১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব ছিল বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর মধ্যে অন্যতম। ১৯১৪ সালে মিত্রশক্তির অংশ হিসেবে রাশিয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ১৯১৪ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত কেন্দ্রীয় শক্তিভুক্ত জার্মানি, অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরি ও ওসমানীয় সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে রাশিয়া তীব্র যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। যুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পর থেকেই কেন্দ্রীয় শক্তির আরোপিত নৌ অবরোধের ফলে রাশিয়া মিত্রশক্তির অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্র এবং সমগ্র বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। রুশ রাজতান্ত্রিক সরকারের মধ্যে তীব্র অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং তাদের চরম অকর্মণ্যতা ও দুর্নীতির ফলে রাশিয়া যুদ্ধে অকল্পনীয় ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। রুশ সৈন্যরা ছিল মূলত স্বল্পপ্রশিক্ষিত কৃষক এবং যুদ্ধ চলাকালে জার্মান, অস্ট্রো–হাঙ্গেরীয় ও ওসমানীয় সৈন্যদের হাতে লক্ষ লক্ষ রুশ সৈন্য নিহত, আহত বা বন্দি হয়।
সর্বোপরি, অন্তহীন যুদ্ধের ফলে রুশ অর্থনীতির ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয় এবং রুশ জনসাধারণ চরম ভোগান্তির সম্মুখীন হয়। রুশ জনগণ ও সৈন্যদের মধ্যে চরম যুদ্ধবিরোধী মনোভাব দেখা দেয় এবং ১৯১৭ সালের মার্চে রাশিয়ার রাজধানী পেত্রোগ্রাদে প্রবল গণবিক্ষোভ দেখা দিলে রুশ সৈন্যদের একাংশ বিদ্রোহ করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে রুশ রাজতন্ত্রের পতন ঘটে এবং একটি অস্থায়ী সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। কিন্তু নতুন সরকার রাশিয়ায় বিরাজমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নৈরাজ্য নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হয় এবং কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে, ফলে তাদের জনসমর্থন ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে ১৯১৭ সালের নভেম্বরে ভ্লাদিমির লেনিনের নেতৃত্বাধীন বলশেভিকরা অস্থায়ী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং রাশিয়াকে একটি ‘সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র’ ঘোষণা করে।
বলশেভিকরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং ১৯১৮ সালের মার্চে অপমানজনক ব্রেস্ত–লিতোভস্ক চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে কেন্দ্রীয় শক্তির কাছে বিরাট একটি অঞ্চল হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে এই যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে আসে। কিন্তু এর ফলে রাশিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয় নি। রাশিয়া এককভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে বেরিয়ে আসায় মিত্রশক্তি রাশিয়ার ওপরে ক্ষিপ্ত হয় এবং ব্রিটেন, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের নেতৃত্বে মিত্রশক্তির রাষ্ট্রগুলো রাশিয়ার বিভিন্ন প্রান্তীয় অঞ্চলে আক্রমণ চালায়। তারা রাশিয়ার ওপর একটি কঠোর নৌ অবরোধ আরোপ করে, রাশিয়ার বিভিন্ন প্রান্তীয় প্রদেশগুলোতে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সক্রিয়ভাবে সমর্থন করে এবং রুশ সেনাবাহিনীর বলশেভিকবিরোধী কর্মকর্তাদের (যেমন: আলেক্সান্দর কোলচাক, পিওতর ভ্রাঙ্গেল, আন্তন দেনিকিন এবং নিকোলাই ইয়ুদেনিচ) বলশেভিকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে উৎসাহ যোগায়। এর ফলে রাশিয়া জুড়ে একটি রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, যার ফলে লক্ষ লক্ষ রুশ প্রাণ হারায় এবং রুশ অর্থনীতি, সমাজব্যবস্থা ও রাষ্ট্রযন্ত্র সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়ে।
এই পরিস্থিতিতে ১৯২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে প্রখ্যাত ব্রিটিশ লেখক হার্বার্ট জর্জ ওয়েলস, যিনি এইচ. জি. ওয়েলস নামে সমধিক পরিচিত, সোভিয়েত রাশিয়া সফর করেন। সুবিখ্যাত বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ‘দ্য টাইম মেশিন’ এবং ‘ওঅর অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’–এর রচয়িতা ওয়েলস ছিলেন রাজনৈতিকভাবে একজন সমাজতন্ত্রী এবং ব্রিটিশ সমাজতন্ত্রী সংগঠন ‘ফেবিয়ান সোসাইটি’র সদস্য। ওয়েলস ছিলেন মূলত সমবায়পন্থী (collectivist); মার্ক্সবাদ (Marxism) তথা কমিউনিজমে তার কোনো আস্থা ছিল না। কিন্তু সোভিয়েত রাশিয়া সম্পর্কে তার যথেষ্ট কৌতূহল ছিল এবং তার সোভিয়েত রাশিয়া সফরের অভিজ্ঞতা তিনি ‘রাশিয়া ইন দ্য শ্যাডোজ’ (Russia in the Shadows) বইতে চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
ওয়েলস রাশিয়া সফরকালে পেত্রোগ্রাদ ও মস্কো সফর করেন এবং গৃহযুদ্ধে জর্জরিত সোভিয়েত রাশিয়ার ইউরোপীয় ভূখণ্ড সম্পর্কে ধারণা লাভ করেন। সোভিয়েত রাশিয়া সফরকালে তিনি বিভিন্ন বলশেভিক নেতা, সাহিত্যিক, সঙ্গীতজ্ঞ, বৈজ্ঞানিক, অভিনেতা ও অন্যান্য শ্রেণির ব্যক্তিবর্গের সাক্ষাৎ লাভ করেছিলেন। পেত্রোগ্রাদে তিনি বিশ্ববিখ্যাত সোভিয়েত সাহিত্যিক মাক্সিম গোর্কির বাসায় অতিথি হিসেবে ছিলেন। এ সময় ওয়েলস ‘পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েত’–এর (পেত্রোগ্রাদের আইনসভা) অধিবেশনে অংশগ্রহণ করেন এবং সফরের শেষ পর্যায়ে মস্কোর ক্রেমলিনে খোদ লেনিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তার এই বিচিত্র অভিজ্ঞতা তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন ‘রাশিয়া ইন দ্য শ্যাডোজ’ বইটিতে।
ওয়েলস পেত্রোগ্রাদ ও মস্কো সফর করে একটি হতাশাজনক চিত্র প্রত্যক্ষ করেন। যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষের কারণে এবং বলশেভিকরা ব্যক্তিগত বাণিজ্য নিষিদ্ধ করায় রুশ শহরগুলোর জনসংখ্যা সেসময় ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছিল। শহরগুলোতে জীবনযাত্রার মান নিম্নতম পর্যায়ে নেমে এসেছিল এবং এর ফলে সাধারণ জনগণের পাশাপাশি বিজ্ঞান, শিল্প–সংস্কৃতি ও সাহিত্যের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরাও অত্যন্ত করুণ পরিস্থিতির মধ্যে জীবন কাটাচ্ছিলেন। রুশ শহরগুলোর এই ক্রমাবনতিকে ওয়েলস বিবেচনা করেছিলেন রুশ সভ্যতার আসন্ন ধ্বংসের নিদর্শন হিসেবে। উল্লেখ্য, পেত্রোগ্রাদ শহরটির প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত শহরটির নাম ছিল সেন্ট পিটার্সবার্গ (রুশ উচ্চারণে ‘সাঙ্কৎ পিতারবুর্গ’) এবং ওয়েলস তার বইয়ে শহরটিকে পিটার্সবার্গ হিসেবেই উল্লেখ করেছেন।
কিন্তু একই সঙ্গে রুশ বুদ্ধিজীবীদের জীবনদর্শন ওয়েলসকে মুগ্ধ করেছিল। রুশ বৈজ্ঞানিকরা মিত্রশক্তির আরোপিত অবরোধ এবং নবগঠিত সোভিয়েত সরকারের অবহেলার কারণে প্রায় দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতিতে দিনাতিপাত করছিলেন, কিন্তু এর মধ্যেও তাদের বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেমে থাকেনি। দুর্ভিক্ষ ও যুদ্ধের মধ্যে তাদের সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা ছিল এই যে, অবরোধের কারণে বিদেশি বিজ্ঞান সংক্রান্ত বই ও জার্নাল তাদের কাছে পৌঁছাচ্ছে না এবং এজন্য তারা বহির্বিশ্ব থেকে পিছিয়ে পড়ছেন! রুশ সঙ্গীতজ্ঞরা তাদের প্রায় ফুরিয়ে আসা সঞ্চয় নিয়ে চিন্তিত ছিলেন না, বরং চিন্তা ছিল তাদের ফুরিয়ে আসা মিউজিক্যাল পেপার নিয়ে! এবং এই যুদ্ধাবস্থার মধ্যেও রুশ থিয়েটারগুলো একদিনের জন্যও বন্ধ থাকেনি!
বলশেভিকদেরকে ওয়েলস বর্ণনা করেছেন ‘অকর্মণ্য ও নিষ্ঠুর, কিন্তু সাধারণভাবে সৎ’ হিসেবে। ওয়েলসের মতে, বলশেভিকদের ক্ষমতা লাভের মূল কারণ ছিল তাদের সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি এবং ইচ্ছাশক্তি, যেটি তাদের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ছিল না। কার্ল মার্ক্সের তত্ত্ব অনুযায়ী, শিল্পোন্নত পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোতে প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার কথা ছিল এবং সেই মোতাবেক কৃষিপ্রধান রাশিয়া নয়, বরং শিল্পপ্রধান ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই বিপ্লব হওয়ার কথা। এজন্য রুশ বিপ্লবের প্রায় তিন বছর পরেও পশ্চিম ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় কেন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হচ্ছে না, সেটি নিয়ে বলশেভিকরা উদ্বিগ্ন ছিল। তাদের এই রাজনৈতিক সারল্য ওয়েলসকে একই সঙ্গে হতাশ ও কিছুটা হলেও তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল করে তুলেছিল। বস্তুত, বলশেভিকরা বুঝতে পারেনি যে, রাশিয়ায় যেটা ঘটেছিল সেটি মার্ক্সের বর্ণিত সামাজিক বিপ্লব নয়, বরং পরিপূর্ণ সামাজিক পতন।
পশ্চিমা বিশ্বে বলশেভিকদের অনুকরণে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত না হওয়ায় বলশেভিকরা এশিয়া ও ঔপনিবেশিক বিশ্বের প্রতি ঝুঁকে পড়ছিল এবং ১৯২০ সালের সেপ্টেম্বরে সোভিয়েত আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে ‘প্রাচ্যের জনসাধারণের কংগ্রেস’ আয়োজন করেছিল। এতে এশিয়া, পূর্ব ইউরোপ ও আফ্রিকার বিভিন্ন প্রতিনিধিদল অংশগ্রহণ করেছিল এবং শ্বেতাঙ্গ, কৃষ্ণাঙ্গ, মঙ্গোলয়েড ও অস্ট্রালয়েড সকল বর্ণের মানুষ অংশ নিয়েছিল। এর ফলে রাশিয়া পাশ্চাত্যমুখিতা থেকে মুখ ফিরিয়ে প্রাচ্যমুখী হয়ে পড়তে পারে বলে ওয়েলস আশঙ্কা করছিলেন। ওয়েলসের মতে, গোর্কিও রাশিয়ার প্রাচ্যমুখী হয়ে উঠার সম্ভাব্যতা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলেন। এর মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, পশ্চিমা বিশ্বে প্রাচ্যের তুলনায় পাশ্চাত্যের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে যে মনোভাব প্রচলিত আছে, ওয়েলসও সেই মনোভাব থেকে মুক্ত ছিলেন না।
পেত্রোগ্রাদ শহরের আইনসভা ‘পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েত’–এর একটি অধিবেশনেও ওয়েলস অংশ নিয়েছিলেন। তিনি সেখানে কেবল একজন দর্শক হিসেবেই উপস্থিত ছিলেন না, বরং রীতিমতো একজন সদস্য হিসেবে আইনসভার কার্যপ্রণালীতে অংশ নিয়েছিলেন। ওয়েলসের মতে, ব্রিটেন বা পশ্চিমা বিশ্বের অন্য কোনো রাষ্ট্রে এ রকম অংশগ্রহণমূলক আইনসভার অস্তিত্ব থাকা অসম্ভব। পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েতের কার্যপ্রণালী ছিল চরমভাবে গণতান্ত্রিক, এবং কিছু সদস্য যখন রাশিয়ার দুর্গতির জন্য বলশেভিকদের ‘ধর্মহীনতা’কে খোলাখুলিভাবে দায়ী করছিল, তখন কেউই তাদেরকে নিরস্ত করার চেষ্টা করেনি।
ওয়েলসের সোভিয়েত রাশিয়া ভ্রমণের সবচেয়ে চমকপ্রদ অংশ ছিল লেনিনের সঙ্গে তার সাক্ষাৎকার ও সুদীর্ঘ আলোচনা। তিনি লেনিনকে আখ্যায়িত করেছেন ‘ক্রেমলিনের স্বপ্নচারী’ হিসেবে। যেখানে সমগ্র সোভিয়েত রাশিয়া ছিল যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষে নিমজ্জিত, সেখানে লেনিন সমগ্র রাশিয়াকে বিদ্যুতায়িত করার পরিকল্পনা করছিলেন! ওয়েলসের সঙ্গে আলোচনাকালে লেনিন একমত হয়েছিলেন যে, রাশিয়ায় তখনো সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি এবং এজন্য বলশেভিকদের পরবর্তী বছরগুলোতে প্রচুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে হবে। লেনিন ওয়েলসকে বলেছিলেন, ‘দশ বছর পরে ফিরে আসুন, আপনি এক নতুন রাশিয়া দেখবেন।’
রাশিয়াকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে শোষণ করার জন্য বিভিন্ন পশ্চিমা রাষ্ট্রের, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা সম্পর্কেও ওয়েলস লেনিনের কাছ থেকে জানতে পেরেছিলেন। ওয়েলস যখন লেনিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের জন্য মস্কোয় ছিলেন, তখনই তিনি সেখানে মার্কিন বাণিজ্যিক প্রতিনিধিদের উপস্থিতি লক্ষ্য করেছিলেন, যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সেসময় সোভিয়েত রাশিয়ার কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল না এবং মার্কিন সৈন্যরা তখন রাশিয়ার উত্তর ও পূর্বাঞ্চল দখল করে রেখেছিল।
লেনিন ওয়েলসকে জানান যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত রাশিয়াকে অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান করতে সম্মত হয়েছে এবং সাইবেরিয়ায় চলমান জাপানি আগ্রাসন প্রতিহত করার জন্য মস্কোর সঙ্গে একটি আত্মরক্ষামূলক মৈত্রী গড়তে আগ্রহী। বিনিময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার এশীয় উপকূলে নৌঘাঁটি নির্মাণ করবে এবং কামচাতকা উপদ্বীপ ও এশীয় রাশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদ ৫০ থেকে ৬০ বছরের জন্য ইজারা দিতে হবে। বলাই বাহুল্য, লেনিন এই প্রস্তাবে রাজি হননি।
সোভিয়েত রাশিয়া ভ্রমণ শেষে ওয়েলস উপসংহার টেনেছেন যে, রাশিয়া ছিল একটি পশ্চিমা সভ্যতা, যেটির প্রথম বিশ্বযুদ্ধের চাপে পতন ঘটেছে। এমতাবস্থায় কেবল বলশেভিকদেরই সামর্থ্য রয়েছে রাশিয়াকে নতুন করে গড়ে তোলার। কিন্তু যদি পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়ার বিরুদ্ধে সামরিক ও অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখে, সেক্ষেত্রে সৃষ্ট নৈরাজ্যের ফলে রাশিয়ার শহরগুলো ও রেলপথ ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে এবং এর ফলে কোনো কেন্দ্রীয় সরকারের অস্তিত্ব থাকবে না। রাশিয়া পরিণত হবে অশিক্ষিত ও অদূরদর্শী কৃষকদের দ্বারা অধ্যুষিত প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যবর্তী একটি অস্পৃশ্য দেশে, যেটি হবে দুর্ভিক্ষ ও মহামারীর আখড়া। এবং সস্তা রুশ কাঁচামালের অভাবে পশ্চিম ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোও দরিদ্রতর হয়ে পড়বে, যার ফলে সেগুলোতেও রাশিয়ার অনুরূপ পতন ঘটার সম্ভাবনা দেখা দেবে। এই তিক্ত বাস্তবতা তুলে ধরার মধ্য দিয়ে ওয়েলস তার বইয়ের যবনিকা টেনেছেন।
যে সময় সমগ্র পশ্চিমা বিশ্ব সোভিয়েত রাশিয়াকে ধ্বংসের প্রচেষ্টায় লিপ্ত ছিল, সে সময় এইচ. জি. ওয়েলস একটি নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে সোভিয়েত রাশিয়াকে বোঝার চেষ্টা করেছেন। এজন্য তার এই বইটি নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রমধর্মী।
বইয়ের নাম: রাশিয়া ইন দ্য শ্যাডোজ || লেখক: হার্বার্ট জর্জ ওয়েলস
ভাষা: ইংরেজি || প্রকাশনী: Hodder & Stoughton Ltd. Publishers, London || প্রকাশকাল: ১৯২১