ডিসির জনপ্রিয় সুপারহিরোদের প্রথমবারের মতো লাইভ অ্যাকশনের পর্দায় দেখার যে আকুতি ছিল, তার কিছুই পূরণ করতে পারেনি ২o১৭ সালে মুক্তি পাওয়া ‘জাস্টিস লিগ’। মুভিটি নির্মাণের শুরু থেকেই জন্ম নিচ্ছিল নানা বিতর্ক। বেশ কয়েকবার স্ক্রিপ্ট পুনর্লিখন, শেষে পরিচালক বদল, রানটাইম কমিয়ে আনা এবং সিজিআই বিপর্যয়ে ফ্যানরা চরম হতাশ হয়। এর ফাঁকেও আশার একটি আলো মিটমিট করে জ্বলছিল, যার নাম স্নাইডার কাট। স্টুডিওসহ অনেকেই একসময় বলেছিলেন, বাস্তবে এ স্নাইডার কাটের কোনো অস্তিত্ব নেই। কিন্তু স্নাইডার এবং ফ্যানরা হার মানেনি। অবশেষে সবাইকে অবাক করে সেই অবাস্তব স্নাইডার কাট মুক্তি পেতে যাচ্ছে আগামী বছর। তো স্নাইডার কাট আসলে কী? চলুন একেবারে শুরু থেকে জেনে আসা যাক।
সুপারম্যান রিটার্ন্সের ব্যর্থতার পর ক্রিস্টোফার নোলান এবং ডেভিড গয়ার আধুনিক সময়ের সুপারম্যানের একটি ধারণা তুলে ধরেন স্টুডিওর কাছে, যেটা পছন্দ হয় তখনকার ওয়ার্নার ব্রসের প্রেসিডেন্ট জেভ রবিনভের। তখনও তাদের সেভাবে ওয়ার্ল্ড অফ ডিসি নিয়ে বড় কোনো পরিকল্পনা ছিল না। তারা চেয়েছেন এই মুভি ম্যান অফ স্টিলের মাধ্যমেই বড় একটি ইউনিভার্সের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। ২০১০ এর অক্টোবরে সেই মুভিটি পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয় জ্যাক স্নাইডারকে। ২০১৩ সালে মুক্তি পাওয়া ম্যান অফ স্টিল সফল ছিল। স্নাইডারও মুভিতে বেশ কিছু ইস্টার এগ ব্যবহারের মাধ্যমে বুঝিয়েছিলেন, তারা একটি বড় সুপারহিরো ইউনিভার্সের দিকে এগোচ্ছেন।
স্টুডিও তখন আরো বড় পরিসরে পরিকল্পনা শুরু করে। যার ফলে ফ্যানদের অবাক করেই ২০১৩ স্যান ডিয়েগো কমিকনে স্নাইডার ঘোষণা দেন সুপারম্যানের সিক্যুয়েলের, যাতে লাইভ অ্যাকশনের পর্দায় প্রথমবারের মতো একসাথে দেখা যাবে সুপারম্যান এবং ব্যাটম্যানকে। যে মুভিটি ফ্র্যাংক মিলারের জনপ্রিয় কমিক ডার্ক নাইট রিটার্নস থেকে অনুপ্রাণিত হবে। মুভির টাইটেল ঠিক করা হয়, ব্যাটম্যান ভার্সাস সুপারম্যান: ডন অফ জাস্টিস। ২০১৪ সালেই ওয়ার্নার ব্রস তাদের ডিসি সুপারহিরো মুভি ইউনিভার্স প্রতিষ্ঠিত করতে দশটি মুভির ঘোষণা দেয়, যার মধ্যে ছিল দুই পর্বের জাস্টিস লিগ, যেগুলো পরিচালনা করবেন জ্যাক স্নাইডার।
কিন্তু যতটা আশা করা হয়েছিল ততটা সফল হয়নি ব্যাটম্যান ভার্সাস সুপারম্যান। বিশেষ করে অনেকেই দোষ দিচ্ছিলেন মুভিটি অতিরিক্ত ডার্ক হওয়াকে। পাশাপাশি খুব কম সময়ের জন্য ব্যাটম্যান আর সুপারম্যানের লড়াই, নো কিলিং রুল থেকে সরে আসা ব্যাটম্যান, কিংবা জনপ্রিয় রবিন ডিক গ্রেসনকে এবং জিমি ওলসেনকে মেরে ফেলা ইত্যাদি ঘিরেও বিতর্ক সৃষ্টি হয়। তবে এই মুভিকে কেন্দ্র করেই স্নাইডারের যে বেশ বড় একটি প্ল্যান ছিল তা কয়েকটি দৃশ্যেই আমরা বুঝতে পারি।
১. ফ্ল্যাশের টাইম ট্রাভেল।
২. ব্রুসের নাইটমেয়ার সিকুয়েন্স। যেখানে ওমেগা সাইন, প্যারাডিমন, ইভিল সুপারম্যানকে দেখা যায়।
৩. ব্যাটক্যাভে মৃত রবিনের স্যুট; যেগুলোর ব্যাখ্যা হয়তো স্নাইডার দুই পর্বের জাস্টিস লিগ মুভিতে তুলে ধরতেন।
এদিকে এ মুভিটি এবং সুইসাইড স্কোয়াড মুক্তির পর থেকেই যেটা সবার নজরে আসতে শুরু করে সেটা হলো স্টুডিওর অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ এবং মুভিতে অতিরিক্ত কাটছাট করা। বিভিএসের এডিটর ব্রেনার বলেন, মুভিটির মূল সংস্করণ ছিল প্রায় চার ঘন্টা দীর্ঘ!
যা-ই হোক, জাস্টিস লিগের প্রথম পর্বের শ্যুটিং শুরু হয় বিভিএস মুক্তির পরের মাসেই। ডিরেক্টর জ্যাক স্নাইডারের সাথে এবার স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসেবে যুক্ত হন ক্রিস টেরিও। স্নাইডার জানান, এই মুভিটি জ্যাক কারবির নিউ গডস থেকে অনুপ্রাণিত হবে। মুভির কাজ চলমান অবস্থায় স্নাইডারের মেয়ে আত্মহত্যা করে। ততদিনে মুভির শ্যুটিং অনেকটুকুই এগিয়ে গেছে। কমিকন ফুটেজের পাশাপাশি ট্রেলারও বের হয়েছে।
পরিবারকে সময় দিতে স্নাইডার মুভি থেকে সরে আসেন। কিন্তু পেছনের কাহিনী আরো পরে উন্মোচিত হয়, আমরা সেই আলাপে পরে আসছি। মুভির বাকি অংশের কাজ সমাপ্ত করার জন্য ওয়ার্নার ব্রাদার্স নিয়োগ দেয় প্রথম দুই অ্যাভেঞ্জার্স মুভির আলোচিত ডিরেক্টর জশ হোয়েডনকে। এরপর থেকেই আস্তে আস্তে বিতর্ক শুরু হয়।
হোয়েডন মুভির কম্পোজার জাংকি এক্সএলকে সরিয়ে নিয়ে আসেন ড্যানি এলফম্যানকে। যদিও স্টুডিও থেকে দাবি করা হয় স্নাইডার মুভির কাজ ৭০-৮০ ভাগই করে গিয়েছেন এবং হোয়েডন শুধুমাত্র অসমাপ্ত অংশের কাজই করবেন, যা ছিল অ্যাডিশনাল ফুটেজ, রিশ্যুট ইত্যাদি। স্নাইডারের ভিশন অনুযায়ীই মুভির কাজ শেষ করার ঘোষণা দেয়া হয়। কিন্তু মুভির পরের ট্রেলারে আগের সিন রিশ্যুটের পাশাপাশি ফাইনাল ফাইটের আবহই বদলে দেয়া হয়। রাতের স্বাভাবিক আকাশ হয়ে যায় লাল ফিল্টার যুক্ত।
মুভির রান টাইম ঘোষণা করা হয় ১১৯ মিনিট। যেখানে সলো মুভির দৈর্ঘ্যই সাধারণত ২ ঘণ্টার উপরে হয়ে থাকে, সেখানে টিম-আপ মুভির দৈর্ঘ্য ২ ঘণ্টারও কম হওয়াটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার। কিন্তু এরপরও ফ্যানরা হাল ছাড়েনি, আশায় বুক বেধে ছিল হয়তো বা আগের বিভিএস, সুইসাইড স্কোয়াডে নিজেদের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছে ওয়ার্নার ব্রাদার্স। নির্দিষ্ট সময়ে রিলিজ হয় মুভি এবং দেখা দেয় ভয়াবহ বিপর্যয়।
ট্রেলারের অনেক দৃশ্য গায়েব মুভি থেকে, সুপারম্যানের হাস্যকর সিজিআই, লেম জোকস, ব্যাটম্যানকে হাস্যকরভাবে উপস্থাপন- সমস্যার কোনো শেষ নেই। ফলাফল বক্স অফিসে ভরাডুবি। কিছুদিন পর আস্তে আস্তে থলের বেড়াল বের হতে শুরু করে। জানা যায়, ওয়ার্নার ব্রাদার্সের কর্মকর্তাদের স্নাইডারের শ্যুট করা অংশ দেখে খুবই ডার্ক মনে হয়েছে। এছাড়াও তারা শুরু থেকে চেয়েছিল মুভি ২ ঘণ্টার কমে আনতে। সেখানে তাদের কথা রাখতে স্নাইডার ৪ ঘণ্টার র’ ভার্সন কেটে আড়াই ঘণ্টায় নিয়ে আসেন। এতেও তারা রাজি হননি।
স্নাইডারকে বাদ দিয়ে হোয়েডনকে নিয়ে আসা হয় মুভির টোন লাইট করার পাশাপাশি কিছু ফানি সিন অ্যাড করার জন্য। এসবের পেছনে কলকাঠি নেড়েছেন ওয়ার্নার ব্রাদার্সের তৎকালীন সিইও কেভিন সুজিহারা। শেষ পর্যন্ত হোয়েডনের ফাইনাল কাট থেকেও অনেক সিন কেটে ২ ঘণ্টার কমে নিয়ে এসে মুভির জায়গায় শর্ট ফিল্মে পরিণত করা হয়। এছাড়াও মুভির দৈর্ঘ্য মাত্রাতিরিক্ত ছোট করার আরেকটি কারণ ছিল, কম দৈর্ঘ্যের মুভিতে বেশি শো পাওয়া যাতে বেশি আয় করা যায়।
সিজিআই বিপর্যয়ের আসল কারণও জানা যায়। জাস্টিস লিগের রিশ্যুট করার সময়ে হেনরি ক্যাভিল প্যারামাউন্টের মিশন ইমপসিবল মুভির কাজ করছিলেন। তখন ক্যারেক্টারের প্রয়োজনে তাকে গোফ রাখতে হয়। এদিকে স্নাইডারের আগের শ্যুট করা অংশে সুপারম্যান অর্থাৎ হেনরি ক্যাভিল ছিলেন ক্লিনশেভড। এ অবস্থায় তাকে আবার শেভ করিয়ে রিশ্যুট করাতে গেলে প্যারামাউন্টকে ক্ষতিপূরণ দিতে হত ওয়ার্নার ব্রাদার্সকে। তাই গোফ থাকা অবস্থাতেই ক্যাভিলের সিনগুলো রিশ্যুট করা হয়। সেই গোফ সিজিআই ব্যবহার করে ঢাকার জন্য মুভির সিজিআই টিমের কিছু অতিরিক্ত সময়ের প্রয়োজন ছিল। এখানেও বাগড়া দেয় ওয়ার্নার ব্রাদার্স তথা কেভিন সুজিহারা।
২০১৮ সালে ওয়ার্নার ব্রাদার্স এবং এটিএন্ডটি এর একত্রীকরণ হওয়ার কথা ছিল। সুজিহারা এবং তৎকালীন প্রেসিডেন্ট টোবি এমেরিখের এই একত্রীকরণ হওয়ার আগে বোনাস পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ২০১৭ এর নভেম্বরে মুক্তি পাওয়া জাস্টিস লিগ পিছিয়ে নিলে তাদের বোনাস না পাওয়ার আশংকা থাকে। শুধুমাত্র বোনাসের লোভে তারা মুভির মুক্তির তারিখ পেছাতে রাজি হননি এবং অসমাপ্ত সিজিআই দিয়েই মুভিটি মুক্তি দেয়া হয়। ফলাফল এখন সবাই জানে। এটা সহ আরো নানা বিতর্কে সুজিহারাকে পরবর্তীতে পদ ছাড়তে হয়, কিন্তু ততদিনে ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে গেছে।
মুভি মুক্তির দুই দিনের মধ্যেই ফ্যানদের সন্দেহ শুরু হয় মুভি নিয়ে। স্নাইডার যেরকম ডার্ক টোনে মুভি বানিয়ে থাকেন, জাস্টিস লিগ তার ধারে-কাছেও নেই। পিটিশন খোলা হয় জাস্টিস লিগ মুভির অরিজিনাল স্নাইডার কাট ভার্সন রিলিজ করার, ৫ দিনের মধ্যে সেটার পক্ষে ১ লাখ সাইনও হয়ে যায়। আস্তে আস্তে এর পক্ষে ফ্যানের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ফেসবুক, টুইটারে ট্রেন্ডিং হয়ে যায় ‘রিলিজ দ্য স্নাইডারকাট’ হ্যাশট্যাগ। এদিকে ফ্যানদের সমর্থন পেয়ে স্নাইডার নিজেও মুভির বিভিন্ন কেটে ফেলা অংশ আপলোড করতে থাকেন ভেরো নামক সোশাল অ্যাপে নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে। ফলাফল হয় আরো জোরালো। ওয়ার্নার ব্রাদার্সের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টগুলোর কমেন্ট ইনবক্স ভেসে যায় স্নাইডারকাট রিলিজের দাবিতে। টাইমস স্কয়ারের বিলবোর্ড থেকে শুরু করে স্যান ডিয়েগো কমিকনের উপর দিয়ে ‘রিলিজ দ্য স্নাইডারকাট’ লেখা নিয়ে উড়ে যায় ফ্যানদের ভাড়া করা প্লেন। এমনকি ইংলিশ এফএ কাপের ম্যাচেও দেখা যায় এই বিখ্যাত হ্যাশট্যাগ।
২০১৯ সালে মুভি রিলিজের দুই বছর পূর্তিতে ফ্যানদের সাথে মুভির কাস্টরাও যোগ দেয় এই আন্দোলনে। বেন অ্যাফ্লেক, হেনরি ক্যাভিল, গ্যাল গ্যাডটরা নিজেদের অফিশিয়াল সোশ্যাল অ্যাকাউন্ট থেকে এই হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করেন। আর জেসন মোমোয়া অনেক আগে থেকেই স্নাইডার কাটের পক্ষে থেকে কথা বলে আসছিলেন। তিনি এটাও দাবি করেন যে, স্নাইডার তাকে অরিজিনাল ভার্সন দেখিয়েছেন এবং তার কাছে সেটা অসাধারণ লেগেছে। শেষ পর্যন্ত ফ্যান, ডিরেক্টর এবং কাস্টদের এই যৌথ চাপে ওয়ার্নার ব্রাদার্স কর্তৃপক্ষ মাথা নত করে এবং স্নাইডার কাট রিলিজের সিদ্ধান্ত নেয়।
গত বছরের নভেম্বরে স্নাইডারের সাথে যোগাযোগ করা হয় এই ব্যাপারে এবং স্নাইডারের অরিজিনাল কাট এইচবিও ম্যাক্স স্ট্রিমিং সার্ভিসে রিলিজ দেয়ার সিদ্ধান্তে আসে দুই পক্ষ। যদিও করোনাভাইরাসের প্রকোপে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা পিছিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত মে মাসের ২০ তারিখে স্নাইডার ডিসিইইউতে তার প্রথম মুভি ম্যান অফ স্টিলের ওয়াচ পার্টির আয়োজন করেন, যেখানে সারপ্রাইজ গেস্ট হিসেবে আসেন হেনরি ক্যাভিল। ওয়াচ পার্টির শেষে ফ্যানদের প্রশ্নের জবাবে এইচবিও ম্যাক্সে জাস্টিস লিগ স্নাইডার কাটের ২০২১ সালে রিলিজের পোস্টার দেখানোর মাধ্যমে ওয়ার্নার ব্রাদার্সের বিরুদ্ধে তার এবং ফ্যানদের আড়াই বছরের ভার্চুয়াল লড়াইয়ের অবসান ঘটান। এর মাধ্যমে কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডের বিরুদ্ধে ফ্যানদের আবেগের জয়ই হলো শেষ পর্যন্ত।
আগামী বছরের মে মাসেই আসবে জ্যাক স্নাইডারের জাস্টিস লিগ। হয়তো চার ঘন্টার একটি মুভি হিসেবে অথবা ছয় পর্বের একটি সিরিজ আকারে এইচবিও ম্যাক্স স্ট্রিমিং সার্ভিসে রিলিজ দেয়া হবে এ কাট। ডিসি-ভক্তরা এখন অপেক্ষায় আছে আগামী বছরের। স্নাইডার কাট আসলেই অনেক ভাল হবে নাকি সিনেমা হলগুলোতে মুক্তি দেয়া সংস্করণ থেকে খারাপ হবে সেটা নিয়ে মাথা ঘামানোর চেয়ে তারা এখন দেখতে চায় এতদিনের সাধনার ফল আসলেই কী ছিল। ভাল-খারাপ না হয় দেখার পরেই বিবেচনা করা যাবে।