২৩ মার্চ, ২০০৩। মাত্রই বিশ্বকাপ ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে গো-হারা হেরেছে ভারত। তারপরও কলকাতার বাঙালিরা সৌরভ গাঙ্গুলীর নেতৃত্বগুণে মুগ্ধ। তাদের মতে, সৌরভের কারণেই ফাইনাল পর্যন্ত খেলতে পেরেছে ভারত। একই অভিমত ইন্ডিয়া টাইমস পত্রিকার কলকাতা শাখার কর্মরত সাংবাদিকদেরও।
ব্যতিক্রম শুধু রিপোর্টার চন্দ্রচূড় ধর। তার মতে, ইতিহাস কেবল বিজয়ী দলকেই মনে রাখবে। ইতিহাস বলবে, বিশ্বকাপ জিতেছে রিকি পন্টিং-এর অস্ট্রেলিয়া। পাদটীকায় বিজিত দল হিসেবে ভারত ও সৌরভের নাম লেখা থাকবে বটে, কিন্তু আজি হতে শতবর্ষ পরে কে-ইবা খেয়াল করে দেখবে, কী লেখা আছে পাদটীকায়! মোদ্দা কথা হলো, চন্দ্রচূড়ের জীবন-দর্শন: জো জিতা ওহি সিকান্দার। অর্থাৎ, জীবনে চেষ্টা কিংবা লড়াই নয়, জয়টাই মুখ্য।
অথচ এই চন্দ্রচূড়কেই কিনা দেওয়া হলো এমন একজন মানুষকে নিয়ে অ্যাসাইনমেন্ট, যিনি ছিলেন আপাতদৃষ্টিতে জীবনযুদ্ধে পরাজিত এক সৈনিক। বলছি নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর কথা। বাঙালির কাছে তিনি এক চিরকালীন মহানায়ক বটে, কিন্তু ইতিহাস তাকে পরাজিত হিসেবেই জানে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অক্ষশক্তি জাপানের সাথে হাত মিলিয়ে তিনি সংগ্রামে নেমেছিলেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে। যুদ্ধে অক্ষশক্তি হেরে গেলে, মিত্রশক্তির কাছে তিনি পরিণত হয়েছিলেন নিতান্তই এক যুদ্ধাপরাধী হিসেবে।
সেই নেতাজির রহস্যজনক মৃত্যু নিয়ে চন্দ্রচূড়কে অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হলে, কিছুটা যেন অনাগ্রহভরেই কাজটি হাতে নিলেন তিনি। আর সবার মতো নেতাজিকে নিয়ে আবেগে ভেসে তো গেলেনই না, বরং যাচ্ছেতা-ই বলতেও ছাড়লেন না নেতাজিকে নিয়ে।
তবে কাজের জায়গায় চন্দ্রচূড় পরিচয় দিলেন পুরোদস্তুর পেশাদারিত্বের। ব্যক্তিগত অভিমতকে একপাশে সরিয়ে রেখে, কাজটিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নিলেন তিনি। শুরু করলেন গবেষণা। দিনের পর দিন বইয়ের পাহাড়ে মুখ গুঁজে রইলেন, দৌড়ে বেড়াতে লাগলেন এ লাইব্রেরি থেকে ও লাইব্রেরিতে। বিবাহিত চন্দ্রচূড়ের জীবন হয়ে উঠল প্রচণ্ড রকমের ছন্নছাড়া। নেতাজিকে নিয়ে চিন্তা ছাড়া আর কিছুতেই মন বসাতে পারেন না তিনি। এভাবে এক পর্যায়ে স্ত্রীর সাথে বিবাহবিচ্ছেদও হয়ে গেল তার। কিন্তু তাতে যেন কিছুই যায় আসে না চন্দ্রচূড়ের। তার জীবনে তখন কেবল একটিই লক্ষ্য, যেভাবেই হোক উদঘাটন করতে হবে নেতাজির মৃত্যুরহস্য। প্রায় ৬০ বছর ধরে যে সত্যটা মিথ্যার আড়ালে চাপা পড়ে রয়েছে, সেটি এবার বের করে আনতে হবে।
তিন বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেলেন চন্দ্রচূড়, নেতাজিকে নিয়ে গবেষণায়। শেষ পর্যন্ত কোন সত্যের সন্ধান পেলেন তিনি? নেতাজি কি আসলেই ১৯৪৫ সালে প্লেন ক্র্যাশে মারা গিয়েছিলেন, নাকি প্লেন ক্র্যাশের নাটক সাজিয়ে তিনি চলে গিয়েছিলেন রাশিয়ায়? এরপর কি তিনি আবারো ফিরে এসেছিলেন স্বাধীন ভারতবর্ষে? গুমনামি বাবা নামে পরিচিত সাধুর আড়ালের মানুষটিই কি ছিলেন নেতাজি? এবং চন্দ্রচূড় তার গবেষণার মাধ্যমে যে সত্যটা বের করে আনলেন, সেটিকে কি রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হলো?
এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর রয়েছে ‘গুমনামি’ ছবির শেষে। সৃজিত মুখার্জি ও মনীশ পাত্রের রচনায়, এবং সৃজিত মুখার্জির পরিচালনায় নির্মিত ছবিটিতে মূলত নেতাজির মৃত্যু রহস্য নিয়ে গঠিত তিনটি রিপোর্ট, শাহনেওয়াজ কমিটি, খোসলা কমিশন এবং মুখার্জি কমিশনের তত্ত্বগুলোকে উপস্থাপন করা হয়েছে। তবে এই তিনের মধ্যে যেহেতু মুখার্জি কমিশনের রিপোর্টটি সবচেয়ে সাম্প্রতিক, এবং এই ছবির কাহিনীর মূল অনুপ্রেরণা অনুজ ধর ও চন্দ্রচূড় ঘোষ রচিত ‘কোনানড্রাম’ নামের যে বইটি সেখানেও মুখার্জি কমিশনের রিপোর্টটিই প্রাধান্য পেয়েছে, তাই ছবিতেও সেটিকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ফলে নেতাজি যে প্লেন ক্র্যাশে মারা যাননি, বরং গুমনামি বাবা রূপে ফিরে এসেছিলেন, সেই তত্ত্বটিকে এই ছবির সিংহভাগ জায়গা জুড়ে আলোকপাত করতে দেখা যায়।
কলকাতার বৃহত্তম চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থা এসভিএফের ব্যানারে বাংলা ও হিন্দি ভাষায়, ১৩৭ মিনিট দৈর্ঘ্যের ছবিটি মুক্তি পায় ২০১৯ সালের ২ অক্টোবর। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর ভূমিকায় অভিনয় করেন প্রসেনজিৎ চ্যাটার্জি, আর চন্দ্রচূড় ধরের ভূমিকায় অনির্বাণ ভট্টাচার্য। এছাড়াও চন্দ্রচূড়ের স্ত্রী রণিতা ধর হিসেবে একটি ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে ছিলেন তনুশ্রী চক্রবর্তী।
অভিনয় নিয়ে যদি বলতে হয়, নেতাজির ভূমিকায় প্রসেনজিৎ অবশ্যই দারুণ অভিনয় করেছেন। কিন্তু আজকাল বায়োপিকগুলোতে যেমন দেখা যায়- অভিনেতারা চরিত্রটির সাথে একদম মিশে যাচ্ছেন, সেই প্রবণতাটির কিছুটা খামতি অনুভূত হয়েছে এই ছবিতে। তাছাড়া ইতঃপূর্বে ‘মনের মানুষ’-এর মতো ছবিতে লালন ফকির চরিত্রে যে অভিনয় প্রসেনজিৎ করেছিলেন, তাতে তার ওপর প্রত্যাশা আরো বেশিই ছিল। তবে এরপরও এই ছবির প্রসেনজিতকে কোনোভাবেই ছবির দুর্বলতা বলা যাবে না, কেননা এটি তো আর সেই অর্থে কোনো বায়োপিক নয়।
ফ্ল্যাশব্যাকে কখনো সাদা-কালো, আবার কখনো রঙিন পর্দায় নেতাজি রূপে প্রসেনজিতকে যতবার দেখা গেছে, মন্দ লাগেনি। বিশেষ করে ছবির একদম প্রথম দৃশ্যে, যেখানে নেতাজিকে কথা বলতে দেখা যায় মহাত্মা গান্ধী এবং জওহরলাল নেহেরুর সাথে, সেখানে প্রসেনজিতের পর্দায় উপস্থিতি ছিল দুর্দান্ত। গান্ধী বা নেহেরুর চেয়ে নেতাজি যে কোনো অংশে কম নন, বরং কাহিনীর প্রয়োজনে আরো মহৎ, সেই চাহিদাটি খুব ভালোভাবেই পূরণ করেছেন গত দশকের শুরুতে সৃজিতের হাত ধরে ক্যারিয়ারে নবজন্ম লাভ করা প্রসেনজিৎ।
তবে নেতাজি হিসেবে প্রসেনজিতকে নিয়ে কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকলেও, তার ছিটেফোঁটা নেই চন্দ্রচূড় ধর হিসেবে অনির্বাণকে নিয়ে। এ মুহূর্তে কলকাতার সেরা অভিনেতাদের একজন তিনি। ইতোমধ্যেই তার মাঝে অনেক বড় কিছুর সম্ভাবনা দেখতে শুরু করে দিয়েছে অনেকে। তাই তিনি এ ছবিতে কেমন করেন, সেটি নিয়ে আগ্রহ ছিল তুঙ্গে। এবং বলতেই হবে, নিজের কাজটি দুর্দান্ত করেছেন তিনি। একজন আত্মনিবেদিত অথচ প্রচণ্ড রকমের অন্যমনস্ক সাংবাদিক কাম গবেষক চরিত্রের নিজের অভিনয়শৈলীর পুরোটা উজাড় করে দিয়েছেন তিনি।
কখনো খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, কখনো মুখভর্তি দাঁড়ি, কখনো ক্লিনশেভড- সব ইমেজেই অনির্বাণ অসাধারণ। চন্দ্রচূড় ধরের সংগ্রামময় তিনটি বছর যেভাবে ফুটে উঠেছে অনির্বাণের অভিনয়ে, তাতে দর্শকও খুব সহজেই একজন গবেষকের পরিশ্রমটা উপলব্ধি করতে পারবে।
২০১৮ সালটা পরিচালক সৃজিতের জন্য স্মরণীয় ছিল। সে বছর ‘উমা’ দিয়ে দর্শকের হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার পর তিনি মাত করেছিলেন ‘এক যে ছিল রাজা’ দিয়ে। দ্বিতীয় ছবিটির ভাগ্যে জুটেছিল জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ অসংখ্য সম্মাননা। সে ধারাবাহিকতা তিনি বজায় রেখেছেন ২০১৯ সালেও। এ বছর তার তিনটি ছবি মুক্তি পেয়েছে: ‘শাহজাহান রিজেন্সি’, ‘ভিঞ্চি দা’ এবং ‘গুমনামি’। প্রথম দু’টি ছবিও বেশ আলোড়ন তুলেছিল বটে, তবে সবার চোখ ছিল আসলে ‘গুমনামি’-র দিকে। আর তা হবে না-ইবা কেন! একে তো নেতাজিকে নিয়ে ছবি, তার উপর আবার মুক্তির আগেই একের পর এক বিতর্ক একে ঘিরে। এক পর্যায়ে তো ছবিটির মুক্তিও হয়ে পড়েছিল অনিশ্চিত। শেষ পর্যন্ত সব বাধা পেরিয়ে দর্শকের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাওয়া ‘গুমনামি’ কি পেরেছে দর্শকের মন জয় করতে?
একদম শুরু থেকে শুরু করা যাক। ছবির প্রারম্ভেই জানিয়ে দেওয়া হয়, ছবির কাহিনী তিনটি পৃথক রিপোর্টের মিশেল। কিন্তু যেমনটি আগেই বলেছি, একটি নির্দিষ্ট রিপোর্টের প্রতিই পরিচালকের অনুরক্তি বেশি ছিল। এবং সেটি হওয়াও খুবই স্বাভাবিক। কেননা একদম নিরপেক্ষভাবে ছবির কাহিনীবিন্যাস সম্ভব ছিল না। তাই ছবির পোস্টারেও পরিষ্কারভাবেই মুখার্জি কমিশন শুনানির কথা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, ছবির প্রথম দৃশ্যেই একসাথে নেতাজি, গান্ধীজী ও নেহেরুর যে নাটকীয় দৃশ্যায়ন, এবং পরে সনু নিগমের কণ্ঠে ‘সুভাষজি’ গানটি, সেগুলো দর্শকের হৃৎস্পন্দন বাড়িয়ে দিতে সক্ষম।
তবে ব্যক্তিগতভাবে সবচেয়ে ভালো লেগেছে চন্দ্রচূড় ধর চরিত্রটির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার অংশটি। চন্দ্রচূড় চরিত্রটির মুখে ক্ষুরধার সংলাপ শুনে তার প্রেমে পড়ে যাবেন যে কেউ। নেতাজিকে নিয়ে নির্মিত ছবিতে তার পাশাপাশি আরেকটি চরিত্রও যেহেতু সমান গুরুত্বপূর্ণ, তাই তাকে প্রথমবার এভাবে তুলে ধরাটা দর্শকমনে দীর্ঘস্থায়ী ছাপ ফেলার জন্য অত্যন্ত দরকারি ছিল। সৃজিতের মুনশিয়ানা ও ‘ব্যোমকেশ’ অনির্বাণের সহজাত অভিনয়ে সম্ভব হয়েছে সেটি। এছাড়া এই অংশেই সৌরভ গাঙ্গুলীর অধিনায়কত্বের সাথে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নেতাজির লড়াইয়ের মাঝে সংযোগ স্থাপন ছিল একটি মাস্টারস্ট্রোক।
বর্তমান প্রজন্মের দর্শক, যারা নেতাজির ব্যাপারে খুব একটা অবগত নয়, তাদেরকেও নেতাজির প্রতি আগ্রহী করে তুলতে এই অংশটির ভূমিকা ছিল অনবদ্য। এই অংশটি আরো যে উদ্দেশ্য পূরণ করেছে তা হলো, শুরুতে চন্দ্রচূড়ের মনে নেতাজির ব্যাপারে নেতিবাচকতা তুলে ধরা, যাতে পরবর্তী সময়ে তার গবেষণায় নতুন নতুন তথ্য উঠে আসা এবং নেতাজির ব্যাপারে তার মনোভাবের পরিবর্তন তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে।
শূন্য দশকের প্রেক্ষাপটে চন্দ্রচূড়ের ভাগটুকু অবশ্য অনেকের কাছেই বিরক্তিকর ও অপ্রয়োজনীয় মনে হতে পারে, যারা ‘গুমনামি’ দেখবেন কেবলই নেতাজিকে দেখার জন্য। কিন্তু মনে রাখতে হবে, পরিচালক এখানে অতীতের নেতাজির সাথে বর্তমান সময়ের একটি যোগসূত্র স্থাপন করতে চেয়েছেন, এই সময়ে নেতাজি সম্পর্কে বাঙালির দৃষ্টিভঙ্গিকে সূক্ষ্মভাবে তুলে ধরতে চেয়েছেন। সব মিলিয়ে বলা যায়, নেতাজির ভাগ ছবির মূল প্রাণ হলেও, গভীরের ভিত হিসেবে সেটিকে শক্তি যুগিয়েছে চন্দ্রচূড়ের ভাগটিই।
ছবির ন্যারেটিভ স্টাইল অবশ্য তেমন কোনো নতুনত্ব তুলে ধরেনি। এ ধরনের ছবিতে, এমনকি ‘এক যে ছিল রাজা’-তেও যেভাবে কোর্টরুম ড্রামায় ফ্ল্যাশব্যাকের মাধ্যমে অতীতকে দেখানো হয়েছিল, ‘গুমনামি’-তেও ঠিক সেভাবেই কাহিনীবিন্যাস করেছেন সৃজিত। তবে তারপরও কাহিনীর প্রতি দর্শকের আকর্ষণে ভাঁটা পড়ার কথা নয়। বরং মুখার্জি কমিশন রিপোর্ট সম্পর্কে যাদের পূর্ব ধারণা নেই, ছবির শেষ ভাগে গিয়ে উত্তেজনায় তাদের দমবন্ধ হবার জোগাড় হতেই পারে।
তাই বলে কি ‘গুমনামি’-তে কোনো খামতি নেই? আলবৎ আছে। চন্দ্রচূড়ের অংশে বেশ কয়েকবারই অতিরঞ্জন বা অতি নাটকীয়তার জন্ম দেয়া হয়েছে। যেমন: স্ত্রী ঘনিষ্ঠ হতে চাইলেও চন্দ্রচূড়ের বইয়ের পাতায় বুঁদ হয়ে থাকা। নিজের কাজে চন্দ্রচূড় কতটা আচ্ছন্ন হয়ে আছে, তা ফুটিয়ে তুলতে এই দৃশ্যের ভূমিকা ছিল বটে, কিন্তু সেটি আরো বাস্তবসম্মত ও যৌক্তিক করার সুযোগ ছিল। এমন আরোপিত কোনো দৃশ্য ছবিতে না থাকলেই বোধহয় ভালো হতো।
ছবির আরেকটি পশ্চাৎপদতা হলো গুমনামি বাবার অংশে। এমনকি ছবির পোস্টারেও, নেতাজির ভূমিকায় অভিনয় করা প্রসেনজিতই যে গুমনামি বাবার চরিত্রেই অভিনয় করছেন, সেটি শুরু থেকেই একেবারে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া। তাই নেতাজিই (প্রসেনজিৎ) যে গুমনামি বাবা, তা খোলাসা হওয়া নিয়ে যে একটি শ্বাসরুদ্ধকর দৃশ্যের অবতারণা ঘটতে পারত, তা এতে ছিল অনুপস্থিত। অবশ্য পরিচালক যদি অতিনাটকীয়তা এড়ানোর জন্য এ অংশটি ছবিতে না রেখে থাকেন, তাহলে অবশ্য ঠিক আছে।
যারা ‘গুমনামি’ ছবিটি এখনো দেখেননি, কিন্তু এই লেখা পড়ার পর দেখতে আগ্রহী, তাদেরকে আবারো মনে করিয়ে দিতে চাই, এটি কিন্তু নেতাজির পুরোদস্তুর কোনো বায়োপিক নয়। তার জীবনের (কিংবা জীবন-পরবর্তী সময়ের) একটি অংশের উপরই কেবল এ ছবিতে আলোকপাত করা হয়েছে। এবং ছবিটি যতটুকু নেতাজি বা গুমনামি বাবার, ঠিক ততটুকুই চন্দ্রচূড়েরও।
এরপরও ছবিটি কেন দেখবেন, তার পেছনে কয়েকটি কারণ দেখানো যেতে পারে। সর্বপ্রধান কারণ হলো: নেতাজির মৃত্যুরহস্য নিয়ে জানার জন্য। এ বিষয়ে এখন অবধি অনেক বই-ই লেখা হয়েছে বটে, কিন্তু সেগুলো পড়ার সময় আপনার না-ও থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে সহজ উপায় হতে পারে এ ছবিটি দেখে নেয়া। তবে মনে রাখবেন, এ ছবিতে যা দেখেছেন, সেগুলোকেই ধ্রুবসত্য ধরে নেবার কোনো কারণ নেই। যদি এ ছবি দেখার পর নেতাজির মৃত্যুরহস্য নিয়ে আপনার মনে আগ্রহ সৃষ্টি হয়, তাহলে আপনার উচিত হবে এ বিষয়ে অন্যান্য বইপত্র থেকে আরো বিশদে জানা, এবং তারপরই নিজে থেকে কোনো সিদ্ধান্তে আসা।
এছাড়াও ছবিটি দেখার পেছনে আরেকটি কারণ হতে পারে- প্রথমবারের মতো সৃজিতের ছবিতে মুখ্য দুই চরিত্রের একটিতে অনির্বাণের অভিনয় দেখা, কিংবা সামগ্রিকভাবে সৃজিতের বর্ণিল নির্মাণ ক্যারিয়ারেরই নবতম সংযোজনটির সাথে পরিচিত হওয়া। এ মুহূর্তে হয়তো কেবল নেতাজির মৃত্যুরহস্য নিয়ে বিতর্কের কারণেই ‘গুমনামি’ নিয়ে এত আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে, কিন্তু ভবিষ্যতে একটা সময় আসবে, যখন পরিচালক সৃজিতের একটি ছবি হিসেবেই বড় ধরনের গবেষণার নমুনা উপাদানে পরিণত হবে ‘গুমনামি’।