১.
রোগমুক্ত জীবন কে না চায়? সবাই জন্মের পর জীবনে কোনো না কোনো রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। কিন্তু কেমন হবে, যদি পৃথিবীর আলো দেখার আগেই এসব রোগ বালাই থেকে মুক্ত হয়ে পৃথিবীতে জন্ম নেয়া যায়? জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং খুঁজছে সেই উপায়। মানুষকে জন্ম থেকে অতিমানব হয়ে উঠবার পথ দেখাতে চাইছে জিন প্রকৌশল। যদি সত্যিই এমন হয় তাহলে কি সেটা মানব জাতির জন্য সুফল বয়ে আনবে, নাকি মানুষকেই ফেলে দেবে সমূহ বিপদের মুখে? আজকের জেনেটিক সুপার বেবি কি রুপ নেবে আগামীর অতিমানবে?
চীনের সেনজেন প্রদেশের সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির গবেষক হি জিয়ানকি এভাবে ভ্রূণ এবং জিন সংশোধনের মাধ্যমে পৃথিবীর সর্বপ্রথম জেনেটিক সুপারবেবি জন্ম দেয়ার দাবি করেছেন। তিনি মানব ভ্রূণ থেকে সিসিআর ফাইভ (CCR5) জিনকে নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছেন। এই জিন এমন একধরনের প্রোটিন গঠন করে, যা কোষের মধ্যে এইচআইভি ঢুকতে সাহায্য করে। যেহেতু তিনি এই জিনটিকে নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছেন, এর ফলে পিতামাতার জিন থেকে ভ্রুণের মধ্যে এইচআইভি ঢুকতে পারবে না এবং এই ভ্রূণ থেকে জন্ম নেয়া শিশুটিও থাকবে এইচআইভির আক্রমণ থেকে মুক্ত।
চীনা উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা স্বভাবতই এই পদক্ষেপের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। জিন সংশোধনের মাধ্যমে মানবশিশু জন্ম দেয়ার নিয়ম সবসময় নিষিদ্ধ থাকাই উচিত। কারণ এরকম কিছু ঘটলে, জেনেটিক প্রকৌশলের মাধ্যমে উদ্ভাবিত শিশুরা এতটাই উন্নত হবে যে, শেষপর্যন্ত মানব জাতিই হুমকির মুখে পড়ে যাবে। চিকিৎসা বিজ্ঞানও বলছে, জিন প্রকৌশলের মাধ্যমে তৈরি মানবশিশু জন্ম দেয়ার কোনো দরকারও নেই। কারণ ভ্রুণ সম্পাদনা করে মানবশিশু উৎপাদন করতে হবে, পৃথিবী এমন কোনো সংকটময় পরিস্থিতিতে গিয়ে ঠেকেনি।
এইচআইভি থেকে শুরু করে আরো অনেক জটিল রোগের আক্রমণ থাকে বাঁচার জন্য জিন সম্পাদনা ছাড়াও আরো অনেক পদ্ধতি রয়েছে। আর এমনটাও তো নয় যে, বন্ধ্যাত্ব ঘোচানোর জন্য এই প্রযুক্তি মানুষের উপকারে আসবে। বরং জিন সম্পাদনা করে মানব শিশু জন্মদানের সাথে জড়িত আছে ঝুঁকি এবং অনিশ্চয়তা। উপরন্তু, যদি জিন প্রকৌশলের মাধ্যমে মানবশিশু উৎপাদন করা হয়, তাহলে যুগের পর যুগ ধরে চলে আসা চিকিৎসাবিজ্ঞানের মূলতত্ত্ব– “সর্বোপরি কোনো ধরনের ক্ষতি করা যাবে না”-কে প্রশ্নবিদ্ধ করা হবে ।
২.
স্বভাবতই প্রশ্ন আসতে পারে, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ব্যবহৃত জিন এডিটিংয়ের যেসব কৌশল- যেমন CRISPR-Cas9– এগুলোকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব? এই ব্যাপারগুলো আন্তর্জাতিকভাবে নিয়ন্ত্রণের চাইতে রাষ্ট্রীয় উপায়ে নিয়ন্ত্রণ করাই শ্রেয় হবে বলে সমালোচকেরা মনে করছেন। এমনকি এফডিএ (ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) এর মতো শক্তিশালী পর্যবেক্ষক এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থা চাইলেই একে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। এফডিএ’র অধীনে জিন প্রকৌশলের মাধ্যম CRISPR-Cas9 কোনো যন্ত্র হিসেবে না, বরং ঔষধ হিসেবে নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। ফলে জিন এডিটিংয়ের এই মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করা তাদের পক্ষে আরো বেশি সহজ এবং কার্যকরী বলে মনে করা হচ্ছে। এমনকি কংগ্রেস তার ব্যয়ের তালিকা থেকে এফডিএ কর্তৃক জীবাণু এবং জীন কোডিং করার খরচও বাদ দিয়ে দিয়েছে। তারপরেও আমেরিকার সংবিধানে এখনও এমন কোনো আইন নেই, যা জিন প্রকৌশলের মাধ্যমে মানবশিশু উৎপাদনকে আইনের আওতায় এনে নিষিদ্ধ করতে পারে।
সমালোচকরা মনে করেন, জিন প্রকৌশলের মাধ্যমে মানবশিশু উৎপাদনকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বিশ্বের বেশিরভাগ আধুনিক রাষ্ট্রের যথেষ্ট ক্ষমতা রয়েছে। তবে এটা জেনে রাখা ভাল, জিন প্রকৌশলের মাধ্যমে মানবশিশুর জন্ম দেয়ার ফলে যে স্বাস্থ্যগত সুবিধার কথা বলা হচ্ছে তা খুবই সন্দেহজনক এবং অস্পষ্ট। সিসিআর৫ জিন নিষ্ক্রিয় করে ফেলার ধারণাটি নতুন কিছু নয়। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের বায়োটেক কোম্পানিগুলো এই ধারণাকে পুঁজি করে ইতোমধ্যে এইচআইভির আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
৩.
জিন সম্পাদনা এবং রোগ নিবারক জিন থেরাপির সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হচ্ছে, যখন কোনো মানুষের ক্ষেত্রে এই জিন থেরাপি প্রয়োগ করা হবে, তখন রোগী জিন থেরাপির ফলে অন্যান্য জিনের পরিবর্তন বা কার্যকরী জিনের ক্ষতিসাধনকে পুষিয়ে নিয়ে পারবে। তবে জিন সংশোধনের মাধ্যমে মানবশিশু জন্ম দেয়ার ক্ষেত্রে এই ক্ষতির মাত্রা অনেক বেশি, কারণ এখানে জিন সংশোধনের মাধ্যমে একজন মানুষের স্বাস্থ্যগত সুবিধার চাইতে CRISPR-Cas9 অণু মানবদেহে স্থাপন করার মতো একপেশে ঝুঁকি বহন করে।
দ্বিতীয়ত, আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ এবং নৈতিক পার্থক্য হচ্ছে, সিসিআর৫ জিন থেরাপি মানবকোষের বংশগত জিনকে প্রভাবিত করে না। ফলে এই জিন থেরাপির প্রভাব ডিএনএ’র মাধ্যমে বংশানুক্রমিকভাবে পরের প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব একটা নেই। অন্যদিকে চীনা গবেষকদের জিন সম্পাদনার ক্ষেত্রে ঘটনটি সম্পূর্ণ বিপরীত। অর্থাৎ তাদের সম্পাদিত জিন বংশানুক্রমে পরের প্রজন্মের মধ্যেও ছড়িয়ে যাবে। তবে টি-সেলের জিন থেরাপি বা যেকোনো ধরনের জিন সম্পাদনা পরবর্তী প্রজন্মের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলবে, যা হয়তো এই অল্প সময়ের মধ্যে স্পষ্টভাবে বোধগম্য হচ্ছে না।
আমাদের জিন আমাদের বাবা-মা দুজনের কাছ থেকে প্রাপ্ত। তাই আমাদের বেশিরভাগ জিনেরই দুটি করে প্রতিরূপ জোড়ায় জোড়ায় বিদ্যমান। ফলে কোনো একটি জিনের সংশোধনের ফলে, সেটি পরবর্তী বংশের জন্মের মাধ্যমে ছড়িয়ে যাওয়ার সময় তার প্রতিরূপ আরেকটি জিনের সাথে জোড়া বাঁধতে চাইবে। ফলাফলস্বরূপ, যখন কোনো শিশু জন্ম নেবে, বাবা এবং মা- দুদিক থেকে আসা ক্রোমোজোমের মধ্যে ক্রস-ওভার হবার সময় সম্পাদিত জিনটি ভ্রুনের অন্যান্য জিনের সাথে ব্যাপক আকারে অদল-বদল হয়ে যাবে। আর এভাবেই মানবশিশু জন্মদানের জন্য জিন সংশোধনের প্রভাব, অন্যান্য জিনগত পরিবর্তনের সুবিধাকে হুমকির মুখে ঠেলে দেবে। এর চাইতেও জটিল ব্যাপার হচ্ছে, কোনো একটি জিনের রূপান্তর বা পরিবর্তনের প্রভাব অন্যান্য আরো দশ থেকে একশটি জিনের সহযোজনের উপর নির্ভর করে। জিন সংশোধনের ফলে, এই নতুন জিনটি অন্যান্য জিনের মধ্যে মিশে গিয়ে সেসব জিনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে বাঁধা দিতে পারে।
৪.
ভারসাম্যপূর্ণ জিন নির্বাচন কোনো মামুলি ব্যাপার নয়। ১৯৭০ এর দিকে বিজ্ঞানী লিয়েন্টিন এবং হাবি ব্যালেন্সিং সিলেকশন বা ভারসাম্যপূর্ণ নির্বাচনের একটি ধারণা সবার আগে সামনে নিয়ে আসেন, যে ধারণাটি এর আগেই একটি তত্ত্বে বর্ণনা করা হয়েছে। তত্ত্বটি হচ্ছে, বিভিন্ন রোগের জন্য দায়ী বিরল জীনগুলো মানবদেহে সহজেই মিশে থাকতে পারে, কারণ বংশগত ভিন্নতা অনুসারে ক্ষতিপূরণ হিসেবে তারা বিষমসত্ত্বা সৃষ্টি করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। অর্থাৎ রোগের জন্য দায়ী এই জিনগুলো এক অর্থে ভাল কাজে ভূমিকা পালন করে থাকে। ঝুঁকিপূর্ণ বা স্বাস্থ্যঝুকির জন্য দায়ী জিনগুলো, উপকারী জিনগুলোর সাথে হিচহাইকিং বা অনুগত ভ্রমণের মাধ্যমে জুড়ে থাকতে পারে।
স্কিৎজোফ্রেনিয়া নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, ঝুঁকিপূর্ণ জিনগুলো ব্যাকগ্রাউন্ড সিলেশনের কারণে আমাদের সাথে সহজেই খাপ খাইয়ে থাকতে পারে। ফলে সময়ের সাথে সাথে অনেক ধরনের জন্মগত বৈশিষ্ট্য বিলুপ্ত হয়ে যায়। অতএব মানুষের জন্মগত বৈশিষ্ট্যগুলো খারাপ নাকি ভাল তার চাইতেও বড় ব্যাপার হচ্ছে এরা কীভাবে অন্যান্য জন্মগত বৈশিষ্টের পরিবর্তন এবং পটভূমির উপর নির্ভরশীল।
বিজ্ঞানীরা এখন ডিএনএ সার্জারির আরো সঠিক পন্থা খুঁজে যাচ্ছেন। প্রথমত, তারা দুটো ডিএনএর যুক্ত থাকা বিটকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। তারপর ভাইরাসের মাধ্যমে এই ডিএনএ বিটগুলো মানবকোষের অভ্যন্তরে স্থাপন করার কথা ভাবছেন। ১৯৬০ সালের দিকে পল বার্গের ল্যাবরেটরিতে ইকোআর১ এর মাধ্যমে দুটো ডিএনএ জোড়কে বিভক্ত করা হয়েছিল। এ নিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যাসিলোমার কনফারেন্স সেন্টারে ব্যাপক বিতর্ক হয়েছিল। বিজ্ঞানীরা যে নিজেরাই তত্ত্ব এবং বিশ্লেষণের মাধ্যমে নিজেদেরকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন এটি তারই একটি বিখ্যাত উদাহরণ।
৫.
তবে বিজ্ঞানীরা জিন প্রকৌশলের মাধ্যমে অত্যাধুনিক মানবশিশু জন্মদান নিয়ন্ত্রণ করবেন কি না তা এখনও স্পষ্ট নয়। ১৯৭০ এর দিকে ডিএনএ এবং জিন বিভক্তিকরণ শুধুমাত্র অভিজাত শ্রেণীর কিছু মাইক্রোবায়োলজি বিশেষজ্ঞ কর্তৃক সম্পাদন করার সুযোগ ছিল। কিন্তু বর্তমানে CRISPR-Cas9 প্রযুক্তি অনেক বেশি পেশাদার উপায়ে জিন সংশোধনের ক্ষমতা রাখে, যা জিনতত্ত্বে আগে কখনোই সম্ভব হয়নি। হয়তো CRISPR বা এই প্রযুক্তির সাথে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীদেরকে থামানো অসম্ভব। তবে জিন সম্পাদনার মাধ্যমে মানবশিশু উৎপাদনের অস্পষ্ট কারণ এবং তাদের এই মুর্খ আত্মবিশ্বাসকে দূর করার জন্য আইনের সহায়তাও সমানভাবে জরুরি।
১৯৮০ সালে মার্টন ক্লাইন নামক একজন ইউসিএলএ গবেষক সর্বপ্রথম অনুমোদন ছাড়াই মানব কোষে জিন সংশোধনের চেষ্টা করেছিলেন। ১৯৯৬ সালে ডলি নামক একটি ভেড়ার ক্লোন করার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর অনেকেই বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন যে, জিন সংশোধনের মাধ্যমে আসলেই হয়তো মানবশিশু জন্ম দেয়া সম্ভব। অথচ ডলির সেই ক্লোন ভেড়াটিকে কিন্তু বাঁচানো যায়নি!
তারই সুবাদে ২০০২ সালে ইতালীয় প্রজনন চিকিৎসক সেভেরিনো এন্টেনরি, শল্য চিকিৎসক পেনোস জাভোস এবং র্যালিয়ান কাল্ট দাবি করেছিলেন, তারা মানব ইতিহাসের সর্বপ্রথম ক্লোন শিশু জন্ম দিয়েছেন। অদ্ভুত হলেও সত্য, তারা তিনজনই পৃথকভাবে এই দাবি করেছিলেন। সম্প্রতি চীনা বিজ্ঞানীর জেনেটিক প্রকৌশলের মাধ্যমে মানবশিশু জন্ম দেয়ার ঘটনাটি উল্লেখিত উচ্চাকাঙ্ক্ষার ও প্রচেষ্টাগুলোর বর্ধিত রুপ। এবং এটাও অনুমান করা যায় যে, এমন মানবশিশু জন্মদানের ঘটনা বা আইডিয়া সামনে আরও আসবে।
৬.
জিন এডিটিংয়ের প্রযুক্তি এখন যেমন আগের চাইতে আরো বেশি পেশাদার এবং সহজ হয়ে উঠেছে, তেমনই জিন এডিটিংয়ের জন্য দরকারি জেনেটিক ইনফরমেশনও আগের চাইতে আরো সহজলভ্য। ড্যানিয়েল পস্থুমার কথাই ধরা যাক। ২০১৭ সালে এই বিজ্ঞানী ৫২টি জিনকে মানব বুদ্ধিমত্তার সাথে যুক্ত করেছিলেন।
কিন্তু যেভাবে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এগিয়ে যাচ্ছে এবং সহজ হয়ে উঠছে, তাতে কি আসলেই কৃত্রিম উপায়ে নিরোগ মানবশিশু জন্ম দেয়া সম্ভব হবে? অভিভাবকরা কি নিরোগ এবং উন্নত শিশুর জন্য জেনেটিক ল্যাবরেটরিগুলোতে আবেদন করা শুরু করবেন?
যতটা সহজে ভাবা যায়, বাস্তবতা আসলে এতটা সহজ নয়। শারীরিক রোগ বালাই থেকে হয়তো এসব শিশু মুক্ত থাকবে, কিন্তু মানসিক সমস্যাগুলো সমাধানের কোনো পথ এখনও খুঁজে পাননি বিজ্ঞানীরা। অতএব আজকের জেনেটিক সুপারবেবি যে আগামীর অতিমানব সৃষ্টির প্রাথমিক ধাপ, তা এখনই নিশ্চিতভাবে বলা যায় না।
আর আসলেই যদি এমন কিছু সম্ভব হয়, তাহলে স্বাভাবিক মানুষের সাথে এদের সামঞ্জস্যতা এবং সাম্যবাদ কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে সেটিই প্রধান চিন্তার বিষয়।