Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

গোল মিসের পর ফুটবলাররা মাথায় হাত দেয় কেন?

ফুটবল মাঠে কত চমকপ্রদ দৃশ্যেরই না অবতারণা ঘটে। সেরকমই একটি সংগ্রহে রাখার মতো, অভূতপূর্ব দৃশ্যের সৃষ্টি হয়েছিল ১৯৯৯ সালে, প্রিমিয়ার লিগের লিভারপুল বনাম ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ম্যাচে। এবং সেই দৃশ্যটি ক্যামেরাবন্দি করে রাতারাতি তারকাখ্যাতি পেয়ে গিয়েছিলেন আলোকচিত্রশিল্পী ফিল নোবেল। ছবিটি নির্বাচিত হয়েছিল প্রিমিয়ার লিগের দশকসেরা আলোকচিত্র হিসেবে।

ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে, মাইকেল ওয়েনসের গোলে নেয়া একটি শট ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ইটালিয়ান গোলরক্ষক মাসিমো তাইবি ঠেকিয়ে দিলে, মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়েছেন ওয়েনস। ফ্রেমের ভিতর থাকা তার দুই সতীর্থ খেলোয়াড়েরও হতাশায় মাথায় হাত। এবং একই দশা পশ্চাৎপটে থাকা অধিকাংশ লিভারপুল ভক্তেরও। সব মিলিয়ে একটি দেখার মতো দৃশ্যই বটে!

প্রিমিয়ার লিগ ইতিহাসের অন্যতম সেরা ছবি এটি; Image Source: Phil Noble/PA Archive/Press Association Images

তবে এই ছবিটিতে না হয় প্রায় সকলেরই মাথায় হাত থাকায় এটি অসাধারণত্ব লাভ করেছে। কিন্তু এমনিতে ফুটবল খেলায় এমন দৃশ্য খুবই সাধারণ। লিওনেল মেসি, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো কিংবা নেইমার জুনিয়রদের গোল করা, এবং তা উদযাপনের ধরনে ভিন্নতা থাকতে পারে। কিন্তু নিশ্চিত গোলের সুযোগ হাতছাড়া করার পর তারা সকলেই হতাশ হন, এবং সেই হতাশার বহিঃপ্রকাশের ধরনও একদম এক: সঙ্গে সঙ্গে মাথায় হাত দেয়া।

কৌতূহলী মনের অধিকারী অনেক দর্শকই হয়তো কোনো না কোনো সময়ে ফুটবল খেলা দেখতে গিয়ে নিজের মনকে প্রশ্ন করেছেন, কেন এমন করে ফুটবলাররা? কিন্তু না, ফুটবলারদের এমন অভিব্যক্তির সাথে ফুটবল খেলার আদতে কোনো সম্পর্কই নেই। পুরো ব্যাপারটিকেই মনস্তাত্ত্বিক হিসেবে দাবি করছেন প্রাণীবিদ্যাবিশারদ, মনোবিদ এবং অন্য বিশেষজ্ঞরা, যারা এ বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করেছেন।

“ফুটবলারদের মাথায় হাত দেয়া থেকে বোঝা যায়, তারা বুঝে গেছে তারা কত বড় ভুলটাই না করে ফেলেছে। তারা অন্যদেরকে তখন বোঝাতে চায়, ‘হ্যাঁ আমি বুঝতে পেরেছি আমি কী করেছি। এজন্য আমি দুঃখিত। তোমাদের আমাকে দল থেকে বের করে দেয়া, কিংবা আমাকে খুন করে ফেলার কোনো প্রয়োজন নেই!'” এমন ব্যাখ্যা দিয়েছেন ইউনিভার্সিটি অভ ব্রিটিশ কলম্বিয়ার মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক, জেসিকা ট্রেসি।

মাথায় হাত দিয়ে হতাশা প্রকাশের মধ্যে নিহিত রয়েছে নিজেকে সান্ত্বনা প্রদানের আকাঙ্ক্ষা; Image Source: AFP/Getty Images

শরীরী ভাষা বিশেষজ্ঞ, স্মার্ট ট্রেনিং ইউকে লিমিটেডের রবার্ট ফিপসের কাছে থাকা ব্যাখ্যাটিও অনেকটা এমনই। “তারা কিছু সময়ের জন্য পারিপার্শ্বিক পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে চায়। তারা নিজেরা কিছু দেখতে চায় না, এবং চায় না অন্য কেউও তাদের দেখুক। তারা তাদের লজ্জা গোপন করতে চায়। অনেক ফুটবলার এমন পরিস্থিতিতে হাত দিয়ে মুখ লুকায়, কিংবা হাঁটু ভেঙে বসেও পড়ে। কারণ হতবুদ্ধিতায় তাদের সকল শক্তি বিমূঢ় হয়ে পড়ে।

তবে এই বিষয়ে আরেক শরীরী ভাষা বিশেষজ্ঞ ও বেস্টসেলিং লেখক অ্যালান পিসের তত্ত্ব কিছুটা ভিন্ন। তিনি বলেন, “একজন মা-ও কিন্তু তার ছোট শিশুর মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। এর মাধ্যমে তিনি শিশুকে সান্ত্বনা দিতে চান, এবং নিশ্চিত করতে চান যে সবকিছু ঠিক আছে। একজন ফুটবলারও ঠিক এই কাজটিই করে। ব্যতিক্রম শুধু এটুকুই যে, এখানে সে নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে স্বাভাবিক করতে চাইছে।

তবে মাথায় হাত দিয়ে হতাশা প্রকাশের বিষয়টি কিন্তু কেবল গোলের সুযোগ হাতছাড়া করা শুটারদের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। একইভাবে হতাশা প্রকাশ করে থাকে তার সতীর্থরাও। এক্ষেত্রে আমরা স্মরণ করতে পারি ফুটবল ইতিহাসের আরেকটি স্মরণীয় দৃশ্যের, যেটির অবতারণা ঘটেছিল ২০১০ ফুটবল বিশ্বকাপে। সেবার দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে ম্যাচে নাইজেরিয়ার ফুটবলার ইয়াকুবু আইয়েগবেনি যে মিসটি করেছিলেন, সেটি অনেকের মতেই ‘পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক মিস অভ দ্য সেঞ্চুরি’

কী করেছিলেন ইয়াকুবু? তিনি অরক্ষিত গোলপোস্ট পেয়েও মাত্র কয়েক হাত দূরত্ব থেকে বল জালে জড়াতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। এরপর কয়েক মুহূর্ত তিনি নড়াচড়ার ক্ষমতাই যেন হারিয়ে ফেলেছিলেন। অধিক শোকে পাথর হওয়া যাকে বলে আর কী! কিন্তু তার সতীর্থ, কোচ ও ডাগ-আউটে বসে থাকা সকলেই একই ছন্দে মাথায় হাত দিয়েছিল। অ্যালান পিসের মতে, এক্ষেত্রেও সকলে নিজ নিজ মাথায় হাত দিয়ে নিজেদেরকে সান্ত্বনা দিতে চাইছিল।

এই সুযোগও কাজে লাগাতে পারেননি ইয়াকুবু! Image Source: Getty Images

মজার ব্যাপার হলো, ফুটবলারদের হতাশা প্রকাশের ভঙ্গি নিয়ে আগ্রহ হাল আমলের কোনো ব্যাপার নয়। সেই ১৯৮১ সালেই প্রাণীবিদ্যাবিশারদ ডেসমন্ড মরিস খেলাধুলার উপর ‘দ্য সকার ট্রাইব’ নামক একটি গবেষণা গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, যেখানে তিনি হারের পরে ১২ জন খেলোয়াড়ের প্রতিক্রিয়ার ক্যাটালগ অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। সেখানে তিনিও বিষয়টিকে ‘আত্ম-সান্ত্বনা’ বলে অভিহিত করেছিলেন।

তার মতে, “এটি নিজের সাথে একধরনের স্বয়ংক্রিয় যোগাযোগ। এবং এটি নিজের সাথে যোগাযোগের একটি বহুল প্রচলিত মাধ্যম। হতাশাগ্রস্ত অবস্থায় প্রতিটি ব্যক্তিবিশেষই কারো নিশ্চয়তাপূর্ণ স্পর্শ কামনা করে। কিন্তু যেহেতু খেলা চলাকালীন একজন খেলোয়াড়ের আশেপাশে অন্য কেউ থাকে না, তাই সে নিজেই নিজের চাহিদা পূরণ করে।

২০০৮ সালে সহকর্মী ডেভিড মাতসুমোটোকে সাথে নিয়ে একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেন জেসিকা ট্রেসি। সেখানে তিনি খেলোয়াড়দের মাথায় হাত দিয়ে হতাশা প্রকাশকে ‘লজ্জার প্রতীক’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। এবং কীসের এই লজ্জা, তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন স্বয়ং একজন সাবেক পেশাদার ফুটবলার। তিনি কোবি জোনস, যুক্তরাষ্ট্র পুরুষ ফুটবল দলের সাথে লম্বা একটি আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শেষে বর্তমানে টিভি বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করছেন।

তার ভাষ্যমতে, সহজ কোনো গোল মিস করলে একইসাথে মনের মধ্যে অবিশ্বাস ও বিব্রতবোধ খেলা করতে থাকে। “বলটাকে জালে জড়াব বলেই তো আমরা দিনের পর দিন প্রশিক্ষণ নিতে থাকি, নিজেদেরকে প্রস্তুত করি। অথচ মূল খেলায় অনেক সময় খুব সহজ একটা মিস করে ফেলি, যেটি আমাদের কখনোই করা উচিৎ নয়।

কিন্তু সব সময়ই কি গোল মিস করার দায় পুরোপুরি নিজের উপর বর্তায়? অনেক সময় কিন্তু গোলরক্ষকের তুখোড় সেভেও একটি নিশ্চিত গোল হাতছাড়া হতে পারে। কিন্তু তখনও খেলোয়াড়দের প্রতিক্রিয়া সেই একই থাকে। এমনই একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছিল ২০০৬ বিশ্বকাপের ফাইনালে।

বুফনের অতিমানবীয় সেভ; Image Source: The New York Times

ফ্রান্স বনাম ইতালির খেলা চলছে। নির্ধারিত সময়ের খেলা অমীমাংসিতভাবে শেষ হওয়ায় খেলা গড়িয়েছে অতিরিক্ত সময়ে। এবং সেই অতিরিক্ত সময়ের খেলাও প্রায় শেষের পথে। ফরাসি তারকা জিনেদিন জিদানের মাথা থেকে এলো দুর্দান্ত একটি হেডার, যেটি নির্ধারণ করে দিতে পারে গোটা টুর্নামেন্টের ভাগ্য। কিন্তু বিধি বাম! ইতালিয়ান গোলরক্ষক জিয়ানলুইজি বুফন লাফ দিয়ে, আঙ্গুলের ছোঁয়ায় বলটিকে ক্রস বারের উপর দিয়ে ঠেলে পাঠিয়ে দিলেন। তার এই অতিমানবীয় সেভের কল্যাণে জিদানের হাত তখন নিজের টেকো মাথায়।

এর মানে দাঁড়াচ্ছে, শুটার নিজের ভুলেই গোল দিতে ব্যর্থ হোক, কিংবা গোলরক্ষক অসাধারণ কোনো কেরামতি দেখাক, পরবর্তী প্রতিক্রিয়াটি কিন্তু একই থাকছে। ব্রিটিশ ফুটবল ইতিহাসবিদ ডেভিড গোল্ডব্ল্যাটের মতে, “এটি একদম একই পরিসংখ্যানগত বাস্তবতা। আপনার সামনে সুযোগ ছিল। এখন আপনি নিজেই সেটি মিস করুন, কিংবা গোলরক্ষক সেভ করে দিক, যা-ই হোক। হতাশা আপনাকে গ্রাস করবেই, এবং আপনি সেটি প্রকাশও করবেন।

মনোবিজ্ঞানীদের কাছে অবশ্য হতাশায় মাথায় হাত দেয়ার আরো গভীর অর্থ রয়েছে। ইউনিভার্সিটি অভ ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলির মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক ডেচার কেল্টনার যেমনটি বলেন, “মানুষ যখন অপ্রত্যাশিতভাবে হতভম্ব হয়ে যায়, মোটামুটি স্বয়ংক্রিয়ভাবেই তাদের হাত মাথার উপর উঠে যাবে। মানবসভ্যতার বিকাশের গোড়াতেই এর উৎস নিহিত রয়েছে। তারা সর্বদা তটস্থ থাকত মাথায় আঘাত পাওয়ার, তাই কিছু হলেই আগে তারা নিজেদের মাথা বাঁচানোর চেষ্টা করত।

এমন উদযাপনের কারণ আজও ব্যাখ্যাতীত; Image Source: Getty Images

সুতরাং বুঝতেই পারছেন, ফুটবলারদের গোল মিস করার পর মাথায় হাত দেয়ার ব্যাপারটি আপাতদৃষ্টিতে যতটা সহজ মনে হয়, আসলে বিষয়টি ঠিক ততটাই জটিল। কিন্তু তারপরও সান্ত্বনা এই যে, এর পেছনে কিছু ব্যাখ্যা অন্তত পাওয়া গেছে। কিন্তু ফুটবল মাঠে আরো অনেক ব্যাখ্যাতীত ঘটনাও কিন্তু ঘটে। যেমন- গোল করার পর নিশ্চিত হলুদ কার্ড দেখতে হবে জেনেও অনেক খেলোয়াড়ের জার্সি খুলে ফেলা, কিংবা সতীর্থদের আলিঙ্গনকে উপেক্ষা করে অন্যদিকে দৌড়ে যাওয়ার প্রবণতা। কিংবা ক্রিকেটের মাঠে একটি অতি পরিচিত দৃশ্য যেমন উইকেট পাওয়ার পর ইমরান তাহিরের তুমুল বেগে স্প্রিন্ট শুরু করা।

সাধারণভাবে এসবের নেপথ্যের কারণ হিসেবে অ্যাড্রেনালিন রাশ বা আবেগের আতিশয্যকে দায়ী করা হলেও, আসলে যে খেলোয়াড়দের মনোজগতে তখন ঠিক কী ধরনের চিন্তা খেলা করতে থাকে, তা সত্যিই বড় রহস্যময় একটি বিষয়।

বিজ্ঞানের চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কেঃ roar.media/contribute/

This article is in Bengali language. It discusses the psychology behind footballers clapping their hands to their heads immediately after missing a goal-scoring chance. Necessary references have been hyperlinked inside.

Featured Image © Getty Images

Related Articles