বিজ্ঞানী হিসেবে যে কয়েকজন ব্যক্তি সারা বিশ্বে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম জামাল নজরুল ইসলাম। ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি সহ বেশ কয়েকটি নামীদামী বিশ্ববিদ্যালয়ে তার লেখা বই পাঠ্য হিসেবে পড়ানো হয়। বিশ্বের বেশ কয়েকটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে তার লেখা বই ‘The Ultimate Fate of the Universe’। কিন্তু আক্ষেপের ব্যাপার হলো, বাংলাদেশী এই বিজ্ঞানীর বিশ্ববিখ্যাত এই বইটি স্বয়ং বাংলাতেই অনূদিত হয়নি এখনো। মহাবিশ্বের অত্যন্ত চমকপ্রদ একটি বিষয় নিয়ে লেখা বাংলাদেশী বিজ্ঞানীর অত্যন্ত চমৎকার এই বইটি বাংলায় ফিরিয়ে আনা উচিৎ ছিল অনেক আগেই। এই দায়িত্ববোধ থেকেই বইটিকে অনুবাদের প্রয়াস নেয়া হয়েছে। পূর্বে ১ম অধ্যায়ের বাংলা রূপান্তর উপস্থাপন করা হয়েছিল। এখানে ২য় অধ্যায় উপস্থাপন করা হলো।
দূরত্ব ও বিশালতার মাপামাপি
পরিমাপের সাধারণ একক দিয়েই দৈনন্দিন জীবনের হিসাব-নিকাশ করা যায়। কিন্তু কেউ যখন মহাবিশ্ব নিয়ে আলোচনা করে, তখন এসব সাধারণ একক ব্যবহার না করে বড় একক ব্যবহার করে। জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করতে গেলে দূরত্ব ও সময়ের ক্ষেত্রে বড় একক ব্যবহার করতেই হয়। ‘Astronomical’ তথা ‘জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক’ শব্দটির উৎপত্তিগত অর্থই হচ্ছে, ‘অনেক বেশি পরিমাণ’। জ্যোতির্বিজ্ঞানের সাধারণ আলোচনা করতে গেলে বড় একক তো ব্যবহার করতে হয়ই, পাশাপাশি সামগ্রিকভাবে মহাবিশ্ব নিয়ে আলোচনা করতে গেলে এর চেয়েও বড় স্কেল ব্যবহার করতে হয়।
জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক হিসাব-নিকাশে মাইল কিংবা কিলোমিটার কোনোটিই সুবিধাজনক নয়। এখানে সবচেয়ে উপযুক্ত একক ‘আলোক বর্ষ’ বা Light year। আলোর বেগ প্রতি সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার। আলো যদি এই বেগে টানা এক বছর ভ্রমণ করে তাহলে যে দূরত্ব অতিক্রম করবে, তাকে বলে এক আলোক বর্ষ। কিলোমিটারের মাধ্যমে আলোক বর্ষকে প্রকাশ করলে দাঁড়াবে, এক আলোক বর্ষ সমান ৯×১০^১২ কিলোমিটার বা ৯ মিলিয়ন মিলিয়ন কিলোমিটার।
আলোক বর্ষ সম্পর্কে আরেকটু পরিস্কার ধারণা পাবার জন্য আমাদের চেনা-জানা কিছু দূরত্বকে আলোর গতির সাথে তুলনা করে দেখতে পারি। পৃথিবীর পরিধি প্রায় ৪০ হাজার কিলোমিটার। আলো এক সেকেন্ডের ভেতর পৃথিবীকে সাতবারের মতো পাক খেতে পারবে অনায়াসেই। পৃথিবী থেকে চাঁদের গড় দূরত্ব প্রায় ৩ লক্ষ ৭১ হাজার কিলোমিটার। এক থেকে দেড় সেকেন্ডের ভেতরেই আলো এই দূরত্ব পার হয়ে যেতে পারবে। সূর্য থেকে পৃথিবীর গড় দূরত্ব প্রায় ১৫০ মিলিয়ন কিলোমিটার। আলো যদি সূর্য থেকে যাত্রা শুরু করে তাহলে এই দূরত্ব পার হয়ে পৃথিবীতে আসতে ৮ থেকে ৮.৫ মিনিটের মতো সময় লাগবে। সৌরজগতের সবচেয়ে দূরের গ্রহ প্লুটো[1]। সূর্য থেকে প্লুটোর গড় দূরত্ব ৫ হাজার ৯ শত মিলিয়ন কিলোমিটার। এই দূরত্ব অতিক্রম করতে আলোর সাড়ে ৫ ঘণ্টা সময় লাগে। সূর্য থেকে প্লুটোর যে দূরত্ব, তার চেয়েও ১৬ শত গুণ বেশি দূরত্ব ধারণ করে মাত্র এক আলোক বর্ষ।
আবার যখন শুধুমাত্র সৌরজগতের গ্রহ-উপগ্রহের দূরত্ব পরিমাপ করা হয়, তখন একক হিসেবে ‘আলোক বর্ষ’ খুবই বড় হয়ে যায়। সৌরজগতের ভেতরে পরিমাপের বেলায় এত বড় এককের প্রয়োজন নেই। এর জন্য বিজ্ঞানীরা ‘জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক একক’ বা Astronomical Unit নামে একটি একক ব্যবহার করেন। একে সংক্ষেপে AU বলা হয়। সূর্য থেকে পৃথিবীর গড় দূরত্বকে এক AU বলা হয়। এই এককে সূর্য থেকে প্লুটোর দূরত্ব দাঁড়ায় ৩৯.৫ জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক একক। আলোক বর্ষের সাথে তুলনা করলে দাঁড়ায়, ৬০ হাজার জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক একক সমান ১ আলোক বর্ষ।
আলোক বর্ষের পাশাপাশি জ্যোতির্বিদরা আরো একটি একক ব্যবহার করেন। এর নাম ‘পারসেক’। ৩.২৬ আলোকবর্ষে হয় ১ পারসেক। অতি বিশাল দূরত্বের হিসাবের জন্য জ্যোতির্বিদরা ‘মেগা পারসেক’ও ব্যবহার করে থাকেন। এক মিলিয়ন পারসেকে হয় এক মেগা পারসেক।
মিল্কি ওয়ে
চাঁদ ওঠেনি এমন কোনো রাতে পরিস্কার আকাশের দিকে তাকালে যে কেউই হাজার হাজার তারা দেখতে পাবে। মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করলে এসব তারার মাঝে উজ্জ্বল একটি প্রণালীর দেখা পাওয়া যাবে। এই প্রণালীটি লক্ষ লক্ষ তারার সমাবেশে গঠিত এবং আকাশের এক মাথা হতে আরেক মাথা পর্যন্ত বিস্তৃত। খালি চোখে পৃথিবীর প্রায় সকল এলাকা থেকেই এটি দেখা যায়। প্রাচীনকালের মানুষেরাও এটি শনাক্ত করতে পেরেছিল। এটি মিল্কিওয়ে বা আকাশগঙ্গা নামে পরিচিত।
খালি চোখে যত তারা দেখা যায়, এমনকি সাধারণ টেলিস্কোপে যত তারা দেখা যায়, তাদের প্রায় সকলেই মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে অবস্থিত। আমাদের সূর্য তথা সৌরজগতও সেসব তারাদের সাথে সম্পর্কিত। সূর্য সহ সকল তারার সমন্বয়েই আমাদের গ্যালাক্সি গঠিত। এই গ্যালাক্সিটি বেশ কয়েকটি নামে পরিচিত- মিল্কিওয়ে, মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি, আমাদের গ্যালাক্সি, ছায়াপথ ইত্যাদি। সাধারণভাবে একে শুধু ‘গ্যালাক্সি’ বা শুধু ‘ছায়াপথ’ নামেও ডাকা হয়।
ইংরেজি গ্যালাক্সি শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে গ্রিক শব্দ Galaxias kyklos থেকে। এই গ্রিক শব্দের মানে হচ্ছে দুধের রাস্তা বা দুগ্ধ প্রণালী। এভাবে হিসেব করলে মিল্কিওয়ে এবং গ্যালাক্সি শব্দ দুটি মূলত একই অর্থ বহন করে। এখানে আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিকে শুধুমাত্র ‘গ্যালাক্সি’ হিসেবেও উল্লেখ করতে পারি।
আমাদের গ্যালাক্সিটিকে অনেক অনেক দূর থেকে দেখলে অনেকটা সমতল ডিস্কের মতো বলে মনে হবে। সিডি বা ডিভিডিতে যেমন ডিস্কের একটি কেন্দ্র থাকে, তেমনই গ্যালাক্সিরও একটি কেন্দ্র আছে। আমাদের সূর্য তার গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে। মধ্যভাগের কেন্দ্র এবং বাইরের পরিধিকে সীমানা বিবেচনা করলে, কেন্দ্র থেকে এই সীমার দুই-তৃতীয়াংশ দূরত্বে অবস্থান করছে আমাদের সূর্য।
যে গ্যালাক্সিটিকে আমরা ডিস্ক হিসেবে কল্পনা করে নিয়েছি, তার ব্যাস তথা এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত দূরত্ব প্রায় ৮০ হাজার আলোক বর্ষ এবং তার পুরুত্ব প্রায় ৬ হাজার আলোক বর্ষ। কেউ যদি দিন রাত চব্বিশ ঘণ্টা কোনোপ্রকার বিরতি না দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে ৩ লক্ষ কিলোমিটার বেগে চলে, তাহলে এই গ্যালাক্সিকে মাত্র একটি চক্কর দিতেই ৮০ হাজার বছর লেগে যাবে।
গ্যালাক্সির চারিদিকে গোলক আকৃতির বিস্তৃত একটি আবরণ আছে। আবরণটিকে বলে হালো (Halo)। নক্ষত্র দিয়ে গঠিত আবরণটির ব্যাস প্রায় এক লক্ষ আলোক বর্ষ। গ্যালাক্সির মূল ডিস্কের মধ্যে নক্ষত্রের পরিমাণ বেশি। অন্যদিকে বাইরের গোলকীয় আবরণে নক্ষত্রের পরিমাণ কম। যদিও বাইরের আবরণটির বিস্তৃতি মূল ডিস্কের চেয়ে অনেক অনেক বেশি, কিন্তু তারপরেও সেখানে নক্ষত্রের ঘনত্ব কম।
১৭৫০ সালে টমাস রাইট নামে একজন ইংরেজ কারিগর (Instrument-maker) তার একটি বইয়ে বলেছিলেন- আমাদের গ্যালাক্সি অনেক অনেক তারার সমন্বয়ে গঠিত এবং সেসব তারা একত্রে একটি সমতল তলে অবস্থান করছে। তার লেখা বইটির নাম ছিল Original theory or new hypothesis of the universe।
কেউ চাইলে একটি সাধারণ টেলিস্কোপ দিয়েই অনেকগুলো উজ্জ্বল ও ক্ষীণ নক্ষত্র দেখতে পাবে। ১৭৮১ সালের শুরুর দিকের কথা, চার্লস মেসিয়ের[2] (১৭৩০ – ১৮১৭) নামে একজন ফরাসী জ্যোতির্বিদ ও ধূমকেতু পর্যবেক্ষক ছিলেন। তিনি এ ধরনের ১০৩টি নাক্ষত্রিক বস্তুর তালিকা করেন, যেন অন্যান্য ধূমকেতু পর্যবেক্ষকরা এদেরকে ধূমকেতু বলে ভুল না করেন। ধূমকেতু যখন সূর্যের কাছাকাছি থাকে, তখন তার লম্বা লেজ বা পুচ্ছ দৃশ্যমান থাকে। ফলে তাদেরকে চেনা যায় সহজে। সূর্য থেকে দূরে অবস্থান করলে লেজ বিলুপ্ত হয়ে যায়। ফলে কোনো কোনো পর্যবেক্ষক তাদেরকে ভুলভাবে নক্ষত্র বলে ধরে নেন।
এমনকি বর্তমানকালের জ্যোতির্বিদরাও সেই আড়াই শত বছর আগের তালিকা মেনে চলেন। নক্ষত্রের আধুনিক নামকরণে কোনো কোনো নক্ষত্রের নামের শুরু হয় M দিয়ে। M এর পর একটি সংখ্যা থাকে। M দিয়ে জ্যোতির্বিদ মেসিয়ের-এর তালিকা নির্দেশ করা হচ্ছে, আর নম্বরটি এসেছে ঐ তালিকায় উল্লিখিত ক্রম থেকে। যেমন- ক্র্যাব নেব্যুলা, এটি একটি বিস্ফোরিত নক্ষত্রের ধ্বংসাবশেষ, একে ডাকা হয় M1 বলে। কারণ মেসিয়েরের মূল তালিকায় প্রথমেই এর উল্লেখ আছে।
চার্লস মেসিয়েরের তৈরি করা ঐ তালিকাটির নাম ছিল নেব্যুলি (Nebulae)। এটিকে পরবর্তীতে অনুসরণ ও উন্নয়ন করেন জার্মান বংশোদ্ভূত ইংরেজ জ্যোতির্বিদ উইলিয়াম হার্শেল (১৭৩৮ – ১৮২২) ও তার সন্তান জন হার্শেল (১৭৯২ – ১৮৭১)। উইলিয়াম হার্শেল মূলত একজন সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন। ১৭৮১ সালে সৌরজগতের সপ্তম গ্রহ ইউরেনাস তিনিই আবিস্কার করেন। এই সময়কালে জ্যোতির্বিজ্ঞানের অনেক গুরুত্বপূর্ণ উন্নতি সাধিত হয়েছে তার হাত ধরেই। প্রায় দুই হাজার নতুন নেব্যুলির একটি তালিকা তৈরি করেছিলেন তিনি। সন্তান জন হার্শেল তার বাবার কাজকে এগিয়ে নিয়ে যান। ১৮৬৪ সালে তিনি ‘দ্য জেনারেল ক্যাটালগ অব নেব্যুলি’ নামে একটি তালিকা তৈরি করেন, যেখানে প্রায় ৫ হাজার ৭৯টি অনুজ্জ্বল নাক্ষত্রিক বস্তুর উল্লেখ ছিল।
পরবর্তীতে জন লুই ড্রেয়ার নামে (১৮৫২ – ১৯২৬) একজন ড্যানিশ জ্যোতির্বিদ জন হার্শেলের তালিকাকে আরো এগিয়ে নিয়ে যান। তার উন্নয়নকৃত তালিকাটি ১৮৮৮ সালে ‘ক্যাটালগ অব নেব্যুলি অ্যান্ড ক্লাস্টার্স অব স্টার্স’ নামে প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে ১৮৯৫ ও ১৯০৮ সালে এর বর্ধিত রূপও প্রকাশ করেন। তালিকাটিতে প্রায় ১৫ হাজার নেব্যুলি[3] ও নক্ষত্রপুঞ্জের বিবরণ লিপিবদ্ধ ছিল। তালিকাটি এতটাই চমৎকার ছিল যে, ১৯৫০ এর দশক পর্যন্তও জ্যোতির্বিদেরা এই তালিকাটিকে আদর্শ (Standard) হিসেবে ব্যবহার করতেন।
এই তালিকাটি জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের জন্য আসলেই অনন্য এক অর্জন ছিল। কারণ তালিকার সবগুলো নাক্ষত্রিক বস্তুর পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল শুধুমাত্র টেলিস্কোপের মাধ্যমে। বিশেষ কোনো প্রযুক্তি তখন ছিল না। কোনো প্রকার ফটোগ্রাফিক ইকুইপমেন্টের সাহায্য ছাড়াই তারা করেছিলেন এই কাজ।
মেসিয়েরের তালিকায় উল্লিখিত বস্তুগুলোর অধিকাংশই মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে অবস্থিত। তার তালিকায় অনেকগুলো তারকাপুঞ্জ বা নক্ষত্র স্তবকের উল্লেখ আছে। নক্ষত্র স্তবক বা Star cluster বলতে এখানে একগুচ্ছ নক্ষত্রের সমন্বিত অবস্থাকে বোঝানো হচ্ছে, যারা একত্রে মিলে আকাশপটে অনেকটা ‘উজ্জ্বল মেঘ’ তৈরি করে। দু’ধরনের নক্ষত্র স্তবক আছে। প্রথম প্রকার হলো বিচ্ছিন্ন স্তবক বা Open cluster। এ ধরনের স্তবকে কয়েকশত নক্ষত্র পরস্পর হালকাভাবে যুক্ত থেকে গ্রুপ তৈরি করে। উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করা যায় ওপেন ক্লাস্টার M67 এর কথা (মেসিয়েরের তালিকার ৬৭ তম বস্তু)। এটি আকাশপটের কর্কট (Cancer) নক্ষত্রমণ্ডলীতে অবস্থিত।
দ্বিতীয় প্রকার স্তবক হলো গোলকীয় স্তবক বা Globular cluster। এ ধরনের স্তবকে প্রায় লক্ষ পরিমাণ নক্ষত্র জোরালোভাবে যুক্ত হয়ে গ্রুপ তৈরি করে। এদের আকৃতি গোলকের মতো হয়। উদাহরণ হিসেবে গ্লবিউলার ক্লাস্টার M5 এর কথা বলা যায়। এটি আকাশপটের সর্প (Serpens) নক্ষত্রমণ্ডলীতে অবস্থিত।
ওপেন ক্লাস্টার ও গ্লবিউলার ক্লাস্টারের যে দুটি উদাহরণ দেয়া হয়েছে, এগুলোকে যথাক্রমে NGC2682 ও NGC5904 নামেও ডাকা হয়। সংখ্যার আগে NGC উপসর্গটি এসেছে জ্যোতির্বিদ ড্রেয়ার কর্তৃক তৈরিকৃত তালিকা New General Catalogue থেকে। নক্ষত্র স্তবকের পাশাপাশি বেশ কিছু নেব্যুলা বা নীহারিকার উল্লেখও আছে, যারা সত্যিকার অর্থেই নীহারিকা। এরা আসলেই নক্ষত্রের প্রাথমিক পর্যায়ের ধূলি ও গ্যাসের মেঘ।
আমাদের গ্যালাক্সির কোনো কোনো এলাকায় গ্যাস ও ধূলির মেঘের অস্তিত্ব আছে, যেখানে নবীন নক্ষত্র বিদ্যমান। নক্ষত্র সেখানে জন্মলাভ করছে, কিন্তু জন্মের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া এখনো পুরোপুরি সম্পন্ন হয়নি। কিছু ধূলিমেঘ আছে যেখানে নক্ষত্রের গঠন প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে। এর একটি উদাহরণ কালপুরুষ নীহারিকা (Orion nebula)। একে M42 কিংবা NGC1976 নামেও ডাকা হয়। এই নীহারিকাটি পৃথিবী থেকে খালি চোখেই দেখা যায়। এর অবস্থান কালপুরুষ মণ্ডলীর তলোয়ারের স্থানে। আকাশপটের কতগুলো নক্ষত্র নিয়ে একটি গ্রুপ বা মণ্ডলী কল্পনা করা হয়। সম্মিলিত অবস্থায় এদের বাহ্যিক রূপ অনেকটা তলোয়ারধারী যোদ্ধার মতো। কাল্পনিক যোদ্ধার হাতে ধরা তলোয়ারের অংশে অবস্থান করছে এই নীহারিকটি।
আমাদের গ্যালাক্সি আকৃতির দিক থেকে সর্পিলাকার। সর্পিলাকার সামগ্রিক বস্তুটি তার নিজের তলের কেন্দ্রকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। গ্যালাক্সির কেন্দ্রকে (Center) বলা হয় নিউক্লিয়াস। পুরো গ্যালাক্সির মাঝে এই অংশটিতে বস্তুর ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি। ডিস্কের তুলনায় এই অংশটি একটু স্ফীত। গ্যালাক্সির মধ্যবর্তী বস্তু তথা নিউক্লিয়াসের আশেপাশের বস্তুগুলো দৃঢ় বা অনমনীয় বস্তুর মতো ঘুরে। এদের ঘূর্ণন গতি অনেক বেশি। অন্যদিকে কেন্দ্র বা নিউক্লিয়াস থেকে দূরের বস্তুগুলো দৃঢ় বস্তুর মতো নয়। তারা হালকাভাবে পরস্পরের সাথে যুক্ত। এদের ঘূর্ণন গতিও কেন্দ্রের দিকের বস্তুগুলোর তুলনায় বেশ কম। এই বাইরের দিকের অংশেই সূর্য সহ অন্যান্য পর্যবেক্ষণযোগ্য নক্ষত্রের অবস্থান। আকাশপটের অধিকাংশ পর্যবেক্ষণযোগ্য নক্ষত্রই আছে এই অংশে।[4]
নিউক্লিয়াসের চারিদিকে কৌণিক ঘূর্ণনের দৌড়ে কেন্দ্রভাগের বস্তুগুলোর তুলনায় বাইরের বস্তুগুলো পিছিয়ে পড়ে। অনেকটা আমাদের সৌরজগতের গ্রহগুলোর মতো। সূর্য থেকে গ্রহের দূরত্ব যত বাড়ে, তাদের কৌণিক ঘূর্ণনের বেগ তত কমে। সূর্যের সবচেয়ে কাছের গ্রহ বুধ, এটি সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করে ৮৮ দিনে। অন্যদিকে সবচেয়ে দূরের গ্রহ নেপচুন[1] প্রদক্ষিণ করে ৬০ হাজার ১৯০ দিনে।
সূর্যও মিল্কিওয়ের কেন্দ্রভাগকে কেন্দ্র করে ঘোরে। সূর্যের ঘূর্ণন গতিবেগ সেকেন্ডে ২৫০ কিলোমিটার। এই বেগে কেন্দ্রের চারদিকে একবার ঘূর্ণন সম্পন্ন করতে সূর্যের ২০০ মিলিয়ন বছর সময় লাগে।
গ্যালাক্সির কেন্দ্রভাগটি বিভিন্ন মহাজাগতিক বস্তু দ্বারা আবৃত হয়ে আছে, ফলে এটিকে অস্পষ্ট দেখায়। এই কারণে দৃশ্যমান আলোর মাধ্যমে অর্থাৎ সরাসরিভাবে একে পর্যবেক্ষণ করা যায় না। কেন্দ্রভাগের গঠন সম্পর্কে অধিকাংশ তথ্যই এসেছে রেডিও তরঙ্গ ব্যবহারের মাধ্যমে। রেডিও তরঙ্গ ব্যবহার করে কেন্দ্রভাগের ছবি তোলা হয় এবং সেই ছবির মাধ্যমে কেন্দ্রভাগ সম্পর্কে পরোক্ষভাবে জানতে পারে মানুষ।
গ্যালাক্সির অধিকাংশ পদার্থই নক্ষত্র হিসেবে বিদ্যমান। অর্থাৎ গ্যালাক্সির সকল বস্তুর মাঝে পরিমাণের দিক থেকে নক্ষত্রই সর্বাধিক। এসব নক্ষত্রের আবার বেশ কিছু প্রকারভেদ আছে। কোনো কোনোটি সাধারণ নক্ষত্র, কোনো কোনোটি নীহারিকা, কোনো কোনোটি নবতারা (Nova)। গ্যালাক্সিতে মোট নক্ষত্রের পরিমাণ প্রায় একশত বিলিয়ন, যা আগেও উল্লেখ করা হয়েছিল। নক্ষত্রের পাশাপাশি আরো কিছু আন্তঃনাক্ষত্রিক পদার্থ আছে , যারা গ্যাস মেঘ হিসেবে বিদ্যমান। এদেরও আবার প্রকারভেদ আছে।
আন্তঃনাক্ষত্রিক পদার্থগুলোতে অনেক আগ্রহোদ্দীপক জৈব ও অজৈব যৌগের অস্তিত্ব আছে। এসব আন্তঃনাক্ষত্রিক বস্তু সম্পর্কে এখনো অনেক গবেষণা বাকি আছে, প্রচুর গবেষণা হচ্ছেও। তার উপর সমগ্র গ্যালাক্সি জুড়ে একটি চুম্বক ক্ষেত্রের উপস্থিতিও আছে। গ্যালাক্সির নিখুঁত গঠন ও বিবরণ এখনো জানা সম্ভব হয়নি। বেশ কিছু জটিলতা ও অমীমাংসিত রহস্য এখনো বিদ্যমান। বিজ্ঞানীরা কাজ করে যাচ্ছেন, একসময় এসব রহস্য ও জিজ্ঞাসার উত্তর আসবে।
অনুবাদকের নোট
[1] প্লুটো বর্তমানে গ্রহ নয়। গ্রহের সংজ্ঞা নিয়ে দোটানা সৃষ্টি হওয়াতে ২০০৬ সালে বিজ্ঞানীদের নিয়ে এক সম্মেলনের আয়োজন করে ‘ইন্টারন্যাশনাল এস্ট্রোনোমিক্যাল ইউনিয়ন। সেখানে তারা প্লুটোকে গ্রহের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে ‘বামন গ্রহের’ তালিকাভুক্ত করার ব্যাপারে ঐক্যমতে পৌঁছান। উল্লেখ্য, জামাল নজরুল ইসলামের বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৩ সালে।
[2] Charles Messier: ফরাসিতে এর উচ্চারণ দাঁড়ায় শাখল মেসিয়েঁ। তবে আন্তর্জাতিকভাবে চার্লস মেসিয়েরও প্রচলিত।
[3] বিপুল বিস্তৃত ধূলিমেঘ ঘনীভূত হয়ে নক্ষত্র তৈরি হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নক্ষত্রের এই গঠনরত অবস্থা পৃথিবী থেকে উজ্জ্বলরূপে দৃশ্যমান হয়। এ ধরনের প্রাথমিক নক্ষত্রকে বলা হয় নেব্যুলা বা নেব্যুলি বা নীহারিকা। শব্দগত দিক থেকে নেব্যুলার বহুবচন নেব্যুলি, তবে এরা উভয়ে একই অর্থ বহন করে।
[4] কিছু কিছু নক্ষত্র দৃশ্যমান আলোর সাহায্যেই দেখা যায়। আবার কিছু কিছু নক্ষত্রকে দেখার জন্য ইনফ্রারেড (অবলোহিত) বা রেডিও তরঙ্গ ব্যবহার করা হয়। এই তরঙ্গগুলো আবার মানুষ খালি চোখে দেখে না। বিশেষ ফটোগ্রাফিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে ছবি তোলার পর সেই ছবি মানুষ দেখতে পায়, পরোক্ষ উপায়ে দেখা যাকে বলে। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উপায়ে যে যে নক্ষত্র মানুষ দেখতে পায়, তাদেরকে বলে পর্যবেক্ষণযোগ্য নক্ষত্র বা Observable stars।
মহাকাশের কথা বাদ দিলে পৃথিবীতে বাস্তব ক্ষেত্রেও মানুষ পরোক্ষভাবে অনেক কিছু দেখে, যেমন- এক্স-রে। এক্সরে তরঙ্গ মানুষ দেখতে পায় না, কিন্তু এক্সরে থেকে তোলা ছবি ঠিকই দেখতে পায়।
বি: দ্র: বইয়ের মূল টেক্সট এবং এখানে প্রকাশিত টেক্সটের মাঝে সামান্য পার্থক্য আছে। কিছু বিষয় ওয়েবসাইটের জন্য অপ্রয়োজনীয় বলে দেওয়া হয়নি এখানে। বইটি যখন সম্পূর্ণভাবে কাগজে ছাপা হয়ে প্রকাশিত হবে, তখন টেক্সট মূল বইয়ের মতোই থাকবে। বিজ্ঞানের বিষয়গুলো পাঠকের বোঝার সুবিধার জন্য এখানে কোনো কোনো অংশে অনুবাদক কর্তৃক ক্ষুদ্র ব্যাখ্যা সংযোজিত হয়েছে। এখানে ব্যবহৃত কোনো ছবিই মূল বইতে ছিল না, পাঠকের অনুধাবনের সুবিধার জন্য অনুবাদক কর্তৃক সংযোজিত হয়েছে। তবে কোনোভাবেই মূল লেখকের বক্তব্যের ভাব ক্ষুণ্ন করা হয়নি। প্রকাশিত বইতে অনুবাদকের সংযোজিত ব্যাখ্যা আলাদা করে নির্দেশিত থাকবে।