সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে এক কাপ গরম চায়ের জাদুকরি ধোঁয়ার সাথে যে জিনিসটি না থাকলে একদমই হয় না, তা হচ্ছে নতুন দিনের পত্রিকা। পত্রিকার পাতা উল্টাতে উল্টাতে একটু করে চায়ে চুমুক দেয়ার মাঝে যে অদ্ভুত সুখ লুকিয়ে আছে, এর সাথে আপনাদেরকে আর নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে না। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় তিনশোর বেশি দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক পত্রিকা রয়েছে। প্রথম আলো, যুগান্তর, ইত্তেফাক, ইনকিলাবের কলরবে প্রতিদিন হকাররা শহরের রাজপথ মাতিয়ে তুলে। দেশ, আন্তর্জাতিক, বিনোদন, পড়াশোনা কিংবা খেলা- যে যার প্রয়োজন মতো কলামের পর কলাম ঘুরে বেছে নিচ্ছে নিজের পছন্দের সংবাদ। এমনকি গণমাধ্যম এবং ইন্টারনেটের আগ্রাসনে পড়ে একটুও কমেনি পত্রিকার চাহিদা। জাতীয় পত্রিকাগুলো একটি জাতির সার্বিক পরিস্থিতি ও জনগণের চিন্তাধারার প্রতিনিধি হিসেবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে বছরের পর বছর ধরে। কিন্তু, আজকের বড় বড় পত্রিকার দীর্ঘ যাত্রাপথের শুরুটা হয়েছিলো একটি পত্রিকার সাহসী আবির্ভাব থেকে। আর সেই পত্রিকার নাম ছিল বেঙ্গল গেজেট। জেমস অগাস্টাস হিকি নামক বিদেশির একক প্রচেষ্টায় গড়ে উঠা এই পত্রিকা ছিল উপমহাদেশের বুকে প্রকাশিত প্রথম পত্রিকা।
হতভাগা বিদেশি
ঘটনার শুরু এক বিদেশির হাত ধরে। হতভাগা সেই বিদেশির কপাল এতটাই মন্দ ছিল যে, কাজের সন্ধানে নিজের দেশ ইংল্যাণ্ড ত্যাগ করে পাড়ি জমাতে হয়েছিলো সুদূর ভারতবর্ষে। তার দেশত্যাগের সাল ছিল ১৭৭৪। জাহাজের রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে টুপি খুলে অশ্রুসিক্ত চোখে বিদায় জানিয়েছিলেন জন্মভূমি বাকিংহামকে। ভারতের হিজলি নামক স্থানে এসে নিজের নতুন নিবাস খুঁজে পান এই বিদেশি। নতুন দেশ, নতুন জীবন, একটি নতুন সূচনা। জীবিকার তাগিদে নেমে পড়লেন জাহাজ ব্যবসায়। এই বিদেশি ভদ্রলোক হয়তো সেদিন ঘুণাক্ষরেও টের পাননি, তিনি ভবিষ্যতে কী করতে যাচ্ছেন।
সুপ্রিয় পাঠক, কথা বলছিলাম জেমস অগাস্টাস হিকি সম্পর্কে, যাকে স্থানীয়রা হিকি সাহেব নামে ডাকতেন। নিজের দেশ না হলেও তিনি বেশ সহজে ভারতের মানুষের মাঝে নতুন ঠিকানা খুঁজে পান। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে নতুন দেশেও তার বিপদ কাটলো না। জাহাজ ব্যবসায়ও তেমন সুবিধা করতে পারলেন না। উপায় না দেখে তিনি পরের বছর ব্যবসা বন্ধ করে দিলেন। হিকি সাহেব চিন্তা করলেন, বড় বড় ব্যবসায় তিনি শত শত প্রতিযোগীর সাথে পেরে উঠবেন না। তাই তাকে ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করতে হবে। তিনি ভারতবর্ষের সার্বিক পরিস্থিতির সাথে ইংল্যাণ্ডের পরিস্থিতির তুলনা করতে চাইলেন। বেশ চিন্তাভাবনা করে তিনি বেশ কিছু সম্ভাবনাময় নতুন ব্যবসার নাম বের করতে সক্ষম হন। এদের মধ্যে পত্রিকা চালু করার চিন্তাও ছিল। শেষপর্যন্ত তিনি পত্রিকা বের করার সিদ্ধান্ত নেন।
বেঙ্গল গেজেট
হিকি সাহেব যখন পত্রিকা বের করার কথা চিন্তা করছিলেন, তখন ভারতবর্ষে প্রকাশিত হওয়া পত্রিকার সংখ্যা ছিল শূন্য। তাই ভারতের জনগণ পত্রিকাকে কীভাবে গ্রহণ করবে, সেটা নিয়ে সন্দিহান ছিলেন তিনি। কিন্তু শেষপর্যন্ত তিনি তার সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। ১৭৮০ সালের ২৯ জানুয়ারি হিকি সাহবের সাহসিকতার ফসল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলো এক বিপ্লব, যার নাম ছিল বেঙ্গল গেজেট। বারো বাই আট ইঞ্চি আকারের দু’পাতার পত্রিকা গড়নে ছোট হলেও এর ভূমিকা ভারতবর্ষের ইতিহাসে ছিল অনেক বড়।
তা কেমন ছিল বেঙ্গল গেজেটের পহেলা সংস্করণ? প্রথম সংখ্যায় সংবাদের পাশাপাশি হিকি সাহেব কিছু কবিতা এবং বিজ্ঞাপন প্রকাশ করেছিলেন। এই পত্রিকার একমাত্র সাংবাদিক, সম্পাদক ও কবির দায়িত্বে ছিলেন হিকি সাহেব নিজে। প্রথম যখন ভারতের বুকে কাগজ বের হলো, তখন সেটাকে আপন করে নিলো ভারতে বসবাস করা বিদেশিরা। বিশেষ করে, সৈনিকদের মাঝে এই পত্রিকার চাহিদা ছিল অনেক। শুরুর দিকে সবাই একে ‘হিকির গেজেট’ নামে ডাকতো। অফিসের বাইরে অর্ডার পড়তো এই ডাকনামে। ধীরে ধীরে ভারতবর্ষের ইংরেজি জানা মানুষরাও বেঙ্গল গেজেটের ভক্ত হয়ে উঠেন। এভাবে যাত্রা শুরু হয় উপমহাদেশের পত্রিকার।
সাহসী সাংবাদিকতা
হিকি সাহেবের লেখার হাত ছিল চমৎকার। তার গল্প বলার ধরন ছিল কিছুটা হাস্যরসাত্মক। তার পত্রিকার মাঝে এই বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন ঘটেছিলো। একজন জাহাজের ব্যাপারী থেকে কীভাবে খুব সহজে পুরোদস্তর সাংবাদিক বনে যাওয়া যায়, সেটা তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন। শুধু পত্রিকা বের করা দু’চারটা পাড়ার খবর ছেপে দেওয়ার মানুষ তিনি ছিলেন না। তারপরেও বলতে পারেন, যার পত্রিকায় কাজ করার পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই, সে আর কী এমন খবর ছাপাবে! কিন্তু আপনারা জেনে অবাক হবেন যে, অভিজ্ঞতায় কাঁচা হলেও হিকি সাহেবের সাংবাদিকতায় কোনো ভুল ছিল না। পাকা সাংবাদিকের মতো তিনি নেতৃস্থানীয় বিদেশিদের বিভিন্ন অপকর্মের কথা তুলে ধরেন তার দু’পাতার রাজ্যে। কিন্তু তিনি কোথায় তাদের নাম সরাসরি ব্যবহার করতেন না। সংবাদের ব্যক্তিবর্গের পরিচয় তিনি তার নিজের দেয়া ছদ্মনামের আড়ালে লুকিয়ে রাখতেন। কিন্তু এতেই নড়েচড়ে উঠলো শাসক সমাজ। কারণ, তার লেখার ধরন এবং তথ্যসম্ভার এতটা শক্তিশালী এবং সমৃদ্ধ ছিল যে তা অত্যাচারীদের মর্মে আঘাত করতে সক্ষম হয়েছিলো। হিকি সাহেব বেশ দক্ষভাবে গল্পের একদম গভীরে ঢুকে যেতেন তদন্ত করতে করতে।
প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের অনিয়ম এবং দুর্নীতির খবর ছাড়াও গণমানুষের কথা ছাপানো হতো তার পত্রিকায়। ভারতীয়দের সাথে অন্যান্য দেশের নাগরিকদের জীবনধারার তুলনামূলক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল বেঙ্গল গেজেটে। সামরিক, বেসামরিক পদে কর্মরতদের আত্মত্যাগের কথা তুলে ধরে হিকি সাহেব পরোক্ষভাবে এক জাগরণের ডাক দিয়েছিলেন। প্রাথমিকভাবে বিদেশি কর্মকর্তাগণ জবাবদিহিতা না থাকায় নিজের খেয়াল খুশিমতো ক্ষমতার অপব্যবহার করতেন। কিন্তু যখন উপমহাদেশে বেঙ্গল গেজেটের নজরদারি শুরু হলো, তখন অনেকে নিজের মুখোশ খুলে যাওয়ার ভয়ে সংযত থাকা শুরু করেন। সাধারণ মানুষ পত্রিকার অসাধারণ ক্ষমতা অনুভব করতে পারলো। এজন্য কিছুদিনের মধ্যে উপমহাদেশে আরো কিছু পত্রিকার আবির্ভাব ঘটে। হিকি সাহেব যে বিপ্লবের বীজ বুনেছিলেন, তা ভারতবর্ষের মাটিতে শক্ত শিকড় ছড়িয়ে বৃক্ষে রূপ নিতে থাকলো।
গভর্নর জেনারেল বনাম বেঙ্গল গেজেট
হিকি সাহেব এবং তার বেঙ্গল গেজেটের আতশ কাঁচের নিচে ধরা পড়লেন স্বয়ং তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস। সুপ্রিম কোর্টে প্রধান বিচারপতিকে ঘুষ প্রদানের মাধ্যমে তার পছন্দের রায় দিতে বাধ্য করেছিলেন তিনি। বেঙ্গল গেজেটে হেস্টিংস এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সাথে তার দুর্নীতির কথা বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করা হয়। এমনকি অতিরিক্ত কর আরোপের ফলে জনগণের ভোগান্তির জন্য সরাসরি তাকে দায়ী করা হয়।
বেঙ্গল গেজেটের হুংকার ভারতবর্ষ ছাপিয়ে ইংল্যাণ্ডে গিয়ে পৌঁছালো। সেখানে কর্তৃপক্ষ ওয়ারেন হেস্টিংসের নিকট জবাবদিহিতা চেয়ে পত্র প্রেরণ করেন। সাথে সাথে শুরু হয় তদন্ত। হিকি সাহেবের সেদিনের প্রতিবেদন ভারতবর্ষ থেকে হেস্টিংস অধ্যায়ের যবনিকাপাত ঘটিয়েছিলো। তাকে পদচ্যুত করে ইংল্যাণ্ডে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। ক্ষমতাধর গভর্নর জেনারেল হিকির কলমের কাছে পরাজিত হতে বাধ্য হলেন।
গেজেটের মৃত্যু
হিকি সাহেব যখন গভর্নর জেনারেলের মতো ক্ষমতাধর ব্যক্তির মুখোশ উন্মোচনের পেছনে সরাসরি ভূমিকা পালন করলেন, তখন থেকে অন্যান্য ইংরেজ তার পেছনে লেগে গেলেন। প্রশাসনিক পর্যায়ে কর্মরত দুর্নীতিবাজ সাহেবরা হিকি সাহেবকে হেনস্তা করার জন্য ফন্দি আঁটতে লাগলেন। যদি দ্রুত কোনো ব্যবস্তা না নেওয়া হয়, তাহলে হয়তো লোকটা মাথায় চড়ে বসবে- এমনটাই আশঙ্কা করছিলেন তারা। তাই পদচ্যুত হওয়ার আগেই হেস্টিংস জেমস হিকির ক্ষতি করতে চাচ্ছিলেন। প্রথমে ইংরেজরা বেঙ্গল গেজেটের প্রতিদ্বন্দ্বী বিভিন্ন পত্রিকায় হিকির বিরুদ্ধে কুৎসা রটিয়ে প্রবন্ধ রচনা করতে থাকলেন। কিন্তু তাতেও হিকি সাহেব থেমে যাননি। তাই স্বয়ং গভর্নর জেনারেল তার নামে আদালতে মানহানির মামলা ঠুকে দিলেন। সাজানো মামলায় হিকি সাহেবের জেল হয়ে যায়।
কিন্তু তাতেও এই পাগলা সাহেবকে দমানো গেলো না। কোথায় জেল থেকে বের হওয়ার জন্য অর্থ জোগাড় করবেন, তিনি উল্টো জেলে বসেই পত্রিকা ছাপাতে থাকলেন। হেস্টিংস এই কথা জানতে পেরে রেগে আগুন হয়ে গেলেন। এবার তিনি হিকিকে সমূলে উপড়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন। তার নির্দেশে সুপ্রিম কোর্ট বিশেষ আদেশে পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে দেন। এমনকি হিকির ছাপাখানা, কাগজ-কলম, কালি সবকিছু সিলগালা করে বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করা হলো। একা একা তিনি আর কদ্দুর পেরে উঠবেন। শেষপর্যন্ত বাধ্য হয়ে হার মানলেন তিনি। আর সেই সাথে অবসান ঘটলো নির্ভীক পত্রিকা বেঙ্গল গেজেটের।
জেমস হিকির স্বপ্নের প্রকল্প ছিল বেঙ্গল গেজেট। তাই পত্রিকা বন্ধ হওয়ার পর তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। স্বৈরাচার সরকার দু’হাতে গলা টিপে তার এই বিপ্লবকে হত্যা করে ফেলেছেন। হাজার হাজার দুর্নীতিবাজ ইংরেজের ছিল ক্ষমতা, কিন্তু হিকি সাহেবের ছিল দু’পাতার একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা। কয়দিন পর তিনি জেল থেকে বের হয়ে আসলেন নিঃস্ব অবস্থায়। তার পকেটে এক পয়সাও ছিল না। একবার যেহেতু ভাগ্য সন্ধানে ইংল্যাণ্ড ছেড়েছেন, এবার নাহয় ভারতবর্ষ ছাড়বেন। তিনি চীনের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমালেন জাহাজে চড়ে। কে জানতো যে, এটাই হবে তার শেষযাত্রা! জাহাজে ভ্রমণরত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন বাংলা পত্রিকার পথিকৃৎ জেমস অগাস্টাস হিকি সাহেব। কিন্তু তার বিপ্লব থেমে যায়নি। প্রতিদিন সকাল সকাল হকারের কাছ থেকে পত্রিকা কিনে যখন দু’পাতার খবরে আপনি হারিয়ে যাবেন, তখন এর মাঝে বেঁচে থাকবে হিকি সাহেবের সংগ্রাম। ভাবতে অবাক লাগে, অষ্টাদশ শতকে হিকি সাহেব যে সাহস দেখিয়েছিলেন তার পত্রিকার মাধ্যমে, সেটি আধুনিক যুগের সংবাদপত্রে বিরল।