সিরিজের একটি এপিসোডের একটি দৃশ্যে দেখা যায় কেন্দ্রীয় চরিত্র অঞ্জলি ভাটি (সোনাক্ষী সিনহা)-কে তার মা যখন এক পাত্রের ছবি দেখাচ্ছে, সোনাক্ষী তখন বালিশের নীচ থেকে অনেকগুলো মেয়ের ছবি বের করে মায়ের সামনে ছড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘এই ২৯ জন’ মেয়ে মৃত, কারণ তাদের মায়েরাও সারাটা দিন বিয়ে দেওয়া নিয়ে তাদের কানের কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর করতো। নীচু জাতের মেয়ে, তাই সহসা কেউ বিয়ে করতে চাইতো না। তার উপর মায়েরা সারাক্ষণ বিয়ে নিয়ে এমন যন্ত্রণা দিতো, মেয়েগুলোরও মনে হতো, বিয়ে না হলে মরে যাওয়া ছাড়া তাদের কোনো গতি নেই। জগত-সংসারে বিয়েতে বসে যাওয়াই তাদের একমাত্র সদগতি!
তখন যে ছেলেই একটুখানি ভালোবাসার আশা জাগিয়েছে তাদের মনে, তারা দৌড়ে গিয়েছে। আর এই সাইকোপ্যাথ সেই সুযোগ নিয়েই ২৯ জনকে হত্যা করেছে।’ তাদেরকে রাতের পর রাত ফুসলিয়ে, প্রেমের নাটক করে, মিথ্যা প্লট সাজিয়ে পালিয়ে যাবার পরিকল্পনা করতে বাধ্য করেছে। তারপর পালিয়েছে। বিয়ের আশা দেখিয়ে সঙ্গমে বাধ্য করেছে। এবং কৌশলে সায়ানাইড খাইয়ে মেরে রেখে গেছে!
৮ পর্বের এই ‘দাহাড়’ সিরিজ এমনই এক জঘন্য সাইকোপ্যাথকে ধরার গল্প নিয়ে। সাইকোপ্যাথ মাত্রই তো অসুস্থ, জঘন্য। ওতে আবার অ্যাম্ফ্যাসিস করবার কী আছে! ওই দৃশ্য বর্ণনার সাথেই অবশ্য গল্পের গতিপ্রকৃতি জুড়ে দিয়েছি। তবে দৃশ্যটি বর্ণনার কারণ হলো, গোটা সিরিজের যে বক্তব্য, সেটার সারমর্ম ওই দৃশ্যেই। সোনাক্ষী সিনহার যে চরিত্র, অঞ্জলি ভাটি, সে একজন পুলিশ অফিসার। কিন্তু পুলিশ হওয়া সত্ত্বেও তাকে নীচু হতে হয়, কারণ সে নীচু জাতের। পুলিশের পোশাক তার জাত উঁচুতে নিয়ে যেতে পারবে না; এমনটাই তো শেষে বলে ওই সাইকোপ্যাথ। পুলিশ হওয়া সত্ত্বেও তার মা সর্বদা তটস্থ কোনোভাবে মেয়ের জন্য পাত্র জোগাড় করা নিয়ে। নীচু জাতের তো!
সহজে বিয়ে করবে কে! হোক না পুলিশ। তো ওই সূত্র ধরেই ত্যক্তবিরক্ত হয়ে সোনাক্ষী সেই সংলাপ দেয় (শুরুতে বর্ণিত), মায়ের মুখোমুখি বসে। সেখানেই, সোনাক্ষীর মায়ের চরিত্রেই ভারতীয় উপমহাদেশের এই আবহমান কালের পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার আবাদী সেই ধারণা প্রকাশ পায়। মেয়ে যত যা-ই কিছু হোক, ছড়ি তার পুরুষের হাতেই। পুরুষ ছাড়া সে চলবে কী করে! প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে আসছে এই ভয়, এই ধারণা। সোনাক্ষীর মা সেটারই প্রতীক। তাই মেয়ে নিজে প্রতিষ্ঠিত হবার পরও, কীভাবে তার বিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে- সেটা নিয়েই মায়ের যত চিন্তা।
সিরিজের গল্প তো এতক্ষণে বোঝা হয়ে গেছেই। একজন সিরিয়াল কিলার, যে নীচু জাতের মেয়েদের প্রেমের ফাঁদে ফেলে, ঘর থেকে ভেগে যাবার প্ররোচনা দিয়ে, বিয়ের স্বপ্ন দেখিয়ে সঙ্গমে লিপ্ত হয়। তারপর জন্মনিরোধক বড়ির সাথে সায়ানাইড মিশিয়ে খাইয়ে মেরে ফেলে! তবে এটা কিন্তু ‘হুডানইট’ নয়। শুরু থেকেই দর্শক জানে, কে সেই খুনী/সাইকোপ্যাথ। এটা মূলত ‘হাওডানইট’ এবং শেষত ‘হোয়াইডানইট’। পুরোপুরি পুলিশ প্রসিডিওরাল বা পুলিশি তদন্ত প্রক্রিয়াধর্মী সিরিজ এটি।
শুনে মনে হতে পারে, রুটিন গল্পের বয়ান। তবে ‘দাহাড়’ সিরিজে ভিন্ন মাত্রা যোগ হয় এই রুটিন স্ট্রাকচার কিংবা ন্যারেটিভ ফ্রেমের ভেতর দিয়ে এটা যেভাবে গোটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার বয়ান দেয়। হ্যাঁ, সেটাও অনেক সিরিজ দেয়/দিতে পারে। তবে ‘দাহাড়’ একদম শেকড়ে প্রোথিত মিসোজিনি (নারীবিদ্বেষ) আর পুরুষতান্ত্রিকতাকে উপস্থাপন করেছে। এবং সেটাও যথেষ্ট প্রগাঢ়তার সহিত।
‘দাহাড়’ দেখিয়েছে, এই উপমহাদেশে মিসোজিনি কীভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়ায়। সাইকোপ্যাথ ভিজয় ভার্মার বাবার চরিত্রেই সেই সাবটেক্সট লুকিয়ে আছে। ৭ নাম্বার এপিসোডে, ভিজয় ভার্মা যখন বাবার বাড়িতে আশ্রয় নেয়, তখন বাবার সাথে মৌখিক বিবাদে জড়ালে বাবা তাকে “দানব” বলে। ভিজয় ভার্মা তখন প্রত্যুত্তর দেয়, “দানব তো তুমি। তোমারই তো রক্ত।” এবং এরপর কথায় কথায়, ছেলেবেলায় তাদের মা মারা যাবার রহস্য সামনে আসে! মায়ের মৃত্যু যে স্বাভাবিকভাবে হয়নি! এবং সেই জায়গাতেই ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের পাশাপাশি মিসোজিনি বা নারীবিদ্বেষও কীভাবে পূর্বপুরুষ থেকে উত্তমপুরুষ উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করে (!) আর সমাজে যেভাবে এটা একটা স্বাভাবিক বিষয় হিসেবেই পরিগণিত হয়- সেই বক্তব্য উপস্থাপিত হয়।
দাহাড়ের চিত্রনাট্যই আসলে এর চমৎকারিত্বের জায়গা। ন্যারেটিভ ফ্রেমওয়ার্কে যত চেনা বৃত্তই থাকুক, এর লেখায় শেকড়প্রোথিত একটা ব্যাপার আছে, যা একে অত্যন্ত বাস্তবিক করে তোলে, এবং অনেক ক্ষেত্রেই সেটাকে এই উপমহাদেশীয় সমাজব্যবস্থার ডকুমেন্টেশন বলা যায়। আর তার সাথে অনেক লেয়ার আর নানামুখী মাত্রা যোগ করে সুঢৌল আকৃতির, সঠিক অঙ্গসৌষ্ঠব ও সুগভীর একটি চিত্রনাট্য হয়েছে দাহাড়ের। সিরিজের আরো একটি শক্তিশালী দিক হলো, এর প্রতিটি চরিত্রকে যেভাবে লেখা এবং ভিজ্যুয়ালি রূপায়িত করা হয়েছে। ভারতীয় সিরিজের ক্ষেত্রে এটা বেশ বিরল। প্রতিটি চরিত্রের সমস্যা, জটিলতা এবং দ্বন্দ্ব সুস্পষ্টভাবে উপস্থিত।
সোনাক্ষীর অঞ্জলি ভাটি চরিত্রটি হয়েছে এই পলিটিক্যালি কারেক্ট থাকার যুগের ‘স্পিরিটেড উইমেন’। তাতে সমস্যা নেই, কারণ নারীর ক্ষমতায়ন দেখাবার বিষয়টি অত স্থূলভাবে কাজ না করে, সুমসৃণ আর স্বাভাবিক নিয়ত ছন্দে কাজ করেছে। সোনাক্ষী সিনহা বা অঞ্জলি ভাটি নীচু জাতের হওয়াতে নিজের পরিচিতি আর জায়গা করে নিতে সর্বদা তাকে লড়াই করতে হয়। সে নাজুকতা প্রদর্শন করে না সহসা, কারণ ওই পর্যায় পার করে, দুর্বলতাকে দৃঢ়তায় রূপান্তর করেছে সে। এবং শেষে গিয়ে দেখা যায়, যতটুকু দ্বন্দ্ব সেটাকেও ঘুচিয়ে নিজের আসল পরিচয়ই আপন করে নেয় সে। তাকে তার গোত্রপরিচয়ের জন্য হেনস্তা হতে হয় নানা জায়গায়, তবে সে শক্ত হয়ে দাঁড়ায় ওর বিরুদ্ধে। আর এই দিকটি সোনাক্ষী তার বাচিক অভিনয় এবং শরীরী অভিনয়; দু’দিকেই ভালোভাবে আয়ত্ত করেছে।
ভিজয় ভার্মার সাইকোপ্যাথ চরিত্রটি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের এই স্ট্রাকচারাল মিসোজিনিকে অধিগত করার পাশাপাশি এই উপমহাদেশীয় পুরুষদের নারীকেন্দ্রিক হিপোক্রেসিকেও একইরকম দক্ষতার সাথে অমোঘরূপে ধারণ করেছেন। তার অভিনয়ের বিস্তৃত সীমার প্রশংসা করতেই হয়। উল্টোদিকে আছে সোহম শাহর পার্গি চরিত্র। অন্যরকম এক অভিঘাতী তল খুঁজে পেয়েছে এই চরিত্রটি। কারণ, এই চরিত্র দিয়েই চিত্রনাট্যকারদ্বয় সিরিজের অন্যতম সূক্ষ্ম আর জটিল একটি বিষয় উপস্থাপন করেছেন। নুন্যোক্তভাবে। ‘অ্যান্টি-নাটালিজম’কে এনে এই সিরিজ সাহস আর অন্যরকম পরিপক্বতার পরিচয় দিয়েছে। “বিয়ে করো, বাচ্চা পয়দা করো। এতেই জীবন শাশ্বত, সাফল্যমণ্ডিত”- এই যে আবহমান কাল ধরে আমাদের মাঝে গেড়ে বসে থাকা এই ধারণা, যা এই সময়ে এসে বদলাচ্ছে, সেই প্রজননবাদের বিপরীতে গিয়ে দাঁড়ানোর সাহস এই সিরিজ রেখেছে। সোহম শাহর চরিত্র যে মুহূর্তে জানতে পারে যে সে বাবা হতে চলেছে, তখনই সে মানসিকভাবে এক অমোঘ দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হয়।
এই ভয়ংকর পৃথিবীতে, এই নারীবিদ্বেষ ভরা সমাজ ব্যবস্থায় সে নতুন কোনো প্রাণ আনতে চায় না। এবং এই চাওয়া সম্পর্কে কাউকে বলতে না পেরে অক্ষম ক্রোধে ভোগে সে। এই দ্বন্দ্বই অন্যরকম তল আর মাত্রা দিয়েছে, চরিত্র এবং সিরিজ উভয়কেই। এছাড়া চাকরির ক্ষেত্রেও একটা ধূসর জায়গায় দেখা যায় তাকে। এবং এই নানামুখী জটিলতাকে নিজের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করার কাজ দারুণ বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছেন সোহম শাহ। প্রকৃত অভিনেতার মতো অনায়াসেই তা করেছেন। পার্গি চরিত্রের ব্রেকিং পয়েন্ট ধরা যায় যখন সে বড় স্যারের কাছে বাকি দুই সহকর্মীর ব্যাপারে সন্দেহের কথা বলতে যায় (কিন্তু বলে না)। একা একা বসে নিজের মধ্যেই ভাংচুর হয় সে। খুব বেশি স্থূলতার পরিচয় এই জায়গায় দেওয়া হয়নি, যেটা ভালো দিক, তবে নুন্যোক্ত থাকলেও তাকে আরেকটু জায়গা দেওয়া উচিত ছিল। বিশেষ করে এর পরপরই বাচ্চা নেবার সিদ্ধান্তে তার যে পরিবর্তন, সে যে রাজি হয়- এই ব্যাপারে তাকে আরেকটু বিশ্লেষণ করবার দরকার ছিল। হুট করে এই পরিবর্তন একটু আরোপিত মনে হয়েছে। জোর করে আশাবাদী বানানো যেন।
এরপর গুলশান দেভায়াহর চরিত্রও বেশ ‘আদর্শ’ একটা চরিত্র হয়েছে। সে হিপোক্রেট না, নারীবিদ্বেষী না। তার স্ত্রীর মধ্যেও গেড়ে বসে থাকা সংকীর্ণ দৃষ্টির প্রভাব সে তার মেয়ের উপর পড়তে দেয় না। সে বিশ্বাস করে, নিজের বস্ত্র আর রুটির ব্যবস্থা নিজে করতে পারার মাঝেই সর্বোচ্চ সম্মান। বন্ধুর মতো ছেলের পাশে বসে, ছেলেকে যখন যৌনশিক্ষা সম্পর্কে জানায়, অদ্ভুত এক কমনীয়তা আর পরিপক্বতা যোগ হয় তাতে। আবার বউয়ের সাথে সংগমের মুহূর্তে হুট করে অঞ্জলির চিন্তা তার মাথায় আসে, তখন সাথে সাথেই সে যেভাবে অনুতপ্ত হয়- তা তার চরিত্রে উদ্ভূত জটিলতাকেই নির্দেশ করে।
গুলশান দেভায়াহর চরিত্র সেখানে গৎবাঁধা বলিউডি আচরণ না করে পুরোপুরিই প্রফেশনাল গণ্ডিতে থাকে। এটাও চিত্রনাট্যের পরিণত স্বভাবই প্রদর্শন করে। আর এই চরিত্রে গুলশান দেভায়াহর সূক্ষ্ম এবং নিয়ন্ত্রিত অভিনয়ের কারণে অতি নীতিমূলক হওয়া ছাড়াই, চরিত্রটি হয়ে ওঠে সবচেয়ে ভরসাযোগ্য একটি চরিত্র। এছাড়া, বাদবাকি যেসব চরিত্র- সাইকোপ্যাথের শিকার হিসেবেও এক এক করে যে মেয়েগুলো এসেছে, স্বল্প সময়েও তাদের চরিত্রগুলো কী ভালোভাবে ফুটিয়ে তোলা! কোনো অতিরঞ্জন নেই, অতি ড্রামাটিক কিছুই নেই। দুই পরিচালক- রীমা কাগতি আর রুচিকা ওবেরয়ের সুদক্ষ ট্রিটমেন্টের ফলেই সেটা সম্ভব হয়েছে।
দাহাড়ের গোটা প্রেক্ষাপট রাজস্থানে সেট করাও অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত কাজ হয়েছে। একইসাথে নারীবিদ্বেষ, ঘোর পুরুষতান্ত্রিকতা, আর জাতপাতের তীব্র বৈষম্য ধরতে রাজস্থানের চেয়ে সঠিক প্রেক্ষাপট আর কোনটি হতে পারে! হ্যাঁ, পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা; নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ কোথায় নেই? গোটা ভারতেই আছে। এই সিরিজ ওসবের সাথে উঁচুনীচু জাতগোত্রের বিভেদকেও যোগ করেছে। এবং আগের দুটোর সাথে এটাও সমভাবে পাওয়া যাবার কথা আসলে তো রাজস্থানের নামই আগে আসবে। রাজস্থানের পরিবেশেই রুক্ষতা আছে। আর রাজস্থান নিয়ে অন্যান্য কনটেন্ট দেখলেও তো সেই ব্যাপারটি আঁচ করা যায়। বছর দুয়েক আগের একটি হরর সিনেমা, ছোড়ি, সেটার প্রেক্ষাপট রাজস্থান। এবং সিনেমায় কীভাবে সেই জায়গায় মেয়ে হিসেবে জন্ম নেওয়াটা অভিশাপ তারই বয়ান করে। কিংবা ‘ফিল্মিস্তান’ (২০১১)-এর একটা কমেডি সিনেমার কথাই ধরুন। সেটার উদ্দেশ্যই হলো সিনেমার মাধ্যমে ভারত-পাকিস্তানের বন্ধন মজবুতের আহ্বান। তো সেই সিনেমার দুটি চরিত্র টেরোরিস্ট, এবং সেটার প্রেক্ষাপট কোথায় পড়লো- রাজস্থানেই।
এছাড়া রাজস্থানি প্রেক্ষাপটে গেলবছরের ‘দহন’ ওয়েবসিরিজেও দেখা যায় নারীদের প্রতি ডমেস্টিক ভায়োলেন্সের সাবটেক্সট। কিংবা সেই কালের মনি কৌলের সিনেমা ‘দুবিধা’ও তাই তুলে ধরে। মোদ্দাকথা হলো এই- রাজস্থানি সেটিংয়ে অন্য গল্প বলা ছাড়া যদি রাজস্থানের গল্পই বলা হয়- সেক্ষেত্রে এই নিগূঢ় ব্যাপারগুলো এড়াবার কোনো সুযোগই নেই।
দাহাড়ের চিত্রনাট্যের স্তুতি তো আগেই গাওয়া হয়েছে- এর বক্তব্যের, বক্তব্যের রূপায়নের, চরিত্র গঠনের এবং সামগ্রিক ন্যারেটিভ স্ট্রাকচারের। কোনো টান টান ভাগদৌড়, ক্ষণে ক্ষণে গল্পবাঁক নেই এতে। কিন্তু তদন্তনির্ভর ড্রামা হয়েই অবিরত গতিতে এগিয়েছে এই সিরিজ। এপিসোড বাই এপিসোড ধরে। কোনো ক্লেশ জাগায়নি। এর প্রধান কারণ এত সুতীক্ষ্ণ, সমঝদার আর বাস্তবতা নিংড়ানো লেখনী। সাথে প্রত্যেকের সুনিয়ন্ত্রিত অভিনয়, যেটার সাধুবাদ রীমা কাগতি ও রুচিকা ওবেরয়কে দিতে হয়। এবং দুজনের পরিচালনায়ও পরিণত আর পরিমিত ভাবটা ছিল। ছন্দের পতন ঘটেনি। আবার ঠিকঠাক সংসক্তিও ছিল দুজনের পরিচালনায়। তাই দেখতে গিয়ে কোথাও থমকাতে হয় না। থমকাতে হয়, তো রূঢ় বাস্তবতার চিত্রায়ন আর বক্ত্যবের স্পষ্টবাদিতা দেখে। সফট লাইটিং আর ওয়াশড কালার প্যালেটের অ্যাস্থেটিকে রাজস্থানি রুক্ষতা আর পেলবতা দুটোই পাওয়া যায়। ভিজ্যুয়ালি দেখতে সুন্দর লাগে।
তবে এটাও বেশ প্রশংসাযোগ্য যে, শুধুমাত্র সুন্দর দেখানোর জন্য সিনিক শটের বাহুল্য এখানে নেই। প্রতি এপিসোডের প্রি-টাইটেল সিন, যেখানে সায়ানাইড খেয়ে এক মেয়ের মৃত্যুকেই টুকরো টুকরো অংশে বিভক্ত করে দেখানো হচ্ছিল, ওটার বিষাদময় আবহসঙ্গীত একটা হন্টিং কোয়ালিটি এনে দেয় গোটা দৃশ্যে। যেন ‘ডেথ অভ দ্য ভার্জিন’! হ্যাঁ, দুই-একটা ত্রুটি তো এতে আছেই। ধারাবাহিকতার ত্রুটি ওগুলো। ফোন খুঁজে পাবার পর ওটার ফলোআপ একটু দেরিতে হয়েছে। পার্গি একটা কেস দেখছিল- প্রাপ্তবয়স কপোত-কপোতী ভেগে যাবার, জাতগোত্রের সীমানা ভুলে। ওদের গোত্র যে প্রেমে নয়, হিংস্রতায় বিশ্বাসী! তো এই কেসের সাবপ্লট হঠাৎ করেই কর্পুরের মতো মিলিয়ে যায়। হ্যাঁ, সেটাকে সিরিজ নিজেই আবার স্বীকার করেছে। তবে ওতে সংসক্তি নষ্ট হয় কিছুটা। ভিজয় ভার্মার চরিত্রের বিটও আরো ওপরে ওঠানো যেত। তাকে ধরবার জন্যই যেন কিছু জিনিস অতি সহজ করে দেওয়া হয়েছে। তবে সে যে আদতে ভুলত্রুটিওয়ালাই একটা সাইকোপ্যাথ সেটা বেশ আলগোছেই রূপায়িত হয়েছে। তা যাক। ওসব বাদে, মূল গতিপ্রকৃতি আর চালিকাশক্তি সমান্তরালেই ছিল।
গেল ডিসেম্বর (‘২২) আমাজন প্রাইমেই একটা তামিল সিরিজ এসেছিল ‘ভাধান্ধি’ নামে। একটা মিস্ট্রি থ্রিলার সিরিজ আদতে পুরোদস্তুর সোশাল ড্রামা। অ্যান্ড্রু লুইয়ের লেখা ও নির্মাণের এই সিরিজ ভেলোনি নামের এক তরুণী মারা যাবার পর মার্ডার মিস্ট্রি হিসেবে শুরু হয়। ন্যারেটিভ এগোয় ‘রশোমন ইফেক্ট’ দিয়ে। একেক এপিসোড একেক দৃষ্টিকোণ থেকে বর্ণিত হয়। এবং সবাই ওই তরুণীর চরিত্রের দোষ ধরতে ব্যস্ত। কী ভয়ানক প্রাসঙ্গিক এই সিরিজ! সমাজের চোখে সব দোষ যে মেয়েদের, সেটাকেই যত কোণ আছে সব কোণ ধরে-ধরে চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়। একদলা বিদ্রুপ ছুড়ে দেয় সমাজ আর তার ব্যবস্থার প্রতি। শেষে গিয়ে উপহার দেয় নিগূঢ় হতাশা! সেই ভাধান্ধির পর এই দাহাড় আরেকটি সিরিজ, যেটি এক অকপট সমাজচিত্রের বয়ান দেয়। সাহসের সাথে, স্পষ্টতার সাথে।