
যেকোনো বই হাতে নিলেই শুরুতে আমরা বোঝার চেষ্টা করি, নামটা যা দেখছি তার সাথে কভার ডিজাইন দেখে ভেতরের কন্টেন্ট অর্থাৎ আলোচ্য বিষয় নিয়ে কতটুকু আইডিয়া করা যায়। এই বইয়ের প্রচ্ছদ দেখে মোটা দাগে মনে হবে, একটা তালায় চাবি প্রবেশের ছিদ্র দিয়ে লেখক হয়তো এই বইয়ে বিক্রয়পেশার সাথে যুক্ত লোকজনকে কোনো একটা মুক্তির উপায় বাতলে দিতে চাইছেন।
সেই একই আপনি (অর্থাৎ পাঠক) যদি পুরো বই শেষ করে এরপর কভারের দিকে মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করেন, তাহলে বড় সেই চাবি ঢোকানোর গর্ত থেকে বরং এর নিচে ছোট করে দাঁড়ানো দুজন মানুষের দিকেই নজর যাবে। খেয়াল করে দেখুন, একটু পেছনের দিকে দাঁড়ানো লোকটির হাতে ব্রিফকেস, দেখেও তাকে বেশ অভিজ্ঞই মনে হচ্ছে। ওদিকে দরজার আরেকটু কাছে দাঁড়ানো মানুষটির হাতে ব্রিফকেস না থাকাটা তাকে একধরনের ‘নবীন’ বা ‘সাহায্যপ্রার্থী’ হিসেবে প্রকাশ করতে চাওয়ারই চিত্রিত রুপ। অভিজ্ঞ লোকটির কাছ থেকে নবীন লোকটি (এক্ষেত্রে বিক্রয়কর্মী) নিশ্চয়ই মূল্যবান, বহু কাঙ্ক্ষিত কোনো পরামর্শ পেয়েছে। তাই তো হ্যান্ডশেক করে সে বিফলতার প্রকোষ্ঠ থেকে সফল এক দুনিয়ার পথে পা বাড়াতে চাইছে!

আচ্ছা, তাহলে বোঝা গেল যে নামকরণের সাথে বইয়ের প্রচ্ছদ ডিজাইন বেশ ভালোভাবেই সংযুক্ত, আর এক্ষেত্রে বইটি সফলও হয়েছে। কিন্তু মূল যে বিষয়, অর্থাৎ বইয়ের আলোচ্য বিষয়াদি, সেগুলোর বেলায় কি তাহলে একই কথা খাটবে? লেখক কি সেখানেও সফল হয়েছেন?
একবাক্যে বললে, লেখক শুধু সফলই হননি, বরং নতুন এক দিগন্তই উন্মোচন করে দিয়েছেন! নতুন কিছু জানার, বোঝার, নতুন করে চিন্তার জন্য যেসব তথ্যের সমাহার মাত্র ১৩৬ পৃষ্ঠার এই বইয়ে লেখক ঘটিয়েছেন, তা বিক্রয়পেশার সাথে যুক্ত যে কারো জন্য তো বটেই, এর বাইরেও যারা অনুসন্ধিৎসু পাঠক হিসেবে আছেন, তাদের জন্যও বেশ মূল্যবান এক তথ্যের খনি হিসেবে কাজ করবে।
মোটা দাগে ৪ ভাগে বিভক্ত এই বইটিতে আলোচনা করা হয়েছে সর্বমোট ৪১টি বিষয় নিয়ে। তবে মজার ব্যাপার হলো, এই ৪১টি বিষয় আসলে আমাদের সবার জীবনেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দেখা ৪১টি পরিস্থিতির কথা বলে। এই পরিস্থিতিগুলোকে ফুটিয়ে তুলতে লেখক আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল ছাড়াও তার নিজের জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা, নিজের নানা অনুসন্ধানও এর সাথে যুক্ত করেছেন, যাতে একজন পাঠক খুব সহজেই বইটির আলোচ্য বিষয়বস্তুর সাথে নিজেকে একাত্ম করে নিতে পারেন। সত্যি বলতে, পুরো বই জীবন্ত করে তুলতে আসলে লেখকের এই গুণ সবচেয়ে কাজে এসেছে, যা পাঠককে এমন এক অনুভূতি দেবে যে তিনি যেন লেখকের সামনে বসেই বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জানতে পারছেন।
তবে এখানে লেখক আবার আপত্তির কথা জানিয়ে দিয়েছেন শুরুতেই। তার মতে, বইয়ে গুরুত্বপূর্ণ নানা বিষয় আলোচিত হয়েছে তা সত্য, তবে কেউ যেন তা মুখস্ত করতে না যায়। কারণ তাহলে এই বইয়ের যে মূল বার্তা, মূল রস- সেটার স্বাদ নিতেই ব্যর্থ হবেন পাঠক। সেজন্য তার পরামর্শ হলো- পাঠক যেন আর আট-দশটা বইয়ের মতোই এই বইটি পড়ে যান শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। কেবলমাত্র তাহলেই গল্পের মতো বিষয়গুলো পাঠকের মাথায় গেথে থাকবে। কথাটা যে একেবারেই অসত্য না, তা বই শেষ করে নিজেই বুঝতে পারছি।

পাশাপাশি আরেকটা কথাও বলে রাখা ভাল। বইটির লেখক শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের একজন অধ্যাপক। একজন শিক্ষক এমন একটি বই লিখেছেন, যা বিক্রয়পেশার বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা দিয়েই ভরপুর। ফলে বিক্রয়পেশার সাথে সংযুক্ত যে কেউ এমন প্রশ্ন করতেই পারেন, “যার নিজেরই বিক্রয় সম্পর্কে বাস্তব অভিজ্ঞতা নাই, তার বই পড়ে আর কী শিখব?” বলে রাখা ভাল, আগের বাক্যের প্রশ্নটা আমার না, বরং বইয়ের শুরুতেই ‘যে কথাগুলো আপনার জানা দরকার’ নামের একটি অংশে লেখক নিজেই নিজের প্রতি এই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন, এবং সেই প্রশ্নের অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য উত্তরও দিয়েছেন। সেটাও সামান্য কিছু আলাপ না, পাঁচ পৃষ্ঠা জুড়ে যুক্তির মাধ্যমেই লেখক বুঝিয়ে দিয়েছেন সব।
ব্যক্তিগতভাবে ৪১টি অধ্যায় উপভোগ করলেও বেশি উপভোগ করেছি ‘কে বেশি গুরুত্বপূর্ণ- ক্রেতা নাকি ভোক্তা?’, ‘নদীতে মাছ ধরা আর নগরে ক্লায়েন্ট ধরা’, ‘শুধু ডিজিটাল নয়, অ্যানালগও দরকার’, ‘নিজেকে ভালোবাসুন, সাথে নিজের কাজটাকেও’, ‘ব্যবস্থাপনা সক্ষমতা ও নেতৃত্বের গুণাবলী’, এবং সর্বশেষে ‘হুজুরের ইউটিউব সংকট’ অধ্যায়গুলো। প্রতিটি অধ্যায়ই শিক্ষণীয়, তবে এখানে কেবলই আমার ব্যক্তিগত পছন্দের কথা বললাম।
এতক্ষণ তো কেবলই প্রশংসা করে গেলাম, এবার একটু উন্নতির দিকগুলো কী কী আছে দেখা যাক:
১) বইয়ের ভেতরে বিভিন্ন জায়গায় ইংরেজি শব্দ এসেছে (বাংলা বা রোমান হরফে), এসেছে ইংরেজি বাক্য ও সংজ্ঞাও। এগুলো যদি বাংলায় ভাষান্তর করে দেয়া যেত, তাহলে সেটা বইয়ের সৌন্দর্য ও গ্রহণযোগ্যতাকে আরও বৃদ্ধি করবে নিঃসন্দেহে, কারণ সেসবের বাংলা প্রতিনিয়তই ব্যবহার করে চলেছি আমরা।
২) যেসব জায়গায় লেখক কোনো অনলাইন ভিডিও সাইট থেকে তথ্য নিয়েছেন (যেমন- ইউটিউব), সেসব ক্ষেত্রে তথ্যসূত্র হিসেবে সেই লিঙ্কটাই তুলে দেয়া আছে পৃষ্ঠার নিচে। এই বিষয়টি বইয়ের বেলায় বেশ বেমানান। কারণ এখান থেকে তো কেউ আর কপি-পেস্ট করে ল্যাপটপ বা মোবাইলে দেখতে পারছেন না। এর চেয়ে যদি সেই ভিডিওর নামটাই উল্লেখ করে দেয়া হতো (প্লাটফর্মের নাম পাশে দিয়ে), তাহলেই হয়ে যেত।
উল্লেখিত পরামর্শ দুটো একজন পাঠক হিসেবে লেখক-প্রকাশক উভয়ের জন্যই। আশা করছি উভয়পক্ষই এসব নিয়ে কাজ করে পরবর্তী সংস্করণে আরও চমৎকার রূপে বইটি পাঠকদের হাতে তুলে দিতে পারবেন।

পাঠকদের জন্য জ্ঞানের আরেকটা খনি দিয়েছেন লেখক বইয়ের শেষেও। সেখানে এই বিষয়ে আরও জানার জন্য ২৭টি বইয়ের নামও যুক্ত করে দিয়েছেন। ফলে এই বইটিকে ভিত্তি ধরে যে কেউ যদি আরও এগোতে চায়, সেই সুযোগও রয়েছে।
এই বইটি পড়ার জন্য আপনাকে সেলসপার্সন হতে হবে এমন না। ক্রেতা হিসেবে নিয়মিতই আমাদের নানা জিনিস কিনতে হয়। এই সময়গুলোয় বিক্রেতাদের মনস্তত্ব বুঝতে, তাদের জীবনসংগ্রামের গল্প বুঝতেও সাহায্য করবে বইটি।
…
বই: ফেইলিওর ইন সেলস || বিক্রয়চেষ্টা ব্যর্থ হবার কারণ ও প্রতিকার
লেখক: মো. আব্দুল হামিদ
প্রকাশনা সংস্থা: স্বরে অ
মুদ্রিত মূল্য: ২৭০ টাকা (পেপারব্যাক), ৩৪০ টাকা (হার্ডকভার)
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ‘২০
ফেইলিওর ইন সেলস বইটি পেতে লিংকে ক্লিক করুন।