সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের মধ্যে চলমান দ্বন্দ্বের চিত্রায়ন হয়েছে বহুবার। অনেক নির্মাতা, লেখক, চিত্রকর তাদের কাজে এই দ্বন্দ্বের চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। বাংলা সিনেমার একজন পরিচালক মৃণাল সেন তাঁর সিনেমায় তুলে এনেছেন আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে থাকা দ্বন্দ্বের চিত্র। তাঁর নির্মিত ‘খারিজ’, ‘কলকাতা ৭১’ কিংবা ‘কোরাস’ সিনেমার রাজনৈতিক বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছেন শ্রেণীদ্বন্দ্বের চিত্র।
মৃণাল সেন ছাড়াও বাংলা চলচ্চিত্র জগতে সত্যজিৎ রায় একজন প্রবাদপুরুষ হিসেবে স্বীকৃত। দেশে এবং বিদেশে তাঁর পরিচিতি ব্যাপক। তাঁর নির্মিত সিনেমায় চিত্রায়িত রূপ নিয়ে প্রশংসা করেছেন অনেক চলচ্চিত্র রথী মহারথীরা।
পরিচালক মৃণাল সেন যেমন আমাদের সমাজের শ্রেণীদ্বন্দ্বকে ফুটিয়ে তুলেছেন, তেমনভাবে সত্যজিৎ রায় হয়তো পারেননি। তাঁর নির্মিত সিনেমা দেখলে এই ধারণা হতে পারে অনেকেরই। একেকটা সমস্যার চিত্র সত্যজিৎ রায় মূলত রূপকের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন।
সত্যজিৎ রায়ের মোটামুটি সব কাজ নিয়েই অনেকের প্রশংসার বার্তা শোনা যায়। তবে তাঁর কাজগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম আলোচিত হচ্ছে শর্ট ফিল্ম ‘টু’। অথচ ছোট্ট এই নির্মাণে তিনি তাঁর প্রতিভার বৃহদাংশ নিংড়ে দিয়েছিলেন। এর স্ক্রিনপ্লে আর মিউজিকেও তিনি নিজেই ছিলেন।
ইএসএসও ওয়ার্ল্ড থিয়েটার নামে একটি কোম্পানি সত্যজিৎ রায়কে একটি শর্ট ফিল্ম নির্মাণের অনুরোধ জানায়। সেটি করতে বলা হয় ইংরেজি ভাষায়। কিন্তু সত্যজিৎ রায় ইংরেজি ভাষায় করতে মনস্থির করতে পারেননি। ফলে তিনি কোনোরকম সংলাপের ব্যবহার না করেই নির্মাণ করেন ১৫ মিনিটের ‘টু’। এটি নির্মাণের জন্য তিনি মাত্র তিনদিন সময় পেয়েছিলেন। ফলে অল্প সময়েই তাকে কাজটি করতে হয়েছিলো। সাদা-কালো এই নির্বাক ছবিটি ভারতে ১৯৬৪ সালে মুক্তি পায়। এর অভিনেতা ছিলেন দুটি ৬-৭ বছরের শিশু। তাদেরকে কোনো কিছুই বলা হয়নি। শুধুমাত্র শট নেয়ার সময় তাদের অভিব্যক্তি এবং চলাফেরা পরিচালকের নির্দেশমতো করতে বলা হয়। পরবর্তীতে সম্পাদনার মাধ্যমে এর কাজ শেষ করা হয়।
কেমন ছিলো এই ফিল্মের কাজ? কী বার্তা ছিলো এখানে?
মূলত আমাদের সমাজের দ্বন্দ্বের চিত্র এবং শিশুদের মনের ধ্বংসাত্মক মনোভাবের চিত্র উঠে এসেছে এই ফিল্মে। এর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি শটেই একেকটি বার্তা লুকিয়ে আছে।
এই ছবির কাহিনী একটি ধনী ও একটি দরিদ্র ছেলেকে ঘিরে। তবে অন্যান্য কাহিনীর মতো এত সাদামাটা কাহিনী নয় এটি। যদিও ঘটনা পরম্পরা সাদামাটাই মনে হবে দর্শকদের কাছে।
প্রথম শটেই দেখানো হয়, কলকাতার একটি দোতলা বাড়ির বারান্দায় একটি ৭-৮ বছরের ছেলে মাথায় মিকি মাউসের ক্যাপ এবং হাতে কোকাকোলার বোতল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেই বাড়ির ইমারতগুলো যেন শোষণ করা জমিদারদেরই মনে করিয়ে দেয়।
সে নিচে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে থাকা গাড়িতে অবস্থান করা তার মায়ের সাথে হাত নেড়ে বিদায় নিচ্ছে। ধনী পরিবারের সন্তানেরা তাদের বাবা কিংবা মাকে কাছে পায় না। এটা তারই ইঙ্গিত। বিদায় নিতে নিতে সে তার হাতে থাকা কোকাকোলা পান করতে থাকে মদ্যপের মতো।
বিদায় দিয়ে তাদের ভেতরের রুমে আসার পর বেলুন আর ফিতা দেখে মনে হয়, এই বাড়িতে হয়তো গতকাল কোনো পার্টির আয়োজন করা হয়েছিলো। মনে করিয়ে দেয়া হয়, আমাদের সমাজের ধনীদের জন্য পার্টির আয়োজন করা খুব সাদামাটা একটা ব্যাপার।
সে একটি রাবারের বলকে লাথি দিয়ে চলার পথ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। এমতাবস্থায় ধারণা করা যেতে পারে, সে এখন বাসায় একা।
সোফায় হেলান দিয়ে বসে তার মনে ধ্বংসাত্মক মনোভাবকে জাগ্রত করে সে। হুট করে ক্যামেরা ক্ষণিক সময়ের জন্য টেবিলে দেখানো হয়। দেখা যায়, টেবিলে দিয়াশলাই আর সিগারেট। তার অভিভাবক এতই অসচেতন যে, তারা সিগারেট আর দিয়াশলাই ফেলে রেখে যায়। সেটা হয়ে যায় শিশুটির খেলনার হাতিয়ার।
সে দিয়াশলাই হাতে তার কাছে থাকা বেলুনগুলো দিয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়ে ফাটাতে থাকে। ধ্বংসাত্মক মনোভাব বেরিয়ে আসে তার। তখন তার কোমরে ঝোলানো ছিলো খেলনা তলোয়ার। অর্থাৎ তাকে পরিচিত করানো হচ্ছে বিনাশের হাতিয়ারের সাথে। ফলে তার মননে তৈরি হচ্ছে বিনাশের মানসিকতা। বেলুন ফাটানোর পর তার মুখে লেগে থাকে এক চিলতে হাসি।
তার ঘরে যায় সে। সেখানে থরে থরে সাজানো খেলনা। মেঝেতে সেফল ডিফান, প্লাস্টিকের ইটের মনুমেন্ট আর সেলফের উপর যান্ত্রিক খেলনা সাজানো। রোবট, পাইপার, ভায়োলিন, মাংকি ড্রাম আরও কত কী! সে তার একটি খেলনা বাদ্যযন্ত্র বাজাতে থাকে।
নেপথ্যে ভেসে আসে একটি বাঁশের বাঁশির সুর। পরিচালক শুরু করেন দ্বন্দ্ব নির্মাণের প্রথম ধাপ। জানালার কাছে গিয়ে সে দেখে পোড়া জমির ঝুপড়িতে থাকা এক দরিদ্র ছেলে আপন মনে বাঁশের বাঁশি বাজাচ্ছে।
আনন্দের মতো মনে হওয়া এই দৃশ্য তার মনে আনন্দ দেয়নি। তার মুখাবয়ব কেমন যেন হিংসা, ঘৃণা আর বিরক্তিতে ভরে যায়। তার কাছে মনে হয়, তার সাথে প্রতিযোগিতা করার জন্য এই ছেলের বাঁশি বাজানো। সে এটি মেনে নিতে পারে না। সে তার খেলনা ক্লারিওনেট নিয়ে দরিদ্র ছেলেটাকে দেখিয়ে দেখিয়ে বাজাতে থাকে।
হুট করে এরূপ ঘটে যাওয়ায় হতভম্ব হয়ে যায় দরিদ্র ছেলেটি। সে তো তার কোনো পাকা ধানে মই দেয়নি। তারপরেও নিজে থেকে কেমন প্রতিযোগিতা শুরু করলো! আমাদের সমাজের ধনীদের অনেকেই এর চেয়ে আরও ছোট্ট ঘটনা নিয়ে দরিদ্রদের নাজেহাল করার প্রতীকি রূপ হয়তো এটি।
এরপর সে বাঁশি রেখে ঢোল নিয়ে আসলে ধনী ছেলেটার মুখে হাসি দেখা যায়। কারণ এর পরিবর্তে তার তো মাংকি ড্রাম আছেই। এরপর মুখোশ পরে সাথে নিয়ে আসে বর্শা। সার্কাসের মানুষদের মতো সেজে আসে সে। তাকে একের পর এক তলোয়ার আর অন্যান্য ধ্বংসাত্মক হাতিয়ার নিয়ে আসতে দেখা যায়। মন্তাজ শটে দেখানো হয় একের পর এক ভয়ানক খেলনা অস্ত্রের মহড়া। আর সেইসাথে তার মুখের আওয়াজ।
তার সব খেলনা কৃত্রিমতায় ভরপুর। সবগুলোয় ভয়ানক সব অস্ত্রের খেলনা ভার্সন। এখানে আরেকটা ব্যাপার পরিচালক কৌশলে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। দরিদ্র ছেলেটির মুখোশ প্রাণীর আদলে তৈরি। আর ধনীর ছেলেরটা মানুষের আদলে। ধনীর ছেলেরা মানুষরূপী জানোয়ারদের সাথে পরিচিত। আর দরিদ্ররা জীবজন্তুর সাথে। এখানে দুজনারই মননের বেড়ে ওঠা যে কিছুটা হলেও নেতিবাচক, তা বোঝানো হচ্ছে।
দরিদ্র ছেলেটা হেরে যাবার হতাশা থেকে ফিরে গেলে ধনী ছেলেটা গর্বের সাথে তার কক্ষে ফিরে আসে। একটু পর জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে দেখা যায় ঘুড়ি উড়ছে। দরিদ্র ছেলেটা ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। সে হেরে যাবার পাত্র নয়। তার কাছে আছে প্রাকৃতিকভাবে বানানো সব হাতিয়ার। তবে তা কাউকে ধ্বংস করার নিমিত্তে নয়, একেকটা আনন্দের হাতিয়ার।
ধনী ছেলেটার কাছে এই খেলনার প্রতিযোগিতা করার মতো কিছু না থাকায় সে ঘুড়ি ধ্বংস করার চিন্তা আঁটে। প্রথমে তার কাছে থাকা গুলতি দিয়ে চেষ্টা করে। ব্যর্থ হলে সে হাতে তুলে নেয় এলো এয়ারগান। গুলি করার পর ঘুড়ি ছিঁড়ে পড়ে যায়।
ক্যামেরায় কুইক জুম করে দেখানো হয় দরিদ্র ছেলেটার মুখ। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত আর হতাশার চিত্র। অন্যদিকে ধ্বংসের খুশিতে বীরের মতো আনন্দ নিয়ে ফিরে ধনী ছেলেটা।
সে তার কক্ষে এসে তার সব যান্ত্রিক খেলনা চালু করে দেয়। এগুলোই তো আজ তার জয়ের কারণ। তার রোবটকে সে মেঝেতে ছেড়ে দেয়।
কিন্তু নেপথ্যে আবার বাজতে থাকে বাঁশির সুর। ছেলেটার চোখ কুঞ্চিত হয়ে যায়। মেঝের রোবট চলতে চলতে তার ইটের মনুমেন্টটাকে ভেঙে ফেলে। কোথা হতে যেন বাতাস এসে তার আরও একটি খেলনাকে মাটিতে আছড়ে ফেলে। হতাশায় আর মানসিক ক্লান্তিতে সোফায় বসে ছেলেটা। নেপথ্যে বাজতেই থাকে বাঁশের বাঁশির সুর।
মনে করিয়ে দেয়া হয়, অবহেলায় থেকেও আমাদের দরিদ্রদের হার মেনে না নেয়ার চিত্র। তাদের যা আছে তা নিয়েই তারা সুখে থাকতে চায়। কারণ তারা স্বাধীনভাবে বেঁচে আছে। অন্যদিকে, অফুরন্ত সুযোগ আর আরামে থেকেও সুখ নেই ধনীদের।
সত্যজিৎ রায় মাত্র ১৫ মিনিটে তুলে ধরেন সমাজের এই বাস্তব সত্য। আর চিনিয়েছেন তাঁর প্রতিভার রূপের সাথে।
সিনেমা সম্পর্কে আরও জানতে আজই পড়ুন এই বইগুলো