The nymphs are departed.
Sweet Thames, run softly, till I end my song.
The river bears no empty bottles, sandwich papers,
Silk handkerchiefs, cardboard boxes, cigarette ends
Or other testimony of summer night. The nymphs are departed.
– The Waste Land, T. S. Eliot
দানিয়ুব নদীর পাড়ে বসে টি এস এলিয়টের মতো বিলাপ করছেন কিছু উন্মাদ কবি। এই তো সেদিনও ঝিরিঝিরি বাতাসে বয়ে চলা কাকের চোখের মতো স্বচ্ছ জলে স্নাত হয়ে এখানে অবিরাম গান লিখতেন তাদের সগোত্রীয়রা। বাদামি, সোনালী, লাল, নীল, সবুজ পালের রঙে বিমোহিত হয়ে ওক কিংবা পাইনের শাখা বেয়ে নেমে আসত স্বর্গীয় পরীরা। গলা মেলাত তাদের সঙ্গে। বোতল, স্যান্ডউইচ পেপার, কার্ডবোর্ড আর সিগারেট প্যাকেটে তারা আজ নির্বাসিত। ‘Nymphs are departed’ ‘Nymphs are departed’ বলে কাঁদছেন উন্মাদ কবির দল!
এই ভাগাড় আমার না বলে নির্বাসিত হতে পারতেন তারাও। কিন্তু উন্মাদের দল জানতেন, গা ঘিনঘিনিয়ে ওঠা এই শহুরে রাস্তায় যদি কোনদিন মেথরের গান আর ভাঙা মটরের হর্ন শোনা না যায়, মৃত ইদুরের উৎকট গন্ধ একদিন তাদের রক্ত চলাচলও বন্ধ করে দেবে।
ক্যামেরা হাতে ভাগাড় সরিয়ে পরীর খোঁজে নেমে গেলেন উন্মাদ কবির দল। কাতালিন মিতুলেস্কু, ক্রিস্তি পুইউ, কর্নেলু পরমবোইউ, রাদু মানতিনদের ফ্রেমে বাঁধতে লাগলেন এক একটি অমর কবিতা। বেলা তারদের মতো অধিবিদ্যায় ডুব দিয়ে নয়; বরং ভাগাড়কে ভাগাড় বলে স্বীকার করেই যাত্রা শুরু হলো তাদের। কিছুদিনের মধ্যে একটি ভদ্রস্থ নামও জুটে গেল তাদের সৃষ্টির- রোমানিয়ান নিউওয়েব। ২০০৭ সালে এই ভাগাড় পরিস্কারকারীদের একজনের সৃষ্টি ‘4 Months, 3 Weeks and 2 Days‘ জিতে নিল সম্মানজনক পুরস্কার পাম ডি’অর। নাম ক্রিস্তিয়ান মুনজুউ। বাকিদের অর্জনের তালিকাও বেশ দীর্ঘ। কিন্তু পরিহাস এই যে, যাত্রা শুরুর দেড় দশক পর এসেও তাদের বলতে হয়, “রোমানিয়ায় সত্যিকার অর্থে আমাদেরকে কেউ বোঝে না এবং সম্মানও করে না।” তাদের খেদ মাখানো কথায় বোঝা যায়, পুরস্কার নয়; বরং তারা শুধু চেয়েছিলেন কেউ তাদের কবিতার ছন্দে মাতাল হোক।
ফিল্ম কমেন্ট এর হারল্যান জ্যাকবসনকে ২০১২ সালে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কান চলচ্চিত্র উৎসবে একাধারে পাম ডি’অর, সেরা চিত্রনাট্য (Beyond the Hills, ২০১২), সেরা পরিচালকের (Graduation, ২০১৬) পুরস্কারজয়ী রোমানিয়ান নিউওয়েব এর শুব্ধতম পরিচালক ক্রিস্তিয়ান মুনজুউর বয়ানে ধরা পড়েছে সিনেমা জগতের অপেক্ষাকৃত তরুণ তরঙ্গ ‘রোমানিয়ান নিউওয়েব’ এর গতিপথ, রোমানিয়ানদের প্রতি এই তরঙ্গ সৃষ্টিকারীদের অভিমান এবং শিল্প বিষয়ক বিভিন্ন ভাবনা-চিন্তা। পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি এখানে তুলে ধরা হলো।
হারল্যান জ্যাকবসন: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরে রোমানিয়ান শিল্পীদের অবস্থাটা তুলে ধরুন।
ক্রিস্তিয়ান মুনজুউ: খুব নিষ্ঠুরভাবে ১৯৪৭ সালে রোমানিয়ায় কম্যুনিজম প্রবেশ করে। আমাদের রাজাকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করা হয়। শিল্পের তেমন কোনো মূল্যই ছিল না। পঞ্চাশের দশকে প্রোপাগান্ডার অপর নামই ছিল শিল্প। ১৯৬৫ সালে নিকোলাই চৌসেস্কু ক্ষমতায় আসার পর আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রভাব কমতে শুরু করল। আমরা আগের তুলনায় বেশি জাতীয় সংস্কৃতির ভেতর বিকশিত হতে লাগলাম। ফলে কিছু কিছু শিল্পী কম্যুনিস্ট লাইনের বাইরে গিয়ে নিজেদের প্রকাশের সুযোগ পান। ১৯৬৮ সালে চৌসেস্কু সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিলেন। অবিস্মরণীয় ঘটনা! কিংবদন্তিতে পরিণত হলেন তিনি। কিন্তু হায়! ১৯৭২ সালে চৌসেস্কু এশিয়া ভ্রমণের পর সংস্কৃতি সম্পর্কে তার নতুন ভাবনা সবকিছু ওলটপালট করে দিল।
সেন্সরশিপ সর্বগ্রাসী হয়ে উঠল। প্রতিটি বই, প্রতিটি ফিল্ম, প্রতিটি পেইন্টিং সরকারী কমিশন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখত। পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিল আশির দশকে। শিল্পীদের জন্য দুটি পথ খোলা ছিল- হয় তারা দেশ ছাড়বেন, নয় দেশে থেকেই বিদ্যমান বাস্তবতার বিরেুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন। কবিতার মাধ্যমে প্রতিবাদ করা সহজ ছিল। কিন্তু গদ্য-সাহিত্য কিংবা ফিল্ম! ভয়াবহ নিষ্পেষণের মধ্য দিয়ে যেত হয়েছে এই দুই শিল্প মাধ্যমকে।
আশির দশকের শেষের দিকে আমি সাংবাদিক হিসেবে কাজ করতাম। আমাদের কিছু গ্রাফিক চিহ্নের তালিকা ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল, যেগুলো ছবিতে থাকা যাবে না। অনেক সময় হাস্যকর হয়ে উঠত ব্যাপারটা। একটি উদাহরণ দিলেই বুঝবেন। আমি একদিন একটা ভুট্টার ছবি তুললাম। কবের (ভুট্টা-শিষের মধ্যভাগ- যেখানে শস্য জন্মে) উপরে কিছু অংশে শস্যদানা ছিল না। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, ছবিটি প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে! কেন শস্যদানা নেই?
শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তন আসল ১৯৮৯ সালে। মানুষজন ভাবল তারা এখন মুক্ত। নতুন পরিবেশেও ১০ বছরে কোনো শক্তিশালী সিনেমা নির্মিত হলো না। স্বাধীনতায় স্নাত হয়ে নিজস্ব প্রকাশভঙ্গি খুঁজে পাওয়া গেল না। ফিল্ম বলেন, সাহিত্য বলেন, কবিতা বলেন; প্রথমে লোকজনের প্রয়োজন ছিল শিল্পের প্রতিটি শাখায় উঁকি মারা। প্রয়োজন ছিল কথা বলার। কিন্তু সত্যিকারার্থে সেগুলো শিল্পিত কিছু হয়নি।
হারল্যান জ্যাকবসন: চারপাশের সামাজিক সমস্যার ভেতরে পরিচালক, লেখক কিংবা অভিনেতাদের মতো ফিল্ম শিল্পীরা কতটা অবগাহন করবেন? তারা কি অচেতন থাকবেন নাকি সচেতন ব্যাখ্যাদাতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন?
ক্রিস্তিয়ান মুনজুউ: আমার লক্ষ্য থাকে গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধগুলো গল্পের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা। গল্পের উপরই সবকিছু ছেড়ে দেই। নিজস্ব ব্যাখ্যা আরোপ করি না। আমার দায়িত্ব পরিস্থিতি তুলে ধরা। তারপর দর্শক-শ্রোতারা ব্যাখ্যা করুক। সিনেমায় মানুষের জন্য পূর্ব-ব্যাখ্যা হাজির করা উচিত নয়। গল্পই মানুষকে মূল্যবোধ নিয়ে ধ্যানমগ্ন করুক, হাজির করা গল্পের মধ্যেই সে তার নিজস্ব বয়ান খুঁজে নিবে। সত্যি কথা বলতে, সিনেমা এমনই হওয়া উচিত। মানুষ যে মূল্যবোধগুলো কোনরূপ ভাবনা-চিন্তা ছাড়াই আঁকড়ে ধরে আছে, সেগুলো নিয়ে ভাবনার সুযোগ করে দিতে হবে সিনেমাকে।
হারল্যান জ্যাকবসন: ১৯৮৭ সালের প্রেক্ষাপটে নির্মিত 4 Months, 3 Weeks and 2 Days এবং Beyond the Hills সাম্প্রতিক হলেও বলা চলে আরো বেশি কালোত্তীর্ণ। দুটি সিনেমার একটিতে আপনি পতনোন্মুখ সরকারী এবং অন্যটিকে ধর্মীয় যুগকে তুলে ধরছেন।
ক্রিস্তিয়ান মুনজুউ: আমি চরিত্রের মধ্যকার সম্পর্ক এবং তাদের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের জায়গাগুলো ফুটিয়ে তোলা গল্পের মাধ্যমে শুরু করি। যার গভীর এবং তাৎপর্যপূর্ণ বৈশ্বিক পটভূমি থাকে, ১৯৮৭ সালে আমরা জানতাম না রোমানিয়ায় কম্যুনিজম পতনের একেবারে দ্বারপ্রান্তে। 4 Months, 3 Weeks and 2 Days এর কোনো চরিত্রই এটা জানত না। Beyond the Hills ধর্ম ও প্রতিষ্ঠান হিসেবে চার্চ এবং ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও কুসংস্কারের মধ্যে একটি ভেদরেখা টেনে দেয়। এর সমস্ত কিছু ধর্মীয় মানুষের মনে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসবাস করে। সিনেমাটি প্রশ্ন করে- আধুনিক সমাজে আপনি কী দিয়ে খ্রিস্টীয় মূল্যবোধকে প্রতিস্থাপন করবেন? কী লাভ এই সমস্ত খ্রিস্টীয় শিক্ষায়? কম্যুনিজমের ৫০ বছর এবং নৈতিক অবক্ষয়ের সময় ধর্ম হয়তো একটা সমাধান হতে পারত। কিন্তু সামাজিক সমানুভূতি শূন্যতার ধারা আজও বহমান।
হারল্যান জ্যাকবসন: মানুষ দেখতে চাওয়া বিষয়গুলোই প্রক্ষেপ করে। Beyond the Hills সিনেমাটি বলতে চায় আমরা ধর্মীয় যুগের শেষ পর্যায়ে এসে গেছি।
ক্রিস্তিয়ান মুনজুউ: আমি আর আমার অভিনেতারা গল্পের বাহক মাত্র। নির্মাতা হিসেবে এটাই আমাদের দায়িত্ব। প্রত্যেকটি দৃশ্যকে বিশ্বাসযোগ্য এবং যৌক্তিক করে তোলা। সিনেমায় কোনো চরিত্র যা-ই করুক না কেন, তার দৃষ্টিকোণকে আমাদের সম্মান করতে হবে। সর্বোপরি গল্প বলতে গিয়ে আমরা যেন সততা থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়ে যাই। ফিল্ম হচ্ছে আয়নার মতো। মানুষ যা দেখে তার মধ্যেই নিজস্ব মূল্যবোধ প্রক্ষেপ করে।
4 Months, 3 Weeks and 2 Days এর ক্ষেত্রে এটি অনেকবার হয়েছে। Beyond the Hills ও খুব গভীর। সিনেমাটি দেখে আপনি নিখুঁতভাবে বলতে পারবেন না, “এই লোকগুলো দোষী”। কারণ সবাই-ই কিছু মাত্রায় দোষী। শুধু তা-ই নয়, ফিল্মে আপনি যাদের দেখতে পান না, তাদের মধ্যেও দোষীরা বিরাজমান। এই মেয়েগুলোকে তাদের মা-বাবারা ত্যাগ করেছে। তারা যে সমাজ, দারিদ্র্য, শিক্ষাগত বঞ্চনা, দীর্ঘদিনের প্রোপাগান্ডার মধ্যে বড় হয়েছে, তা-ও বিবেচনায় নিতে হবে। তারা প্রোপাগান্ডার রাজ্য থেকে ধর্মীয় রাজ্যে এসে পড়েছে। শুধু বলে দিলেই হয় না, এখন আমরা মুক্ত! মুক্তির অর্থ এক ধরনের প্রোপাগান্ডা দ্বারা অন্য ধরনের প্রোপাগান্ডা প্রতিস্থাপন করা নয়। মুক্তির অর্থ স্বাধীন ইচ্ছার বিকাশ, মানুষের নিজের পছন্দকে গুরুত্ব দিতে পারা।
হারল্যান জ্যাকবসন: একজন রোমানিয়ান দর্শক থেকে একজন বিদেশী দর্শক কীভাবে ভিন্ন?
ক্রিস্তিয়ান মুনজুউ: রোমানিয়ানরা সিনেমাকে বিনোদন হিসেবে দেখে। এই ধরনের সিনেমাগুলো খুব গভীর। সেই গভীরতাকে ধরতে না পারা শুধু শিক্ষার অভাব নয়; বরং তাদের এই ধরনের ফিল্মি ভাষা আত্মস্থ করার উপায় এবং অভ্যাসেরও ঘাটতি রয়েছে। বিকল্পধারা দেখার সুযোগ রয়েছে এমন দেশের দর্শকদের তুলনায় তাদের কাছে এই ফিল্মগুলো তাই দুর্বোধ্য লাগে।
হারল্যান জ্যাকবসন: আপনার ফিল্মগুলোর অর্থায়ন হয় কীভাবে?
ক্রিস্তিয়ান মুনজুউ: ন্যাশনাল সেন্টার ফর সিনেমাটোগ্রাফি চিত্রনাট্য পর্যালোচনা করে পছন্দ করলে কিছু টাকা-পয়সা দেয়। কিন্তু এখন এটা খুবই সীমিত। Beyond the Hills ব্যয়বহুল সিনেমা। তাই আমাদের বাইরে থেকে অর্থ সংস্থান করতে হয়েছে। প্রথমবারের মতো কো-প্রডাকশনে গিয়েছি। প্রধানত ফরাসি টিভি এবং জার্মান তহবিল থেকে আমার অংশীদাররা কিছু টাকা-পয়সা পেয়েছিল।
হারল্যান জ্যাকবসন: অর্থদাতা আর শিল্পীর দৃষ্টিভঙ্গি কি এক থাকে?
ক্রিস্তিয়ান মুনজুউ: তাদের কোনো দৃষ্টিভঙ্গিই নেই! অনেক বছর ধরে আমরা একটা সিনেমা নীতিমালা নিয়ে পীড়াপীড়ি করে আসছি। লোকজন রোমানিয়ান নিউওয়েব নিয়ে অনেক কথা বলে। কিন্তু এই আমরাই ২০০৭ সালে পাম ডি’অর জয়ের সময় একটি প্রোডাকশন স্টান্ডার্ড ঠিক করার সময় পাইনি। এমনকি এরপর আর ব্যবস্থাটাকে সামগ্রিকভাবে তলিয়েও দেখা হয়নি। এখন অর্থায়নের বিষয়টি ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে। প্রদত্ত অর্থের ২৫ শতাংশের মতো আমরা পাই। বাকি ৭৫ শতাংশ যে ফিল্মগুলোর জন্য দেওয়া হয়, তা দেখার মতো না।
সরকারের সিনেমা বিতরণ নিয়েও কোনো নীতিমালা নেই। আমরা কোনো থিয়েটার পাই না। বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সহায়তায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিছু মাল্টিপ্লেক্স গড়ে উঠেছে। কিন্তু মাল্টিপ্লেক্সে ফিল্মি ভাষার অনুভূতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। সিনেমা বোঝে এমন সংগঠিত, কল্পনাপ্রবণ, পরিমার্জিত কেউ আমাদের নেই। ফিল্ম কমিশন বুঝেছিল যে, আমরা জনপ্রিয় এবং বাইরে প্রচুর প্রশংসিত। যার পুরোটাই বিদেশী সংবাদ মাধ্যম এবং কান ফিল্ম ফেস্টিভালের অবদান। ভিনদেশী আগ্রহ উবে গেলে আমাদের এই ফিল্মমেকার প্রজন্ম হারিয়ে যাবে। রোমানিয়ায় সত্যিকার অর্থে আমাদেরকে কেউ বোঝে না এবং সম্মানও করে না। সেখানে সাধারণ ধারণাই এমন, আমরা ছলচাতুরি দেখিয়ে সারা বিশ্বকে বোকা বানিয়েছি; কিন্তু রোমানিয়ানরা এত সহজে বোকা হবার পাত্র নয়!
ফিচার ইমেজ: seanax.com