১.
ছেলেটা খুব খারাপ খেলতো না। তবে প্রতিযোগিতার এই দুনিয়ায় ভালোর শেষ নেই। সবচেয়ে বড় কথা, আপনি যদি এমন একটা দলে খেলেন, যেখানে সফলতার সাথে সাথে ব্র্যান্ড ভ্যালুও একটা ফ্যাক্ট হিসেবে দাঁড়ায়, তখন চাইলেও কিছু করার থাকে না।
এরকমই একটা ঘটনা ঘটেছিল তার সাথে।
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে রিয়াল মাদ্রিদের মতো একটা দলে খেললে স্বাভাবিকভাবেই স্ট্রাইকার হিসেবে রাউলকেই প্রাধান্য দেওয়া উচিত। মরিয়েন্তেসের ক্ষেত্রেও সেটাই হচ্ছিল। এটাতে তেমন কোনো সমস্যাও হচ্ছিল না। ১৯৯৭-৯৮ সাল থেকে মাদ্রিদ ক্যারিয়ারে তিনটা চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতাও হয়ে গিয়েছিল।
এই সময়ে লিগে ‘৯৮-‘৯৯ মৌসুমে রাউলের ২৫ গোলের পরই ১৯ গোল নিয়ে দলের দ্বিতীয় এবং লিগের চতুর্থ সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছিলেন মরিয়েন্তেস। এছাড়া ২০০১-০২ মৌসুমে দলের সর্বোচ্চ এবং লিগের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতাও হন তিনি। কিন্তু সমস্যাটা হয়ে গেল ২০০২ বিশ্বকাপের পর।
২০০২ বিশ্বকাপে রোনালদো লিমা’র অস্বাভাবিক পারফরম্যান্স, আর ইন্টারে খেলতে না চাওয়ার সুযোগে রিয়াল মাদ্রিদ রোনালদো লিমা’র দিকে হাত বাড়ায়। লিমাও যেন উদগ্রীব ছিলেন জিদান, ফিগো, কার্লোসদের পাশে খেলার জন্য। সাথে সাথে মাদ্রিদে এসে পড়লেন। তবে প্রাথমিকভাবে তিনি তার পছন্দের ৯ নম্বর জার্সিটি পাননি, সেটা মরিয়েন্তেসের গায়েই রইলো। রোনালদো লিমা পেলেন ১১ নম্বর জার্সি।
দলে আগে থেকেই ছিলেন রাউল। তাছাড়া রোনালদো লিমা প্রথম ম্যাচেই বদলি হিসেবে নেমে ৩৬ সেকেন্ডের মাথাতেই একটা অসাধারণ গোল করে বুঝিয়ে দিলেন যে, তিনি প্রথম একাদশে খেলার জন্যেই দলে এসেছেন। স্বাভাবিকভাবে তাই মরিয়েন্তেসের সুযোগও ধীরে ধীরে কমতে লাগলো। ২০০২-০৩ মৌসুমে প্রথম একাদশ আর বদলি হিসেবে খেলতে নেমে ২৭ ম্যাচে করেন মাত্র ৬ গোল। পরের মৌসুমে যখন মাদ্রিদের পরিকল্পনায় থাকলেন না, তখন বাধ্য হয়েই মোনাকোতে ধারে খেলতে চলে গেলেন।
এখানেই গড়লেন আরেক কীর্তি।
২.
মোনাকোর হয়ে লিগে খুব ভালো পারফর্ম করতে না পারলেও খুব বাজেও ছিল না। লিগে করেন ২৮ ম্যাচে ১০ গোল, যা দলের পক্ষে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
তবে মূল খেলাটা দেখালেন চ্যাম্পিয়নস লিগে। সেখানে তিনি দুর্দান্ত পারফর্ম করেন।
গ্রুপপর্ব থেকে সহজেই পরের পর্বে চলে আসে মোনাকো। এখানে ৪টি গোল করেন মরিয়েন্তেস। কিন্তু ঝামেলাটা হয়ে যায় নকআউট পর্বে গিয়ে। নকআউটে নিজেদের প্রথম ম্যাচে লোকোমোটিভ মস্কো’র বিপক্ষে তাদের মাঠেই খেলতে নামে মোনাকো। প্রথম ৫৯ মিনিটের মাঝেই ২ গোলে পিছিয়ে যায় মোনাকো। কিন্তু ম্যাচের ৬৯তম মিনিটে মরিয়েন্তেসের মূল্যবান একটা অ্যাওয়ে গোলে পরবর্তী রাউন্ডে খেলার আশা বাঁচিয়ে রাখে। পরের লেগে মোনাকো ১ গোলে জিতে অ্যাওয়ে রুলস অনুযায়ী কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে যায়।
কোয়ার্টার ফাইনালে মোনাকো মুখোমুখি হয় রিয়াল মাদ্রিদের। রিয়ালের দলে তখন ছিলেন জিদান, ফিগো, বেকহাম, গুতি, রাউল, ক্যাম্বিয়াসো, ক্যাসিয়াস আর রবার্তো কার্লোসদের মতো খেলোয়াড়। তাছাড়া আগের পর্বেই তারা হারিয়ে এসেছে বায়ার্ন মিউনিখের মতো দলকে। শক্তিমত্তার বিচারে মোনাকোর তাই উড়ে যাওয়ারই কথা মাদ্রিদের সামনে।
রিয়াল মাদ্রিদের মাঠে খেলাটা তেমনভাবেই শুরু হলো। শুরুতেই স্রোতের বিপরীতে ৪৩ মিনিটে মোনাকো একটা গোল করে ফেললেও ৫১তম মিনিটে হেলগুয়েরা, ৭০তম মিনিটে জিদান, ৭৭তম মিনিটে ফিগো, আর ৮১তম মিনিটে রোনালদো লিমা টানা চারটি গোল করে বুঝিয়ে দেন যে, প্রথম গোলটা ফ্লুকই ছিল। কিন্তু ৮৩তম মিনিটে মরিয়েন্তেস আরেকটি গোল করে আশা একটু হলেও বাঁচিয়ে রাখেন।
দ্বিতীয় লেগের আগে সমীকরণ ছিল এমন, পরের রাউন্ডে যেতে হলে মোনাকোকে অন্তত ২-০ গোলে জিততেই হবে। সেই সময়ের রিয়ালের বিপক্ষে সেটা কল্পনাতীত মনে করাটাই স্বাভাবিক । ৩৬তম মিনিটে রাউল গোল করে কল্পনার সীমাটাকে আরো দূরের মনে করিয়ে দিলেন। পরের পর্বে যেতে হলে আর গোল না খেয়ে মোনাকোকে ৩টি গোল করতে হবে। রিয়াল মাদ্রিদের মতো দলের বিপক্ষে সেটা কি আদৌ সম্ভব?
প্রথমার্ধের শেষের দিকে ফরাসি খেলোয়াড় জিউলি একটা গোল করে ফেললেও কাজটা অসম্ভবই মনে হচ্ছিল। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই মরিয়েন্তেস আরেকটা গোল করে ফেলায় সম্ভাবনাটা খুব অসম্ভব বলে মনে হচ্ছিল না। ৬৬তম মিনিটে জিউলি আরেকটা গোল করে মাদ্রিদকে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায়ই করে দিলেন।
৫-৫ গোলে ড্র হওয়া ম্যাচটিতে বেশি অ্যাওয়ে গোলের সুবাদে পরের রাউন্ডে ওঠে মোনাকো। চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার জন্য যে খেলোয়াড়টিকে বাদ দিলো মাদ্রিদ, সেই খেলোয়াড়ের কাছেই হেরে গিয়ে টুর্নামেন্ট থেকে বাদ পড়ার পর মাদ্রিদের খারাপ লাগারই কথা।
সেই খারাপ লাগাটাকে আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিলেন মরিয়েন্তেস পরের রাউন্ডে পারফর্ম করে।
সেমিতে মোনাকো মুখোমুখি হলো তখনকার উঠতি দল চেলসির। ঘরের মাঠে চেলসিকে ৩-১ গোলে হারানো ম্যাচে মূল্যবান ১টি গোল করেন। পরের লেগে চেলসির মাঠে মোনাকো ২-১ গোলে পিছিয়ে গেলে চেলসি ফিরে আসার পর্যায়েই ছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে মরিয়েন্তেস আরেকটি গোল করে চেলসির আশা শেষ করে দেন। ড্র হওয়া ম্যাচে আগের লেগে এগিয়ে থাকার কারণে ফাইনালে যায় মোনাকো।
তবে ফাইনালে আর পেরে ওঠেননি। মরিনহোর পোর্তো’র সাথে গোলহীন থাকা ম্যাচে ৩-০ গোলে হেরে যায় তার দল মোনাকো। ফাইনাল জিততে না পারলেও পুরো টুর্নামেন্টে ৯ গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার জিতে নেন মরিয়েন্তেস। মোনাকোর ইতিহাসে প্রথম এবং এখন পর্যন্ত শেষবারের মতো চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে উঠতে পারার মূল কৃতিত্বটা যে মরিয়েন্তেসের, সেটা হয়তো আর না বললেও চলবে।
৩.
মোনাকোতে দুর্দান্ত একটা মৌসুম কাটানোর পর আবার রিয়াল মাদ্রিদে ফেরত আসেন মরিয়েন্তেস। আত্মবিশ্বাসী ছিলেন, এবার সুযোগ পাবেন। কিন্তু লিভারপুল থেকে সেই সময়ের ক্রেজ মাইকেল ওয়েনের আগমন আবারও স্কোয়াডে তার জায়গা পাওয়া নিয়ে সংশয় তৈরি করে। লিগে মাত্র ১৩টি ম্যাচ খেলার সুযোগ পান, সবগুলোই বদলি হিসেবে। একটিও গোল করতে পারেননি। এরপর চলে যান লিভারপুলে, সেখানে উয়েফা সুপার কাপ এবং এফএ কাপ জেতেন।
পরবর্তীতে ভ্যালেন্সিয়া আর মার্শেই’র হয়ে কিছুদিন খেললেও নিজের সেরা ফর্মে আর ফেরত আসতে পারেননি।
অবশ্য ভ্যালেন্সিয়ার হয়ে ২০০৭-০৮ মৌসুমে একটা কোপা দেল রে কাপ জেতেন, যা ১৯৯৮-৯৯ মৌসুমের পর তাদের প্রথম দেল রে শিরোপা। সেই ফাইনালে ১টি গোলও করেন মরিয়েন্তেস। উল্লেখ্য, যেকোনো ধরনের টুর্নামেন্টে এখন পর্যন্ত ভ্যালেন্সিয়ার সেটাই সর্বশেষ শিরোপা।
৪.
জাতীয় দলের হয়েও তার পারফরম্যান্স ভালোই ছিল। ১৯৯৮ সালে স্পেনের হয়ে সুইডেনের বিপক্ষে তার অভিষেক হয়। ম্যাচ শুরুর প্রথম ৫ মিনিটের মাঝেই ২টি গোল করে তিনি অভিষেকটাকে রাঙিয়ে রাখেন। দেশের হয়ে ৪৭ ম্যাচে ২৭ গোল করেন ০.৫৭ গড়ে।
মরিয়েন্তেস তার সময়ে একজন দক্ষ স্ট্রাইকার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। রাউলের সাথে তার জুটি খুবই বিখ্যাত ছিল। বাতাসে দুর্দান্ত ছিলেন, এবং খুবই ভালো ফ্রি কিক টেকার ছিলেন। তবে ক্যারিয়ারের শেষের দিকে গতি হারিয়ে ফেলায় সাপোর্টিং রোলে খেলা শুরু করেন। স্বল্প সময়ের জন্য হলেও নিজ সময়ের সেরা খেলোয়াড়দের একজন ছিলেন তিনি। ফিফা ‘৯৯ এর স্প্যানিশ ভার্সনের কভার পেইজে জায়গা পান মরিয়েন্তেস। এছাড়া ফিফা ‘০৫ এর কভার পেইজেও জায়গা পান।
২০১০ সালের আগস্ট মাসে সব ধরনের ফুটবল থেকে অবসর নিয়ে নেন মরিয়েন্তেস। পরবর্তীতে ম্যানেজার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করলেও সেখানে এখন পর্যন্ত খুব বেশি সফলতা আসেনি।
আমাদের এই পৃথিবীতে ‘অসাধারণ খেলোয়াড়ের সাধারণ পারফরম্যান্স’ নিয়ে মাতামাতি হলেও ‘সাধারণ খেলোয়াড়ের অসাধারণ পারফরম্যান্স’ নিয়ে মাতামাতি কম হয়। এই কারণে মরিয়েন্তেসের ২০০৩-০৪ মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লিগের পারফরম্যান্সটাও অনেকেরই চোখ এড়িয়ে যায়। নয়তো পারফরম্যান্সটা যে আদতেই অসাধারণ ছিল, সেটা স্বীকার করতে কারো মনে বিন্দুমাত্র দ্বিধা থাকার কথা নয়।