মালায়লাম সিনেমাগুলো ভারতের অন্যান্য সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি, বিশেষ করে বলিউডের চেয়ে বহুগুণে এগিয়ে আছে। সম্প্রতি তারা ‘মালিক’ নামে এমন এক সিনেমা বানিয়েছে, যেটা বলিউড কখনোই বানানোর সাহস করত না। এমনকি এই সিনেমাও সেন্সরবোর্ড রিলিজ পেতে দিত কিনা, সন্দেহ আছে; ওটিটি প্ল্যাটফর্ম থাকায় রক্ষা। সিনেমার গল্প লিখেছেন এবং পরিচালনা করেছেন মহেশ নারায়ণ, যিনি ‘সি ইউ সুন’-এর মতো ‘আন-অর্থোডক্স’ সিনেমার পাশাপাশি ‘বিশ্বারূপম’-এর মতো অ্যাকশন প্যাকড মাস ফিল্মও বানিয়েছেন। এই সিনেমাটি তার ড্রিম প্রজেক্ট। শুধু বাজেটস্বল্পতার কারণেই এটি অনেকদিন আটকে ছিল।
সিনেমা শুরু হয় প্রায় ১৪ মিনিটের একটি ওয়ান শট সিঙ্গেল টেক দিয়ে, বিরিয়ানী নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে আলী ইক্কার (ফাহাদ ফাসিল) গাড়িতে চড়া পর্যন্ত। ওই একটি শটেই পরিচালক আমাদের সব গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন ও পুরো সিনেমাতে তাদের ভূমিকা কেমন হতে পারে, সে সম্পর্কে আভাস দিয়ে রেখেছেন। সিনেমা এগিয়েছে তিনটি টাইমলাইন ধরে। ফাহাদ ফাসিলের যৌবন, ক্ষমতা অধিগ্রহণ থেকে পরিণতি- এই ছিল তিনটি টাইমলাইনের উপজীব্য বিষয়।
সিনেমার মূল চরিত্র একজন মুসলিম। বলিউড বা অন্যান্য ইন্ডাস্ট্রিতে যে মুসলিম স্টেরিওটাইপ দেখানো হয়, সে রাস্তায় মালায়লাম ইন্ডাস্ট্রি কখনোই হাঁটেনি। ‘মালিক’ও তার ব্যতিক্রম নয়। এখানে মুসলিম সম্প্রদায়কে যথাসম্ভব বাস্তবভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এবং রাজনীতিবিদেরা তাদের রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের জন্য কীভাবে এক সম্প্রদায়ের সাথে আরেক সম্প্রদায়ের দাঙ্গা লাগিয়ে দেয়, তা-ও তুলে ধরা হয়েছে। আর কিছু ক্ষেত্রে ভারতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লড়াইয়ের চিত্রও প্রতিফলিত হয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে, কেন শুরুতে বলেছি যে সেন্সর বোর্ড এই সিনেমা মুক্তি নিয়ে অব্যশই ঘাপলা করত।
সিনেমায় আলী ইক্কার জীবনপ্রবাহ, স্কুল শিক্ষিকার সন্তান থেকে চোরা চালানে হাতেখড়ি সেখান থেকে মানুষের ভরসা অর্জন, নেতায় পরিণত হওয়া, অতঃপর পরিণতি এই হলো সিনেমার কাহিনীবিন্যাস। আমরা আলী ইক্কার এই যাত্রায় দেখি, সে কীভাবে নিজ ধর্ম পালনে কিছু বাধার সম্মুখীন হয়। সবচেয়ে ভালো বন্ধুর সাথে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়, যেখানেও প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছিল ধর্ম। এবং অবশেষে কীভাবে সে নিজ এলাকার ও সম্প্রদায়ের দণ্ডমুণ্ডের হর্তাকর্তায় পরিণত হয়। সিনেমাটি অত্যন্ত উপভোগ্য। সবচেয়ে বড় কথা হলো, বর্তমান সময়ের জন্য বেশ প্রাসঙ্গিক একটি পলিটিক্যাল থ্রিলার হলো ‘মালিক’।
ফাহাদ ফাসিল কোনো সিনেমায় অভিনয় করবেন, আর তাকে নিয়ে আলাদা স্তুতি গাওয়া হবে না- এ বোধহয় সম্ভব নয়। এই লোকটি দিন দিন নিজেকেই ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। তিনি যে চরিত্রেই অভিনয় করেন না কেন, একদম পুরো মিশে যান যেন সেই চরিত্রের সাথে। ‘মালিক’-এ যুবক, উচ্ছল, চটপটে আলী ইক্কা থেকে প্রৌঢ়-সতর্ক আলী ইক্কার রূপান্তরটা পর্দায় তিনি খুব ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তার সংলাপ বলা, অভিব্যক্তি, অঙ্গভঙ্গি সবকিছু ছিল যথাসাধ্য নিখুঁত।
বলা হয়, ফাহাদ ফাসিল নাকি চোখ দিয়ে কথা বলতে পারেন; যার প্রমাণ পাওয়া যায় কুম্বালাঙ্গি নাইটসের সেই ‘রেমন্ড দ্য কমপ্লিট ম্যান সিন’-এর চোখ দিয়ে ঠিকরে বের হওয়া আত্মবিশ্বাস, আয়ান্নাম রাসূলামের আধো আলোয় দরদ ঝরে পড়া থেকে নর্থ ২৪ কান্থামের বিরক্তি পর্যন্ত। ফাহাদ ফাসিলের চোখই যথেষ্ট, তার অনুভূতি প্রকাশের জন্য। মালিকেও আমরা দেখি ফাহাদের চোখের কারিশমা। ছেলের মৃত্যু থেকে ভাগ্নের সাথে বাক্য বিনিময়ে ফাহাদের চোখ দেখলেই বোঝা যায়, তার ভেতরে কী চলছে।
আবু ও ডেভিড চরিত্রে অভিনয় করা অভিনেতারাও তাদের সেরাটা দিয়েছেন। বিশেষ করে ডেভিডের কথা বলতেই হবে। তার চরিত্রের ভেতরকার দ্বন্দ্বমুখরতা তিনি খুব ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছে। এবং রোজালেন তার জায়গা থেকে সেরাটা দিয়েছেন। মেকআপহীন তরুণী রোজালিন খুবই প্রাণবন্ত ছিলেন। যদিও খুব বেশি স্ক্রিনটাইম তিনি পাননি, কিন্তু যেটুকুই পেয়েছেন, তাতে একদম নিংড়ে দিয়েছেন নিজেকে।
‘মালিক’ শুধু গল্প আর অভিনয়ের দিক দিয়ে নয়, টেকনিক্যালিও অনেক সমৃদ্ধ একটি সিনেমা। শুরুতেই বলা হয়েছে সেই ১৩ মিনিটের সিঙ্গেল শটের কথা। এই মুভির বিজিএমও বেশ দক্ষ, এটা অবশ্য মালায়লাম প্রায় সব ছবির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। সাউন্ড ডিজাইন ও ভয়েস মডুলেশনেও তাদের দক্ষতার জবাব নেই। মুভির গল্প ও সিকোয়েন্স ভেদে বিজিএম খুব ভালোভাবে মিশে গিয়ে দর্শকের জন্য এক স্মরণীয় দৃশ্যমান অভিজ্ঞতার জন্ম দেয়।
সিনেমাটির সিনেমাটোগ্রাফি করেছেন সানু জন ভার্গিস। যিনি এর আগে ‘লুটকেস’, ‘টেক অফ’, ‘ওয়াজির’, ‘জার্সি’-এর মতো সিনেমায় কাজ করেছেন। সিনেমার কিছু কিছু শট ছিল একদম চোখে লেগে থাকার মতো। ডেভিড বাইকে করে আসার সময় গুদামে বিস্ফোরণ, ফাহাদের সৈকতে বসে থাকা সহ প্রতিটি ফ্রেমে ভার্গিস তার কারিশমা দেখিয়েছেন। আর সেট ডিজাইনেও প্রচুর পরিশ্রম দেওয়া হয়েছে। পুরাতন ও বর্তমান টাইমলাইন ভালোভাবে আলাদা ডিজাইন করা হয়েছে, যা একদম বাস্তবসম্মত মনে হয়েছে। কালার গ্রেডিংও ছিল ‘পিকচার পারফেক্ট’। টেকনিক্যাল দিক কমতি রাখা হয়নি।
খুবই সময়োপযোগী একটি পলিটিক্যাল থ্রিলার ‘মালিক’। একসময় মালায়লাম সিনেমা ছিল অশ্লীলতার জন্য অবদমিত। সেই থেকে তারা এখন ভারতে একটি আন্তর্জাতিক মাপদণ্ড নির্ধারণ করে ফেলেছে। ফাহাদ ফাসিল কী অসাধারণ কাজগুলোই না করছেন ওটিটি-তে। নিজেকে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন তিনি। বাংলাদেশেও বর্তমানে ওটিটি প্ল্যাটফর্মের সমৃদ্ধির দিন শুরু হয়েছে। একসময় আমাদেরও হুমায়ুন ফরীদি, নূর, আফজাল হোসেনরা ছিলেন এবং কেউ কেউ এখনো আছেন। আশা করা যায়, বর্তমান প্রজন্মের অভিনেতারাও সুযোগ পাবেন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে নিজেদের সেরাটা দেবার।