সময়টা ১৯শ শতাব্দী। সে সময়ে এখনকার মতো অত্যাধুনিক ইলেক্ট্রনিক প্রযুক্তি ছিল না, যার কারণে রাতের আঁধারে সমুদ্র পাড়ি দিতে দিকনির্দেশনার জন্য বাতিঘরের আলোই ছিলো নাবিকদের ভরসা। বাতিঘরগুলোর বেশিরভাগই তৈরি করা হতো সমুদ্রের কোনো জনশূন্য দ্বীপে। সময়ের বিবর্তনে হারাতে বসলেও এখনও পৃথিবীর অনেক দ্বীপেই বাতিঘর দেখতে পাওয়া যায়, তবে তাদের বেশিরভাগই স্বয়ংক্রিয়।
যারা বাতিঘরগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকতেন তাদের বলা হতো উইকি। জীবিকার তাগিদে এই উইকিদের দীর্ঘদিন পরিবার-সমাজ সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এক রকম নির্বাসিত জীবন যাপন করতে হতো। এরকম এক জীবনে যখন দুজন উইকি কোনো বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হয়, তখন তাদের মানসিক সুস্থতার কতখানি অবনতি ঘটতে পারে? এ প্রশ্নেরই উত্তর খোঁজা হয়েছে এ বছরের মুক্তিপ্রাপ্ত সাইকোলজিকাল হরর ছবি দ্য লাইটহাউজ এ।
১৮০১ সালে ওয়েলসের স্মলস লাইটহাউজে ঘটে যাওয়া এক সত্য ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজের দ্বিতীয় ছবি দ্য লাইটহাউজ ছবিটি তৈরি করেছেন রবার্ট এগার্স, যিনি ইতোমধ্যেই নিজের প্রথম ছবি দ্য উইচ দিয়ে সমালোচকদের প্রশংসা পেয়েছেন। ছবিটির চিত্রনাট্যও তিনি যৌথভাবে তৈরি করেছেন তাঁর ভাই ম্যাক্স এগার্সের সাথে। মাত্র দুইজন অভিনেতাকে নিয়ে ১.১৯:১ অনুপাতে নির্মিত সাদাকালো এই ছবিটি এ বছর কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রথম প্রদর্শিত হয়।
নিউ ইংল্যান্ডের কোনো এক জনশূন্য দ্বীপের বাতিঘরে চার সপ্তাহের জন্য কাজ করতে পাঠানো হয় এফ্রাইম উইনস্লো নামের তরুণকে। তার কাজের তত্ত্বাবধানে থাকেন থমাস ওয়েক নামের এক মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক, যিনি সেই বাতিঘরের নিয়মিত উইকি হিসাবে কর্তব্যরত। বাতিঘরে কাজ করার শুরু থেকেই উইনস্লো বেশ কিছু অস্বাভাবিকতার সম্মুখীন হয়। কাজের প্রথম দিনেই সে নিজের তোষকের ভেতরে খুঁজে পায় হাতির দাঁতের তৈরি একটি মৎস্যকন্যার মূর্তি, যাকে সে এক সময় স্বপ্নেও দেখতে শুরু করে। কাজ করতে গিয়ে সে প্রায়ই মুখোমুখি হয় একটি একচোখা গাংচিলের। ওয়েকের কাছে সে এই ব্যাপারে বললে ওয়েক তাকে বারণ করেন গাংচিলটি হত্যা করতে, কারণ নাবিকদের বিশ্বাস অনুযায়ী কোনো গাংচিলকে হত্যা করলে তা দুর্ভাগ্য বয়ে আনে।
শান্ত, মিতভাষী উইনস্লোকে বাতিঘরের যাবতীয় ভারি কাজের দায়িত্ব দিয়ে ওয়েক নিজে অনবরত কথা বলে যেতে থাকেন, যার ফলে উইনস্লোর মধ্যে ধীরে ধীরে অসহিষ্ণুতা তৈরি হয়। মজার ব্যাপার হলো, বাতিঘরের প্রায় সব কাজই উইনস্লোকে দিয়ে করানো সত্ত্বেও ওয়েক কখনোই উইনস্লোকে বাতি-নিয়ন্ত্রণ কক্ষে যেতে দেন না।
যেদিন সেই বাতিঘরে উইনস্লোর কাজ শেষ হওয়ার কথা, তার আগের দিন সে পানির কল খুলে দেখতে পায় কল থেকে পানির বদলে রক্ত পড়ছে। এই রক্তের উৎস অনুসন্ধান করতে গিয়ে সে দেখে একটি গাংচিল পানির ট্যাংকে মরে পড়ে আছে। তখনই তাকে আবার আক্রমণ করে সেই একচোখা গাংচিলটি। ক্রোধে উন্মত্ত উইনস্লো গাংচিলটিকে সেখানেই পিটিয়ে হত্যা করে। এরপরেই দুই উইকির জীবনে নেমে আসে দুর্যোগ। সেদিনই এক ঝড় আঘাত হানে দ্বীপে, উইনস্লোকে ফেরত নেওয়ার ফেরিটি আর দ্বীপে আসে না। খাবারের অভাবে মদ্যপান করে নিজেদের মধ্যে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে তারা, যার মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসে তিক্ত অতীত। বাড়তে থাকে অস্থিরতা, ঘটনা ক্রমশ মোড় নিতে থাকে অশুভ পরিণতির দিকে।
থমাস ওয়েক এবং এফ্রাইম উইনস্লোর চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছেন যথাক্রমে উইলেম ড্যাফো এবং রবার্ট প্যাটিনসন। স্যাম রাইমির স্পাইডারম্যান ট্রিলজিতে নর্ম্যান অসবর্ন তথা গ্রিন গবলিনের চরিত্রে অভিনয় করে সাধারণ দর্শকদের কাছে পরিচিতি পাওয়া ড্যাফো ইতোমধ্যেই তিনবার শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব-অভিনেতার জন্য অস্কারে মনোনীত হয়েছেন, সর্বশেষ অস্কারেও শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছিলেন অ্যাট ইটার্নিটি’স গেট ছবিতে চিত্রশিল্পী ভিনসেন্ট ফন গগের চরিত্রে অভিনয় করার জন্য। এই ছবিটিও তাঁকে টানা তৃতীয়বারের মতো অস্কারে মনোনয়ন এনে দেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অন্যদিকে রোমান্টিক সিরিজ টোয়াইলাইট এর ভ্যাম্পায়ার এডওয়ার্ড চরিত্রের খ্যাতি থেকে বের হওয়ার জন্য রবার্ট প্যাটিনসন বেশ কয়েক বছর ধরেই অভিনয় করছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারার চরিত্রগুলোতে, এবং এ ছবিতে তাঁর অভিনয় দেখে বলা যায় এ যাত্রায় তিনি সাফল্যের দিকেই এগোচ্ছেন। ড্যাফোর তুলনায় ছবিতে তাঁর সংলাপ অনেক কম থাকা সত্ত্বেও এর মধ্যেই নিজের ছাপ রাখতে সমর্থ হয়েছেন তিনি। দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ এর চিত্র সমালোচক রবি কলিন প্যাটিনসনের অভিনয়কে তুলনা করেছেন দেয়ার উইল বি ব্লাড ছবিতে ড্যানিয়েল ডে-লুইসের অভিনয়ের সাথে।
সাইকোলজিকাল হরর ঘরানার হওয়া সত্ত্বেও ছবিতে কিছু হাস্যরসাত্মক উপাদানও খুঁজে পাওয়া যায়। ছবির সংলাপে প্রায়শই উঠে এসেছে সমুদ্রের নাবিকদের মধ্যে প্রচলিত বিভিন্ন মিথ। প্রতিকূল পরিবেশের প্রভাবে একজন মানুষের স্বভাব কতোখানি বদলে যেতে পারে তার খানিকটা আঁচ পাওয়া যায় ছবির সংলাপের মধ্য দিয়ে। পুরো ছবিতে ড্যাফো কথা বলেন নাবিকদের মধ্যে প্রচলিত উপভাষায়, যা সাধারণ ইংরেজির তুলনায় খানিকটা দুর্বোধ্য। সে তুলনায় ছবির শুরুতে প্যাটিনসন স্বাভাবিক ইংরেজিতে কথা বললেও কাহিনী যতো এগোতে থাকে তার সংলাপে নাবিকদের উপভাষার প্রভাব ততোই বাড়তে থাকে। আলাদাভাবে ছবির মিউজিক ও ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরের কথা না বললেই নয়- দ্বীপে সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ার শব্দ, ফগহর্নের শব্দ বা গাংচিলের চিৎকার বেশ সফলভাবে ভয়ের আবেশ তৈরি করে, যার জন্য ছবির সাউন্ড ডিজাইনার ডেমিয়ান ভল্প প্রশংসার দাবিদার।
বক্স অফিসে তেমন কোনো সাড়া তৈরি করতে না পারলেও প্যারাসাইট, ম্যারেজ স্টোরি বা দ্য আইরিশম্যান এর পাশাপাশি এই ছবিটিও জায়গা পেয়েছে সমালোচকদের দৃষ্টিতে বছরের সেরা ছবির বেশিরভাগ তালিকায়। রটেন টোমাটোজে ৯২% ফ্রেশ এবং আইএমডিবিতে ৮.১/১০ রেটিং পাওয়া এই ছবিটি তাই আগামী ফেব্রুয়ারিতে অস্কারের সেরা ছবি হিসাবে মনোনয়ন পেলে অবাক হবার কিছু থাকবে না।