তারা এলো, সবকিছু খুঁড়ে ফেললো, জ্বালিয়ে দিল, লুটে নিল, এরপর চলে গেল
উপরের এই বাক্যটিই যথেষ্ট কোনো এক ভয়াবহ আক্রমণকে অতি সংক্ষেপে প্রকাশের জন্য। সেটাও যেন-তেন কোনো আক্রমণ না। বরং মানবজাতির ইতিহাসে কালো অধ্যায় হয়ে টিকে থাকা চেঙ্গিস খানের হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞকে ইঙ্গিত করেই বলা হয়েছে এই কথাটি। অথচ কী আশ্চর্য, যে মানুষটি চেঙ্গিস খানের সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণ ছিলেন, যিনি মঙ্গোলদের সামনে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়তে থাকা প্রতিরোধকে পুনরুজ্জীবিত করে তুলেছিলেন, খাওয়ারিজম সাম্রাজ্যের সেই মহান বীর সুলতান জালালুদ্দিন খাওয়ারিজম শাহকেই আমরা অনেকে চিনি না, জানার চেষ্টাও করি না। সবচেয়ে বড় কথা, কেন যেন ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই চরিত্রকে সেভাবে পরিচিত করানোর চেষ্টাও করা হয় না!
সেই আক্ষেপ থেকেই মাওলানা ইসমাইল রেহান ‘শেরে খাওয়ারিজম জালালুদ্দিন খাওয়ারিজম শাহ আওর তাতারি ইয়ালগার’ বইটি রচনা করেন উর্দু ভাষায়। আর বাংলা ভাষায় সেই সুবিশাল গ্রন্থেরই সংক্ষিপ্ত অনুবাদ হিসেবে কিছুদিন আগে প্রকাশিত হলো ‘সুলতান জালালুদ্দিন খাওয়ারিজম শাহ’ বইটি, যার ভাষান্তরের দায়িত্ব পালন করেছেন সুলেখক ইমরান রাইহান। বাংলা ভাষার পাঠকদের হাতে বইটি তুলে দিয়েছে কালান্তর প্রকাশনী।
‘সংক্ষিপ্ত অনুবাদ’ কথাটি বইয়ের মলাটেই উল্লেখ করা, বইয়ের ভেতরেই উল্লেখ করেছেন অনুবাদক নিজেও। তবে এই ‘সংক্ষিপ্তকরণ’ যেন আবার পাঠকের জন্য বইয়ের মূল স্বাদ আস্বাদনে বাধার কারণ না হয়ে দাঁড়ায় সেখানেও সতর্ক নজর ছিল অনুবাদকের। তাই তো মূল বইয়ের গুরুত্বপূর্ণ কিছুই বাদ দেননি তিনি। তবে হ্যাঁ, যেখানে সংক্ষিপ্ত আলাপেই কাজ হয়ে যায়, সেখানে বিস্তারিত আলাপে যাওয়া থেকেও নিজেকে সযত্নে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। পাশাপাশি প্রয়োজনমতো সাম্প্রতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে নিজের পর্যবেক্ষণও জুড়ে দিয়েছেন, যাতে পাঠকের বইচলাটা (‘পথচলা’ পুস্তকীয় সংস্করণ!) আরও সহজ হয়ে যায়।
বইয়ের ভেতরে যাবার আগে এর শুরুর দিক নিয়েই বেশি আলাপ হয়ে যাচ্ছে- তবে আসলে এই বইটি সেই আলাপের যোগ্য দাবিদারও বটে। তবে পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি না ঘটিয়ে বইয়ের ভেতরে প্রবেশের আগে অন্য যে গুরুত্বপূর্ণ অংশের কথা না বললেই নয়, তা হলো এর ‘ভূমিকা’। এই অংশটা বেশ বড়; প্রায় বিশ পৃষ্ঠা জুড়ে মূল লেখক এখানে সুলতান জালালুদ্দিনের জীবনের বিভিন্ন বিষয় বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন, তৎকালীন পরিস্থিতিকে তুলে ধরেছেন। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে অংশটি তা হলো “সুলতান জালালুদ্দিনকে অবমূল্যায়নের কারণসমূহ”। বেশ কিছু যৌক্তিক পয়েন্টের মাধ্যমে তিনি এই বই রিভিউয়ের একেবারে প্রথম অনুচ্ছেদে উল্লেখিত হতাশার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন।
এবার আসা যাক মূল বইয়ের আলোচনায়।
যদিও এটি একজন ব্যক্তির জীবনী, তার জীবনসংগ্রামের কাহিনী- তবে বই পড়ার সময় এসব ভুলেও মনে হবে না। বরঞ্চ মনে হবে, কোনো এক রোমাঞ্চকর যুদ্ধোপন্যাস পড়ছেন আপনি, পড়ছেন ধ্বংস আর হত্যাযজ্ঞের নির্মম বর্ণনা আর সেখান থেকে উঠে দাঁড়াবার নিরন্তর প্রয়াসের কথা। এখানেই মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন লেখক। তিনি বইয়ের কাহিনী এমনভাবে এগিয়ে নিয়েছেন যে তাশখন্দ, সমরকন্দ, বুখারার মতো নানাবিধ শহরের পতন আর বইয়ের পাতায় আটকে থাকেনি, বরং তা যেন পাঠক নিজের চোখের সামনেই দেখতে পারবে, সেখানকার মানুষদের আর্তনাদ যেন তাদের বুকে শেলের মতোই এসে বিঁধবে। আর বাংলা ভাষায় কাহিনী বর্ণনার এই গতিধারা অব্যহত রেখেছেন অনুবাদক ইমরান রাইহান। বইটি যে ভাষান্তরের মতো এমন একটি পরিশ্রমসাধ্য প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গিয়েছে, বাংলা বইটি পড়ার সময় তা একবারের জন্যও মাথায় আসবে না।
বইয়ের একেবারে শেষে ‘সুলতান জালালুদ্দিনের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধসমূহ‘ শিরোনামে সংযুক্ত মানচিত্রটির কথাও না বললেই নয়। বইয়ের কাহিনীগুলো পড়বার সময় এই মানচিত্রটি ধরে ধরে এগোলে ঢাল-তলোয়ারের ঝনঝনানি, আহত সৈনিকদের আর্তনাদ আর সাহসী সেনাদের বীরত্ব যেন আরও ভালোভাবে ভূপ্রকৃতি বুঝে বুঝেই পড়তে পারবেন পাঠক।
কেউ যদি মনে করেন পুরো বইটি সুলতান জালালুদ্দিন খাওয়ারিজম শাহর স্তুতিবাক্যে পরিপূর্ণ, তাহলে তিনি ভুল করছেন। কারণ জায়গামতো তার সমালোচনা করতেও ছাড়েননি মূল লেখক, এবং সেটা অবশ্যই ঐতিহাসিক নানা দলিলের সাহায্য নিয়েই। ফলে একজন কিংবদন্তিতুল্য ব্যক্তি হলেও দিনশেষে তিনিও যে একজন রক্তমাংসেরই মানুষ, যিনি কোনোভাবেই ভুলের উর্ধ্বে নন, সেটাও বেশ পরিষ্কার হয়ে ওঠে শেষের দিককার ‘সুলতান জালালুদ্দিন সমালোচনা ও পর্যালোচনা‘ এবং ‘সুলতান জালালুদ্দিনের ব্যর্থতার কারণ‘ অধ্যায় দুটো পড়লে।
তৎকালীন বিশ্বমানবতার কাছে ত্রাসের নামান্তর তাতারদের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধকারী ছিলেন এই জালালুদ্দিনই। মোটা দাগে যুদ্ধে জয় ও পরাজয় নামে দুটো ফলাফল থাকলেও অনেক সময় পরাজিত পক্ষের প্রতিরোধও এমন সুদূরপ্রসারী বিক্রিয়ার জন্ম দিয়ে যেতে পারে, যার ফলাফল বোঝা যায় বেশ লম্বা সময় পরে। ঠিক এই কাজটিই করেছিলেন সুলতান জালালুদ্দিন। সব যুদ্ধে ফলাফল নিজের পক্ষে না আনতে পারলেও তার দেয়া প্রতিরোধের দেয়াল না থাকলে অনেক আগেই মুসলিমরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারত। ফলে একেবারে শেষে যখন এই মানুষটি ক্রমাগত গাদ্দারির শিকার হতে থাকে, যখন তার অন্তর্ধানের অমীমাংসিত রহস্য আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়, তখন অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে, মন বলে ওঠে,
আহ সুলতান জালালুদ্দিন!
দুনিয়াপ্রেমী মুসলিম শাসকেরা বুঝল না;
তারা কাকে ফিরিয়ে দিলো!
কার সঙ্গে তারা বিশ্বাসঘাতকতা করল!
হায় সুলতান জালালুদ্দিন!
স্বার্থান্ধ মুসলিম শাসকেরা টেরও পেল না;
তারা কাদের ডেকে আনল!
কাদের হাতে নিজেদের সবটাই তুলে দিলো…
ইতিহাসের এক মহান বীর, এক সাইলেন্ট গার্ডিয়ান সম্পর্কে জানতে তাই অল্প কিছুদিন আগেই বাংলা ভাষায় বের হওয়া এই বইটি সংগ্রহ করুন দ্রুতই; সমৃদ্ধ করুন আপনার লাইব্রেরির কালেকশনও।
…
বই: সুলতান জালালুদ্দিন খাওয়ারিজম শাহ
মূল: ইসমাইল রেহান
ভাষান্তর: ইমরান রাইহান
প্রকাশক: কালান্তর প্রকাশনী
পৃষ্ঠাসংখ্যা:
মুদ্রিত মূল্য: ৩০০/-
সুলতান জালালুদ্দিন খাওয়ারিজম শাহ বইটি সংগ্রহ করুন রকমারি থেকে।