শুরুর আগে
বিজ্ঞানের ইতিহাসকে এক অর্থে মানুষের ইতিহাসই বলা যায়। মানব ইতিহাসের মতো বিজ্ঞানের ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতেও দেখা যায়, পুরুষ না হবার কারণে একজন মানুষ তার কাজের প্রাপ্য স্বীকৃতি পায়নি। এটা দুর্ভাগ্যজনক, কিন্তু সত্যি। আর, এই সত্যিগুলো স্বীকার করে নিয়ে সেই মানুষগুলোকে প্রাপ্য কৃতিত্বের যতটুকু সম্ভব, আমাদের দেওয়া উচিত। স্বীকার করে নেওয়া উচিত, একসময় মানুষ তাদের স্বীকৃতি না দিয়ে ভুল করেছিল।
সম্প্রতি এর একটি বড় উদাহরণ হিসেবে আমরা রোজালিন্ড ফ্র্যাংকলিনের ঘটনার কথা শুনে থাকি। ডিএনএ আবিষ্কারের প্রাপ্য স্বীকৃতি থেকে তাকে কীভাবে বঞ্চিত করা হয়েছিল। এরকমই আরেকটি উদাহরণ হলেন লিজে মাইটনার। ফিশন প্রক্রিয়া আবিষ্কারের পেছনে যার অবদান সবচেয়ে বেশি, তার যে নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার কথা, তা কি আর বলতে হয়? অথচ তাকে সেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। এমনকি আজও অনেক মানুষ তার নাম ঠিকভাবে জানেও না! মানব সভ্যতার যুগান্তকারী আবিষ্কারগুলোর একটির মূল নায়ক শুধু ইহুদি নারী হওয়ায় হারিয়ে গেছেন বিস্মৃতির অতলে।
সেই মানুষটিকেই আজ আমরা একটু ভালোভাবে জানতে চেষ্টা করব।
১
৭ নভেম্বর, ১৮৭৮। ভিয়েনা। পরিবারের তৃতীয় সন্তান হিসেবে জন্ম নিল মেয়েটি। লিজে মাইটনার। একে তো মেয়ে, তার উপর জন্মসূত্রে তিনি ইহুদি। তবে কিছুদিনের মধ্যেই তার দুই বোন ক্যাথলিক হয়ে যায়। তিনি নিজেও ধর্মে বদলে হন প্রট্যাস্টেন্ট। কিন্তু পারিবারিক ইহুদি তকমাটি লেগেই ছিল তার নামের পাশে।
অস্ট্রিয়ায় সে সময় সরকারিভাবে কোনো মেয়েকে কলেজে পড়ার যোগ্য বলে বিবেচনা করা হতো না। কিন্তু মাইটনারের পরিবারের প্রাইভেট কোথাও পড়ানোর মতো আর্থিক সঙ্গতি ছিল। নাহয় তার পড়াশোনা থেমে যেত ওখানেই।
১৯০১ সালে সফলভাবে কলেজ শেষ করলেন মাইটনার। স্নাতক সম্পন্ন করতে চলে গেলেন ইউনিভার্সিটি অফ ভিয়েনাতে। প্রকৃতি মাঝে মাঝে কিছু মানুষের ভাগ্য নিজ হাতে খুলে দেয়। নাহয় এত মানুষ থাকতে মাইটনার গিয়ে বোল্টজম্যানের হাতে পড়বেন কেন? শিক্ষক লুডভিগ বোল্টজম্যান তখন বিজ্ঞান জগতের রথী-মহারথীদের একজন। পরমাণু নিয়ে কাজ করলেও বোল্টজম্যানের মূল মনযোগ ছিল স্ট্যাটিসটিক্যাল মেকানিক্স বা পরিসংখ্যানগত বলবিদ্যার দিকে।
তার তার কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে মাইটনারও পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পড়লেন। তার মনযোগ গিয়ে পড়ল তেজস্ক্রিয়তায়। ১৯০৫ সালে ডক্টরেট ডিগ্রি পেলেন মাইটনার। ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনিই দ্বিতীয় ডক্টরেট ডিগ্রি পাওয়া নারী।
এর কিছুদিন পরেই মাইটনারের আবেদন মেনে নিয়ে তাকে লেকচারে যোগ দেওয়ার সুযোগ দেন ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক। বিজ্ঞান জগতের মহারথী হলেও, প্ল্যাঙ্ক এর আগে কোনো নারীকে তার লেকচারে আসতে দিতেন না। যত আবেদন এসেছে, সব নাকচ করে দিয়েছেন। মাইটনার কতটা উজ্জ্বল ছিলেন, সেটা এ থেকে বোঝা যায়। কিছুকাল পরে তিনি প্ল্যাঙ্কের সহকারী হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেয়ে যান।
কিন্তু নারী এবং জন্মসূত্রে ইহুদি হওয়ার দায় তার পিছু ছাড়ছিলই না। সেই দায়ের পরবর্তী আঘাত এসে পড়ল। সে গল্প বলার আগে আরেকটি চরিত্রের সাথে পরিচিত হতে হবে আমাদের। মাইটনারের জীবন ও কাজ নিয়ে বলতে গেলে তার কথা অবধারিতভাবেই চলে আসবে। তিনি অটো হান। মাইটনারের বন্ধু এবং সহকর্মী। কিন্তু আসলেই কি বন্ধু ছিলেন হান?
২
বাবা চেয়েছিল ছেলে স্থপতি হবে। কিন্তু ছেলের পছন্দ ছিল রসায়ন। কলেজের পাঠ চুকিয়ে অটো হান তাই পাড়ি দেন ইংল্যান্ডে। আরেক বিখ্যাত বিজ্ঞানী স্যার উইলিয়াম রামসের অধীনে কাজ করতে গিয়ে হাতে-কলমে শেখেন তেজস্ক্রিয়তার ভেতরের ব্যাপার-স্যাপার। রামসে তাকে অপরিশোধিত রেডিয়াম দিয়েছিলেন বিশুদ্ধ করার জন্য। কাজ করতে গিয়ে হ্যান রামসেকে বললেন, এখানে তো অন্য একটা জিনিস আছে! মূলত ওটা ছিল একটা তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ। হান এর নাম দিলেন রেডিও-থোরিয়াম। কিন্তু পড়াশোনা শেষে হান চেয়েছিলেন, কোনো ইন্ডাস্ট্রিতে ঢুকবেন। অর্থসংস্থান তো করা লাগবে।
এদিকে হানের কাজে মুগ্ধ হয়ে রামসে চিঠি লিখলেন আর্নেস্ট রাদারফোর্ডের কাছে। বললেন, আপনার অধীনে ওকে কাজ করার সুযোগ দিন। ছেলেটাকে আপনার মন্দ লাগবে না! শুধু তা-ই নয়, নিজ দায়িত্বে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে হানকে একটি চাকরিও জুটিয়ে দিলেন তিনি। বেশ কিছু দিন কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে জার্মানিতে ফিরে এলেন অটো হান। ইচ্ছে, তেজস্ক্রিয়-রসায়ন (radiochemistry) নিয়ে কাজ করবেন।
১৯০৬ সালে জার্মানিতে লিজে মাইটনারের সঙ্গে পরিচয় হয় হানের। একসঙ্গে শুরুতে পাঁচ বছর কাজ করেছেন, এরমাঝেই দুজনে মিলে আবিষ্কার করেছেন বেশ কিছু আইসোটোপ। হান ছিলেন তেজস্ক্রিয়-রসায়নের বিশেষজ্ঞ। এদিকে মাইটনার ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানে গ্র্যান্ডমাস্টার। একজন ভেতরের কারিকুরি বোঝেন, চিন্তা করে বের করার চেষ্টা করেন, কী করলে কী হবে। কীভাবে বের করা যায় নতুন মৌল বা আইসোটোপ। নতুন জিনিসটার বৈশিষ্ট্যই বা কেমন আর সেটা কী কাজেই বা লাগতে পারে। আরেকজন জানেন, কীভাবে এই কাজগুলো বাস্তবায়ন করা যায়, হাতে-কলমে। নানারকম বিক্রিয়া, এর পেছনের কলকব্জায় তার বিশেষ দক্ষতা।
তাদের দুজনের সাথে তিন নম্বর আরেকজন মানুষ ছিলেন। অটো ফ্রিস্ক। মাইটনারের তরুণ ভাইপো ও ল্যাব অ্যাসিসটেন্ট। বিভিন্নভাবে মাইটনার ও হানকে সাহায্য করতেন তিনি।
মাইটনার ও হান মোট ৩০ বছর একসঙ্গে কাজ করেছেন। অনেকভাবেই হান সাহায্য করেছেন মাইটনারকে। এতকিছু বলার উদ্দেশ্য, মাইটনারের কৃতিত্ব হান চুরি করেননি মোটেও। সেরকম কিছু করার তার দরকারই ছিল না। কিন্তু তিনি মাইটনারের কৃতিত্ব গোপন করে অন্যায় করেছিলেন। তবে এই অন্যায়ের পেছনে তার যতটা দোষ, সে সময়ের বিজ্ঞান-সমাজের দায় তারচেয়ে কোনোভাবেই কম ছিল না।
মাইটনারকে হান না, পুরো বিজ্ঞান-জগত তার প্রাপ্য স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল শুধু ইহুদি নারী হওয়ার অপরাধে।
৩
আগেই বলেছি, মোট ৩০ বছরের ৫ বছর শুরুতে একসঙ্গে কাজ করেছেন তারা দুজন। তারপর দুজনেই যোগ দিয়েছেন কাইজার ভেলহেলম ইন্সটিটিউটে। মজার ব্যাপার হলো, দুজনেই ২টি বিভাগের প্রধান হিসেবে কাজ করছিলেন। সে কালে নারী হয়ে একটি বিভাগের প্রধান হওয়ার জন্য তাকে কতটা সংগ্রাম করতে হয়েছে, সেটা ভাবলে এমনিতেই শ্রদ্ধা চলে আসে। পরবর্তীতে যুগ্মভাবে যেমন চমৎকার সব অর্জন ঝুলিতে পুরেছেন, তেমনি আলাদাভাবেও দারুণ সব কাজ করেছেন তারা। নিউক্লিয়ার ফিজিক্স বা পারমাণবিক গবেষণায় সমান তালে পাল্লা দিয়েছেন আইরিন কুরি, ফ্রেডরিক জুলিয়ট এবং অন্যান্য বিজ্ঞানী দলকে।
১৯৩৪ সালে এক্ষেত্রে সবচেয়ে সফল কাজগুলোর একটি করলেন এনরিকো ফার্মি। কণাপদার্থবিজ্ঞানের আরেক জাদুকর। মহাবিশ্বের অর্ধেক কণা তার নামে পরিচিত! সহজ করে বললে, মৌলের নিউক্লিয়াসে নিউট্রন ছুঁড়ে দিলেন তিনি। সেই আঘাতের ফলে তৈরি হলো তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ। কিন্তু ইউরেনিয়াম নিয়ে ঝামেলা লেগে গেল। ইউরেনিয়ামের মতো বড় ও ভারী কোনো মৌলের নিউক্লিয়াসকে যে নিউট্রনের টোকায় দুইভাগ করে ফেলা যায়, সেটা অনেক বিজ্ঞানীরাই মানতে পারছিলেন না।
১১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৯। বিজ্ঞানীদের এসব ঝামেলা, তর্ক-বিতর্কের সমাধান হয়ে গেল সেদিন। আবিষ্কৃত হলো ফিশন। আর, এই সবকিছুর কেন্দ্রে ছিলেন তিনজন মানুষ। এরমাঝে মূল কাজ করেছেন দুইজন। হ্যাঁ, এদের একজন অটো হান, আরেকজন লিজে মাইটনার।
৪
একটু পেছনে ফিরি। ফিশন আবিষ্কৃত হওয়ার বছরখানেক আগের কথা। ১৯৩৮ সাল। জার্মানী দখল করে নেয় অস্ট্রিয়াকে। ধর্মান্তরিত হয়ে প্রোট্যাস্টেন্ট হলেও, জন্মসূত্রের ইহুদি পরিচয়ের ফলে জার্মানী নিরাপদ ছিল না তার জন্য। তাই জার্মানি থেকে পালালেন মাইটনার। চলে এলেন সুইডেনে।
যত যাই হোক, মাইটনারের মতো বিজ্ঞানীকে একেবারে অস্বীকার তো করা যায় না। সেজন্য কাজ জুটে গেল। স্টকহোমে ম্যান সিবানের ইন্সটিটিউটে যোগ দিলেন মাইটনার। কিন্তু ইহুদি-নারী হওয়ার অভিশাপ তার পিছু ছাড়ল না। টের পেলেন, এখানে তাকে কেউ ঠিক নিতে পারছে না। সিবান তাকে নিজের দলে যোগ দিতে বলেননি। আবার, যথেষ্ট সুযোগও দেননি নিজের মতো করে কাউকে নিয়ে দল বানিয়ে নেওয়ার। ল্যাব আছে ঠিকই, কিন্তু মানুষ নেই তার সাথে কাজ করার মতো। নেই প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও। রুথ লুইন সিমে মাইটনারের জীবনী লিজে মাইটনার: আ লাইফ ইন ফিজিক্স বইতে লিখেছেন,
মাইটনারের কাছে তার নিজের ল্যাব বা ওয়ার্কশপের একসেট চাবি পর্যন্ত ছিল না।
ইন্সটিটিউটের অন্য সবার থেকে তাকে একরকম আলাদা করেই দেওয়া হলো। তৎকালীন অনেকেই মনে করতেন, নারীরাও যে বৈজ্ঞানিক কাজ-কর্ম করতে পারেন, এটা সিবান একদমই মানতে পারতেন না। মাইটনারের সাথে তার অমন আচরণের এটাও একটা কারণ।
কথা হলো, এত অপছন্দ হলে মাইটনারকে কাজের সুযোগ দিয়েছিলেন কেন সিবান? এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেওয়া কঠিন। কারণ, মাইটনারের অভিজ্ঞতা যত সমৃদ্ধই হোক, সিবান অস্বীকার করলে কারো কিছু করার থাকতো না। কিন্তু মাইটনারের অভিজ্ঞতা মানে, শুধু অভিজ্ঞতাই না। চমৎকার কিছু ভিত্তি প্রস্তর গেঁড়ে এসেছিলেন তিনি পথে।
প্রথমত, সে কালে নারী হয়েও পিএইচডি করেছিলেন তিনি। পরে কাজ করেছিলেন ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের সাথে। আবিষ্কার করেছেন বেশ কিছু আইসোটোপ এবং মৌল। যেমন, এক্টিনিয়াম-সি আইসোটোপ, প্রোটেকটিনিয়াম মৌল ইত্যাদি।
তেজষ্ক্রিয়তা নিয়ে তার কাজ এতই চমৎকার ছিল যে, ১৯৩০ সালের ৪ ডিসেম্বর জার্মানির টুবিঙ্গেনে হ্যান্স গেইগার এবং মাইটনারের যৌথ উপস্থিতিতে তেজষ্ক্রিয়তা নিয়ে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। হ্যান্স গেইগারের নাম অনেকে ‘গাইগার’ও উচ্চারণ করেন। হ্যাঁ, বিখ্যাত গাইগার কাউন্টারের আবিষ্কারকদের একজন তিনি। আরেক মহারথী, উলফগ্যাং পাউলিও (পাউলির বর্জন নীতির জন্য বিখ্যাত) সেখানে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জুরিখ থেকে এসে অনুষ্ঠান ধরতে পারবেন না বলে পাউলি একটা চিঠি লিখে দিয়েছিলেন। কী ছিল সেই চিঠিতে? সেই চিঠিতেই পাউলি জানিয়েছিলেন ‘নিউট্রিনো’ নামের একটা কণার অস্তিত্বের কথা!
সেজন্যেই বলেছি, লিজে মাইটনারের মতো কাউকে আসলে অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু সিবান যথাসম্ভব এড়িয়েই চলতে লাগলেন। ফলে সুইডেনে থেকেও মাইটনার যোগাযোগ রাখছিলেন অটো হানের সঙ্গে। এ সময় আরেকটা দারুণ ব্যাপার ঘটে। নিলস বোরের সঙ্গে পরিচয় হয় মাইটনারের।
বোর প্রায়ই কোপেনহেগেন থেকে স্টকহোমে আসতেন। মাইটনারের কথাবার্তা শুনে আগ্রহী হয়ে ওঠেন বোর। আসতে না পারলে, নিজেদের মধ্যে কাজ নিয়ে চিঠি-পত্রও আদান-প্রদান করেছেন তারা। বোরের সঙ্গে মাইটনারের এই পরিচয় বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে ফিশন আবিষ্কারে। না, বোর তাকে কোনো পরামর্শ দেননি। কিন্তু এই পরিচয় ও যোগাযোগের কারণেই মাইটনার মাঝে মাঝে কোপেনহেগেন যেতে শুরু করেন।
এই সব কিছুর মধ্যে দিয়েই চলে এলো ১৯৩৯ সাল।
৫
মাইটনারের কাজে যাওয়ার আগে আমাদের দুটো জিনিস জানতে হবে। এক, ফিশন ও দুই, লিকুইড ড্রপলেট মডেল কী? শেষটা থেকেই শুরু করা যাক!
সহজ ভাষায় লিকুইড ড্রপলেট মডেল বলে, নিউক্লিয়াস হলো পানির ফোঁটার মতো। এর কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য আছে। সারফেস টেনশন বা পৃষ্ঠটানের জন্য ফোঁটাটার ভেতরের অণুগুলো একসঙ্গে থাকে।
একই জিনিস যদি নিউক্লিয়াসের জন্য ভাবি, সমধর্মী চার্জগুলোকে একসাথে ধরে রাখে একটি বল (Force)। এখন, উত্তপ্ত কোনো নিউট্রন যখন এই নিউক্লিয়াসে আঘাত করে, তখন সেটাসহ একসঙ্গে জটিল গড়নের এক নিউক্লিয়াস গঠিত হয়। বাড়তি নিউট্রনের জন্য এই নিউক্লিয়াসের কিছু বাড়তি শক্তি জমা হয়। এই শক্তির কারণে নিউক্লিয়াসের ভেতরে দ্রুত কম্পন তৈরি হয়। ফলে নিউক্লিয়াসটা কাঁপতে কাঁপতে ডাম্বেল বা বেলনাকার ধারণ করে, ভাঙ্গতে থাকে সেই বলের বাঁধন। তারপর নিউক্লিয়াসটা মাঝখান থেকে দুই ভাগ হয়ে যায়, পরিণত হয় দুটো ভিন্ন ফোঁটায়, মানে ভিন্ন নিউক্লিয়াসে।
এই ব্যাপারটাই হলো ফিশন বিক্রিয়া। যেখানে নিউট্রন দিয়ে আঘাত করে ভেঙ্গে ফেলা যায় ইউরেনিয়ামের মতো ভারী ও তেজস্ক্রিয় মৌলের নিউক্লিয়াস।
আগে বলা হয়েছিল, নিউট্রন দিয়ে ইউরেনিয়ামকে আঘাত করা নিয়ে একটা ঝামেলা সৃষ্টি হয়েছিল। অনেকেই মানতে পারছিলেন না, এত ভারী নিউক্লিয়াস নিউট্রনের টোকায় দুইভাগ হয়ে যেতে পারে। কিন্তু এটা মানতে না পারলেও অনেক বিজ্ঞানী মেনে নিয়েছিলেন, ইউরেনিয়ামকে নিউট্রন দিয়ে আঘাত করলে ট্রান্সইউরেনিয়াম মৌল তৈরি হয়। এদের মধ্যে মাইটনার যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন আইরিন জুলিয়ট কুরিও।
আইরিন দেখলেন, নতুন তৈরি হওয়া মৌলটি রাসায়নিকভাবে রেডিয়ামের মতো আচরণ করে। এই রেডিয়াম আবিষ্কার করেছিলেন তার মা, মেরি কুরি। এখানে ঘটনা হলো, ইউরেনিয়ামের পারমাণবিক ভর ২৩৫। আর রেডিয়ামের ভর ২২৬। মাইটনার ভাবলেন, উৎপন্ন মৌলটা যদি রেডিয়াম হয়, তাহলে হিসেব মেলে না। ঘটনাটাকে কোনো নিয়মে ঠিকভাবে বাঁধা যাচ্ছে না, ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না।
কথা হলো, কিছু একটার হিসেব না মিললে সমস্যা কী? জিনিসটা যে হচ্ছে, সেটাই যথেষ্ট না? উত্তর, না, যথেষ্ট না। যতক্ষণ জিনিসটা কী এবং কীভাবে কাজ করে, সেটা জানা না যায়, ততক্ষণ ওই ব্যাপারটাকে কোনো কাজে লাগানো যাচ্ছে না। তাহলে, সেটাকে কী হিসেবে ধরা হয়? সমস্যা। এরকম অনেক সমস্যা এখনো রয়ে গেছে, যেগুলো আজো সমাধান করা যায়নি। প্রসঙ্গে ফিরি।
মাইটনার ভাবলেন, লিকুইড ড্রপলেট মডেল দিয়ে এই ঘটনাকে ব্যাখ্যা করা যাবে, যদি উৎপন্ন জিনিসটা এত ভারী কোনো মৌল না হয়। কেন? কারণটা সহজ ভাষায় বললে এমন: পানির ফোঁটা ভাঙলেও এর মধ্যে একটা ভারসাম্য থাকতে হবে। নতুন উৎপন্ন ফোঁটা দুইটার একটা অনেক বেশি ভারী, আরেকটা অতিরিক্ত হালকা হবে না। তেমনি, নতুন উৎপন্ন মৌলের একটা রেডিয়াম হলে ইউরেনিয়ামের ভর ২৩৫ এর ২২৬ই সে নিয়ে নেয়। বাকি অংশটা বেশি হালকা হয়ে যায়।
সমস্যার সমাধানও ভাবলেন তিনি। রেডিয়াম না হয়ে ওটা যদি বেরিয়াম হয়, তাহলে এর ভর হবে অনেকটা কম, ১৩৫। এদিকে, রেডিয়ামের সঙ্গে বেরিয়ামের রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যেরও অনেক মিল। তারমানে, ইউরেনিয়ামের নিউক্লিয়াস পানির ফোঁটার মতোই দুইভাগ হয়ে যাচ্ছে।
সবই বুঝলেন, কিন্তু প্রমাণ করবেন কীভাবে? অটো হানকে চিঠি দিলেন মাইটনার, দেখা করতে চান। কোথায় দেখা করা যায়? কেন, কোপেনহেগেনে! হান-মাইটনার দেখা করলেন। মাইটনার তাকে বললেন, উৎপন্ন জিনিসটাকে বেরিয়ামের সাথে মিলিয়ে দেখ। বাকিটা আমি বেসিক ফিজিক্স দিয়ে ব্যাখ্যা করে দিচ্ছি!
ফিরে গেলেন হান। পরীক্ষা করে দেখলেন, মাইটনারই ঠিক।
হান এই পরীক্ষাটা করেছিলেন আরেক বিখ্যাত বিজ্ঞানী স্ট্র্যাসম্যানকে সাথে নিয়ে। এদিকে, মাইটনার পুরো জিনিসটা দাঁড় করাতে কাজ করেছিলেন ভাইপো ফ্রিস্কের সাথে।
তো, হান আর স্ট্র্যাসম্যান তাদের পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে জার্নাল লিখে পাঠালেন নেচারওয়াইজেনস্কাফতেন-এ। এটা প্রকাশিত হয় ৬ জানুয়ারি, ১৯৩৯-এ।
এদিকে মাইটনার আর ফ্রিস্ক প্রক্রিয়াটার নাম রাখলেন নিউক্কিয়ার ফিশন, এবং জার্নাল পাঠালেন নেচারে। সেটা প্রকাশিত হলো মাসখানেক পরে, ১১ ফেব্রুয়ারিতে।
তাহলে, হানের অন্যায়টা কী ছিল?
হান যে পরীক্ষা করেছিলেন, সেটা তিনি করেইছিলেন মাইটনারের কথায়। কিন্তু হান যে পেপার পাঠালেন, সেখানে মাইটনারের কোনো উল্লেখই ছিল না! আসলে হান বুঝেছিলেন, জন্মসূত্রে ইহুদি, তার ওপর নারী-এমন কারো কথা পেপারে রাখলে সেটা ঠিক মূল্য পাবে না।
৬
১৯৪৪ সালে নোবেল পুরষ্কার পেলেন হান। ভারী নিউক্লিয়াসের ফিশন আবিষ্কারের জন্য তিনি নোবেল পান। মাইটনার কোনো স্বীকৃতিই পেলেন না।
নোবেল কমিটির এই অন্যায় ঢাকতে গিয়ে অনেকে একটা অদ্ভুত অজুহাত দেন। তারা বলেন, মাইটনার আর হান দীর্ঘদিন একসাথে কাজ করেননি। যেহেতু হানের পেপারে মাইটনারের কথা ছিল না, কাজেই তার অবদান নোবেল কমিটি বুঝতেই পারেননি।
মজার ব্যাপার হলো, হানের পেপারে ফিশন শব্দটা ছিলই না! ছিল না কোনো ব্যাখ্যাও যে, কী কারণে তিনি বেরিয়ামের কথা ভাবলেন; আর উৎপন্ন মৌল দুটোকে আলাদা করে বেরিয়ামের সাথে তুলনা করে দেখলেন।
এই তো গেল একদিক। আরেকদিক হলো, ভন লাউয়ে নোবেল কমিটিকে অনুরোধও করেছিলেন মাইটনারকে পুরষ্কার দিতে। এমনকি ম্যাক্স প্ল্যাংক তাতে সম্মতও হয়েছিলেন। তাতেও চোখ-কান খোলেনি নোবেল কমিটির।
এদিকে, মাইটনারের পেপারের গুরুত্ব বুঝেছিলেন আইনস্টাইনও। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে চিঠি লিখে বলেছিলেন, এই ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা হিটলারের হাতে পড়লে সব শেষ হয়ে যাবে। সেই চিঠির সূত্র ধরেই শুরু হয় ম্যানহাটন প্রজেক্ট। রুথ সিমে লিখেছেন, মাইটনারকেও এই প্রজেক্টে কাজ করতে বলা হয়। মাইটনার তা প্রত্যাখ্যান করেন। মানুষ মারার জন্য তো তিনি বিজ্ঞানে আসেননি! অথচ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে তাকে ফিশন নয়, আখ্যায়িত করা হয় পারমাণবিক বোমার জননী হিসেবে!
৯
বেশ কিছু পুরষ্কার পেয়েছেন মাইটনার। এরমাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পুরষ্কারটি হলো এনরিকো ফার্মি পুরষ্কার। ১৯৬৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অফ এনার্জি মাইটনার, স্ট্রেসম্যান ও হানকে ফিশন আবিষ্কারের জন্য পুরষ্কৃত করে। বলা যায়, এটাই মাইটনারের পাওয়া প্রথম আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি। তার পাওয়া বড় স্বীকৃতিগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম।
শেষ জীবনে মাইটনার অনেকটা নিরবে-নিভৃতেই কাটিয়েছিলেন। ১৯৬৮ সালের ২৭ অক্টোবর তিনি ওপারে পাড়ি জমান।
সে সময় স্বীকৃতি না দিলে কী হবে, সত্যটা জানে সবাই। সেজন্যেই মাইটনারের সম্মানে পর্যায় সারণীর ১০৯তম মৌলের নাম রাখা হয় মাইটনেরিয়াম। মাত্র ১৫ জন বিজ্ঞানী এই বিরল সম্মান পেয়েছেন। এর মাঝে নারী বিজ্ঞানী আছেন মাত্র দুজন, মাইটনার আর মেরি কুরি (কুরিয়াম)।
কাব্য করে বলা যায়, নোবেল পুরষ্কারের দুর্ভাগ্য, মাইটনারের হাতে জায়গা করে নিতে পারেনি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, জীবনভর প্রচণ্ড কষ্ট করে এই সমাজের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গেছেন মাইটনার। তাঁকে যথার্থ সম্মান দিতে না পারলেও, আমাদের চেষ্টা হতে হবে, আর কখনো যেন কারো সাথে এমনটা না হয়। তাতে করে হয়তো তাঁর স্মৃতিকে কিছুটা সম্মান দেওয়া হবে।
মাইটনার বেঁচে থাকলেও যে তা-ই চাইতেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।