বাংলাদেশটি আয়তনে ছোট। তবে ছোট হলেও বিভিন্ন সময়ে জন্ম নেওয়া শিল্প, সাহিত্য কিংবা বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় পাণ্ডিত্যের পরিচয় দেওয়া অনন্য প্রতিভার সংখ্যা অনেক। সত্যেন্দ্র নাথ বসু, জগদীশচন্দ্র বসু কিংবা আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের মতো ব্যক্তিরা সে কালে যেমন বিজ্ঞানচর্চায় অবদান রেখেছিলেন, তেমনই আজকের দিনেও বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় নিজ নিজ প্রতিভা ও বৈদগ্ধ্যের মাধ্যমে অবদান রাখছেন অনেকে। তেমনই একজন ব্যক্তি হলেন নারায়ন চন্দ্র পাল।
তিনি একজন স্বনামধন্য বাঙালি কৃষিবিজ্ঞানী ও জৈব-প্রযুক্তিবিদ। ১৯৭৬ সালের ২০ ডিসেম্বর কুমিল্লা জেলার বরকামতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সেখানে নিবিড় প্রকৃতির সান্নিধ্যে বেড়ে উঠেছেন তিনি। তার ছোটবেলা কেটেছে একই গ্রামে থাকা তার মামাবাড়িতে। সেখানে তার দুই মামাও নিজেদের শিক্ষাজীবনে তৎকালীন সময়ের প্রেক্ষাপটে অনবদ্য মেধার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। মামাদের উৎসাহ আর অনুপ্রেরণা তাকে পরবর্তী জীবনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল। তিনি বলেন-
মামাবাড়িতে আমি খুব অসাধারণ একটি পড়ালেখার পরিবেশ পেয়েছিলাম। ছোটবেলায় দেখতাম লেখাপড়ায় খুব ভালো ফল করবার জন্য আমার মামারা প্রশংসিত হতেন সর্বত্র। এই বিষয়টি নিয়ে আমি গর্ববোধ করতাম। পাশাপাশি তাদের এই সাফল্য আমাকেও ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করতো সামনের দিকে এগিয়ে যেতে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর মামাবাড়ির বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাই শুধু নয়, অনন্য দেশপ্রেমের শিক্ষাও তিনি পেয়েছিলেন বরকামতা গ্রাম থেকে। খাদির গৌরবময় ঐতিহ্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল বরকামতা গ্রামের নাম। কুমিল্লার বরকামতার খাদি কাপড় ছিল বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। যদিও আজকের ‘খাদি’ নামে পরিচিত তাঁত শিল্পে তৈরী এসব কাপড়ের তৎকালীন কোনো নাম ছিল না।
১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধীর হাতে তাঁতে তৈরি খদ্দর কাপড় তুলে দিলে তিনি এর নতুন নামকরণ করেন। গর্তে (খাদে) বসে এই কাপড় তৈরি করা হয় বলে এর নামকরণ করে দিয়েছিলেন খদ্দর। সেই থেকে এই শিল্পের উৎপাদিত কাপড় বিশ্বব্যপী খুব দ্রুত প্রসার পায়। এবং খদ্দর থেকে খাদি নামে পরিচয় লাভ করে।
মহাত্মা গান্ধীর অনুপ্রেরণায় স্বদেশপ্রেমের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার বাসিন্দা শৈলেন্দ্র নাথ গুহ বরকামতায় এসে গড়ে তুলেছিলেন ‘গ্রামীণ খাদি’ কারখানা। এর মধ্য দিয়ে স্বদেশী আন্দোলন আর স্বদেশপ্রেমের একজন নায়ক হিসেবে তিনি ধীরে ধীরে প্রসিদ্ধ হয়ে উঠেন ভারতীয় উপমহাদেশে। নারায়ণ চন্দ্র পাল ছোটবেলা থেকেই কাছে পেয়েছেন এই মানুষটিকে। উনার কাছ থেকে পাওয়া স্বদেশপ্রেমের দীক্ষা আজও মাতৃভূমির প্রতি তার আত্মিক বন্ধনকে প্রগাঢ় মমতায় আচ্ছন্ন করে রেখেছে।
বরকামতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করে তিনি মতিঝিল মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৯২ সালে তিনি এখান থেকে মাধ্যমিক ও সরকারি বিজ্ঞান কলেজ থেকে ১৯৯৪ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক-দুই পরীক্ষাতেই তিনি প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।
এরপর ভর্তি হন শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিবিজ্ঞান বিভাগে। এখান থেকে প্রথম শ্রেণি প্রাপ্ত হয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেন। কৃষিবিজ্ঞান নিয়ে স্নাতক পড়ার সময়ই অণুজীব এবং আণবিক জীববিজ্ঞান সম্বন্ধে তার আগ্রহ জাগে। কিন্তু সে সময় আণবিক জীববিজ্ঞান নিয়ে বাংলাদেশে গবেষণা সুযোগ ছিল অপ্রতুল। তাই পরিস্থিতি মেনে নিয়ে ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিবেশবিজ্ঞানের উপর এমএস কোর্সে ভর্তি হন। এখানে এমএস ডিগ্রির সময় তার রচিত অভিসন্দর্ভের শিরোনাম ছিল “Trace Metal Contamination in the Water Environment of Dhaka Metropolitan City”।
জীববিজ্ঞানের প্রেক্ষিতে ট্রেস মেটাল হলো সেসব ধাতু যেগুলো উদ্ভিদকোষ কিংবা প্রাণীকোষে খুব অল্প পরিমাণে উপস্থিত থাকে কিন্তু কোষগত বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই অভিসন্দর্ভটিতে তিনি মূলত ঢাকার জলজ পরিবেশে এই ট্রেস মেটালজনিত দূষণের স্বরূপ নিরূপণের চেষ্টা করেছিলেন।
এই অভিসন্দর্ভের উপর ভিত্তি করে ঢাকার জলজ পরিবেশ দূষণের উপর তিনি একটি বই লিখেন। বইটি ২০১১ সালে জার্মানির ল্যাম্বার্ট একাডেমিক পাবলিশিং নামের প্রখ্যাত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত হয়।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএস সম্পন্ন করার পর তিনি অণুজীব নিয়ে গবেষণায় মনোনিবেশ করবেন বলে স্থির করেন। এজন্য তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার চুংনাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্ল্যান্ট প্যাথলজি অ্যান্ড প্ল্যান্ট সেল টেকনোলোজি বিভাগ থেকে তার দ্বিতীয় এমএস ডিগ্রিটি লাভ করেন। এ সময় তার গবেষণার বিষয় ছিল ‘Diversity of Endophytic fungi of Medicinal Plants in Korea and Their Antifungal and Plant Growth Promoting Activity’।
এন্ডোফাইট ছত্রাক হলো সে সকল ছত্রাক যেগুলো তাদের জীবনচক্রের কোনো না কোনো পর্যায়ে নিজেদের শারীরবৃত্তিক প্রয়োজনে উদ্ভিদের অভ্যন্তরে বসবাস করে। সাধারণত এন্ডোফাইট ছত্রাক উদ্ভিদে কোনোপ্রকার রোগ তৈরি করে না। বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে অন্যান্য ক্ষতিকর ছত্রাক থেকে উদ্ভিদকে রক্ষা করে। উদ্ভিদের বৃদ্ধি বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় জৈবনিক প্রক্রিয়াতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এরা।
এই গবেষণায় তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার বিভিন্ন ওষুধি উদ্ভিদ নিয়ে কাজ করেন। সেসব উদ্ভিদে থাকা ছত্রাকের বৈচিত্র্য পর্যবেক্ষণ করেন এবং ক্ষতিকর ছত্রাক থেকে উদ্ভিদকে রক্ষা করতে এন্ডোফাইট ছত্রাকের ভূমিকা বিশ্লেষণ করেন। দক্ষিণ কোরিয়ার ওষুধি উদ্ভিদের উপর করা তার এই গবেষণার উপরে ভিত্তি করে একটি বই প্রকাশিত হয়। এটিও প্রকাশিত হয় ল্যাম্বার্ট পাবলিশিং গ্রুপ থেকে। এতে তার সহলেখক হিসেবে ছিলেন খ্যাতনামা উদ্ভিদ রোগতত্ত্ববিদ অধ্যাপক সং হুন ইয়ু (Professor Seung Hun Yu)।
একই বিভাগ থেকে তিনি ২০১২ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। এ সময় তিনি মরিচের (Chili Pepper) এন্ডোফাইট নিয়ে গবেষণা করেন। পিএইচডি লাভ করার পর তিনি গবেষক হিসেবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কৃতিত্বের সাথে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার গ্রাম উন্নয়ন প্রশাসনিক পরিষদ (Rural Development Administration)-এর অধীনে বায়ো এনার্জি ক্রপ রিসার্চ ডিভিশনে গবেষক হিসেবে কর্মরত আছেন।
তিনি যে গবেষণা দলের সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন সেই দলটি অণুজীব, বিশেষত ছত্রাক সম্পর্কিত গবেষণায় অনন্য সাফল্য দেখিয়েছে। অল্টারনেরিয়া গণের ছত্রাক বিভিন্ন উদ্ভিদে রোগ সৃষ্টি করে থাকে। তাই কৃষিখাতে প্রতি বছর বড় ধরনের ক্ষতি হয় এদের কারণে। এদের শিকারের মাঝে বাঁধাকপি একটি। বাঁধাকপিতে রোগ সৃষ্টিকারী এই গণের সম্পূর্ণ নতুন একটি ছত্রাক প্রজাতি আবিষ্কার করেছেন তারা। প্রজাতির নাম Alternaria brassicifolii।
এটি ছাড়াও এই দলটি বিভিন্ন সময় আরো চারটি নতুন ছত্রাক প্রজাতি আবিষ্কার করেছে। সেগুলো হলো-
1. ২০১৩ সালে আঙ্গুর থেকে Penicillium daejeonium
2. ২০১৪ সালে বেলুন ফুল থেকে Stemphylium platycodontis
3. ২০১৪ সালে কোরিয়ান হগ ফেনেল থেকে Alternaria peucedani
4. ২০১৫ সালে আরালিয়েসি বীরুৎ থেকে Alternaria dendropanacis
কোনো রোগ সৃষ্টিকারী অণুজীব থেকে যদি উদ্ভিদকে বাঁচাতে হয় তাহলে সবার আগে সেই অণুজীবের পরিচয় ভালোভাবে জানা দরকার। এই পরিচয় নিরূপণের ক্ষেত্রে একটি বড় সহায়ক হচ্ছে তার জিনগত তথ্য। শুধু অণুজীব নয় বিজ্ঞানীদের গবেষণায় পাওয়া এখন পর্যন্ত যেসব প্রাণের জিনগত তথ্য আমরা জানোতে পেরেছি তা সংরক্ষিত থাকে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশন (এনসিবিআই) এর তথ্যভাণ্ডারে। এই তথ্যভাণ্ডার সকলের জন্য উন্মুক্ত। নারায়ন চন্দ্র পালদের আবিষ্কৃত ছত্রাক প্রজাতিগুলোর বিভিন্ন জিনের তথ্য এখন এনসিবিআই এর তথ্যভাণ্ডারে উন্মুক্ত।
তার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কৃতিত্ব হলো ব্লু মোল্ড, রাইজোপাস সফট রট সহ মিষ্টি আলুর এমন কিছু রোগকে সারা বিশ্বের সামনে তুলে ধরা, যেগুলোর অস্তিত্ব সম্বন্ধে কোরিয়াতে বিজ্ঞানীরা একদমই জানতেন না। মিষ্টি আলু কোরিয়ার অন্যতম জনপ্রিয় খাদ্য হওয়ায় কৃষি ও অর্থনৈতিক দিক থেকে এর গুরুত্ব প্রচুর। তাই তার এই আবিষ্কারের মাধ্যমে এই উদ্ভিদটি নিয়ে গবেষণায় একটি নতুন দিক উন্মোচিত হয়। গবেষণাক্ষেত্রে এই অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ক্রপ সায়েন্স’ থেকে ২০১৭ সালে তাকে সেরা বিজ্ঞানীর সম্মাননায় ভূষিত করা হয়।
একজন বাংলাদেশি হিসেবে তার এই অর্জন সারা বিশ্বে বাংলাদেশকে নিয়ে গিয়েছে অনন্য উচ্চতায়। তার সাথে কথা বলে জানা যায়, গবেষণা প্রতিষ্ঠানে থাকা বিভিন্ন প্রকল্পের পাশাপাশি তিনি বর্তমানে ছত্রাকের নতুন কিছু প্রজাতি আবিষ্কারের উপর কাজ করছেন।
উল্লেখযোগ্য কিছু গবেষণাপত্র
1. Paul, Narayan Chandra, et al. “Fungal endophytes in roots of Aralia species and their antifungal activity.” Plant Pathology Journal 23.4 (2007): 287.
2. Paul, Narayan Chandra, et al. “Distribution and antifungal activity of endophytic fungi in different growth stages of chili pepper (Capsicum annuum L.) in Korea.” The Plant Pathology Journal 28.1 (2012): 10-19.
3. Paul, Narayan Chandra, et al. “Endophytic fungi from Lycium chinense Mill and characterization of two new Korean records of Colletotrichum.” International journal of molecular sciences 15.9 (2014): 15272-15286.
4. Paul, Narayan Chandra, et al. “New records of endophytic paecilomyces inflatus and bionectria ochroleuca from Chili Pepper Plants in Korea.” Mycobiology 41.1 (2013): 18-24.
5. Ji, Seung Hyun, et al. “Biocontrol activity of Bacillus amyloliquefaciens CNU114001 against fungal plant diseases.” Mycobiology 41.4 (2013): 234-242.
গবেষণার পাশাপাশি নারায়ণ চন্দ্র পাল ভালবাসেন বিতর্ক আর খেলাধুলা করতে। বিশ্বের বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী স্থানে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন। শেরেবাংলা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি ছিলেন সেখানকার বিতর্ক ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। নিরন্তর গবেষণা করতে থাকা এই মানুষটি স্ত্রী-পুত্র সহ এখন দক্ষিণ কোরিয়ার গুয়াংজু শহরে বাস করছেন। প্রবাসে তার গবেষণা আর ব্যক্তিগত জীবনের পুরো সময়টায় সর্বদা একাগ্রতা আর ভালোবাসা নিয়ে পাশে থাকেন তার সহধর্মিণী।
দেশ থেকে এত দূরে থাকা মানুষটি এখনো দেশকে ভুলেননি। বাংলাদেশের যেকোনো তরুণ গবেষণা করতে চাইলে তিনি সবসময় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। সময় পেলেই তিনি চলে যান কুমিল্লার বরকামতা নামের সেই ছায়া সুনিবিড় সবুজ গ্রামখানিতে যেখানে তিনি তার প্রিয় শৈশব কাটিয়েছিলেন।
বিশেষ কৃতজ্ঞতা: ড. নারায়ণ চন্দ্র পাল ও তার পরিবারের প্রতি