বিশ্বসেরা ক্রীড়াবিদদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শনীর সবচেয়ে বড় মঞ্চ হলো অলিম্পিক গেমস। পৃথিবীর সকল দেশের প্রতিনিধিদের একক সর্বোচ্চ মিলনমেলাও এটি। তাই তো এটিকে অভিহিত করা হয় ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ হিসেবে। সাম্প্রতিক অতীতের সকল অলিম্পিক আসরই ছিল নিজ নিজ জায়গা থেকে শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। ২০০৮ সালে বেইজিং, ২০১২ সালে লন্ডন, কিংবা ২০১৬ সালে রিও ডি জেনিরো- সকল অলিম্পিকই চেষ্টা করেছে নতুন কিছু করে দেখাতে, ইতোপূর্বের সকল আসরকে পেছনে ফেলতে। আসলেই তারা এক্ষেত্রে সফল হয়েছে কি না, তা তর্কসাপেক্ষ ব্যাপার। তবে একটি কথা নিঃসন্দেহেই বলা যায় যে, জাপানের রাজধানী টোকিওতে অনুষ্ঠিতব্য অলিম্পিক ২০২০ হতে চলেছে প্রযুক্তিগত দিক থেকে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে এগিয়ে থাকা অলিম্পিক আসর। সূর্যোদয়ের দেশে এমন চমকপ্রদ সব প্রযুক্তির ব্যবহার হতে চলেছে, যা কখনো কেউ ভাবতেও পারেনি। সেরকমই কিছু বিস্ময়কর প্রযুক্তির গল্প নিয়ে আজকের এই আয়োজন।
ই-বর্জ্য দিয়ে তৈরী মেডেল
অলিম্পিকের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো বিজয়ীদের জন্য বরাদ্দ থাকা সোনা, রূপা ও ব্রোঞ্জের মেডেলগুলো। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, ২০২০ সালের অলিম্পিকের মেডেলগুলো এমন কোনো মূল্যবান ধাতু দিয়ে তৈরী হচ্ছে না। মেডেলের প্রধান উপকরণ হিসেবে কাজে লাগানো হচ্ছে ই-বর্জ্য বা পুরনো, ব্যবহৃত মোবাইল ফোন, কম্পিউটার ও অন্যান্য গেজেট, যার ভেতরে সামান্য পরিমাণে সোনা ও রূপার অস্তিত্ব বিদ্যমান। প্রায় ৫,০০০ মেডেল তৈরির জন্য টোকিও গেমসের আয়োজকরা অনুদান পেয়েছেন প্রায় এক লাখের কাছাকাছি মোবাইল, কম্পিউটার কিংবা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইস।
হাইড্রোজেন পরিচালিত ভিলেজ
কার্বন নিঃসরণের বিরুদ্ধে লড়াইকে জাপান সরকার এত বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে যে, অলিম্পিক ভিলেজে প্রয়োজনীয় সকল শক্তি যেন হাইড্রোজেনের মাধ্যমে মেটানো সম্ভব হয়, তা নিশ্চিত করতে ৩০০ মিলিয়ন ডলার খরচ করছে তারা। ভিলেজের খুব কাছেই, মাটির নিচে একটি বিশাল পাইপলাইন সৃষ্টি করা হচ্ছে, যেখান থেকে সরাসরি ভিলেজের সকল জায়গায় হাইড্রোজেন গ্যাস পৌঁছে যাবে। এছাড়া অলিম্পিক চলাকালীন ৬,০০০ ফুয়েল সেল কার রাস্তায় ছাড়ার পরিকল্পনার পাশাপাশি, জাপান সরকার টয়োটা কোম্পানিকেও ৩৮৫ মিলিয়ন ডলার আর্থিক অনুদান দিচ্ছে নতুন ফুয়েল সেল মিরাই তৈরির জন্য।
চালকবিহীন ট্যাক্সি
টোকিও অলিম্পিক ২০২০-এর জন্য জাপান সিদ্ধান্ত নিয়েছে রোবট ট্যাক্সি রাস্তায় ছাড়ার, যা দর্শনার্থী ও অ্যাথলেটদের শহরের যেকোনো স্থানে নিয়ে যাবে। অনলাইন সার্ভিস প্রোভাইডার ডেনার সাথে রোবোক্যাব তৈরির লক্ষ্যে কাজ করছে নিসান ও টয়োটা। যাত্রীরা ডাউনলোডযোগ্য, ভয়েস কমান্ড সমৃদ্ধ একটি মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে রোবট ট্যাক্সি ডাকতে পারবে। এই প্রকল্পে আরো কাজ করছে রোবট ট্যাক্সি ইঙ্ক নামক একটি প্রতিষ্ঠান।
সৌরশক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার
২০১২ সালে লন্ডন অলিম্পিকে ৩ দশমিক ৪৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন কার্বন নিঃসরণ হয়েছিল। ২০১৬ সালের রিও ডি জেনিরো অলিম্পিকে সেই পরিমাণ আরো বেড়ে হয়েছিল ৩ দশমিক ৫৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন। টোকিওতেও কি একই পরিণতি হবে? না, টোকিওতে তা হওয়ার কোনো সুযোগই নেই। কারণ জাপান সরকার সমাধান হিসেবে বেছে নিয়েছে নবায়নযোগ্য শক্তি তথা সোলার প্যানেল ও ওয়াইন্ডমিলকে। টোকিওর সকল পথঘাট সোলার প্যানেল দিয়ে ঢেকে দেয়া হবে। এছাড়াও নিশ্চিত করা হবে যেন অলিম্পিক উপলক্ষ্যে বাইরে থেকে আসা খেলোয়াড়, কর্মকর্তা ও দর্শনার্থীদের ব্যবহৃত সকল দ্রব্য রিসাইকেল করে পুনরায় ব্যবহার করা হয়।
রোবট সহযোগী
অলিম্পিক আয়োজকেরা পরিকল্পনা করছে অলিম্পিক ভিলেজের কাছাকাছি একটি ছোটখাট রোবট আর্মির ক্যাম্প গড়ে তোলার। এসব রোবটের কাজ হবে আগত অতিথি কিংবা অ্যাথলেটদেরকে সঠিক পথ দেখানো, যাতায়াতে সাহায্য করা, ভাষা অনুবাদ করে দেয়া ইত্যাদি। এছাড়া তারা কিছু ছোট সাহায্যও করবে, যেমন পর্যটকদের ব্যাগ বহন করে দেয়া।
ফেসিয়াল রিকগনিশন প্রযুক্তি
জাপানের বহুজাতিক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা এনইসি একটি নতুন ফেসিয়াল রিকগনিশন সিস্টেম তৈরি করেছে, যার মাধ্যমে ২০২০ টোকিও অলিম্পিকে ৩ লক্ষাধিক মানুষকে চিহ্নিত করা যাবে। সিস্টেমটি চিহ্নিত করবে অ্যাথলেট, মিডিয়া, স্বেচ্ছাসেবী এবং ইভেন্ট স্টাফদের। আশা করা হচ্ছে, এর মাধ্যমে অলিম্পিক চলাকালীন টোকিও শহরে যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত নিরাপত্তা ঝুঁকির আশঙ্কা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। পাশাপাশি এটি পূর্ববর্তী অথেন্টিকেশন সিস্টেমের চেয়ে অনেক দ্রুতগতিসম্পন্নও হবে।
তাৎক্ষণিক ভাষান্তর
যেকোনো বহুজাতিক সম্মেলনে ভাষা একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। একই কথা প্রযোজ্য অলিম্পিকের ক্ষেত্রেও। ২০৭টির মতো দেশ অলিম্পিকে অংশ নেবে। নানা দেশের নানা ভাষার মানুষের মধ্যে যোগাযোগে ভাষা যেন বাধা হয়ে না দাঁড়ায়, তা নিশ্চিত করতে ভয়েসট্রাস নামক একটি অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপ করা হচ্ছে, যার মাধ্যমে মুহূর্তের মধ্যেই ভাষান্তর করা যাবে। ২৭টি ভাষায় অনুবাদ করতে পারবে এটি। এছাড়া প্যানাসনিক একটি পরিধানযোগ্য (গলায় পরতে হবে) ডিভাইস তৈরির চেষ্টা করছে, যা দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে দশটি ভাষায় কথা অনুবাদ করা যাবে। তারা একটি স্মার্টফোন অ্যাপ্লিকেশন নিয়েও কাজ করছে, যা স্ক্যান করে যেকোনো জাপানি সাংকেতিক চিহ্নের মর্মোদ্ধার করতে পারবে।
ইলেকট্রনিক পাস
চিরাচরিত ইলেকট্রনিক টিকিট সিস্টেমকে আরো একধাপ উন্নত করে, ই-পাসের প্রচলন ঘটানো হতে পারে। ইতোমধ্যেই ওয়ান্ডার জাপান পাস নামক ডিভাইসটি দেখতে অনেকটাই ক্রেডিট কার্ডের মতো, যা দিয়ে বিল প্রদানের কাজও সারা যাবে। একটি নিবন্ধিত আইডি ই-পাসটির সাথে সংযুক্ত করা হবে, যার মাধ্যমে পাসধারী নির্দিষ্ট কিছু জায়গা, এমনকি স্টেডিয়াম এবং দর্শকদের হোটেল রুমেও প্রবেশের সুযোগ পাবে।
৫-জি ওয়্যারলেস সংযোগ
আগের অলিম্পিক আসরগুলোয় আগত দর্শনার্থীদের সংখ্যা থেকে ধারণা করা যায়, টোকিও অলিম্পিক চলাকালীনও অন্তত ৫ লক্ষ বিদেশী দর্শনার্থীর আগমন ঘটবে। এবং তারা সকলেই চেষ্টা করবে তাদের মোবাইল, ট্যাব কিংবা ল্যাপটপে ইন্টারনেট সংযোগ নেয়ার। এই বিশাল চাপ সামলানো জাপানের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। সেই চ্যালেঞ্জ জয়ের লক্ষ্যে নোকিয়ার সাথে পার্টনারশিপের মাধ্যমে ৫-জি ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে জাপানের সবচেয়ে বড় মোবাইল অপারেটর ডোকোমো। টোকিও অলিম্পিক চলাকালীন পুরোদমে কাজ করবে ৫-জি ইন্টারনেট। ইতোমধ্যেই তারা ২ গিগাবিট প্রতি সেকেন্ড গতি অর্জনে সক্ষম হয়েছে, যা ৪-জি ইন্টারনেটের ৩০০ মেগাবিট প্রতি সেকেন্ডের চেয়ে ছয়গুণেরও বেশি।
শৈবাল পরিচালিত জেট ও বাস
সারা বিশ্ব যখন পরিবেশবান্ধব, সবুজ জ্বালানির সন্ধানে মাথা কুটে মরছে, প্রথম সমাধানটি এসে গেছে জাপানের হাত ধরে। উড়োজাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বোয়িং ইতোমধ্যেই চুক্তি সম্পন্ন করেছে যে, টোকিও অলিম্পিক চলাকালীন একধরনের শৈবালকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের মাধ্যমে তারা চালাবে জেট ও বাস। এর ফলে কার্বন নিঃসরণ ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। এই প্রকল্পে বোয়িংয়ের সাথে হাত মিলিয়েছে জাপান সরকার, জাপান এয়ারলাইন্স, ইউনিভার্সিটি অফ টোকিও, নিপ্পন এয়ারওয়েজসহ মোট ৪০টি প্রতিষ্ঠান।
কৃত্রিম উল্কাপাত
২০২০ সালে অলিম্পিক চলাকালীন টোকিও শহরে উল্কাপাত হবে। তবে সেটি কোনো প্রাকৃতিক কারণে নয়, সম্পূর্ণই প্রযুক্তির সাহায্যে। কৃত্রিম উল্কাপাতের মূল উদ্দেশ্য হলো অলিম্পিক উপলক্ষ্যে শহরে আগত দর্শনার্থীদের মনোরঞ্জন। আর তাই এএলই নামক রকটি প্রতিষ্ঠান মহাকাশে খুদে একটি স্যাটেলাইট পাঠাচ্ছে। এই স্যাটেলাইটটিই ঘটাবে কৃত্রিম উল্কাপাত। প্রতি সেকেন্ডে পাঁচ মাইল বেগে ছুটে আসবে বিভিন্ন রঙের উল্কাগুলো, যেজন্য মোট খরচ পড়বে ৪ মিলিয়ন ডলার।
সুপারস্পিড ম্যাগলেভ ট্রেন
১৯৬৪ অলিম্পিকের মাধ্যমে টোকিও বিশ্বকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল বুলেট ট্রেনের সাথে। এবং ২০২০ সালে দেখা মিলবে ট্রেনেরই আরো আধুনিকতম সংস্করণের সাথে। নতুন রেল প্রযুক্তিতে ব্যবহৃত হবে ম্যাগনেটিক লেভিয়েশন। ম্যাগলেভ ট্রেন ইতোমধ্যেই বিশ্বের বেশ কিছু দেশে চলছে বটে, কিন্তু জাপানি মডেলটিই হবে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে দ্রুতগতির। রেকর্ড ৬০১ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা গতিসম্পন্ন ট্রেনটি ২০২০ অলিম্পিকের আগেই চলতে শুরু করবে, এবং ২০৪৫ সালের মধ্যে এগুলো ওসাকাতেও চলবে।
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/