Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

রিয়াল মাদ্রিদ বনাম পিএসজি: দুই দলেরই এবারের মৌসুম বাঁচানোর এক ধ্রুপদী লড়াই

এবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ড্র এর অনুষ্ঠানের প্রায় শেষ অংশ সমাগত, তখনো রিয়াল মাদ্রিদের খেলা কার সাথে পড়তে যাচ্ছে তা নির্ধারিত হয়নি। সবাই উৎকণ্ঠায়, ঠিক শেষের আগে আগে ড্র এর মঞ্চে সাদা বল থেকে যে চিরকুটটি বের হলো তা জিভে জল এনে দেয়ার মতো এক লড়াইয়ের আয়োজন করে দিল। রিয়াল মাদ্রিদ বনাম পিএসজি। একটি দল যারা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শুরু হওয়ার পর প্রথম দল হিসেবে টানা দুবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতেছে আর অন্যদিকে ‘ফুটবল দৈত্য’দের মাঝে নতুন স্থান করে নেওয়া দল যাদের পাখির চোখ এই একটি ট্রফির দিকেই। শিরোনাম দেখে ভ্রু কুচকাবেন না পাঠক, আসলেই এই ম্যাচ দুই দলেরই মৌসুম বাঁচানোর লড়াই। কীভাবে জানেন?

সাবেক রিয়াল তারকা জাভির হাতেই উঠে আসে এই ম্যাচের চিরকুট; Source: dailystar.co.uk

টানা দুইবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতে নেয়া রিয়াল গত মৌসুমে তাদের ইতিহাসের অন্যতম সেরা সাফল্য পেয়ে প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস (মতান্তরে আত্মতুষ্টি) নিয়ে মৌসুম শুরু করে। কিন্তু খেই হারিয়ে ফেলে সেই শুরু থেকেই। পয়েন্ট হারাতে হারাতে বার্সা থেকে এখন অনেক দূরে, লীগের আশা খোদ রিয়ালের সবচেয়ে আশাবাদী ব্যক্তিও করেন না। লিগ কাপ কোপা ডেল রে থেকে ছিটকে গেছে নিজেদের মাঠে লেগানেসের সাথে হেরে। দোর্দন্ড প্রতাপে খেলতে থাকা দলটি এক হতশ্রী অবস্থায় পড়ে যায়।

ঠিক এমনই এক অবস্থায় ২০১৬ সালে দায়িত্ব নিয়ে জিদান স্রোতের বিপরীত দিকে গিয়ে রিয়ালকে জিতিয়ে দিয়েছিলেন সেবারের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। শূন্য হাতে মৌসুম শেষ করার অপেক্ষায় থাকা সমর্থকগোষ্ঠী পেয়েছিল সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ট্রফিটির স্বাদ। এবারও সে আশায়ই আছে রিয়াল সমর্থকগোষ্ঠী। তবে যদি পিএসজির সাথে রিয়ালের বিদায় হয়ে যায়, তবে মৌসুমের বাকি ম্যাচগুলো একপ্রকার মূল্যহীনই হয়ে যাবে। পিএসজির কিন্তু অবস্থা এমন নয়। লিগে বেশ বড় ব্যবধানে এগিয়ে, সবার ধারণামতেই পিএসজিই লিগ জিততে যাচ্ছে সহজে। লিগ কাপেরও ফাইনালে উঠে গেছে তারা। তবে তাদের কেন মৌসুম বাঁচানোর ম্যাচ এটি?

টানা দুবারের চ্যাম্পিয়ন রিয়াল যেন নিজেদের হারিয়ে খুঁজছে; Source: as.com

ফরাসি লিগের তুলনায় পিএসজির ধনকুবের মালিক যে পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করে খেলোয়াড় এনেছেন এই ক্লাবে তা প্রচন্ড অসম। লিগের অন্যান্য ক্লাবের তুলনায় তাদের মানের ফারাকও অনেক বেশী। গতবার মোনাকো লিগ জেতার আগে টানা ৪ বার লিগ জিতেছে পিএসজি। ঘরোয়া কাপও যেন নিজেদের সম্পত্তি বানিয়ে ফেলেছে। কিন্তু ফুটবল ‘কুলীনত্ব’ পেতে গেলে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতার বিকল্প নেই। এই ট্রফিটির জন্য তাদের মালিক এত বেপরোয়া যে, প্রায় সাড়ে চারশত মিলিয়ন খরচ করে কিনে এনেছেন সময়ের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় নেইমার ও এমবাপ্পেকে। ঘরোয়া লিগ ও কাপ জেতা অভ্যাস বানিয়ে ফেলা পিএসজির সামনে একটাই চাহিদা- চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। এই ট্রফি না জিততে পারলে হয়তো ঘরোয়া কাপগুলো জিতলেও তাদের কোচ তার চাকুরি ধরে রাখতে পারবেন না, কারণ আগের কোচও ঘরোয়া সব জিতেও চাকুরী ধরে রাখতে পারেন নি।

এবার একটু দেখে নেয়া যাক লড়াইয়ের ভেতরের লড়াইগুলো।

রক্ষণদূর্গ

খুব সাধারণভাবে বললে দু’দলের কারোরই রক্ষণভাগ কোনো উদাহরণযোগ্য কিছু না। পিএসজির রক্ষণভাগ সামলাবেন তিন ব্রাজিলিয়ান দানি আলভেস, থিয়াগো সিলভা ও মার্কুইনহোস। লেফট ব্যাকে কুরযাওয়া নাকি ইয়ুরি কে খেলবেন তা অনুমান করা কষ্টকর, তবে কুযাওয়ার খেলারই সম্ভাবনা বেশী। দানি আলভেস অভিজ্ঞ রাইটব্যাক, বার্সার হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতেছেন ৩ বার। এখনো এই ৩৫ পেরোনো বুড়োর গতি ও উপরে উঠে আক্রমণ করাটা যেকোন তরুণ রাইটব্যাকের জন্যই ঈর্ষণীয়। থিয়াগো সিলভা এই সময়ের অন্যতম সেরা ও ঠান্ডা মাথার ডিফেন্ডার। নিজের দিনে সিলভা যেকোন ফরোয়ার্ডের জন্যই দুরতিক্রম্য। অন্যদিকে বয়সে তরুণ মার্কুইনহোসকে সেই ১৯ বছর বয়স থেকেই ব্রাজিলে থিয়াগো সিলভার বদলি ভাবা হতো। কাগজ-কলমে তাদের জুটি যেকোনো দলের জন্যই ভীতিকর। কিন্তু সমস্যা হলো, এই মৌসুমে হয়তো পিএসজির মাঝমাঠের রক্ষণাত্মক কাজ কম করার কারণে তাদের জুটিকে একদম নিরেট মনে হচ্ছে না।

নিজেদের দিনে সিলভা-মার্কুইনহোস জুটি হয়ে উঠতে পারে অনতিক্রম্য; Source: The Hard Tackle

অন্যদিকে রিয়াল প্রথম লেগে পাচ্ছে না তাদের প্রথম পছন্দের রাইটব্যাক দানি কারভাহালকে, যেটা আসলেই রিয়ালের জন্য দারুণ এক ক্ষতি। যেহেতু এই পাশ দিয়ে নেইমার খেলবে, তাই রিয়াল অপরিপক্ক আশরাফ হাকিমিকে খেলাবে না, এই পাশে খুব সম্ভবত খেলবেন ডিফেন্সের সব জায়গায়ই খেলতে পারা নাচো। সেন্টার ডিফেন্সের জুটি হবে রামোস-ভারানে। এই জুটি রিয়ালের গত তিনটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালের মধ্যে দুটিতে খেলেছে। লেফটব্যাকে থাকছেন মার্সেলো। রিয়ালের বড় এক মাথাব্যথা তাদের রক্ষণ। দারুণ এক হতশ্রী দশা রিয়াল রক্ষণভাগের। মার্সেলো তার গতবারের ফর্মটা এবার ধরে রাখতে পারেননি। রামোস ও ভারানে প্রায়ই ভুল করছেন, কারভাহাল নেই, আবার প্রতিপক্ষের তূণে আছে নেইমার-ডি মারিয়া-কাভানি-এম্বাপ্পের মতো তীর। সব মিলিয়ে রিয়ালের রক্ষণই রিয়ালের জন্য ফারাক গড়ে দিতে পারে। যদি রিয়াল রক্ষণ তার এই বছরের দশা বজায় রাখে আর পিএসজির সেই ভয়ানক ত্রয়ী তাদের ফর্ম ধরে রাখে তবে মৌসুমের শেষ আশার সলতেও নিভে যাবে রিয়ালের।

মাঝমাঠের মারপ্যাঁচ

চ্যাম্পিয়ন্স লিগের এমন হাই ভোল্টেজ ম্যাচগুলোতে আসল ভূমিকা পালন করে মাঝমাঠ। মাঝমাঠ যার দখলে থাকে তার ম্যাচ জেতার সম্ভাবনা বেশি থাকে। সেই দিক দিয়ে রিয়াল মাদ্রিদের মাঝমাঠের শক্তি বেশী। রিয়ালের মাঝমাঠের দুই খেলোয়াড় ক্রুস ও মড্রিচকে অনায়াসেই বিশ্বের সেরা দুই মাঝমাঠ-মস্তিস্ক বলা যায়। এবার তাদের রসায়ন এত ভাল না জমলেও তাদের যা ফুটবলিক সেন্স, তাতে খুব সহজেই যেকোনো সময় যেকোনো দলের বিপক্ষে ছড়ি ঘোরাতে পারেন এই দুই মহারথী। পিএসজিরও এমন একজন হলেন ভেরাত্তি, কিন্তু পিএসজির মাঝমাঠের বাকি দুজন কে হবে তা নিয়ে অম্ল-মধুর সমস্যায় আছেন তাদের কোচ।

আক্রমণভাগ তো পিএসজির মোটামুটি নিশ্চিত। এখন বাকি দুই জায়গার জন্য লড়বেন ডি মারিয়া, ড্রাক্সলার, চেলসো, দিয়ারা, মোত্তা, পাস্তোরের মতো খেলোয়াড়। এ তো গেল মাঝমাঠ দখলের কথা, কিন্তু মাঝমাঠে এমন একজন থাকেন যার কাজই হলো প্রতিপক্ষকে প্রাধান্য বিস্তার থেকে দূরে রাখা, ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার। সেই কাজটি রিয়ালের হয়ে করবেন ক্যাসেমিরো। কিন্তু পিএসজির হয়ে কে করবেন তা নিশ্চিত নয়। সাম্প্রতিক ম্যাচগুলোতে এই পজিশনে খেলা আর্জেন্টাইন তরুণ লস চেলসো আদতে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার নন, মোত্তা পুরো সুস্থ নন, নতুন নিয়ে আসা সাবেক মাদ্রিদ খেলোয়াড় লাসানা দিয়ারাও দলের সাথে এখনো একাত্ম হতে সময় পাননি। এদিক দিয়ে রিয়াল পরিষ্কার এগিয়ে। রিয়াল মাদ্রিদ মাঝমাঠের লক্ষ্যই হবে বল ধরে রেখে পিএসজিকে প্রতি-আক্রমণের সুযোগ না দেয়া। আবার পিএসজির মাঝমাঠে বল ধরে রেখে খেলানোর খেলোয়াড় রিয়ালের মতো নেই, কিন্তু আছে গতি দিয়ে ছিড়েখুঁড়ে খেয়ে ফেলার রসদ। সুতরাং বলা বাহুল্য, মাঝমাঠেই হবে আসল লড়াই।

রিয়াল মাঝমাঠের দুই মস্তিস্ক ক্রুস ও মড্রিচ; Source:YouTube

আক্রমণভাগ

সমূহ সম্ভাবনা যে, রিয়াল মাদ্রিদের আক্রমণ ত্রয়ী হতে যাচ্ছেন বেল-বেঞ্জেমা-রোনালদো। পুরো রিয়াল মাদ্রিদেরই আক্রমণভাগের মন্দা চলছে, কেউই ধারাবাহিক নন। তবে লিগে ম্লান রোনালদো চ্যাম্পিয়ন্স লিগে দারুণ সপ্রতিভ, গত ম্যাচেও করেছেন হ্যাটট্রিক। যেকোনো একজনের বদলে শুরু থেকেই খেলতে পারেন ইস্কো বা আসেনসিও, যাদের কেউই দারুণ কোনো ফর্মে নেই।

খুব স্বল্প সময়েই এই ত্রয়ী পরিণত হয়ে উঠেছে এক আতঙ্কে; Source:nytimes.com

অন্যদিকে পিএসজির আক্রমণভাগ এই মুহুর্তে বিশ্বের অন্যতম সেরা। চ্যাম্পিয়ন্স লিগে করে ফেলেছে ৬ ম্যাচে ২৫ গোল। নেইমার-এমবাপ্পের বোঝাপড়াটা এককথায় ‘টেলিপ্যাথিক’, সাথে রয়েছেন অভিজ্ঞ স্কোরার কাভানি। বদলি হিসেবে নামতে পারেন দারুণ প্রতিভাবান জার্মান উইঙ্গার ড্রাক্সলার। বিতর্কিত হোক আর যা-ই হোক, পিএসজিতে পূর্ণ স্বাধীনতা পাওয়া নেইমার আছেন ভয়ংকর ফর্মে। সব মিলিয়ে রামোসদের সময়টা খুব একটা সুখকর হবে না বলাই যায়।

কিছু অনুমান

রিয়াল মাদ্রিদের এবার ঘরোয়া ফর্ম তথৈবচ- তা তো বলা হলোই। গোলবন্যা হয়েছে হাতে গোনা দু-তিনটি ম্যাচে, কিন্তু এই আকালের সময়েও চ্যাম্পিয়ন্স লীগে রিয়াল বেশ সপ্রতিভ ছিল। মূলত রিয়ালের ৪-৩-৩ বা ৪-৩-১-২ ফরমেশনের কোনোটাই ভালো কাজ করছে না। ক্যাসেমিরোর ফর্ম ভালো না থাকায় মাঠে তার উপস্থিতি খেলাকে ধীর করে দিচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, যে ম্যাচে ক্যাসেমিরো না থাকেন ও আসেনসিওকে খেলিয়ে দুই উইং দিয়েই পূর্ণ আক্রমণে যায় রিয়াল, সেই ম্যাচগুলোই একটু ভালো করে থাকে। তবে কি ক্যাসেমিরোকে ছাড়া খেলবে রিয়াল? মনে হয় না। কারণ নেইমার, এমবাপ্পেদের সাথে ক্যাসেমিরো ছাড়া এতটা দুর্বল রক্ষণশক্তি নিয়ে যাবে না রিয়াল মাদ্রিদ।

আবার পিএসজির মাঝমাঠ তাদের রক্ষণকে ভালো সহায়তা করছে না। তুখোড় ফর্মে থাকা ডি মারিয়াকে খেলানোর সমূহ সম্ভাবনা, সেই ক্ষেত্রে পিএসজির মাঝমাঠ প্রচন্ড গতিশীল হলেও সময়ের চাহিদায় বল ধরে খেলাটা হয়তো হবে না, কিছুটা রক্ষণেও দুর্বল হবে পিএসজি। লস চেলসো ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে নতুন, বল পায়ে দারুণ কিন্তু অনেক দুর্বলতা আছে রক্ষণের কাজে। তাই এই মাঝমাঠটা রিয়াল পাখির চোখ করবেই। ক্রুস-মড্রিচরা তাদের ক্ষুরধার ফুটবল-মস্তিস্ক দিয়ে মাঝমাঠ ধরে রাখতে পারলে হয়তো পিএসজির আক্রমণভাগের মহারথীরা সেভাবে যোগান পাবেনই না।

ফর্ম সে যা-ই থাক, এখনো রিয়ালের আসল ভরসা এই রোনালদোই; Source: Marca

এতক্ষণ শুনে যদি মনে হয় রিয়ালের তো কোনো সম্ভাবনাই নেই তবে ভুল ভাবছেন। রিয়ালের ১২টি চ্যাম্পিয়ন্স লীগের মধ্যে ৫টিই এমন সময়ে জেতা যখন তাদের ঘরোয়া প্রতিযোগিতাগুলোয় সাফল্য পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। অর্থাৎ আহত বাঘের ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠার অবস্থা! সম্প্রতি বর্তমান বায়ার্ন ও সাবেক রিয়াল কোচ হেইঙ্কেস বলেছেন যে, রিয়ালকে বাদ দিয়ে ভাবাটা বোকামি। তার নিজের অভিজ্ঞতা মতে আসল রিয়ালকে তখনই পাওয়া যায় যখন তাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়। হেইঙ্কেস যেবার রিয়ালকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতান সেইবার রিয়াল লিগে হয় চতুর্থ। বর্তমান ফর্ম অনুযায়ী পিএসজি পরিষ্কার ফেভারিট, কিন্তু প্রতিপক্ষ রিয়াল মাদ্রিদ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ইতিহাসের সেরা দল। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের বাজনাটা শুনলেই যাদের প্রাণ ফিরে আসে, তাদের এত সহজে হিসাব ঠেকে বাদ দেয়া যায় না। সব মিলিয়ে এক ধুন্ধুমার ম্যাচের অপেক্ষায় পুরো ফুটবল বিশ্ব।

Featured image:  (Sofoo) Youtube 

Related Articles