যুগ যুগ ধরেই প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা আমাদের একের পর এক বিস্ময় উপহার দিয়ে চলেছে। প্রায় তিন হাজার বছর ধরে এই সভ্যতা ছিল একপ্রকার অপ্রতিদ্বন্দ্বী। একে শাসন করেছে নিষ্ঠুর সব শাসকগোষ্ঠী, যারা ফারাও নামেই বেশি পরিচিত। তাদের করা বিভিন্ন পৈশাচিক কর্মকান্ড মানব ইতিহাসে বিরল। অসীম ক্ষমতা, অফুরন্ত বিত্ত, অবিশ্বাস্য পদমর্যাদা যেকোনো ব্যক্তিকে খুব সহজেই অন্ধকার দিকে নিয়ে যাবার জন্য যথেষ্ট। আর ঠিক এটিই ঘটেছিল প্রাচীন মিশরের ফারাওদের সাথে। রাজবংশের পর রাজবংশ এক পাপে ভরা দুনিয়ায় বুঁদ হয়ে ছিল। পৃথিবীর বুকে একেকজন ফারাও যেন ছিলেন একজন অত্যাচারী স্বৈরাশাসক, দাম্ভিক ব্যক্তিত্ব এবং বিকৃত যৌনাচারীর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
ফারাওরা নিজেদের ঈশ্বর বলে দাবি করতেন। যদিও বিভিন্ন মানবিক ত্রুটি, যেমন: কামনা, লালসা, লোভ ইত্যাদির উর্ধ্বে তারা কখনোই উঠতে পারেননি। ফারাওদের নিষ্ঠুরতার গল্প শুনলে যে কেউ তাদের উন্মাদ ভেবে ভুল করতে পারেন। বিভিন্ন ফারাওয়ের নিষ্ঠুরতা, তাদের অপকর্ম, লাগামহীন যৌনতা এবং জনগণের ওপর তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি নিয়ে শুরু হতে যাওয়া কয়েক পর্বের ধারাবাহিকের মধ্যে আজ থাকছে প্রথম পর্ব।
প্রাচীন মিশরে একজন ফারাও ছিলেন, যিনি তার প্রজাদের সবসময়ই অসম্মান করতেন এবং মূল্যহীন ভাবতেন। প্রজাদের তিনি শুধু নিজের প্রয়োজনের জন্য ব্যবহার করতে ভালোবাসতেন। তিনি হলেন দ্বিতীয় পেপি। তার রাজকীয় নাম ছিল নেফারকারি। তিনি পুরাতন রাজত্বের শেষের দিকের ফারাও ছিলেন। আর তখন ছিল প্রাচীন মিশরের স্বর্ণযুগ। দ্বিতীয় পেপি মিশরের ইতিহাসে সব থেকে লম্বা সময় ধরে ফারাও ছিলেন। তার রাজত্বকাল ছিল ৯৪ বছর।
দ্বিতীয় পেপি বা নেফারকারিকে নিয়ে একটি বিখ্যাত লোককাহিনী প্রচলিত আছে। তিনি তার শরীরে মাছি বসা একদমই পছন্দ করতেন না। তাই মাছির উপদ্রব থেকে বাঁচতে তিনি একজন দাসকে নিযুক্ত করেছিলেন, যার কাজ ছিল নিজের পুরো শরীরে মধু ঢেলে দাঁড়িয়ে থাকা, যেন মাছিগুলো দাসটির দিকে আকৃষ্ট হয়! আদতে এটি ছিল একেবারেই একটি নগণ্য ঘটনা। তবে এ থেকে নেফারকারির খামখেয়ালীপনার ব্যাপারে একটি ভালো ধারণা পাওয়া যায়।
বিভিন্ন অদ্ভুত ও উদ্ভট জিনিসের প্রতি নেফারকারির ছিল দুর্বার আকর্ষণ। তিনি একবার তার সৈন্যদের দক্ষিণ-সাহারা (নুবিয়া) অভিযানে পাঠালেন। সেখান থেকে তার লোকেরা ফিরে আসলো এক অদ্ভুত সংবাদ নিয়ে। তারা বললো, নুবিয়া অভিযানে তারা একধরনের খর্বাকৃতি মানুষের খোঁজ পেয়েছে। দেখতে ছোটখাট গড়নের ঐসব মানুষের সাথে মিশরীয়দের উচ্চতার বিস্তর ফারাক। এটা শোনার পর নেফারকারি মনস্থির করে ফেলেন, যেভাবেই হোক তার ঐ ধরনের খর্বাকৃতির একজনকে চাই-ই চাই! তিনি তার সৈন্যদের বলেন, “আমি আর কিছুই চাই না, তোমরা শুধু ঐ বামনকে দিন-রাত পাহারা দাও আর আমার কাছে জীবন্ত অবস্থায় নিয়ে আসো।“
এক পাথরে খোদিত হায়ারোগ্লিফিক লিপি থেকে আমরা জানতে পারি, ঐ পিগমিকে মিশরে আনার একমাত্র কারণ ছিল নেফারকারির মনোরঞ্জন।
ফারাও নেফারকারি শুধু নিজের কথাই ভাবতেন। অন্যরা তাকে নিয়ে কী ভাবছে না ভাবছে, এতে তার কিছুই যায় আসতো না। কিন্তু প্রাচীন মিশরে আরও একজন শাসক সম্পর্কে আমরা জানতে পারি, যিনি নিজের ভাবমূর্তি নিয়ে খুঁতখুঁতে স্বভাবের ছিলেন। এটা এমন এক পর্যায়ে পৌছে গিয়েছিল যে, তিনি নিজের প্রসিদ্ধির জন্য প্রজাদের সামনে মিথ্যা পর্যন্ত বলেছিলেন।
ফারাও দ্বিতীয় রামেসিস (রাজত্বকাল: ১২৭৯ খ্রি.পূ.- ১২১৩ খ্রি.পূ.) ছিল তার নাম। তিনি ছিলেন মিশরের ঊনবিংশতম রাজবংশের তৃতীয় ফারাও। তিনি তার রাজত্বকালে অনেক যুদ্ধ জিতেছেন এবং অনেক নগর, মন্দির ও সৌধ নির্মাণ করেছেন। আরও নির্মাণ করেছিলেন নিজের বিশাল বিশাল সব প্রতিমূর্তি।
দ্বিতীয় রামেসিস ছিলেন একজন নির্লজ্জ আত্মপ্রচারক। তিনি নিজেকে মহান, শক্তিশালী যোদ্ধা এবং তার রাজত্বের রক্ষাকর্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তিনি আবু সিম্বেল নামে একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যার প্রবেশদ্বারের উভয়পাশে দুটি করে তার নিজের প্রতিমূর্তি রয়েছে। প্রতিটি প্রায় ৩০ মিটার করে উঁচু।
দ্বিতীয় রামেসিসের মন্দিরের দেয়ালে খোদাই করা হায়ারোগ্লিফিক লিপি থেকে কাদেশ এর যুদ্ধ সম্পর্কে আমরা জানতে পারি। এই যুদ্ধটি সংগঠিত হয়েছিল কাদেশ শহর দখলকে কেন্দ্র করে মিশরীয় সাম্রাজ্যের সাথে হিট্টিটদের মধ্যে। কাদেশের যুদ্ধ হলো ইতিহাসের সবথেকে বড় ঘোড়ার গাড়ির যুদ্ধ। দুই পক্ষ মিলে যুদ্ধে প্রায় ছয় হাজারের মতো ঘোড়ার গাড়ি অংশ নিয়েছিল। দ্বিতীয় রামেসিসের পক্ষে প্রায় বিশ হাজার সৈনিক এবং হিট্টিট রাজা মুয়াতালিশের পক্ষে ছিল এর দ্বিগুণ সংখ্যক যোদ্ধা। দ্বিতীয় রামিসেসের বাহিনী কাদেশের বাইরে হিট্টিটদের দ্বারা গুপ্তহামলার শিকার হয়। এই হামলায় মিশরীয় বাহিনী পরাজয়ের কাছাকাছি পৌঁছে যায় এবং রামেসিস প্রায় প্রাণ হারাতে বসেন। পরবর্তীতে সংরক্ষিত সৈন্যবাহিনী এসে হিট্টিটদের পিছু হটতে বাধ্য করে। ফলে দ্বিতীয় রামেসিস কাদেশ পুনর্দখল করতে পারেননি এবং তার সেনাবাহিনীও বাজেভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তাই তিনিই ছিলেন এই যুদ্ধের পরাজিত শক্তি।
দ্বিতীয় রামেসিস যুদ্ধ থেকে ফিরে আসলেন এবং প্রচার করলেন যে, তিনি অসীম বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন। তিনি একাই প্রায় হাজারখানেক হিট্টিট যোদ্ধাদের মেরেছেন। একে কেন্দ্র করে একটি মনুমেন্টও তৈরি করে ফেললেন!
দ্বিতীয় রামিসেস সেই যুদ্ধে জেতার দাবি করেছেন, যেখানে তিনি জেতেননি। কিন্তু যেহেতু তিনি ছিলেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী দ্বিতীয় রামেসিস, তাই ইতিহাস বলে, তিনিই কাদেশের যুদ্ধের জয়ী! তার তৈরি করা ভাবমূর্তি এবং মিথ্যা যশ তাকে মিশরের সর্বশ্রেষ্ঠ ফারাওদের মধ্যে স্থান দিয়েছে।
ইতিহাস থেকে এমন একজন ফারাও এর কথা জানা যায়, যার বিভিন্ন অদ্ভুত সিদ্ধান্তের কারণে সমগ্র মিশরীয় সাম্রাজ্যে একসময় বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়েছিল। তিনি চতুর্থ আমেনহোটেপ, যিনি আখেনাতেন (“আটেন এর উপাসক”) নামেই বেশি পরিচিত। তিনি নতুন রাজত্বের অষ্টাদশ রাজবংশের একজন ফারাও ছিলেন। তার শাসনকাল ছিল ১৭ বছর এবং তিনি আনুমানিক ১৩৩৪ বা ১৩৩৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মারা যান। তিনি তার দর্পের কারণে মিশরের ২০০০ বছরের ঐতিহ্য ভেঙে ফেলেছিলেন।
আখেনাতেনের শাসনকালের পূর্বপর্যন্ত মিশরের ধর্ম ও সংস্কৃতি বেশ সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু উদ্ধত আখেনাতেন তৎকালীন মিশরের সংস্কৃতি ও সমাজের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক ভিত্তি ধর্মকে পরিবর্তন করার মনস্থির করেন। তিনি নিজেকে এতটা ক্ষমতাবান এবং ঐশ্বরিক মনে করেছিলেন যে, সমাজ, ধর্ম সবকিছুকে রাতারাতি পরিবর্তন করাও তার কাছে অসঙ্গত মনে হয়নি। আর তিনি এই পরিবর্তন সাধন করেছিলেন নতুন এক ঈশ্বরের উদ্ভাবন দ্বারা! তিনি ঐতিহ্যগত মিশরীয় বহুশ্বরবাদ ত্যাগ করে একেশ্বরবাদের প্রবর্তন করেন। এক্ষেত্রে তিনি উপাসনার জন্য দেবতা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন আটেন বা সূর্যকে।
আখেনাতেন তার রাজধানীও পরিবর্তন করেছিলেন। তিনি পুরাতন রাজধানী থিবেস থেকে একদম নতুন এক স্থান আমারনায় রাজধানী স্থাপন করলেন, যার নাম তিনি দিয়েছিলেন আখেতাতেন। নতুন এই রাজধানী পুরাতনটি থেকে ২৫০ মাইল বা ৪০০ কিলোমিটার উত্তরে স্থাপন করা হয়েছিল।
আসলে তিনি এই ধরনের কাজ কেন করেছিলেন তা বলা খুব কঠিন। সবথেকে জনপ্রিয় মতবাদ হচ্ছে, তার সময়ে কারনাকের মন্দিরকে ঘিরে গড়ে ওঠা আমুন দেবতার পুরোহিত সম্প্রদায় খুবই শক্তিশালী ও ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছিল। আখেনাতেনকে তাই যে করেই হোক এই পুরোহিত গোষ্ঠীকে দমাতে হত নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তি টিকিয়ে রাখার জন্য। সেজন্য তিনি একটি সম্পূর্ণ নতুন ধর্ম তৈরি করলেন, যেখানে আমুনের আর কোনো গুরুত্বই ছিল না। ফলে কারনাকের মন্দির পুরোপুরি অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ল। এতে করে পুরোহিত সমাজ, যারা এতদিন ধরে মানুষের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করছিল, তারা মিশরের রাজনীতি, ধর্ম ও অর্থনীতি থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
প্রাচীন মিশরের প্রধান শক্তিই ছিল এর সুপ্রতিষ্ঠিত ধর্ম, সামাজিক ক্রম ও উন্নয়নশীল অর্থনীতি। এগুলো একে অপরের সঙ্গে পুরোপুরি সংযুক্ত ছিল। একে অনেকটা পানিচক্র বা খাদ্যচক্রের সাথে তুলনা করা যায়, যার কোনো একটি উপাদানের পরিবর্তন ঘটলে বাকি উপাদানগুলোর ওপর তার সরাসরি প্রভাব পড়ে। বিশেষ করে মিশরের সামাজিক শ্রেণীবিন্যাস, যা কি না বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষকে বিন্যস্ত করেছিল, তা পুরোপুরি ধর্মের উপর নির্ভরশীল ছিল। তাই হুট করে সাম্রাজ্যের ধর্ম পরিবর্তন করাকে পাগলামো ছাড়া আর কী-ই বা বলা যায়!
হয়তো বা আখেনাতেন ইতিহাসের সফলতম ধর্মপ্রচারক বা ধর্মস্রষ্টা হতে পারতেন, যদি তার উত্তরসূরিরা তাকে অনুসরণ করতো। কিন্তু তা হয়নি। বরং মৃত্যুর পর তার সমস্ত স্মৃতি মুছে ফেলা হয়েছিল। এমনকি তার মমি পর্যন্ত ধ্বংস করে ফেলা হয়েছিল। তবে তার একটি পরিচয় কখনও মুছে ফেলা যায়নি। আর সেটি হলো, তিনি ফারাও তুতের বাবা।
আখেনাতেনের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত হয়তো বা পাগলামোর নামান্তর ছিল, তবে তার বিরুদ্ধে কখনো অযাচিতভাবে মানুষ হত্যার অভিযোগ পাওয়া যায়নি। কিন্তু একজন ফারাও ছিলেন, যিনি নিজের সুখের জন্য শত শত মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন। তা-ও বর্তমান জীবনের জন্য নয়, বরং পরবর্তী জীবনের সুখের জন্য! আগামী পর্বে নাহয় সেই বিষয়ে আলোচনা করা যাবে।
মিশর সম্পর্কে আরও জানতে পড়ুন এই বইগুলো
১) প্রাচীন মিশর
২) মিশর দেখে এলাম
৩) মমির মিশর