হলিউড হয়তো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি নয়, কারণ আকৃতি ও পরিমাণগত দিক থেকে সে খেতাবটি বলিউডের দখলে। কিন্তু হলিউডের চলচ্চিত্রসমূহ আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজিতে হওয়ার সুবাদে, বিশ্বের সকল দেশেই কমবেশি অনুসারী রয়েছে হলিউড থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রের। আর তাই বিশ্ব চলচ্চিত্র শিল্পের হাল-হকিকত জানতে, সবার আগেই চোখ দেয়া হয় হলিউডের দিকে।
সকল শ্রেণী, পেশা, বয়স, লিঙ্গের মানুষের রুচিবোধ ও পছন্দ-অপছন্দের কথা মাথায় রেখেই নিত্যনতুন কনসেপ্টের চলচ্চিত্র নির্মিত হয় হলিউডে। কিন্তু যদি জানতে চাওয়া হয়, হলিউডে আজকাল কোন ধরনের চলচ্চিত্র বেশি চলছে, তাহলে কিন্তু সবার আগেই চলে আসবে সুপারহিরো চলচ্চিত্রের কথা।
শুরুতেই জটিল কোনো পরিসংখ্যানে না যাই। আপনারা বরং ভেবে দেখুন, হলিউড থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত সাম্প্রতিক কোন চলচ্চিত্রটির নাম শুনেছেন। নিঃসন্দেহে বলে দেয়া যায়, অধিকাংশ পাঠকের মনেই প্রথম আসবে কোনো সুপারহিরো চলচ্চিত্রের কথা। আর তা খুবই স্বাভাবিক, কেননা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সুপারহিরো চলচ্চিত্রগুলো নিয়েই যে সবচেয়ে বেশি তর্ক-বিতর্ক হয়।
কিন্তু সুপারহিরো চলচ্চিত্র নিয়ে উন্মাদনা কি কেবল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেই সীমাবদ্ধ? না। বাস্তবেও হলিউডে এখন ছড়ি ঘোরাচ্ছে সুপারহিরো চলচ্চিত্রগুলোই। ২০১৭ সালে হলিউডের সবচেয়ে বেশি আয় করা ১১টি চলচ্চিত্রের মধ্যে ৭টিই ছিল সুপারহিরো কাহিনীনির্ভর। আবার ২০১৮ সালে হলিউড থেকে মুক্তি পায় মোট ৯টি সুপারহিরো চলচ্চিত্র। সব মিলিয়ে সেই ৯টি চলচ্চিত্র ঘরোয়া বক্স অফিস থেকে আয় করে ২.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি (২০১৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য, অ্যাকুয়াম্যান মুক্তির পাঁচদিন পর), অর্থাৎ সারা বছর টিকিট বিক্রি থেকে আয়কৃত অর্থের প্রায় ২৫.৫ শতাংশ। এদের মধ্যে ব্ল্যাক প্যান্থার তো অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডে সেরা ছবিসহ ৬টি ক্যাটাগরিতে মনোনয়ন পায়, এবং শেষপর্যন্ত জিতে নেয় ৩টি অস্কার।
এ বছরও হলিউডে আধিপত্য বিস্তার করবে সুপারহিরো চলচ্চিত্র। গত বছর ৯টি সুপারহিরো চলচ্চিত্রের মধ্যে ৪টির প্রযোজনা করে ঘরোয়া বক্স অফিস থেকে ২.২ বিলিয়ন ডলার কামানো ডিজনি এবার আনছে আরো দুটি মারভেল ফিল্ম। ক্যাপটেন মারভেল তো ইতিমধ্যেই মুক্তি পেয়ে গেছে, এবং চলতি এপ্রিলের ২৬ তারিখ যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে অ্যাভেঞ্জার্স: এন্ড গেমও।
এদিকে মারভেলের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ডিসি সম্প্রতি মুক্তি দিয়েছে শ্যাজাম, এবং তারা আরো নিয়ে আসতে চলেছে বহুল প্রতীক্ষিত জোকার। অপরদিকে সনি আনছে স্পাইডারম্যান: ফার ফ্রম হোম, যেটি মারভেল সিনেম্যাটিক ইউনিভার্সের অংশ হওয়ার দাবিদার। এছাড়া এ বছর জানুয়ারিতে আরো মুক্তি পেয়েছে গ্লাস, এবং আরো মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে হেলবয়, ডার্ক ফিনিক্স, নিউ মিউট্যান্টস ও স্পন।
তার মানে বুঝতেই পারছেন, ২০১৯ সালজুড়েও হলিউডে থাকছে সুপারহিরো চলচ্চিত্রের ছড়াছড়ি। তাই এ কথা বললে একদমই অত্যুক্তি হবে না যে, বর্তমানে আমরা বাস করছি সুপারহিরো চলচ্চিত্রের যুগে।
কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো, হলিউডে সুপারহিরো চলচ্চিত্রের এমন স্বৈরাচারী একনায়কত্ব কেন? যে দর্শকরা সারা বছর অভিযোগ করে যে জীবনমুখী, বাস্তবসম্মত চলচ্চিত্রের সংখ্যা কমে যাচ্ছে, সেই তারাই কেন অবাস্তব, অসম্ভব, অলীক কল্পনাপ্রসূত সুপারহিরো চলচ্চিত্র দেখতে হলে ছুটে যাচ্ছে? বড় বড় প্রযোজক ও নির্মাতারাই বা কেন অন্য আর সব ঘরানাকে পাশ কাটিয়ে, সুপারহিরো চলচ্চিত্রকেই এত বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন?
চলুন পাঠক, হলিউডে কেন এখন চলছে সুপারহিরো চলচ্চিত্রের এমন অভূতপূর্ব জয়জয়কার, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজি।
সুপারহিরো চলচ্চিত্র মানুষের পলায়ন প্রবৃত্তির পৃষ্ঠপোষক
সেই সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই মানুষের মধ্যে এক অদ্ভুত রকমের পলায়ন প্রবৃত্তি দৃশ্যমান। জীবনের রূঢ় ও কঠোর বাস্তবতা থেকে তারা সবসময় পালিয়ে বেড়াতে চায়। প্রাত্যহিক জীবনে তারা যেসব ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট ও অশান্তি দেখে, বিনোদনের অনুষঙ্গ হিসেবেও তারা আবার সেগুলোরই সম্মুখীন হতে চায় না। তাই একসময় তারা বিভিন্ন উপকথা-রূপকথা বানাত, কল্পনার জগতে হারিয়ে যেত। এখন সেসব উপকথা-রূপকথা তাদের আবেদন হারিয়েছে বটে, কিন্তু মানুষের মনে বাস্তবতাকে অগ্রাহ্য করে আকাশ-কুসুম কল্পনায় আহ্লাদিত হওয়ার অদম্য আকাঙ্ক্ষা রয়েই গেছে। আর তাদের সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণ করে, তাদের মনের খোরাক যোগাচ্ছে সুপারহিরো চলচ্চিত্রসমূহই।
সব মানুষই চায় অতিমানবীয় ক্ষমতা অর্জন করতে
মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব হতে পারে, কিন্তু তারপরও তাদের অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। চাইলেই তারা পাখির মতো মুক্ত আকাশে উড়ে বেড়াতে পারবে না। পারবে না মাকড়সার মতো বিশাল বিশাল ভবনের দেয়াল বেয়ে উঠতে। এমনকি মাছের মতো লম্বা সময় জলের তলে সাঁতরে বেড়াতেও পারবে না। কিন্তু তারপরও, ছোটবেলায় সব মানুষই এসব অতিমানবীয় ক্ষমতা লাভের স্বপ্ন দেখেছে। নিজেরা কোনোদিন পারবে না জানা সত্ত্বেও, তারা ঘন্টার পর ঘন্টা ব্যয় করেছে এগুলো ভাবতে। সুপারহিরো চলচ্চিত্রসমূহ পর্দায় তাদের এসব কল্পনাকেই আপাত-বাস্তবরূপে তুলে ধরে। তাই ভিত্তিহীন জানা সত্ত্বেও, তারা এসব চলচ্চিত্র দেখার লোভ সামলাতে পারে না।
মানুষ চায় বাস্তবজীবনের ব্যর্থতা ভুলতে
একজন সাধারণ মানুষকে প্রতিদিন অসংখ্য ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। সে যা চায়, তার খুব কমই পায়। একজন চাকরিজীবী হয়তো খুব ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেছে যেন সে দিনের প্রথম বাসটিতে চেপেই কর্মস্থলে পৌঁছাতে পারে। কিন্তু না, কোনো না কোনো একটা সমস্যা হয়েই যায়। বাথরুমের কলে হয়তো পানি আসে না, গ্যাস না থাকায় নাস্তা তৈরি করতে দেরি হয়ে যায়, কিংবা ভীড় ঠেলে সে হয়তো প্রথম বাসটিতে জায়গা পায় না। আবার তাকে মনের অনেক ইচ্ছাই অবদমিত রাখতে হয়। বাসে বসে কোনো তরুণ যখন সুন্দরী তরুণীর দিকে বাজে নজর দেয়, সে চায় উঠে গিয়ে তরুণকে জুতাপেটা করতে। কিন্তু সে জানে, এমনটা করতে গেলে পরে তার নিজেকেই বিপাকে পড়তে হবে। তাই সে মনের ইচ্ছা মনেতেই কবর দিয়ে, কিচ্ছু হয়নি ভেবে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকানোর ভান করে। কিন্তু সুপারহিরো চলচ্চিত্র অবশেষে তাকে সুযোগ করে দেয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে সফল হওয়ার, যা-ইচ্ছা-তাই করার। পর্দার সুপারহিরো হিসেবে সে নিজেকে কল্পনা করে, জীবনের অনেক অপ্রাপ্তি ও অতৃপ্তিই কিছু সময়ের জন্য ভুলে যেতে পারে। আবার সুপারহিরোরা যখন মানবজাতিকে বাঁচানোর লক্ষ্যে শত্রুর বিপক্ষে প্রাণপণ লড়াই করে, তা দেখে তার ক্যাথারসিসও হয়।
মানুষ চায় মানবতার জয় দেখতে
বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ-বিগ্রহ, সন্ত্রাসবাদ, বর্ণবাদ, হিংসা-বিদ্বেষ এতটাই বেড়ে গেছে যে, এবং পারমাণবিক অস্ত্রের হুমকিতে তাদেরকে প্রতি মুহূর্তে এত বেশি তটস্থ থাকতে হচ্ছে যে, মানবতার উপর থেকে বিশ্বাস হারানোর উপক্রম হয়েছে। মানুষ আজ কোথায় নিরাপদ! তাকে তার শোবার ঘরে ঢুকে হত্যা করে যাওয়া হচ্ছে, তাকে চলন্ত বাসে ধর্ষণ করা হচ্ছে, কর্মস্থলে সে জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ হচ্ছে। সবখানেই মানুষ আজ পরাজিত। ভালো লাগা, পরিতৃপ্ত হবার মতো উপাদান তার জীবনে এখন নেই বললেই চলে। কিন্তু তারপরও মানবতার এমন নির্মম পরাজয় অধিকাংশ মানুষই মেনে নিতে পারে না। তারা চায়, যেভাবেই হোক, মানবতার যেন জয় হয়। আর মানবতাকে উদ্ধার করতে প্রয়োজন একজন মহামানবের। সুপারহিরো চলচ্চিত্র মানুষের এই দুই চাহিদাই মেটাচ্ছে। মহামানবের আগমনও যেমন ঘটছে, ঠিক তেমনই তারা পৃথিবীকে শত্রুমুক্ত করে মানবতার জয়গানও গাচ্ছে। এই বিষয়টিকে সাধারণ দর্শক ভালো না বেসে কি পারে?
মানুষ চায় অনুপ্রাণিত হতে
বিশ্বব্যাপী মানুষের এখন চলছে চরম অর্থনৈতিক দৈন্যদশা। গুটিকতক মানুষ হয়তো অর্থের অকূল পাথারে ভেসে বেড়াচ্ছে, কিন্তু বেশিরভাগ মানুষের দিন গুজরান হচ্ছে অর্থের চিন্তায়। সবারই হয়তো দিন আনি দিন খাই অবস্থা নয়, কিন্তু আজ ভালো থাকলেও আগামীকাল কী হবে, এই চিন্তায় অনেকেরই অকালে মাথার চুল পাকতে বসেছে। এছাড়া পড়াশোনা ও ব্যক্তিজীবনেও মানুষ খুব একটা সুবিধাজনক অবস্থায় নেই। সকল ক্ষেত্রেই তাকে থেমে যেতে হচ্ছে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রার অনেক আগের কোনো স্টপেজেই, ফলে ক্রমাগত সে নিমজ্জিত হচ্ছে বিষণ্নতায়, হারিয়ে যাচ্ছে হতাশার ঘূর্ণিপাকে। এমতাবস্থায় তার অনুপ্রেরণার খুবই প্রয়োজন। এজন্য অনেকে অনুপ্রেরণাদায়ী বই পড়ে, ভাষণ শোনে, ভিডিও দেখে। কিন্তু সুপারহিরো চলচ্চিত্রের মতো বিনোদনমূলক অনুপ্রেরণা আর কে-ই বা দিতে পারে! সকল সুপারহিরো চলচ্চিত্রেই নায়ককে দেখা যায় শুরুতে বিরুদ্ধশক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে, বারবার হোঁচট খেতে, একের পর এক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অধিকাংশ সুপারহিরো চলচ্চিত্রেই কিন্তু নায়কের জয় হয়। ফলে দর্শক হল থেকে কেবল হাসিমুখেই নয়, যথেষ্ট অনুপ্রাণিত হয়েও বের হয়।
সিজিআই মানুষকে আকৃষ্ট করে
সিজিআই অর্থ হলো কম্পিউটার জেনারেটেড ইমেজারি। এর মাধ্যমে আজকাল অনেক অসম্ভব জিনিসকেই পর্দায় বাস্তবসম্মত করে দেখানো সম্ভব হচ্ছে। এখন প্রায় সব সুপারহিরো চলচ্চিত্রেই এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তিটির প্রয়োগ ঘটছে। অবিশ্বাস্য যুদ্ধের দৃশ্য, সুপারহিরোদের কস্টিউম থেকে শুরু করে তাদের অতিমানবীয় সব ক্ষমতা প্রদর্শন, এই সবকিছুই এখন সিজিআইয়ের মাধ্যমে এতটা নিখুঁত করে দেখানো হচ্ছে যে, দর্শক অনেক চেষ্টা করেও নিজেদের মনকে মানাতে পারছে না যে, এগুলো কিছুই আসলে সত্যি নয়! ১৯৯৩ সালে জুরাসিক পার্ক চলচ্চিত্রে প্রথম সফলভাবে সিজিআই ব্যবহৃত হয়েছিল। আর ২০০২ সালে স্পাইডারম্যান চলচ্চিত্রে এটির ব্যবহার এতটাই সাড়া জাগায় যে, তারপর থেকে সিজিআই ব্যতীত সুপারহিরো চলচ্চিত্র যেন কল্পনাও করা যায় না।
মানুষ ফ্র্যাঞ্চাইজি ভালোবাসে
অধিকাংশ মানুষেরই একটি বড় সমস্যা হলো, তারা অজানাকে ভয় পায়। এতদিন যেখানে তারা অভ্যস্ত থেকেছে, সেখানেই তারা আজীবন থাকতে চায়। এ কারণে ছোটবেলায় তিন গোয়েন্দা বা মাসুদ রানার মাধ্যমে বইয়ের পোকা হওয়া অনেক পাঠকই পরবর্তী জীবনে অন্য কোনো বই পড়ে শেষ করতে পারে না। কারণ অন্য কোনো বইতে তারা তাদের চিরন্তন পরিচিত চরিত্র বা বিষয়বস্তুর দেখা পায় না।
একই ঘটনা ঘটে চলচ্চিত্রপ্রেমীদের ক্ষেত্রেও। তারা ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক চলচ্চিত্র দেখতে ভালোবাসে। একেবারে নতুন কোনো কনসেপ্টের চলচ্চিত্র দেখার বদলে, চেনা কনসেপ্টের সুপারহিরো চলচ্চিত্র দেখাটা তাদের কাছে অপেক্ষাকৃত সহজ মনে হয়। এ কারণেই মারভেল সিনেম্যাটিক ইউনিভার্স কিংবা ডিসি এক্সটেন্ডেড ইউনিভার্সের চলচ্চিত্রগুলো তারা সহজেই দেখতে পারে। কারণ এসব ফ্র্যাঞ্চাইজির চলচ্চিত্র থেকে তারা কী আশা করতে পারে, সে সম্পর্কে তাদের আগে থেকেই ধারণা থাকে। এ কারণে, নতুন মুক্তিপ্রাপ্ত কোনো পর্ব ভালো না হলেও, পূর্ববর্তী পর্বগুলোর প্রতি মুগ্ধতা থেকে, বা কোনো বিশেষ চরিত্রের প্রতি ভালোবাসা থেকে, তারা নতুন পর্বগুলোও দেখে। আর এজন্যই, প্রযোজক ও নির্মাতারাও স্ট্যান্ড-অ্যালোন চলচ্চিত্রের বদলে ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক চলচ্চিত্রকেই বেশি গুরুত্ব দেন। তারা জানেন, নতুন কোনো ঝুঁকি নেয়ার চেয়ে ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক চলচ্চিত্র তৈরি করলে সাফল্যের সম্ভাবনা অনেকটাই নিশ্চিত। ২০১৪ সালে যেমন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি আয় করা ১০টি চলচ্চিত্রের মধ্যে ৭টিই ছিল পূর্ববর্তী কোনো চলচ্চিত্রের সিক্যুয়েল।
মারভেল বনাম ডিসি
মানুষ স্বভাবজাতভাবেই প্রতিযোগিতা পছন্দ করে। প্রতিযোগিতাহীন ব্যাপার-স্যাপারকে তাদের কাছে খেলো মনে হয়। তাই তো কোন চলচ্চিত্র কত আয় করল, কোন নায়ক বেশি পারিশ্রমিক পেলেন, এসবের সাথে তাদের কোনো লেনাদেনা না থাকলেও, তারা অনেক সময় ব্যয় করে এগুলো নিজে জানতে এবং অন্যকে জানাতে! কারণ, শুধু দুই বা আড়াই ঘন্টার চলচ্চিত্র দেখে তাদের মন ভরে না। যখন সেই চলচ্চিত্রকে কেন্দ্র করে একটা প্রতিযোগিতাময় আবহ সৃষ্টি করা যায়, তখন তাদের আগ্রহ তুঙ্গে ওঠে। আর এখানেই সুপারহিরো চলচ্চিত্রগুলোর একটা বাড়তি সুবিধা আছে। কারণ সুপারহিরো চলচ্চিত্রের দুনিয়ায় ইতিমধ্যেই একটি প্রতিযোগিতা বিদ্যমান রয়েছে, তা হলো, মারভেল নাকি ডিসি- কে সেরা?
এই প্রতিযোগিতার প্রতি আকর্ষণ থেকেও অনেক দর্শক সুপারহিরো চলচ্চিত্র দেখে। অনেকে আবার এমনও আছে যে, ডিসিকে হয়তো পছন্দ করে না, তবু ডিসির চলচ্চিত্রের সমালোচনা করবে বলে ডিসির চলচ্চিত্র দেখছে। এমন অনেক মারভেলের সমালোচকও রয়েছে। এভাবেই মারভেল বনাম ডিসি বিতর্কের ফলে সুপারহিরো চলচ্চিত্রগুলোতে এক বাড়তি উন্মাদনা যোগ হয়েছে, যার ফলে উভয় দিনশেষে মারভেল ও ডিসি উভয়ই লাভবান হচ্ছে। একবার ভেবে দেখুন তো, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিংবা বাস্তব জীবনে মারভেল ও ডিসি ভক্তরা নিজেদের মধ্যে লড়াই না করলে, এই দুই প্রতিষ্ঠানের চলচ্চিত্র কি এত বেশি প্রচারণা পেত?
টাকা কথা বলে
আজকের দিনে সুপারহিরো চলচ্চিত্রের এত জনপ্রিয়তার পেছনে কারণ ঠিক সেটিই, যে কারণে যেকোনো ক্ষেত্রেই কোনো বিশেষ জিনিস বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করে। কারণটি হলো – অর্থ। প্রযোজক ও নির্মাতারা সুপারহিরো চলচ্চিত্রে অর্থের গন্ধ পেয়েছেন বলেই কিন্তু এতে প্রচুর পরিমাণে অর্থ বিনিয়োগ করছেন, বিশ্বব্যাপী প্রচারণা চালাচ্ছেন, এবং দিনশেষে ব্যয়ের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি আয়ও করে নিচ্ছেন। এই শতাব্দীর প্রথম দশক থেকেই মারভেল ও ডিসির সুপারহিরো চলচ্চিত্রগুলো আকাশচুম্বি ব্যবসা করতে শুরু করেছে, যে কারণে অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন সুপারহিরো চলচ্চিত্র বেশি নির্মিত হচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে যদি সুপারহিরো চলচ্চিত্র এত বেশি আয় না করত, তাহলে ২০১৯ সালেও অবশ্যই এতগুলো এই ঘরানার চলচ্চিত্র মুক্তির অপেক্ষায় থাকত না। আরেকটি বড় বিষয় হলো, অর্থের কাছে শিল্পও হার মেনে যায়। তাই সমালোচকরা অনেক সুপারহিরো চলচ্চিত্রকে রীতিমতো ধুয়ে দিলেও, সেরকম চলচ্চিত্র নির্মাণ অব্যাহত রয়েছে। যেমন ব্যাটম্যান ভার্সেস সুপারম্যান রোটেন টোমেটোসে মাত্র ২৭% রেটিং পেয়েছিল, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে এটি আয় করেছিল ৩২৮ মিলিয়ন ডলার। আবার এক্স মেন: দ্য লাস্ট স্ট্যান্ড পেয়েছিল ৫৮% রেটিং, অথচ ঠিকই আয় করেছিল ৩০৬.৯ মিলিয়ন ডলার। তাই পরবর্তীতে এসব ছবির নতুন পর্ব এসেছে। তাছাড়া এখন পর্যন্ত ৯টি সুপারহিরো চলচ্চিত্র ১ বিলিয়ন ডলার ক্লাবে প্রবেশ করেছে। আর কোনো নির্দিষ্ট ঘরানারই এত বেশি সংখ্যক ছবি ১ বিলিয়ন ডলার আয় করতে পারেনি। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, সুপারহিরো চলচ্চিত্র মানেই নিশ্চিত লাভ এবং অর্থের ছড়াছড়ি, আর সে কারণেই এ ধরনের চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রবণতা কমার বদলে ক্রমশ বেড়েই চলেছে। যতদিন সুপারহিরো চলচ্চিত্র অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হবে, এসব চলচ্চিত্র একের পর এক মুক্তি পেতেই থাকবে।
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/