Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

হলিউডের উত্থানের গল্প: টমাস এডিসন যখন খলনায়ক

চোখের ঘন ভ্রু, লম্বা পাতলা চুল আর আনন্দময় চেহারা দেখে টমাস আলভা এডিসনকে একজন গোবেচারা উদ্ভাবক মনে হতে পারে। কিন্তু তিনি ছিলেন একজন ঝানু ব্যবসায়ী এবং ভয়ংকর প্রতিদ্বন্দ্বী। যেকোনো আবিষ্কারের কৃতিত্ব নিজের উপর নিয়ে নিতেন, আবিষ্কারগুলো তাঁর হোক বা না হোক।

নীল গ্যাবলার (ইতিহাসবিদ)

উনবিংশ শতকের শেষের দিকে এবং বিংশ শতকের শুরুর দিকে ফরাসি অভিনেত্রী সারাহ বার্নহারডট তুমুল জনপ্রিয় ছিলেন। তখন আমেরিকায় চলছিল নিকেলোডিয়নের জমজমাট ব্যবসা। নিকেলোডিয়ন হচ্ছে সেসব সিনেমা থিয়েটার, যেখানে পাঁচ সেন্ট বা এক নিকেলের বিনিময়ে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র দেখা যেত। নিউ ইয়র্ক সিটির এমনই এক নিকেলোডিয়নের মালিক ছিলেন হাঙ্গেরীয় অভিবাসী অ্যাডলফ জুকর। তিনি ১৯১২ সালে সারাহ অভিনীত নির্বাক সিনেমা ‘কুইন এলিজাবেথ’ এর আমেরিকান স্বত্ত্ব কিনে নেন। এতে তার ১৮,০০০ মার্কিন ডলার খরচ করতে হয়।

অ্যাডলফ জুকর; Image Source: jewishcurrents.org

নিজের হলে এটি চালানোর আগে ‘এডিসন ট্রাস্ট’ থেকে অনুমতি নেয়ার নিয়ম ছিল। কিন্তু ট্রাস্টের কাছে মনে হয় সারাহ বার্নহারডট অনেক বড় তারকা। আর সিনেমাটির দৈর্ঘ্যও ৪০ মিনিট, যা তাদের কাছে অনেক বড় মনে হয়েছিল। তাই ট্রাস্টের পক্ষ থেকে এই সিনেমা চালানোর আবেদন নাকচ করে দেয়া হয়। ট্রাস্টের রায় শুনে জুকর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন। তিনি ট্রাস্টের নির্দেশ অমান্য করে নিউ ইয়র্কে নিজেই সিনেমাটি চালানো শুরু করেন। সিনেমাটি যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তি পায় ১৯১২ সালের ১২ জুলাই। এটি ছিল আমেরিকায় প্রদর্শিত সর্বপ্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। মুক্তির পর এটি ব্যবসায়িক সাফল্য পায়। এই সাফল্যে উজ্জীবিত হয়ে জুকর সেই বছরই চালু করেন ‘ফেমাস প্লেয়ারস ফিল্ম কোম্পানি’। বর্তমানে এই সিনেমা স্টুডিওটিই ‘প্যারামাউন্ট পিকচার্স’ নামে বিখ্যাত।

উপরের ঘটনাটি থেকে বেশ কিছু প্রশ্ন আসতে পারে। এডিসন ট্রাস্ট কেন বিখ্যাত অভিনেত্রী থাকায় সিনেমাটিকে প্রত্যাখ্যান করলো? সিনেমার দৈর্ঘ্য বড় হওয়ায় কী সমস্যা ছিল? অ্যাডলফ জুকরকে কেন ট্রাস্টের কাছ থেকে অনুমতি আনতে হবে? আর এই এডিসন ট্রাস্টই বা কী?  

এই প্রশ্নগুলো এবং তাদের উত্তরের সাথেই জড়িয়ে আছে হলিউডের বিশ্বজুড়ে সিনেমার প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠার ইতিহাস। হলিউডের যাত্রা শুরুর গল্প দিয়ে যদি কোনো সিনেমা বা উপন্যাস রচিত হয়, তবে সেই কাহিনীর কোনো নায়ক নেই। এই গল্প পুরোটাই খলনায়কদের। আর সেই খলনায়কদের মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং প্রভাবশালী নাম নিঃসন্দেহে টমাস আলভা এডিসন।

পেটেন্ট যুদ্ধ

১৯১২ সালের আগে হলিউডে কোনো সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি ছিল না। সেখানকার মানুষেরা কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতো। তারা সাইট্রাস জাতীয় ফলের চাষ করতো। আমেরিকায় তখন সিনেমার প্রাণকেন্দ্র ছিল নিউ জার্সির ফোর্ট লি শহরে। তবে বৈশ্বিক চলচ্চিত্র জগতে রাজত্ব ছিল ফ্রান্সের প্যারিসের। প্যারিসের বিখ্যাত দুটি স্টুডিও গাওমন্ট ও প্যাথ-ফ্রেরেস যে পরিমাণ সিনেমা প্রদর্শন করতো তা পুরো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সব স্টুডিওর চেয়ে দ্বিগুণ ছিল। আমেরিকা তখন সিনেমা সম্পর্কিত প্রযুক্তির দিক দিয়ে যত এগিয়ে যাচ্ছিল, তাদের সিনেমা বানানোর গতি ততটা ছিল না। কারণ বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক পুরো সময়টা আমেরিকান স্টুডিওদের মধ্যে পেটেন্ট যুদ্ধ চলতে থাকে।   

টমাস আলভা এডিসন; Image Source: thinkjarcollective.com

শুরুটা হয় ১৮৯২ সালে। টমাস আলভা এডিসন তখন বৈদ্যুতিক বাতি এবং ফনোগ্রাফ আবিষ্কারের জন্য বিখ্যাত। তার অধীনে স্কটিশ তরুণ উইলিয়াম ডিকসন কাইনেটোস্কোপ আবিষ্কার করেন। এটি ছিল প্রথম সিনেমাটিক প্রজেক্টর। কিন্তু এর মূল কৃতিত্ব ডিকসনের হলেও পেটেন্ট করা হয় এডিসনের নামে। এডিসনের কাছে মোশন পিকচার ক্যামেরার পেটেন্টও ছিল। ১৮৯৩ সালে টমাস এডিসন প্রতিষ্ঠা করেন আমেরিকার প্রথম সিনেমা স্টুডিও ‘ব্ল্যাক মারিয়া’।

ব্ল্যাক মারিয়া স্টুডিও; Image Source: onset.shotonwhat.com

১৮৯৫ সাল থেকে যখন আমেরিকায় চলচ্চিত্রের যাত্রা শুরু হয় তখন মূলত স্বল্পদৈর্ঘ্যের নির্বাক চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হতো। তখন কপিরাইট আইন বলে কিছু ছিল না। ফলে অবাধে চলতো পাইরেসি। পাইরেসির জন্য নির্বাচন করা হতো ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের ভালো সিনেমাগুলো। যে স্টুডিও আগে পাইরেসি করতে পারতো তার ব্যবসাই ভালো চলতো। টমাস এডিসনও শুরুর দিকে পাইরেসি করেছেন। এছাড়া চলতো বিখ্যাত উপন্যাসগুলো অনুমতি ছাড়া সিনেমার পর্দায় নিয়ে আসা। তাছাড়া এডিসনের পেটেন্ট করা যন্ত্রপাতি তার অনুমতি ছাড়া অন্য স্টুডিওগুলো ব্যবহার করতো। ফলে এডিসন শুরু করেন পেটেন্ট যুদ্ধ।  

এডিসন ছিলেন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। তিনি তখন প্রতিদ্বন্দ্বী স্টুডিওগুলোকে মামলায় ফেলতে শুরু করেন। কিছু মামলায় তিনি জেতেন, কিছু মামলায় হারেন। তবে হারলেও তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীরা সবাই তাঁর মতো সচ্ছল ছিল না। ফলে একসময় তাদের স্টুডিওগুলো এডিসনের কাছে বেচে দিতে হতো। এছাড়া তিনি বিভিন্নভাবে পেটেন্ট কিনে নিতেন। প্রতিদ্বন্দ্বী স্টুডিওগুলোতে নিজের লোক পাঠাতেন গোপনে। তখনকার পাইরেসির পরও তিনি সফল ছিলেন। প্রথম দশ বছরে তার স্টুডিও থেকে এক হাজারেরও বেশি সিনেমা মুক্তি পায়।

টমাস এডিসনের স্টুডিও সফল হলেও সেটা ছিল দ্বিতীয় স্থানে। প্রথম স্থানে ছিল ‘বায়োগ্রাফ’ স্টুডিও। তাদের আলাদা ভিন্ন মোশন পিকচার ক্যামেরা পেটেন্ট করা ছিল। কিন্তু এডিসন চাইতেন সিনেমার বাজারে তাঁর নিজের একক আধিপত্য। এদিকে আমেরিকা জুড়ে নিকেলোডিয়নের ব্যবসা ছড়িয়ে যেতে লাগলো। একইসাথে বাড়তে থাকলো পাইরেসি। এডিসনের অনুমতি ছাড়া যেসব থিয়েটার তাঁর প্রযুক্তি ব্যবহার করতো, তাদের বিরুদ্ধে তিনি মামলা করতে থাকেন। আদালতে তাদের জরিমানা হতো। কিন্তু একপর্যায়ে দেখা যায়, জরিমানার পরিমাণের চেয়ে নিকেলোডিয়নের ব্যবসায় লাভের পরিমাণ অনেক বেশি। ফলে জরিমানা দিলেও থিয়েটারগুলোর খুব ক্ষতি হচ্ছিল না। এডিসন তখন ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেন।

এডিসনের আধিপত্য

১৯০৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর। টমাস এডিসন চাইলেন পুরো সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিকেই নিজের করে নিতে। এই উদ্দেশ্যে প্রতিদ্বন্দ্বী সব বড় বড় স্টুডিওকে নিয়ে সেদিন আলোচনায় বসলেন। বায়োগ্রাফ, ভিটোগ্রাফ, আমেরিকান মিউটোস্কোপ এবং আরো সাতটি ভিন্ন স্টুডিওকে নিয়ে একটি শান্তিচুক্তি করেন। তাদেরকে নিয়ে ‘মোশন পিকচার পেটেন্টস কোম্পানি’ বা এমপিপিসি প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাব দেন। এটিই এডিসন ট্রাস্ট বা ফিল্ম ট্রাস্ট নামে পরিচিত ছিল। এই প্রস্তাবনা বাস্তবায়িত হলে পুরো সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ থাকবে ট্রাস্টের হাতে। সব প্রতিদ্বন্দ্বীই এই প্রস্তাবনা মেনে নিল।

এডিসন ট্রাস্টের সদস্যরা; Image Source: publishing.cdlib.org

নতুন নিয়মের ফলে সিনেমা বানানো থেকে শুরু করে এর বন্টন, প্রজেকশন, পরিবেশনা সবকিছুর উপর নিয়ন্ত্রণ চলে আসে এমপিপিসির। এই ট্রাস্টের কাজ ছিল এর সদস্যদের পেটেন্টগুলোর অধিকার রক্ষা করা। এর মোট ১৬টি পেটেন্ট ছিল, যার মধ্যে ক্যামেরা, প্রজেক্টর এবং ফিল্ম ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ফলে নতুন কোনো সিনেমা চালাতে হলে ট্রাস্টের কাছ থেকে লাইসেন্স নিতে হতো। ট্রাস্ট তখন প্রযোজক, পরিবেশক এবং প্রদর্শকদের কাছ থেকে রয়্যালটি আদায় করতো।

নতুন নিয়মের ফলে এডিসন অনেক লাভবান হলেও থিয়েটার মালিকদের অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। আগে প্রযোজকদের কাছ থেকে তারা সিনেমা কিনে নিতে পারতো। কিন্তু তখন তাদের ভাড়া নিতে হয়। নিকেলোডিয়ন মালিকদের তখন প্রতি ফুট ফিল্মের জন্য মাসে ১৩ সেন্ট করে দিতে হয় ট্রাস্টকে। এছাড়া তাদের কিছু লাইসেন্স ফিও দিতে হয়। প্রজেক্টরের জন্য প্রতি মাসে ৫ ডলার এবং থিয়েটারের জন্য সপ্তাহে ২ ডলার দিতে হয় তাদেরকে। নিকেলোডিয়ন ব্যবসায়ীদের তখন আর কোনো উপায় ছিল না। কারণ ট্রাস্টকে অর্থ পরিশোধ না করলে তাদেরকে কোনো সিনেমা দেয়া হতো না। কেউ লাইসেন্স ছাড়া সিনেমা প্রদর্শন করলে মামলা করা হতো।  

এডিসন ট্রাস্টের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় নিকেলোডিয়ন ব্যবসায়ীরা; Image Source: historictheatres.org

স্টুডিও মালিকরাও যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিলেন না এমন নয়। ট্রাস্ট থেকে প্রতিটি সিনেমার জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ নির্ধারণ করা হয়। এতে কোনো সিনেমার নির্মাণের খরচের সামঞ্জস্য থাকে না। ফলে স্টুডিওগুলো ভালো মানের সিনেমা নির্মাণে আগ্রহ পাচ্ছিলো না। সিনেমা প্রদর্শনের ক্ষেত্রেও দর্শক চাহিদাকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছিল না। প্রতি সোমবারে পূর্ব নির্ধারিত পাঁচজন প্রযোজকের সিনেমা এবং বুধবারে অন্য নির্ধারিত প্রযোজকদের সিনেমা দেখানো হতো।

এছাড়া ট্রাস্টের আরো অদ্ভুত কিছু নিয়ম ছিল। ট্রাস্টের সিনেমাগুলোতে তারকাদের কৃতিত্ব দেয়া বা কেন্দ্রবিন্দুতে রাখা নিষিদ্ধ করেছিল। কারণ তাদের ভয় ছিল তারকারা বেশি বিখ্যাত হয়ে গেলে তাদের পারিশ্রমিকও বেড়ে যাবে। এছাড়া ইউরোপে তখন পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র জনপ্রিয় হলেও ট্রাস্টের সিনেমাগুলো ২০ মিনিটের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তাদের ধারণা ছিল আমেরিকানরা পূর্ণদৈর্ঘ্য দেখতে আগ্রহী নয়। এসব কারণেই অ্যাডলফ জুকরকে ‘কুইন এলিজাবেথ’ প্রদর্শনে নিষেধাজ্ঞা করেছিল এডিসন ট্রাস্ট।  

ব্যবসায়ীদের অসন্তুষ্টি

নিকেলোডিয়ন ব্যবসায়ীদের মধ্যে আরেকটি ভিন্ন পক্ষ ছিল। তারা ছিল তখনকার তরুণ প্রজন্মের ব্যবসায়ী। তারা ট্রাস্টের সিনেমাগুলোর পরিবর্তে ফ্রান্সের পূর্ণদৈর্ঘ্য নির্বাক সিনেমাগুলো আমদানি করে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করতো। এগুলো ব্যবসাসফল হচ্ছিল। তখন তারা নিজেরাই পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা বানানোর সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ট্রাস্ট তখন বেঁকে বসে। কারণ ট্রাস্টের স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমাগুলো তখন প্রতিদ্বন্দ্বীতায় টিকতে পারবে না। ট্রাস্ট থেকে বরং ইস্টম্যান কোডাক কোম্পানিকে হাত করা হয়। ট্রাস্টের লাইসেন্স ছাড়া কাউকে খালি ফিল্ম দিতে কোম্পানিকে নিষেধ করা হয়। ফরাসি এবং জার্মান সিনেমা প্রদর্শন বন্ধের জন্য এই উদ্যোগ নেয়া হয়। ট্রাস্টের এসব একচেটিয়া নীতি-নির্ধারণীর উপর সিনেমা ব্যবসায়ীরা অসন্তুষ্ট হয়ে ওঠে। এমনকি ট্রাস্টের নিজেদেরই কিছু স্টুডিওগুলোও ছিল বিরক্ত। তারা তখন নিউ জার্সি থেকে সরে যেতে থাকে।

হলিউডের উত্থান

১৯০৬ সালে ৫ ফুট ২ ইঞ্চির এক জার্মান অভিবাসী শিকাগোর একটি নিকেলোডিয়নে সিনেমা দেখতে যান। সিনেমা তাকে এত আকৃষ্ট করে যে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। তার জমানো ৩,০০০ ডলার দিয়ে শিকাগোতে একটি নিকেলোডিয়নের ব্যবসা শুরু করেন। এটি চালু করার নয় মাসের মাথায় তিনি সপ্তাহে ৬,০০০ ডলার করে কামানো শুরু করলেন। তখন তাঁর ব্যবসাকে আরো সম্প্রসারিত করেন। ব্যবসায় অনেক উন্নতি হওয়ায় পরিবারকে নিয়ে চার মাসের জন্য ইউরোপ ভ্রমণে বের হন। কিন্তু ফিরে এসে দেখেন, এডিসন ট্রাস্টের কারণে সিনেমার ব্যবসায় আর আগের মতো সুযোগ নেই।

অভিবাসী ভদ্রলোকের নাম ছিল কার্ল ল্যামলি। তিনি এই ট্রাস্টকে প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯০৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেন নিজের স্টুডিও ‘ইনডিপেন্ডেন্ট মুভিং পিকচার্স কোম্পানি’ বা আইএমপি। তিনি এডিসনের ট্রাস্টকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। চলচ্চিত্র ইতিহাসের প্রথমদিকের একজন তারকা ছিলেন ফ্লোরেন্স লরেন্স। তিনি ট্রাস্টের বায়োগ্রাফ স্টুডিওর সাথে চুক্তিবদ্ধ ছিলেন। ল্যামলি তাকে নিজের স্টুডিওর সিনেমায় নিয়ে আসেন। তাকে নিয়ে ‘দ্য ব্রোকেন ওথ’ সিনেমা নির্মাণের ঘোষণা দেন। এতে ফ্লোরেন্সকে পরিপূর্ণ মর্যাদা দেয়া হয়। তাঁর নাম প্রচার করা হয় গুরুত্বের সাথে।

কার্ল ল্যামলি; Image Source: classic-monsters.com

ল্যামলি একইসাথে ঘোষণা দেন, তিনি এডিসন ট্রাস্টের সাথে কাজ করবেন না। তিনি ফিল্ম এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতি বিদেশ থেকে কিনে আনবেন। একইসাথে বলেন, তাঁর সাথে সিনেমার যন্ত্র প্রস্তুতকারক বা প্রযোজক কাজ করতে চাইলে তিনি রাজি আছেন। থিয়েটার মালিকদেরকে ট্রাস্টের চেয়ে কম দামে তাঁর সিনেমা প্রদর্শনের সুযোগ দেন। টমাস এডিসন তখন আইএমপি এর উপর ২৮৯ বার পেটেন্ট লঙ্ঘনের মামলা করেন। এছাড়া ট্রাস্টের গোয়েন্দারা প্রায়ই আইএমপি’র সেটে হয়রানি করতো। তারপরও আইএমপি ১৯১২ সাল পর্যন্ত টিকে যায়। তারপর ল্যামলি ও এডিসন ট্রাস্টের বাইরে থাকা অন্যান্যরা নিউ জার্সি ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ নিউ জার্সি থেকে যত দূরে থাকবেন এডিসনের নিয়ন্ত্রণ করা ততখানি কঠিন হবে।

নিউ জার্সি ছিল পূর্বাঞ্চলে। পশ্চিমাঞ্চলে ছিল লস অ্যাঞ্জেলস। নিউ জার্সি থেকে দূরে হওয়া ছাড়াও এই অঞ্চল বিভিন্ন কারণে প্রযোজক বা স্টুডিও মালিকদের জন্য সুবিধাজনক ছিল। রেল স্টেশন থাকায় নিউ জার্সি থেকে সিনেমার যন্ত্রপাতি নিয়ে আসার ব্যবস্থা ছিল। আর মেক্সিকো বর্ডারও ছিল কাছাকাছি। তাই এডিসন ট্রাস্ট যদি তাদের পেছনে আসে, তাহলে যন্ত্রপাতি মেক্সিকোতে লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থাও ছিল। তবে প্রযোজকরা লস অ্যাঞ্জেলসে জমি না কিনে কিছুটা দূরে হলিউড শহরের দিকে নজর দেন।

সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি গড়ে ওঠার আগে হলিউড ছিল কৃষিনির্ভর এলাকা; Image Source: kcet.org

হলিউডে জমির দাম ও শ্রমমজুরী তুলনামূলক কম হওয়ায় সিনেমার স্টুডিওগুলোকে তারা এখানে নিয়ে আসেন। এছাড়া এখান থেকে লস অ্যাঞ্জেলস ও টেক্সাস কাছাকাছি ছিল। নিউ জার্সিতে যেখানে অনেক ঠান্ডা ছিল, হলিউডে আবহাওয়া অনেকটাই অনুকূলে। তাছাড়া রকি পর্বতমালা, সমুদ্রসৈকত, বন-জঙ্গল কাছাকাছি হওয়ায় শ্যুটিংয়ে বৈচিত্র আনার সুযোগ ছিল। এদিকে এডিসন তাঁর গোয়েন্দাদের পাঠিয়ে দেন হলিউডে। তিনি কিছু সন্ত্রাসী ভাড়া করেন যারা ট্রাস্টের বাইরের সিনেমার শ্যুটিংয়ের সেটে গিয়ে লাইসেন্সবিহীন ক্যামেরায় গুলি করতো। কিছু প্রযোজককে খুনের চেষ্টাও করা হয়েছিল।

এডিসন ট্রাস্টের পতন

এডিসন তাঁর রাজত্ব পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করলেও শেষ রক্ষা হয়নি। হলিউডে সিনেমার ব্যবসায় অল্প দিনের মধ্যেই অনেক এগিয়ে যায়। কার্ল ল্যামলি আইএমপিকে পরিবর্তন করে এর নাম রাখেন ‘ইউনিভার্সাল পিকচার্স’। এছাড়া অ্যাডলফ জুকরের প্যারামাউন্ট পিকচার্সও হলিউডে চলে আসে। আরো দুটি বড় স্টুডিও গড়ে ওঠে এই সময়। স্টুডিওগুলো হচ্ছে ‘টুয়েন্টিথ সেঞ্চুরি ফক্স’ ও ‘ওয়ার্নার ব্রাদার্স’। বর্তমানে হলিউড তথা বিশ্বজুড়ে এই স্টুডিওগুলো তাদের সিনেমাগুলো দিয়ে রাজত্ব করছে।

অন্যদিকে টমাস এডিসনের অন্যায়ভাবে একচেটিয়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা সরকারের নজরে আসে। এডিসন ট্রাস্টের উপর শারমান এন্টিট্রাস্ট আইন ভঙ্গ করার অভিযোগ আনা হয়। অবশেষে ১৯১৫ সালে টমাস এডিসনের গড়া মোশন পিকচার্স পেটেন্ট কোম্পানিকে ভেঙে দেয়া হয়। তখন থেকেই হলিউডের এগিয়ে যাওয়ার শুরু। সেই সময়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ায় ইউরোপে চলচ্চিত্র নির্মাণ ধীর হয়ে পড়ে। ফলে হলিউড শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই নয়, পুরো বিশ্বজুড়েই জনপ্রিয় হতে থাকে। এক শতাব্দী পার হয়ে যাওয়ার পরও তারা সেই অবস্থান এখনো ধরে রেখেছে।

শেষ কথা

টমাস এডিসন মনে করতেন, চলচ্চিত্র উন্নয়নে যে অবস্থায় পৌঁছেছিল, এর চেয়ে আর উন্নতির সুযোগ ছিল না। এর মধ্যে যে অনেক সম্ভাবনা ছিল তা তিনি উপলব্ধি করতে পারেননি। তখনকার তরুণ প্রজন্ম সুযোগটি গ্রহণ না করলে হয়তো হলিউড আজকের অবস্থানে আসতে পারতো না। তবে সুযোগটি হারিয়েও টমাস এডিসন অখুশি ছিলেন না। কারণ সিনেমা বানানোর চেয়ে এর কারিগরি দিক নিয়েই তাঁর আগ্রহ ছিল বেশি।

This is a Bangla article about rise of hollywood and it's relation with Thomas Edison. All the references are hyperlinked in the article. 

Featured Image:  mentalfloss.com

Related Articles