Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ডার্ক প্লেসেস: অন্তর্ভেদী এক আমেরিকান উপন্যাস

গিলিয়ান ফ্লিনের নামের সাথে এ দেশীয় সিনেমাপাড়ার লোকজন একটু কম পরিচিত হলেও, ফিঞ্চারের বিখ্যাত সিনেমা ‘গন গার্ল’ কিংবা টিভি সিরিজ ‘শার্প অবজেক্টস’-এর নাম বোধকরি অপরিচিত নয়। গিলিয়ান ফ্লিনের উপন্যাসে উপর ভিত্তি করেই এই সিনেমা আর টিভি সিরিজটা নির্মিত। ফ্লিন কিন্তু আরো একটি উপন্যাস লিখেছেন। ‘ডার্ক প্লেসেস’ নামে। সিনেমাও হয়েছে। তবে সেটা সুখকর কিছু হয়নি বিধায়, নামটি চাপা পড়ে গেছে। বলে রাখা ভালো, সাহিত্যের পাশাপাশি তিনি সিনেমার চিত্রনাট্যও লিখেছেন। ‘গন গার্ল’-এর সিনেমাটিক সংযোজনের চিত্রনাট্য তারই লেখা। স্টিভ ম্যাককুইনের ‘উইডোস’-এরও সহকারী চিত্রনাট্যকার ছিলেন।

তার সাহিত্যের ফর্মটা বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায়, সিনেমার কড়চা; সিনেমার ন্যারেটিভ ফর্মের রূপরেখা তাতে আছে। আলাপচারী ভঙ্গিমাটাই সেই ব্যাপারটাকে আরো দৃঢ় করে। সাথে যেভাবে নিগূঢ় বিষয়াদি যোগ করেন, অতীত আর গোপনীয়তায় নিমজ্জিত থাকা চরিত্রগুলোকে যেভাবে গঠন করেন; তা ভিজুয়ালে রূপান্তরের জন্য আদর্শ রূপটাকেই প্রদর্শন করে। ফ্লিনের শৈলী আর আঙ্গিকে তার নিজস্বতার একটা ব্যাপার তো আছেই। ‘ডার্ক প্লেসেস’ নিয়ে গল্প করতে করতে ওদিকেও আলো ফেলা হবে এই আলোচনায়। 

“The days were a clan that mighta lived long

But Ben Day’s head got screwed on wrong

That boy craved dark Satan’s power

So he killed his family in one nasty hour.”

স্কুলের মাঠে সহপাঠীদের আড্ডায় কিংবা ক্লাসের মাঝে ফিসফিসে কথাবার্তায় এই ছড়া চালু ছিল। তাদেরই সহপাঠী অদ্ভুত কিশোর বেন ডে’কে নিয়ে সেই ছড়া। কিন্তু ১৯৮৫-এর জানুয়ারির এক রাতেই কেনই বা সে হত্যা করলো তার পরিবারকে, যেটা বলে দেওয়া আছে শুরুতেই। সেখানে যাবার আগে, লিবি ডে’র কাছে যেতে হবে একবার। লিবি ডে হলো সেই ডে পরিবারের একমাত্র বেঁচে থাকা ছোট্ট মেয়েটি। তাদের বাপটা তো ছিল অমানুষ, নিষ্কর্মা। চার চারটা সন্তান জন্ম দেওয়া আর ব্যবসায় লস করে পরিবারকে ডুবিয়ে মদ আর মাদকে চুর হওয়া ছাড়া যার আর কোনো অর্জন নেই।

প্যাটি ডে, সবসময় তার মনে হয়েছে বাচ্চাদের জন্য যোগ্য মা সে হয়ে উঠতে পারেনি। অভাবের সর্বোচ্চ সীমাতেই তো জন্ম নিয়েছে বেন ডে, মিশেল ডে, ডেবি ডে আর লিবি ডে। ১৯৮৫ সনের জানুয়ারির সেই রাতে অবশ্য সব চুকেবুকে গেছে। ১ রাত আগেই নতুন বছর ঢুকেছিল। কে জানতো, অভাব অনটন নতুন এই বছরে সারাজীবনের জন্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে! গল্প খুলে লিবি ডে’র বয়ানে। পরিবার হারিয়ে যেই অতলে সে পতিত হয়েছে, তা থেকে আজও উঠতে পারলো না। সুবোধ বালিকা সে কখনোই ছিল না। মায়ের পেটে এসেছেও অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে।

Dark Places
Image Source- Amazon

লিবি যখন পেটে এসেছে, তখন মা তাকে চায়নি। ভুলের মধ্য দিয়েই তার জন্ম। খুনগুলোর পর তার মতে, সে একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছে। আত্মীয়-অনাত্মীয়দের অগণিত মোবাইল হোম আর ভাঙাচোরা র‍্যাঞ্চের মাঝে হাঁসফাঁস করে তিক্ততা বুকে নিয়ে তার বেড়ে উঠা। তার মুখে কখনোই কোনো হাসি দেখা যায় না, যা স্বাভাবিক ওই ট্র‍্যাজেডির পর। সে স্কুলে যেত মরা বোনদের ঢিলেঢালা, রোদে জ্বলে রঙ বদলে যাওয়া, জীর্ণ-মলিন সব কাপড় পরে। অযত্নে বেড়ে উঠা চুলের রুক্ষতা তার মুখের কাঠামো আর চরিত্রের কাঠিন্য দুটোকেই আকৃতি প্রদান করেছে। নিরানন্দটাই তার কাছে জীবন। শরীরজুড়ে কানায় কানায় ভর্তি অলসতা। বয়স তো ত্রিশ পেরিয়েছে, কিন্তু তার জীবন আর সামনে বাড়ে না।

গত ২৪ বছর ধরে বিষণ্ণতাকে একচ্ছত্র আধিপত্য করতে দিয়ে শূন্যতায় দোলাচল খাওয়াটাই উপযুক্ত ভেবে নিয়েছে লিবি। নিজেকে সে পরিচয় দেয় মেরুদণ্ডহীন বলে। কারণ গত ১৩ বছর ধরেই অনুদানের টাকায় চলছে সে। দুঃখভরা সেই কাহিনী বলে বলে মানুষের চোখ ভিজানোর দামটা, মানুষ তাকে নগদ অর্থে শোধ করেছে। গত ১৩ বছর ওই টাকাতে অতিবাহিত হয়েছে। সেই ভান্ডার এখন শূন্যের কোঠায়। এখন নতুন করে তার টাকার জোগাড়যন্ত্র করতে হবে। এই গল্প আবার কোথায় বেচা যায়, তা-ই ভাবছে লিবি। এসব কারণেই সে নিজেকে ভাবে মেরুদণ্ডহীন। হাত সাফাইয়ের ক্ষমতাও তার আছে ভয়ংকর রকমের।

এইসব ভাবতে ভাবতেই তার কাছে আসে একটা চিঠি। ‘কিল ক্লাব’ নামে একটা ক্লাব হতে। ক্লাবের প্রধান লাইল ওয়ার্থ। এই ক্লাবের প্রধান উদ্দেশ্য এই ধরনের বাস্তব কেইসগুলো নিরীক্ষা করে দেখা। সূত্রের সাথে সূত্র মেলানো। ঘটনার পেছনের ঘটনা দেখা। রহস্য অনুসন্ধান করা। লিবি ডে সেই ৭ বছর বয়সে সাক্ষ্য দিয়েছিল তার ভাই বেন ডে’ই সেই রাতে পরিবারকে হত্যা করেছিল। হয়তো তার বাচ্চা মন ওটাকেই ভেবেছিল সহজ মুক্তির পথ। সেই সময়ে তদন্তের কাজে অনেক ফাঁকফোকর রেখেই বেনকে জেলে ভরা হয়। ওইযে, সহজ পথ। তাছাড়া তার অন্তর্মুখী স্বভাবের জন্য সবসময়ই সে বিচ্ছিন্ন ছিল। এর আগেরদিনই স্কুলে রটেছিল সে তাদের স্কুলের কয়েক ক্লাস নিচের মেয়ে ক্রিসি ক্রেইটস আর তার কয়েক বান্ধবীকে যৌন হেনস্তা করেছে। গোটা ছোট্ট শহর মুহূর্তেই বেনের উপর ক্ষেপে যায়। শয়তানের উপাসনা, মাদক আসক্তি এসবের সাথেও নাম জুড়ে তার। তাই বেন ডে’ই হত্যাকারী না হয়ে যায় কোথায়!

কিন্তু আজ এতো বছর পরে সেই ‘কিল ক্লাব’-এর অনেক সদস্য অনেক তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে যুক্তির সকল ফাঁকফোকর বের করে। কাউকেই সেই কেইসের সময় ঠিকঠাক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। সেই পুরানো কাসুন্দি ঘেঁটে অনেক কিছু সামনে আনে কিল ক্লাব। বেনের নারীভক্ত হয়েছে এতদিনে প্রচুর। তাদের প্রবল বিশ্বাস, সে নির্দোষ। এসবের সাথে লিবি যুক্ত হয় স্রেফ টাকা পেতে। একেকজন সদস্যের সাথে দেখা করে কিছু বলার বা জানানোর চেষ্টা করলেই ৫০০ ডলার! এই দুই পয়সা ছাড়া যে তার চলছে না। ধীরেধীরে কেইসটার অসংগতি লিবি ডে নিজেই অনুভব করতে শুরু করে। তবে কি বেনের বিপক্ষে সে স্রেফ তাই বলেছিল, যা সে বিশ্বাস করেছিল ঘটেছে বলে! মানুষের বিশ্বাস তো বিভ্রম জাগায় হরহামেশাই। বেনের সাথে আজ ২৫ বছর পর কথা বলতে গিয়ে নতুন গোলকধাঁধায় ছিটকে পড়তে থাকে লিবি। বেন কখনো কিছুই বলেনি। শুধু নীরব থেকেছে।

ডার্ক প্লেসেস বই আর সিনেমার ডিভিডি পাশাপাশি; Image Source: Fandigo

নিজেকে নিরপরাধ ভেবেছিল। কিন্তু নীরবতাই ঠুকেছে কফিনে পেরেক। নির্দোষ কে আর দোষী কে? লাইলকে নিয়ে রহস্য উন্মোচনে নামতেই, লিবিকে তার অতীত অন্ধকার আবার টেনে নামাতে থাকে। স্মৃতির পথ ধরে লিবি আবার হাঁটতে থাকে মিসৌরির সকল দারিদ্র‍্যতায়। জীর্ণশীর্ণ স্ট্রিপক্লাবের ক্রিসি ক্রেইটস, তাদের মদ্যপ বাবা রানার, ডিয়ন্ড্রা, শয়তানের উপাসক ট্রে ট্রিপানো; সকলের কাছেই আছে সেই রাতের ঘটনার ছিন্নবিচ্ছিন্ন অংশ। পাজলের মতো। আশির দশকে স্যাটানিক রিচুয়াল বা শয়তানের উপাসনা রাতারাতি ফেনোমেনা হয়ে উঠাতেও কিছু আধার আছে এই গল্পের। সেইসকল সত্য আবার চেপে বসে লিবি ডে’র মাথায়। বারেবারে তাকে ধাক্কা মারে ‘৮৫-র জানুয়ারির সেই রাতে। রক্তে ভেজা মেঝে, দেয়ালে কাটা আঁচড়, বাতাসে ভুরভুর করে ভাসা তাজা রক্তের গন্ধ, মায়ের লাশ, ছোট্ট বোনেদের লাশ; সবকিছু জট পাকিয়ে শ্বাসরোধ করে লিবির।

‘ডার্ক প্লেসেস’ গিলিয়ান ফ্লিনের বাকি দুইটা উপন্যাসের মতোই সমান্তরালভাবে দুটো টাইমলাইন নিয়ে গল্প বলে। একটা অতীত, আরেকটা বর্তমান। প্রকাশের দিক থেকে, তার দ্বিতীয় উপন্যাস এটি। এবং গিলিয়ান ফ্লিনের স্টাইলের দিক হতে প্রথম উপন্যাসের সাথেই এর সাযুজ্যতা সবচেয়ে প্রবলভাবে স্থাপন করা যায়। এর বড় কারণ; প্রধান চরিত্রের অতীত ট্রমা, একটা মিড-ওয়েস্টার্ন সেটিং, পারিবারিক ইতিহাস আর গোটা আবহে মফস্বল শহর এবং এর বাসিন্দাদের বর্ণনা ও নানা কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে শহরটাকেই একটা চরিত্র হিসেবে দাঁড় করানোর প্রক্রিয়াটা। ‘গন গার্ল’-এও অতীত আর চলমান বর্তমানের টাইমলাইন আছে। চরিত্রদের গোপন রহস্য, যা একান্তই তাদের ব্যক্তিগত। অপছন্দনীয় নারী চরিত্রও আছে। মানে, তার প্রাথমিক বিষয়াদি আর স্টাইল আছে ওতেও, তবে সামগ্রিক ভাবে এবং ন্যারেটিভে বেশ ভিন্নতা আছে। তা-ই ভালো।

নিজের সীমানাকে একদম চেনা বৃত্তে আঁটকে ফেললে সেটা তো আর ভালো ফলাফল বয়ে আনবে না বেশিদিন। ‘অপছন্দনীয় নারী’ চরিত্রের কথা যাতে উঠলো, ও ব্যাপারে শেষ করে নেই। এমন চরিত্রগঠনটাও তার নির্দিষ্ট স্টাইল। ‘ডার্ক প্লেসেস’-এর লিবির চরিত্রটাই দেখা যাক। ইতিমধ্যেই সচেতন পাঠকের তা বুঝতে পারার কথা। অতি ব্যাখ্যার কিছু নেই। তার হাত সাফাইয়ের অভ্যাস আছে, দায়িত্ব থেকে পালিয়ে বেড়ানোর অভ্যাস আছে, নিজের স্বার্থ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল সে, আরেক মেয়ে ভিক্টিমের কারণে তার প্রতি লোকের নগদ দয়ার দান কমে যাওয়ায় ওই মেয়ের প্রতি ঘৃণা পোষণ করে সে। নিজেই অবশ্য নিজের সমালোচক সে। তাইতো নিজেকে শুরুতেই ‘মেরুদণ্ডহীন’ বলে পাঠকের কাছে পরিচয় দিয়েছে লিবি।

গড়পড়তা বিচারে ‘অপছন্দসই চরিত্র’। কিন্তু আসলে তো না, যুক্তি দিয়ে ভাবতে গেলে। তার ছোটবেলার সেই ট্রমা কতটা ভয়ংকর, তা আঁচ করতে চেষ্টা করলেই তার জুতায় পা গলানোটা সহজ হবে। লিবি অপছন্দনীয় নয়, আর সবার মতোই ভুলত্রুটিতে ভরা একটা চরিত্র, যে এমন ত্রুটিগুলোর কারণেই বইয়ের চরিত্র থেকে বাস্তব হয়ে উঠে। তার প্রতি সহানুভূতির জায়গা খুঁজে পায় পাঠক। ওমন অপছন্দনীয় ধরতে হলে এই উপন্যাসের ডিয়ন্ড্রাকেই ধরা উচিত। আর সেই দাগে নিখুঁতভাবে আঁটতে পারে ‘গন গার্ল’ উপন্যাসের প্রধান নারী চরিত্র অ্যামি ডান। 

গিলিয়ান ফ্লিনের ৩টি উপন্যাস; Image Source: Amazon

হাস্যকর ব্যাপার হলো, ফ্লিনের উপন্যাসের নারী চরিত্রগুলোর জন্য অনেক তথাকথিত সমালোচক তাকে ‘নারীবিদ্বেষী’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। অথচ ফ্লিন নারীবাদী হিসেবেই সুপরিচিত। হাস্যকর এই কারণেই, তারা যুক্তি দিয়ে বুঝতে বা চরিত্রটাকে চরিত্রের কোণ থেকে বিচার করতে চান না। নিজের এজেন্ডা থেকে কোনকিছুকে বিচার করতে গেলে এমন ভুলভাল, অযৌক্তিক, হাস্যকর বিশেষণ তো বেরুবেই। ফ্লিন তার নারী চরিত্রগুলোর স্বপক্ষে বলেন, “নারীকে সবসময় শেকড়গতভাবে ভালো দেখাতে হবে, তেমনটা তো নারীবাদ বলে না। নারীবাদ নারীর অধিকার নিয়ে কথা বলে। আর সেক্ষেত্রে একজন নারী যেমন, তাকে সেভাবে প্রকাশ করতে দেওয়াটা তো নারীর স্বাধীনতা আর অধিকারের মধ্যেই পড়ে।” কেউ যদি এটা ভুলে যায় যে, ভুলত্রুটিতে ডুবেই তৈরি হয় মানুষ আর কিছু মানুষ মজ্জাগতভাবেই খারাপ হয়, তবে তাদের প্রতি রইলো “টু সেন্ট।” ফ্লিন ওমন অনেক চরিত্রদের আশেপাশে বেড়ে উঠেছিলেন বলেই, সেই চরিত্রগুলোকে লিখেন। নানান স্তর যোগ করতে পারেন তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে। 

‘ডার্ক প্লেসেস’ ছোটবেলার ভয়ংকর স্মৃতি; সেখান থেকে সৃষ্ট বিষণ্ণতা, একাকীত্ব, হতাশাকে তো এনেছে। আশির দশকে শয়তানের উপাসনা যেভাবে একটা ফেনোমেনায় রূপান্তরিত হয়েছিল সেই ব্যাপারও আছে। এর আগের হিপ্পি সংস্কৃতি আর পপ সংস্কৃতির ভ্রষ্ট ব্যাখ্যা আর মাদকের আগ্রাসন এইসব এই ফেনোমেনা তৈরির পেছনে নানাভাবে জড়িয়ে যেতে পারে বা যাবে। সিরিয়াল কিলারদের প্রতি আমেরিকানদের বিমোহনের জায়গাটিও উঠে এসেছে। তবে ‘ডার্ক প্লেসেস’-এ হাহাকারের অনুভূতি জাগানোর মতো যেই বিষয়টি এসেছে তা হলো, আশির আমেরিকার মফস্বল কিংবা গ্রাম্য অঞ্চলের কঠিন দারিদ্র্যতা এবং খারাপ প্যারেন্টিং। দারিদ্র‍্যতার কষাঘাত আর বেখেয়ালি হয়ে ছেলেমেয়েকে বড় করা যে কী ফলাফল বয়ে আনতে পারে; তার এক অমোঘ চিত্র এই উপন্যাসে এসেছে।

এবং একটা পরিবারের দারিদ্র‍্যতা, ভালো প্যারেন্টিংয়ে কীভাবে বাঁধা তৈরি করে; তা তো এই ডে পরিবারেই স্পষ্টভাবে পাওয়া যায়। প্যাটি ডে’র জন্য পাঠক শুরু থেকেই সহানুভূতি অনুভব করে। এবং বাচ্চাদের জন্য যেই কঠিন সিদ্ধান্তে সে পৌঁছায়, যা ক্লাইম্যাক্সে খোলাসা হয়, ওটুকু জানার পর মুহূর্তের জন্য বিধ্বস্ত আর শূন্য লাগতে পারে যেকোনো পাঠকের। ওমনই বেধনাবিধুর এক মুহূর্ত এটি। এসবের সাথে বেন ডে’র চরিত্রিটিকে গড়ে তোলা হয়েছে অত্যন্ত গভীরতা প্রদান করে। উঠতি বয়সের উষ্ণ রক্তের স্রোত, বাবাহীন বেড়ে উঠার মনস্তাত্ত্বিক আচরণ ও সেই অভাববোধ, জঘন্য বুলিয়িং কীভাবে মনস্তাত্ত্বিকভাবে ওই বয়সী কিশোরকে ম্যানিপুলেট করে, বয়সের কারণে প্রচুর স্বাধীনতা আর উন্মাদনার দৃঢ় আকাঙ্ক্ষা; সবকিছুই একটা গোটা গ্যামাট ধরে এসেছে তার চরিত্রে। আর কেউ যে ভেতরেই এক অন্ধকার নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে, তারও আখ্যান এই উপন্যাস। গিলিয়ান ফ্লিন তার লেখায় প্রধান চরিত্র এবং প্রধান সহকারী চরিত্র, প্রতিটিকেই যথেষ্ট সতর্কতা, দক্ষতা এবং অন্তর্ভেদী রূপে গড়ে তুলেছেন। একমাত্রিক হয়নি তার চরিত্রগুলো। 

লেখক গিলিয়ান ফ্লিন; Image Source: Fandigo

ন্যারেটিভের ক্ষেত্রেও একাধিক ন্যারেটিভ নিয়ে কাজ করেছেন, বাকি উপন্যাসগুলোর মতোই। বর্তমানের ন্যারেটিভ চলে লিবি ডে’র বয়ানে; ফার্স্ট পার্সন ন্যারেটিভ। অন্যদিকে অতীতের অংশগুলোতে ওমনিসিয়েন্ট বা সর্বদর্শী ন্যারেটিভ থাকলেও প্রতিটা অধ্যায় একটা নির্দিষ্ট চরিত্রের দৃষ্টিকোণ ধরে এগোয়। কখনো প্যাটি ডে, কখনো বেন ডে। সর্বদর্শী ন্যারেটর তাদের ভেতরে উঁকি মেরেই সবটা দেখে, বলছে যেন। এতে করে তাদের মনস্তত্ত্বে কী চলছে এবং সেই সম্পর্কে গোটা ধারণাটাই পাঠক পায়। ফলে যেটা হয়েছে যে, পাঠক নিবিড়ভাবে তাদের বুঝতে পারে, বিশ্লেষণ করতে পারে এবং এতে তাদের আরো বাস্তবিক করে তোলার কাজটাও সহজ হয়।

গিলিয়ান ফ্লিন সাহিত্যে আসার আগে ১৫ বছর সাংবাদিকতায় ছিলেন। বুদ্ধিমান কেউ এই তথ্যেই কিন্তু তার লেখনশৈলী সম্পর্কে বুঝতে পারবেন। সাংবাদিকতাই তাকে তার ক্রাফটে পোক্ত করেছে। আলাপচারী ভঙ্গিমার সাথে সাথে একটা নৈমিত্তিক ব্যাপারও আছে তার গল্প বয়ানে। যার কারণে এগোয় দ্রুত। তার বাক্যের গঠন আর প্যারাগ্রাফ দুটোই সংক্ষিপ্ত আকারের হয়। আর বলার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষভাবে বলার স্টাইলটা অনুসরণ করেন। তাই একটা আর্জেন্সি তৈরি হয় গদ্যে। এই স্টাইলকে ওই সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতাই যথাযথ আকারটা দিয়েছে।

বক্তব্য প্রদানের ক্ষেত্রে পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে খুব বেশি সূক্ষ্মতা কিংবা স্থূলতায় না গিয়ে, সরাসরি উল্লেখটাকেই বেছে নেন। এই কারণেই ধাক্কাটা লাগে আকস্মিক এবং নাড়নটাও অনুভব করা যায়। ‘ডার্ক প্লেসেস’-এ যেসকল দার্শনিক লাইনগুলো আছে তা আলাদা আলাদাভাবে, দারুণ। পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই এসেছে। স্বল্প কিন্তু এক্সপোজিশনের ব্যবহারে পরিমিত। অন্তর্ভেদী গদ্যের দেখাও মিলেছে। কিন্তু ফ্লিন ‘জনরার স্টাইল’টাতেই ধারাবাহিক থেকেছেন। সেই হিসেবে মিলিয়ে বলতে হয়; ফ্লিন সুকৌশলী এবং বুদ্ধিদীপ্ত, ন্যারেটিভের উপর যার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকে।

পরিশেষে বলতে হয়; ‘ডার্ক প্লেসেস’ গিলিয়ান ফ্লিনের সবচেয়ে ডার্ক বা তমসাচ্ছন্ন, নিগূঢ় উপন্যাসই বটে। জনরার ফ্রেমেই গভীরতা পেয়েছে এবং ভাবনা উদ্রেককারী অনেক বিষয়ই দিয়ে গেছে। প্রত্যেকের শেকড়ে জড়িয়ে থাকা কিছু অন্ধকারের প্রতি ইঙ্গিত প্রদানের পাশাপাশি অপরাধ, অনুশোচনা আর গ্রহণযোগ্যতাকে ধূসর জায়গায় নিয়ে প্রশ্নটা নুন্যোক্ত রেখেছে পাঠকের প্রতি।

Related Articles