ইংমার বার্গম্যানের ‘সামার ইন্টারল্যুড’ সিনেমার শুরু হয় মন্তাজ দিয়ে। মিড লং শটে গাছপালার ফাঁক দিয়ে একটা বাড়িকে ধরেছে ক্যামেরা। তারপর খরস্রোতা নদীর পানির কলকল শব্দসহ প্রকৃতির নানান সৌন্দর্যকে ধরেছে। ব্যাকগ্রাউন্ডে বেজে চলেছে পাখির কিচিরমিচির শব্দ। গ্রীষ্মের দাবদাহে নয় বরং শরতের কোমল ছোঁয়ায় শুরু এবং শেষ হয় এই সিনেমা। তবে খুব কাছ থেকে খেয়াল করলে বুঝতে পারা যায়, ঠিক গ্রীষ্ম কিংবা শরতে নয়, বরং বসন্তের সময়টাতেই শ্যুট করা হয়েছে এই সিনেমা। প্রারম্ভিক দৃশ্যের মন্তাজে, ব্যাকগ্রাউন্ডে কোকিলের ডাক আর গাছে নতুন মুকুল বের হওয়া দেখেই সেটি নিশ্চিত হওয়া যায়। প্রারম্ভিক দৃশ্যে এই মন্তাজ ব্যবহার করেই গোটা সিনেমার আবহটাকে ঠিক করেছেন বার্গম্যান।
এই শান্ত, ধীর, নিবিড় প্রকৃতিটাই সিনেমার প্রকৃতি। পরিবর্তনের যে পালাগান এই দৃশ্যে বেজে ওঠে, তা গোটা সিনেমাতেই বেজে বেজে উঠে ছিন্ন খঞ্জনীর মতো। শুধু তা-ই নয়, সিনেমার ন্যারেটিভকে এগিয়ে নেবে, এমন কিছু উপাদানের পরিস্থিতি এই মন্তাজেই পাওয়া যায়। যেমন- নদীর পাশে জমা বড় বড় পাথর। এই পাথরই মূল ক্লাইম্যাক্সে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই একদিক থেকে শুরুর এই মন্তাজে বেশকিছু ফোরশ্যাডোয়িং (সিনেমার গল্পে ভবিষ্যতে কী হবে, তার পূর্বাভাস প্রদান করার পদ্ধতি)-এর আলামত খুঁজে পাওয়া যায়।
মন্তাজের পর সিনেমা চলে যায় একটা থিয়েটারে। কেন্দ্রীয় চরিত্র ম্যারি সেই থিয়েটারেই রিহার্সাল করে। একজন সফল ব্যালেরিনা সে। ‘সোয়ান লেক’ ব্যালের রিহার্সাল ছিল সেদিন। কিন্তু সকাল থেকেই কেন যে সেদিন সবকিছু ঠিকঠাক নেই, এমন একটা আভাস ভেসেভেসে আসছিল। এরমাঝেই একজন একটা ডায়েরি দিয়ে গেল থিয়েটারের ম্যানেজারকে। ম্যারির তরফে পাঠিয়েছে কেউ। ব্যালের জন্য ম্যারি তখন প্রস্তুত করছিল নিজেকে। ডায়েরিটা হাতে পাওয়ার পর তা ওল্টাতেই কেমন যেন বদলে যায় সে। বিমর্ষ হয়ে পড়ে, কিন্তু বাইরে যতটা সম্ভব মনের ভাব অপ্রকাশিতই রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। রিহার্সালের ডাক পড়ে যাওয়াতে ডায়েরিটা নিয়ে আর বেশি ভাবার অবকাশ হয়নি তখন।
সোয়ান লেক ব্যালে করতে গিয়ে হঠাৎ করেই থামতে হলো থিয়েটারের আলো চলে যাওয়াতে। এমনটা হয়না সচরাচর। কিন্তু সেদিন হলো। অগত্যা হাতে সময় আছে দেখে ম্যারি বেরিয়ে পড়লো ডায়েরি নিয়ে। ভয়েসওভার ন্যারেশান থেকে দর্শক জানতে পারে, এই ডায়েরি ম্যারির কিশোরকাল থেকে যৌবনে পদার্পণের সময়কার প্রথম প্রেমিক হেনরিকের। ম্যারি সিদ্ধান্ত নেয়, যে ফেরিতে হেনরিকের সাথে তার প্রথম দেখা হয়েছিল, সেই ফেরিতে চড়ে ১৩ বছর আগে ফিরে যাবে সে।
শুরু হয় ম্যারির অতীতের পথে যাত্রা। ভয়েসওভার ন্যারেশানেই ম্যারি, হেনরিকের সাথে তার পরিচয় এবং প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে ওঠার ঘটনাদি বলতে থাকে। তার বলার ভঙ্গিতেই বোঝা যায়, কতটা গভীর ভালোবাসা ছিল তাদের মাঝে। এ-ও বোঝা যায়, হৃদয়বিদারক নিষ্পত্তি ঘটেছে এ সম্পর্কের। ম্যারি যে সে শোক আজো কাটিয়ে উঠতে পারেনি, তা তার বর্তমান পরিস্থিতি দেখেই আঁচ করতে পারা যায়। ১৩ বছর পর এই ডায়েরির ছুতোয় অতীতের সে পথে ম্যারি ফের এগোচ্ছে সবকিছুর অবসান ঘটাতে। কারণ, অতীতকে মুছে ফেলা সম্ভব তখনই হবে, যখন আরো একবার অতীতের মুখোমুখি নিজেকে দাঁড় করানো যাবে। কেন ইতি ঘটেছিল সে সম্পর্কের, কোথায় আছে হেনরিক (?)- এমন সকল প্রশ্ন উত্থাপন করে অতীত আর বর্তমানকে যুগপৎভাবে বর্ণনা করে এগিয়ে যায়, সামার ইন্টারল্যুড বা সমারলেক।
‘ইংমার বার্গম্যান’- এ নামটি শোনা থাকলে, তাকে আর নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার দরকার পড়ে না। এককথায়, সুইডিশ এই চলচ্চিত্র পরিচালককে অভিহিত করা হয় চলচ্চিত্র ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে। সর্বকালের অন্যতম দক্ষ এবং প্রভাবশালী পরিচালক তিনি। ‘দ্য সেভেন্থ সিল’, পারসোনা’, ‘ওয়াইল্ড স্ট্রবেরিজ’, ‘ক্রাইস অ্যান্ড হুইস্পারস’, ‘স্মাইলস অভ আ সামার নাইট’- বিখ্যাত এই সিনেমাগুলো তার ক্যারিয়ারের শ্রেষ্ঠ সব মাইলফলক। তবে ওই সিনেমাগুলোর আগেই নির্মিত হয়েছে সামার ইন্টারল্যুড। তবু সেভাবে কথা হয় না এই সিনেমা নিয়ে। কিন্তু বার্গম্যান নিজেই এটিকে তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সিনেমা এবং নিজের বানানো প্রথম ব্যক্তিগত সিনেমা হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
পরিচালকের একথার সূত্র ধরে গভীরে দেখতে গেলেই দেখা যায়; সামার ইন্টারল্যুড মূলত বার্গম্যানকে ‘বার্গম্যান’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। চলচ্চিত্রে একদম নিজস্ব যে ভঙ্গী আর নন্দনতত্ত্ব তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তার সূচনা হয়েছে এই সিনেমাতেই। এই সিনেমার নানান ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র উপাদানেই প্রোথিত আছে তার পরবর্তীর অনেক সিনেমার বীজ। যেমন একটি দৃশ্যে দেখা যায়; সিনেমার দুই চরিত্র ম্যারি এবং হেনরিকের কথামালার পিঠে ম্যারি হঠাৎ হেনরিককে ওয়াইল্ড স্ট্রবেরিজ খাওয়ার আহব্বান করে, যেটি বার্গম্যানের পরবর্তীকালের বিখ্যাত সিনেমার নাম। আবার আরেকটি দৃশ্যে দেখা যায়; হেনরিকের অসুস্থ আন্টি উকিলের সাথে দাবা খেলছে এবং নিজেকে মৃত্যু বলে সম্বোধন করছে। এই দৃশ্যটি মনে করায় বার্গম্যানের পরবর্তী সময়ের ক্লাসিক সিনেমা দ্য সেভেন্থ সিলের মৃত্যুর সাথে দাবা খেলার বিখ্যাত সেই দৃশ্যের কথা।
এই সিনেমার গল্প নেওয়া হয়েছে বার্গম্যানের নিজের জীবনের গল্প থেকেই। তার নিজের শৈশবের প্রথম প্রেমের গল্প এই সিনেমায় প্রতিভাসিত হয়েছে। প্রথম প্রেমের স্মৃতিচারণ আর ভেঙে যাওয়ার অনুতাপ নিয়েই তিনি একটি ছোটগল্প লিখেন ‘মারি’ নামে। সেই ছোটগল্পই এই সিনেমার চিত্রনাট্য লেখার নেপথ্যে কাজ করছে। সিনেমার নির্মাণকালে নিজের ব্যক্তিজীবনও বেশ জীর্ণতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। দ্বিতীয় বিয়ে, থিয়েটার পরিচালক হিসেবে নিজের আসন হারানোসহ নানাবিধ ঘটনা। এই কথাগুলো আসছে কারণ, এইসব কিছুকে একত্র করে সেগুলোর মাঝে থাকা বিষাদ আর আবেগকে নিংড়ে তিনি এই সিনেমার চিত্রনাট্যে ঢেলেছেন। আরো নির্দিষ্ট করে বললে, ম্যারির চরিত্রটাতে ঢেলেছেন। এই চরিত্রের মাঝে সেই নিগূঢ় বিষাদ আর হতাশা যেমন জন্ম নিয়েছে অতীত থেকে, ব্যক্তি বার্গম্যানেরও তেমন। সামার ইন্টারল্যুড তাই প্রথম প্রেম, ভালোবাসা আর যৌনতার জাগরণে বার্গম্যানের শ্রদ্ধাঞ্জলিস্বরূপ সিনেমা।
সামার ইন্টারল্যুডের বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে ফ্ল্যাশব্যাক। একরকম ফ্ল্যাশব্যাকেই এগিয়েছে সিনেমার গোটা ন্যারেটিভ। ফ্ল্যাশব্যাকে ১৩ বছর আগে ম্যারি এবং হেনরিকের পরিচয়ের মুহূর্তটি থেকে একে অপরের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করা, প্রেমে পড়া, সম্পর্ক আরো গভীর হওয়া এবং তার বিষাদপূর্ণ পরিণতির সম্পূর্ণ চিত্র উঠে আসে। বর্তমানটা এখানে শুধুমাত্র ব্যবহৃত হয়েছে, দর্শককে প্রাপ্তবয়স্কা ম্যারি এবং অতীতের ভূত দ্বারা যে সে তাড়িত হচ্ছে, সেটুকু সময়ে সময়ে মনে করিয়ে দিতে। তবে ভয়েসওভার ন্যারেশান সিনেমায় খুব একটা কার্যকরী ভূমিকা পালন করেনি। কেননা, ম্যারি অতীতের ঘটনাগুলো দেখছে, কাউকে বয়ান করছে না। সেটা ভিজ্যুয়ালিই উপস্থাপিত হয়েছে ফ্ল্যাশব্যাক টেকনিকে। আর চিত্রনাট্যে বিবরণ এতখানি গাঢ় ছিল, তা সহজেই বোধগম্য হয় দর্শকের কাছে। ভয়েসওভার সেক্ষেত্রে বরং স্থূল একটা সিদ্ধান্ত হয়ে ছিল। ক্ষতি করেনি, তবে না থাকলে গোটা বিষয়টি আরো চতুর হতো।
বার্গম্যানের ক্যারিয়ারের প্রথমদিকের, অর্থাৎ ৪০ দশকের শুরুর দিকের সিনেমাগুলো পুরুষ মনস্তত্ত্ব নির্ভর বিশ্লেষণীয় সিনেমা। এরপর তিনি সেদিক থেকে ভেড়েন দাম্পত্যের সম্পর্কে, যা তাঁর ‘পোর্ট অভ কল’ (১৯৪৮), ‘থার্স্ট’ (১৯৪৯) সিনেমাগুলো দেখলে নিশ্চিত হওয়া যায়। ৫০-এর শুরুতে, মূলত এই সামার ইন্টারল্যুড দিয়েই বার্গম্যান নারী মনস্তত্ত্বের গভীরে বিচরণ শুরু করেন। এই সিনেমায় ম্যারি চরিত্রটিকে ব্যাপৃত করতেই বাকি চরিত্রদের আনাগোনা। চরিত্রটির জীবনের প্রতি বিবিধ মনোভাবকে তুলে ধরতে চেয়েছে সিনেমা। বৃহদার্থে, নেতিবাচক মনোভাব। জীবনের অর্থহীনতা নিয়ে আলোচনা করতে চেয়েছে এই সিনেমা, এবং তা শিল্পের মধ্য দিয়ে।
ব্যালেরিনা ম্যারি শিল্পের জন্য নিজের সর্বস্বকে যেভাবে উজাড় করে দিয়েছে, তার সেই শিল্পীসত্ত্বার মাঝ দিয়ে বার্গম্যান শিল্পের প্রকৃতি এবং একজন শিল্পীর আত্মার গভীরে অনুসন্ধান চালিয়েছেন। শিল্প কতখানি পরিতোষ জাগাতে পারে মানবমনে, তা তলিয়ে দেখতে চেয়েছেন। মানুষের নিজের ভেতরকার জীর্ণতা, অশান্তিকে দূর করতে সৃষ্টিশীল কিছুকে বা কোনো মাধ্যমকে আলিঙ্গন করে নিলে সেই মাধ্যম মানবমনে সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর রূপে প্রতিষ্ঠত হতে পারে- এ বক্তব্যই প্রতিফলিত হয়েছে বার্গম্যানের এই সিনেমায় এবং বাকি সিনেমাগুলোয়ও। তাইতো ম্যারি সবকিছুকে ভুলে থাকে তার ব্যালে নৃত্যের মধ্য দিয়ে। যেমন করে, দ্য সেভেন্থ সিল সিনেমায়ও দেখা যায় ‘নাইট’ চরিত্রটি শান্তি খুঁজে পায় একটি শিল্পীদলের সান্নিধ্যে।
ম্যারি চরিত্রটিকে পর্দায় অনবদ্য শৈলীতে রূপায়ন করেছেন অভিনেত্রী ম্যাজ-ব্রিত নিলসন। পরিচালক বার্গম্যানের অন্যান্য সিনেমাগুলো দেখলে চোখে পড়ে, তার সিনেমার নারীরা কখনো অগভীর কোনো সমস্যায় ভোগে না। নারী চরিত্রগুলো আশপাশের কিংবা গল্পের পৃষ্ঠতলে সৃষ্ট জটিলতায় বাঁধা পড়ে না। তাদের সমস্যা, জটিলতার সৃষ্টি একেবারে মূলে, যা লক্ষণীয় ম্যারি চরিত্রটিতেও। ম্যারির সকল জটিলতার সৃষ্টি সেই অতীতে। সেসব জটিলতা স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয় নিলসনের অভিনয়ে। কৈশোরের সময়টায় লাজুক আর চপলতার মিশ্রণে যে অভিনয়টা তিনি দিয়েছেন, তাতে তাকে প্রাপ্তবয়স্ক একজন অভিনেত্রী মনে হওয়ার জো নেই। আবার বর্তমানের সময়টায় যখন তাকে আয়নার সামনে সাজ নিতে দেখা যায়, তখন তার ওই কঠিন মুখটা দেখলেই আঁচ করতে পারা যায়, এই নারী আবেগকে জমিয়ে এবং অবদমিত রেখে নিজেকে দৃঢ়চিত্ত করে তুলেছেন।
সামার ইন্টারল্যুড বার্গম্যানের পূর্বের সকল কাজগুলোর তুলনায় পরিণত এবং অনন্য হয়ে উঠেছে এর ভিজ্যুয়াল ল্যাঙ্গুয়েজের কারণে। পূর্বের কাজগুলোতে মঞ্চের কিছুটা প্রভাব থাকতো, যেহেতু তিনি মঞ্চ পরিচালনায়ও সিদ্ধহস্ত ছিলেন। অভিনয়শিল্পীদের অভিনয়ে কিছুটা মঞ্চের ভাব থাকলেও, চলচ্চিত্র মাধ্যমটির নিজস্ব ভাষা এবং গঠনবিন্যাসের নিখুঁত ব্যবহার তিনি প্রথম এই সিনেমাতেই সফলভাবে করেছেন। কাব্যিকতায় পূর্ণ এর ভিজ্যুয়াল। গোটা আবহটায় ছড়িয়ে আছে কাব্যিক মূর্ছনা। আবেগের তীব্রতা এই সিনেমার ইমেজারিগুলোতেই দৃশ্যমান। একদম প্রথমদিকের সেই ব্যালে নৃত্যের দৃশ্যটাকেই ধরা যাক; নিখুঁতভাবে কোরিওগ্রাফ করার পাশাপাশি ব্যবহার করা আবহসঙ্গীত একটা পরাবাস্তব অনুভূতি জাগায়, যা খানিক বাদে অন্ধকারে ভেসে আসা চিৎকারে ধুম করে নেমে আসে বাস্তবে।
একটি সিঙ্গেল ইমেজারিতে এভাবে একাধিক অনুভূতি জাগিয়ে মানবীয় আবেগের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করেছেন তিনি, শিল্পের বিমূর্ত রূপকেও ধরার পাশাপাশি। সিনেমাটোগ্রাফার গুনার ফিশারকে সাথে নিয়ে সাদা-কালো সিনেমাটোগ্রাফি আর হার্ড লাইটিংয়ে বার্গম্যান, তার এই সিনেমায় জার্মান এক্সপ্রেশনিজমের ভাবটা এনেছেন। ইনডোর দৃশ্যগুলোতে সেটা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ফিশারের শট কম্পোজিশনের টেক্সচার, গভীরতা, ভারসাম্য খুবই শৈল্পিক এবং নান্দনিক। ফ্রেমের মাঝে ফ্রেম, আয়নার স্বতঃস্ফূর্ত ব্যবহার করে রূপকার্থে ম্যারির বিষণ্ণতাকে দৃশ্যমান করা হয়েছে সিনেমায়। ক্লোজআপ শটগুলোকে দীর্ঘক্ষণ ধারণ করে বার্গম্যান দর্শককে সময় দিয়েছেন চরিত্রের মনস্তত্ত্ব বুঝতে। এটিকে নিজের একটি স্বকীয় স্টাইল হিসেবেও প্রতিষ্ঠা করেছেন পরবর্তী সময়ে।
ভিজ্যুয়াল এই সিনেমাকে অনন্য মাত্রা তো দিয়েছেই, তবে সে সৌন্দর্য উপভোগের অভিজ্ঞতা আরো পরিপূর্ণ করেছে সিনেমাটির সম্পাদনাকর্ম। চিত্রনাট্য একহাতে নিয়ে আরেকহাতে শটের পর শট জোড়া লাগালেই তো আর ভালো সম্পাদনা হয় না। সম্পাদনা সিনেমার মাঝে প্রাণের সঞ্চার ঘটায়। আর সে প্রাণ কতটা প্রাণবন্ত হবে, তা নির্ভর করে সম্পাদকের বুদ্ধিদীপ্ততা এবং বিচক্ষণতায়। বার্গম্যানের সামার ইন্টারল্যুডের আগের সিনেমাগুলো পাশে রেখে দেখলেই পরিবর্তনটা সুস্পষ্টভাবে ধরতে পারা যাবে। অতীত আর বর্তমান নিয়ে যেভাবে আগেপিছে করে গল্প এগিয়েছে, সম্পাদনায় ধারাবাহিকতাটা একটু হারালেই নষ্ট হতো সংহতি। ম্যারির হাতে ডায়েরি। ইনসার্ট শটে ডায়েরিটা দর্শককে কাছ থেকে দেখানোর সময় ডায়েরির পাতায় ধীরে ধীরে ভেসে উঠতে থাকে হেনরিকের মুখ- সম্পাদনায় এই দৃশ্যে ডিজলভ প্রক্রিয়ার ব্যবহারটা অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটা উদাহরণ হয়ে থাকবে। তা গোটা সিনেমার এবং এই প্রক্রিয়ার- দুই বিচারেই।
পরিশেষে, সামার ইন্টারল্যুডের চমৎকারিত্বকে স্বল্পকথায় ধরতে গেলে বিখ্যাত ফরাসি চলচ্চিত্র পরিচালক ‘জাঁ-লুক গদার’-এর মন্তব্যটাই টেনে আনতে হয়,
“চলচ্চিত্র ইতিহাসে এমন পাঁচ কি ছ’টা সিনেমা আছে, যেগুলোকে কেউ শুধুমাত্র ‘এটি সর্বাপেক্ষা সুন্দর সিনেমা’ কথাটি বলেই রিভিউ করতে চায়। কারণ, এরচেয়ে বড় প্রশংসা আর থাকতে পারে না।”