আপনি বাড়ির বাইরে বের হলেন। কিন্তু শর্ত হচ্ছে আপনার চোখ থাকবে পুরোপুরি বাঁধা। আপনি কিছুই দেখতে পারবেন না। অর্থাৎ আপনি চোখে দেখতে পেলেও অন্ধ হয়ে থাকতে হবে। আপনাকে কোনো কাজে বের হতে হলে এরকম অন্ধের মতোই সবকিছু করতে হবে। আপনি বাড়ির মধ্যে সূর্যের আলো প্রবেশ করতে দিতে পারবেন না। আপনাকে বাইরের দুনিয়া থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে হবে। আপনি উপভোগ করতে পারবেন না সবুজ গাছগাছালির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পাখির উড়ে যাওয়ার দৃশ্য কিংবা নদীতে বয়ে যাওয়া স্রোতের ধারা। কারণ চোখ খুললেই আপনার জীবনের নিয়ন্ত্রণ কেড়ে নেবে কোনো দৈবশক্তি। আর আপনি পরিণত হবেন একজন দানবে!
এতটুক লেখা পড়ে অনেকের হয়তো ‘হায়রে কপাল মন্দ চোখ থাকিতে অন্ধ’ গানটি মনে পড়তে পারে। উপরের চোখ থেকেও অন্ধ হয়ে থাকার পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি অনলাইন স্ট্রিমিং সার্ভিস নেটফ্লিক্সে মুক্তি পেল ‘বার্ডবক্স’ মুভিটি। পোস্ট অ্যাপোক্যালিপ্টিক সাইফাই হরর থ্রিলার মুভিটি ২০১৪ সালে একই নামে প্রকাশ পাওয়া জশ ম্যালারম্যানের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত। এরকম ছবি এর আগে যে আর হয়নি তা নয়। ড্যানি বয়েলের ‘টুয়েন্টি এইট ডেজ লেটার’, ব্র্যাড পিট অভিনীত ‘ওয়ার্ল্ড ওয়ার জেড’ সহ আরো অনেক সিনেমা হয়েছে। তাই বলে মোটেও একঘেয়ে বা ক্লিশে মনে হবে না একে। এতে অভিনয় করেছেন একঝাঁক তারকা। মূল চরিত্রে আছেন ‘গ্রাভিটি’ খ্যাত সান্ড্রা বুলক।
সান্ড্রা বুলকের সাথে আরো আছেন প্রবীন অভিনেতা জন ম্যালকোভিচ, ‘টুয়েলভ ইয়ার্স অ্যা স্লেভ’ খ্যাত সারাহ পলসন ও ২০১৭ সালে অস্কার জেতা মুভি ‘মুনলাইট’ খ্যাত ট্রেভান্তে রোডস। পরিচালনায় আছেন ড্যানিশ পরিচালক সুসানে বিয়ার। পরিচালক হিসেবে তিনি কেমন সেটা জানার জন্য একটি তথ্যই যথেষ্ট- তিনি একমাত্র নারী পরিচালক, যিনি অস্কার, গোল্ডেন গ্লোব ও এমি অ্যাওয়ার্ড- এই তিনটি পুরষ্কারই জিতেছেন। ২০১১ সালে তার ‘ইন অ্যা বেটার ওয়ার্ল্ড’ সেরা বিদেশী সিনেমা হিসেবে অস্কার পায়। এছাড়া ২০১৬ সালে হিউ লরি ও টম হিডেলস্টন অভিনীত ‘দ্য নাইট ম্যানেজার’ টিভি মিনি সিরিজের জন্য এমি অ্যাওয়ার্ড পান।
এবার সিনেমার গল্পে আসা যাক। শুরুতে দেখায় ম্যালোরি (সান্ড্রা বুলক) তার বাচ্চাদের নির্দেশনা দিচ্ছেন তাদের চোখ বন্ধ রাখার ব্যাপারে। তারা একটি নদী পাড়ি দেবে নৌকায় করে, কিন্তু সবার চোখ থাকবে বাঁধা। চোখ খুলে তাকালেই কী হবে সেই নির্মম পরিণতির কথা তাদেরকে মনে করিয়ে দেয়া হলো বারবার। পর্যাপ্ত খাবার আর নৌকা নিয়ে নদীতে করে যাত্রা শুরু হলো তাদের তিনজনের। ঠিক এই মুহূর্তে গল্প চলে যায় পাঁচ বছর আগের ফ্ল্যাশব্যাকে। ম্যালোরি তখন গর্ভবতী। সে নিজেকে একা তার ফ্ল্যাটে বন্দি রাখে। তার বাচ্চার বাবা তার সাথে আর ছিল না। তাই একাই ফ্ল্যাটের মধ্যে ছবি আঁকিবুঁকি করে সময় কাটায়। তার বোন জেসিকা (সারাহ পলসন) এ সময় আসে তার ফ্রিজে খাবার দিয়ে যাওয়ার জন্য।
তারা তখন টেলিভিশনে দেখতে পায় রোমানিয়া, সার্বিয়া, রাশিয়াসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিপুল পরিমাণ মানুষ আত্মহত্যা করছে। কী কারণে আত্মহত্যা করছে কেউ বুঝতে পারছে না। তারা এটা দেখে চিন্তিত হয়ে পড়ে আর ভাবে, আমেরিকাতেও এর প্রাদুর্ভাব দেখা দেবে কি না তা নিয়ে। ম্যালোরি তখন জেসিকার সাথে নিয়মিত পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে যায়। ম্যালোরি ছিল তার বাচ্চা নিয়ে উদাসীন। ডাক্তার তার উদাসীনতা দেখে নিঃসন্তান কোনো দম্পতিকে বাচ্চা দত্তক দিয়ে দেয়ার কথা বিবেচনা করতে বলেন। কিন্তু ম্যালোরি বাচ্চা নিজের কাছেই রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। কেন নিজের কাছে রাখতে চাইলো সেটা পরিষ্কার করে কিছু বলা হয়নি।
হাসপাতাল থেকে আসার সময় ঘটে খুবই দুঃখজনক একটি ঘটনা। তারা দেখতে পায় ব্যালকনিতে লাল জামা পরিহিতা এক তরুণী নিজের মাথায় আঘাত করে আত্মহত্যা করছে। তখন ম্যালোরি বুঝতে পারে সেই অভিশপ্ত ছায়া ইউরোপ থেকে ছড়িয়ে পড়েছে তাদের এখানেও। ম্যালোরি তখন বোনকে দ্রুত গাড়িতে করে বাড়ির দিকে নিয়ে যেতে বলে। তারা গাড়ি দিয়ে আসার সময় দেখে রাস্তায় প্রচুর মানুষ দিগ্বিদিক দৌড়াচ্ছে আর গাড়ির নিচে আত্মাহুতি দিচ্ছে। এমন সময় জেসিকাও কিছু একটা দেখতে পায় যা ম্যালোরি দেখতে পায় না। জেসিকা তখন এলোপাথাড়ি গাড়ি চালাতে শুরু করে আর গাড়ি উল্টিয়ে ফেলে। শেষে আত্মহত্যা করে।
গর্ভবতী ম্যালোরি তখন গ্রেগ (বিডি ওং) নামক এক আর্কিটেক্টের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। সেখানে তার মতো আরো কয়েকজন শরণার্থীও জড়ো হয়। সেখানে তার সাথে পরিচয় হয় টমের (রোডস) সাথে, যার সাথে পরে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়। এখানে ম্যালোরির আসাটা দেখানো হলেও অন্যরা কীভাবে আসলো তা বিস্তারিত দেখানো হয়নি। তারা তখন টিভিতে খবর দেখে জানতে পারলো এটা সারা বিশ্বেই হচ্ছে। তারা বুঝতে পারে, দরজা-জানালা বন্ধ করে বাড়িতে বন্ধ থাকাই নিরাপদ। বাইরে গেলে চোখ বন্ধ করে যাওয়া লাগবে। এটাকে অনেকে বছরের শুরুতে মুক্তি পাওয়া ‘অ্যা কোয়াইট প্লেস’ সিনেমার সাথে তুলনা করে ‘অ্যা ব্লাইন্ড প্লেস’ও বলে থাকেন।
গল্পের সাসপেন্স, টিকে থাকার লড়াই আর মানব সভ্যতার বিলুপ্ত হওয়ার ভয়াবহতা ভালোই থ্রিলের যোগান দিয়েছে। সচরাচর হরর সিনেমায় দেখা যায়, কোনো একটি বাড়ি ভুতুড়ে হয়ে থাকে আর সেখানে সবাই আটকা পড়ে। কিন্তু এটা ছিল তার উল্টো। বাড়ির বাইরের দুনিয়াই ভুতুড়ে। বাড়ির ভেতরে ম্যালোরিসহ অন্যান্যদের টিকে থাকার লড়াই আর তার বাচ্চাদের নিয়ে নৌকায় অজানার পথে যাত্রা দুটি গল্প একইসাথে চলতে থাকে। এটা ঠিক হরর সিনেমা না হলেও দর্শককে উত্তেজনায় স্ক্রিনে আটকে রাখার মতো অবশ্যই। তবে এর অনেক প্লটহোল আর কিছুটা গতানুগতিকতার কারণে সমালোচকদের কাছে অনেক সমালোচিত হয়েছে। এরকম দুর্যোগপূর্ণ সময়ে বিদ্যুৎ সচল থাকা গল্পের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন নিয়ে তোলে। আর যার কারণে এতকিছু হচ্ছে সেই বস্তু কী সেটাই প্রকাশ করা হয়নি। তাছাড়া গল্প অনেকটা পূর্বানুমানযোগ্য হওয়াতেও সমালোচিত হয়েছে।
তবে দর্শকদের যেন সমালোচকদের কথা কানে নিতে বয়েই গেছে! তা না হলে এক সপ্তাহে ৪৫ মিলিয়ন ভিউ পাবে কেন! এর মাধ্যমে এটি নেটফ্লিক্সের প্রথম সপ্তাহে সর্বোচ্চ ভিউ পাওয়া সিনেমার রেকর্ড করেছে। তবে এ নিয়েও শুরু হয়েছে সমালোচনা। কারণ দর্শকরা অনেক সময় ভুলে ক্লিক করে ফেলেন। পুরো সিনেমা সবাই দেখেছেন কি না সেটা নিয়ে সন্দেহ অনেকের। হলে মুক্তি দিলে ব্যবসাসফল হতো কি না সেই প্রশ্নও উঠেছে।
গল্পে দুই-এক জায়গায় ফাঁকফোকড় থাকলেও অভিনয়ে সবাই ছিলেন সাবলীল। তবে সান্ড্রা বুলক ছিলেন একদম অনন্যা। পুরো সময় জুড়ে তার টিকে থাকার লড়াইয়ের সাথে মাতৃত্বের মহানুভবতাও দেখা যায়। সন্তানদের ভবিষ্যতের আশা দেখানোর পাশাপাশি বাস্তবতার শিক্ষাটাও ভালো করে দেয়ার চেষ্টা দর্শকদের হৃদয় ছুঁয়ে যাবে। যখন বলছিলেন বাচ্চারা আর কখনো মাঠে খেলাধুলা, দৌড়াদৌড়ি বা গাছে চড়া এসব কিছুই করতে পারবে না, সেই দৃশ্য দর্শককে একটু হলেও নাড়িয়ে দেবে।
পার্শ্বচরিত্রে যারা ছিলেন তারাও প্রায় সবাই সেরাটা দিয়েছেন। সারা পলসন বেশি সময় ছিলেন না। তবে যতটুক ছিলেন ভালোই করেছেন। ‘ওশান’স এইট’ এর পর সান্ড্রার সাথে এটি তার দ্বিতীয় কাজ। ট্রেভান্তে রোডস মুনলাইট সিনেমাতেই নিজের প্রমাণ দিয়েছিলেন। এখানেও তার ঝলক দেখা গিয়েছে। জন ম্যালকভিচের অভিনয় এই সিরিয়াস মুভিতেও ভালো বিনোদন দিবে।
চিত্রনাট্যকার এরিক হেইসেরার এর আগে ২০১৬ সালের দারুণ সাইফাই থ্রিলার ‘অ্যারাইভাল’ এর চিত্রনাট্যও লিখেছিলেন। তাই তাকে নিয়ে আর বেশি কিছু বলার প্রয়োজন পড়ে না। সব মিলিয়ে একবার দেখার জন্য দারুণ এক সিনেমা বার্ডবক্স।
সিনেমা সম্পর্কে আরও জানতে আজই পড়ুন এই বইগুলো