দাবী পড়ে শেষ করেছি। বইখানি উত্তেজক। মানে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে মনকে অপ্রসন্ন করে তোলে। লেখকের কর্তব্যের হিসাবে এটাকে দোষের নাও মনে হতে পারে, কেননা লেখক যদি ইংরেজরাজকে গর্হণীয় মনে করেন তাহলে চুপ করে থাকতে পারেন না। নানা দেশ ঘুরে আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাতে এই দেখলেম, একমাত্র ইংরেজ গভর্ণমেন্ট ছাড়া স্বদেশী বা বিদেশী প্রজার বাক্যে বা ব্যবহারে এত বিরুদ্ধতা আর কোন গভর্ণমেন্ট সহ্য করবে না।
তোমার বই তারা প্রচার বন্ধ করে না দিত তাহলে বুঝা যেত সাহিত্যে তোমার শক্তি ও দেশে তোমার প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে তার নিরতিশয় অজ্ঞতা। শক্তিকে আঘাত করলে তার প্রতিঘাত সহ্য করার জন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে”।
রবীন্দ্রনাথ এখানে তার চিঠির মধ্য দিয়ে অনেকখানিই বৃটিশদের পক্ষে বলেছেন। তার মতে, যে বই সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি করবে, সেই বই প্রকাশ করে সমাজে অশান্তি সৃষ্টি না করাই উত্তম। আর লেখক যখন সেই অশান্তি একবার তৈরি করেই ফেলেছেন, এখন আর শাস্তির ভয় না করাই উচিত হবে। কিন্তু শরৎচন্দ্রের মতে বিশৃঙ্খলা মানেই অমঙ্গল নয়, ভুলটাকে মেনে নেয়ার মাধ্যমেই সমাজের ক্ষতি হয়।
রবীন্দ্রনাথের পত্রের জবাবে শরৎচন্দ্রের জবাব কিছুটা তুলে ধরা হলো-
“নানা কারণে বাংলা ভাষায় এ ধরনের বই কেউ লিখে না। তাই আমি যখন লিখলাম, তখন সবদিক জেনেই লিখেছি। কিন্তু বাংলাদেশের গ্রন্থকার হিসেবে যদি মিথ্যার আশ্রয় না নিয়ে থাকি এবং তা সত্ত্বেও যদি রাজশাস্তি ভোগ করতে হয় তো করতেই হবে, তা মুখ বুজেই মেনে চলি কিন্তু প্রতিবাদ করা কি উচিত নয়?
আমার প্রতি আপনি এই অবিচার তুলেছেন যেন আমি শাস্তি এড়াবার ভয়েই প্রতিবাদের ঝড় তুলেছি,কিন্তু বাস্তবিক তা নয়। দেশের লোকে যদি প্রতিবাদ না করে তবে আমাকেই করতে হবে তবে হৈ চৈ করে নয়, আরেকখানা গ্রন্থ লিখে”।
নিজের অবস্থান সম্পর্কে আপোষ নয়, বরং জোরালো মন্তব্যের মধ্য দিয়ে প্রতিবাদের অবস্থান দৃঢ় করেছেন এখানে তিনি।