নিলয় (ছদ্মনাম) আজকেই চলে গেলো।
“আর ক’দিন থেকে গেলে কী-ই বা ক্ষতি হতো ছেলেটার!“, কাপড়গুলো গোছাতে গোছাতে ভাবছেন ইয়াসমীন। “পাঁচ-ছয় মাস বাদে বাসায় আসে, চার-পাঁচ দিন ছুটি কাটিয়েই চলে যায়। ভার্সিটিগুলো কেন যে বেশিদিন ছুটি দিতে চায় না!” রাগে গজগজ করছেন তিনি।
নিলয় ইয়াসমীন নেগমের একমাত্র ছেলে। বড়ো আদরের ছেলে। ছোটবেলা থেকে কখনো চোখের আড়াল হতে দেননি। সেই ছেলে যখন উচ্চ মাধ্যমিক পাশের পর বললো, ভেটেরিনারী পড়তে সে ময়মনসিংহ যেতে চায়, তখন এক অজানা আশংকায় কেঁপে উঠেছিলো তার মন। যে ছেলে কখনও নিজের কাপড় নিজে ধোয়নি, সে কীভাবে একলা অত দূরে থাকবে? কিন্তু শেষমেষ সায় দিতেই হলো। ছেলের কথা কি ফেলতে পারা যায়? চোখের পানি মুছলেন ইয়াসমীন।
কাজ শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। কিছুই ভালো লাগছে না তার। “আচ্ছা, নিলয়কে একটা ফোন দিয়ে দেখলে কেমন হয়? ছেলেটা হয়তো এতক্ষণে পৌঁছে গেছে।”
ফোন করার জন্য নিজের রুমে যাওয়ার আগে শেষবারের মতো ঘরটিতে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন তিনি। ঘরটা কেমন নিশ্চুপ আর অন্ধকার হয়ে আছে। যেন এখানে কেউ থাকে না, কখনও থাকেওনি।
একটু পরেই এই ঘরের দরজায় পড়বে তালা। হয়তো খুলবে আবার মাস ছয়েক পরে। গিটারের আওয়াজ আর যুবককণ্ঠের আবেশে কানায় কানায় ভরে উঠবে এই ঘর। সেই সাথে ইয়াসমীন বেগমের হৃদয়ও। কেননা, এ ঘর যে তার হৃদয়ের প্রতিচ্ছবি।
এম্পটি নেস্ট সিনড্রোম কী?
এম্পটি নেস্ট সিনড্রোম কী, সেটা জানার পূর্বে এম্পটি নেস্ট সম্পর্কে ধারণা নেয়া প্রয়োজন।
একটি পাখির বাসার দিকে তাকান। দেখবেন বাসাটি সবসময়ই বাচ্চা পাখিদের কলরবে মুখরিত হয়ে আছে। কিন্তু যখন সেগুলো বড় হয়ে আকাশে উড়াল দেয়, তখন পেছনে কী পড়ে থাকে? একটি শূন্য-নিঃস্তব্ধ বাসা।
ঠিক একই ঘটনা ঘটে মানুষের জীবনেও। রক্তের সম্পর্কে আবদ্ধ ছোট-বড় কিছু মানুষের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে আমাদের পরিবার। দীর্ঘদিনের সাহচর্যে গড়ে ওঠে একের সাথে অন্যের গভীর অনুভূতির বন্ধন। তাই দেখা যায়, পরিবারের যে কনিষ্ঠ সদস্যটির হৈ-হুল্লোড় আর উদ্দীপনায় মুখরিত হয়ে থাকতো পুরো বাসা, সে যখন বাসা ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যায়, তখন নিঃস্তব্ধ বাসাটি হয়ে ওঠে একটি এম্পটি নেস্ট, যেটি শুধুই বিষাদ ও হাহাকারের প্রতীক।
পাখির বাচ্চা যখন উড়তে শিখে প্রথমবারের মতো ডানা মেলে আকাশের পানে, তখন মা-পাখির মনের যে হাহাকার জেগে ওঠে তার সাথে মিল রয়েছে এর। আর এই হাহাকার অনুভবের নামই এম্পটি নেস্ট সিনড্রোম, যা আমরা উদ্দীপকের শাহানা বেগমের মাঝে দেখতে পাই।
মায়ো ক্লিনিকের এক প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, এম্পটি নেস্ট সিনড্রোম আসলে কোনো রোগ বা মানসিক অসুস্থতা নয়। সাধারণত নিজেদের কাছ থেকে সন্তানের দূরে চলে যাওয়াকে কেন্দ্র করে অভিভাবকের মনে যে শূন্যতা, বেদনা, খেদ এবং আফসোসের জন্ম হয়, তাকেই এম্পটি নেস্ট সিনড্রোম বলে অভিহিত করা হয়।
কারা এম্পটি নেস্ট সিনড্রোমে বেশি ভোগেন?
পূর্বের বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায়, পরিবারে বাবাদের তুলনায় মায়েদের মধ্যে এম্পটি নেস্ট সিনড্রোমে ভুগবার প্রবণতা বেশি। এর পেছনের কারণটাও আন্দাজ করা খুব একটা কঠিন নয়।
চিরায়ত ঐতিহ্য অনুযায়ী আমাদের সমাজে যে সামাজিক রীতিনীতিগুলো গড়ে উঠেছে, সেখানে পরিবারের নারী সদস্যদের ঘরে থাকবার প্রতি উৎসাহিত করা হয়। যার ফলে তারা পরিবারের কনিষ্ঠ সদস্যদের সাথে বেশি সময় কাটানোর সুযোগ পেয়ে থাকেন।
বাচ্চাকাচ্চাদের সাথে এই বেশি সময় অতিবাহিত করার কারণে তারা জড়িয়ে পড়েন এক মায়ার বাঁধনে। বিশেষ করে যারা সারাদিন ঘরকন্নার কাজ করেন অথবা সিঙ্গেল মাদার, তাদের কাছে সন্তানই হয়ে ওঠে একমাত্র জগৎ। তাই সময়ের পরিবর্তনে যখন এসব মায়েরা নিজেদের সন্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন, তখন তাদের হৃদয় আক্ষরিক অর্থে খাঁ-খাঁ করতে শুরু করে।
যখন সন্তান দূরে কোথাও চলে যায়, তখন বেশিরভাগ মা-ই সন্তানের প্রতি আগের চাইতে বেশি টান অনুভব করতে শুরু করেন। সন্তান ঠিকঠাক মতো তার প্রতিদিনকার কাজগুলো করতে পারছে কি না, সেটি নিয়ে তারা সার্বক্ষণিক দুশ্চিন্তায় আক্রান্ত হন। ক্ষণে ক্ষণে সন্তানের সাথে কাটানো স্মৃতিগুলো তাদের মানসপটে ভেসে উঠতে থাকে।
তবে হুইটন কলেজের একজন অধ্যাপক হেলেন ডি’ভ্রিস এর পরিচালিত এক গবেষণায় উঠে আসে ভিন্ন চিত্র। গবেষনায় তিনি দেখান, টিনএজদের যখন বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়, তখন তাদের শূন্যতা কাটিয়ে উঠতে মায়েদের চাইতে বাবাদেরই বেশি বেগ পেতে হয়। এর কারণ হিসেবে তিনি জানান, কর্মস্থলের চাপের কারণে মায়েদের চেয়ে বাবারা তাদের সন্তানদের সাথে তূলনামূলক কম সময় কাটিয়ে থাকেন। তাই সন্তান দূরে চলে গেলে তাদের আফসোস ও অনুতাপের মাত্রা আরো বেড়ে যায়।
এম্পটি নেস্ট সিনড্রোম: কীভাবে প্রতিক্রিয়া ফেলে?
এম্পটি নেস্ট সিনড্রোম সুনির্দিষ্ট কোনো মেডিক্যাল কন্ডিশন না হলেও, একটি এম্পটি নেস্ট শরীর ও মনে নানা ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে যা প্রকাশ পায় বাহ্যিক উপসর্গের মধ্য দিয়ে। সন্তানের স্মৃতিতে নস্টালজিক হয়ে পড়া, ঘন ঘন ফ্ল্যাশব্যাকে যাওয়া, অকারণেই চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়া এদের মধ্যে অন্যতম।
অনেক সময় অভিভাবকরা সন্তানের প্রতি দায়িত্ব পালনে এতটাই মশগুল হয়ে পড়েন যে, তারা ভুলেই যান তাদের একটা আলাদা পরিচয় আছে। সব পরিচয় ছাপিয়ে ‘মা’ কিংবা ‘বাবা’ পরিচয়টাই তাদের কাছে মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। তাই সন্তান যখন বিদায় নেয়, তারা তখন পরিচয় সংকটে ভুগতে শুরু করেন।
প্রিয় সন্তানের অনুপস্থিতিতে অভিভাবকের মনে জেগে ওঠে বিষণ্নতা ও মনঃস্তাপ, যা তাকে অন্যান্য গুরুতর মানসিক ব্যাধির দিকে ঠেলে দিতে পারে। অনেক সময় তিনি অ্যালকোহল বা নেশাদ্রব্যের প্রতি আসক্ত হয়ে উঠতে পারেন।
তবে এম্পটি নেস্ট যে শুধুই নেতিবাচক তা-ও কিন্তু নয়। আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের মতে, অভিভাবক এবং শিশুদের মধ্যে স্বাধীন ও স্বতঃস্ফূর্ত পরিবেশ গড়ে তুলতে সহায়ক হতে পারে এটি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যেসব বাচ্চা ছোটবেলা থেকেই একা একা বড় হয়, তাদের মধ্যে স্বাধীনচেতা ও স্বনির্ভর মনোভাব গড়ে ওঠে।
এছাড়াও বাচ্চারা বাইরে থাকলে অভিভাবকরা নিজেদের শখের কাজগুলো করবার সময় পান। এছাড়াও নিজের জীবনসঙ্গীর সাথে একান্তে অধিক সময় কাটাবারও সুযোগ সৃষ্টি হয়। ফলে দাম্পত্য জীবনে নতুন করে ফিরে আসে ছন্দ ও চাঞ্চল্য। এছাড়াও বন্ধুবান্ধব ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের জন্য সময় বের করাও আগের থেকে সহজ হয়ে ওঠে।
এম্পটি নেস্ট ও সাম্প্রতিক চিত্র
একসময় উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে ব্যাপক হারে এম্পটি নেস্ট গড়ে উঠতে দেখা গেলেও, বর্তমানে এক ভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে।
পিউ রিসার্চ সেন্টারের ২০১৪ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোট তরুণদের ৩২.১ শতাংশই তাদের বাবা-মায়ের সাথে একত্রে বসবাস করছিলেন, যা আলাদা সংসার স্থাপন করে বসবাস করা তরুণদের (৩১.৬ শতাংশ) চেয়ে একটু বেশি।
এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় বুমেরাং জেনারেশন ও মাল্টিজেনারেশনাল পরিবারের কথা।
যেসব তরুণ উচ্চশিক্ষা অর্জনের পর পুনরায় পরিবারের কাছে ফেরত আসেন এবং তাদের সাথে জীবনযাপনের পথ বেছে নেন তাদেরকে ‘বুমেরাং জেনারেশন’ বলে অভিহিত করা হয়। ২০১৫ সালে পরিচালিত এক মার্কিন শুমারীতে দেখা যায়, প্রায় ২৪ মিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্ক আমেরিকানই এই বুমেরাং জেনারেশনের অন্তর্ভুক্ত। এদের সবার বয়সই আঠারো থেকে ছত্রিশ বছরের মধ্যে। এছাড়াও শুমারীতে দেখা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাত্র ৬টি প্রদেশে তরুণদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ স্বাধীনভাবে বসবাস করছে; দশ বছর আগে যেখানে সংখ্যাটা ছিলো পঁয়ত্রিশ। পড়ালেখা শেষ করে স্বাধীন জীবন শুরু করার বদলে মা-বাবার কাছে ফেরত আসার এ প্রবণতার পেছনে কর্মক্ষেত্রে জটিলতা এবং জীবনযাত্রার উচ্চমানকেই দায়ী করছেন তারা।
এছাড়াও কয়েক দশক ধরে উন্নত দেশগুলোতে গড়ে উঠছে অসংখ্য মাল্টিজেনারেশনাল পরিবার, যেখানে একাধিক প্রজন্মের প্রতিনিধি একই ছাদের নিচে বছরের পর বছর বসবাস করে যাচ্ছেন। এই প্রথাটি এসেছে এশিয়ান ও হিস্পানিক পরিবার থেকে।
পিউ রিসার্চ সেন্টারের গবেষণায় উঠে আসে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৬৪ মিলিয়ন মানুষ এই মাল্টিজেনারেশনাল পরিবারগুলোর অধীনে বসবাস করছেন।
এটি দেশটির মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশের মতো। এই মাল্টিজেনারেশনাল পরিবার গড়ে উঠবার কারণে বয়োঃপ্রাপ্ত হবার পর টিন-এজারদের বাড়ি ছাড়া প্রবণতা অনেকাংশে কমে গেছে।
সংস্কৃতি কীভাবে এম্পটি নেস্ট সিনড্রোমের ক্ষয়িষ্ণুতাকে প্রভাবিত করছে, সেটি নিয়েও হয়েছে বিস্তর গবেষণা। বিশেষ করে পারিবারিক বন্ধন এবং মিথস্ক্রিয়ার এতে ভূমিকা কী, সেটি নিয়ে হয়েছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। দেখা গেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যেসব পরিবারে অধিক ধর্মীয় পরিবেশ নিশ্চিত করা হয়, সেসব পরিবারে সন্তানদের মধ্যে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্যত্র স্বাধীন বসবাসের প্রবণতা কম।
অভিভাবক হিসেবে করণীয়
সন্তান দূরে চলে গেছে, এ নিয়ে হা-হুতাশ করার চাইতে নিচের পরামর্শগুলো মেনে চললে কমতে পারে শূন্যতা এবং হতাশা।
মেনে নিন বাস্তবতাকে
বাস্তবতাকে উপলব্ধি করে তার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে শিখুন। কেননা, এর থেকে আর ভালো কোনো বিকল্প ছিলোনা। একবার মুদ্রার অপর পাশটাও চিন্তা করে দেখুন। আপনার সন্তান হয়তো আপনার থেকে আজ অনেক দূরে। কিন্তু সেখানে সে যদি নিজের উন্নতি করতে পারে, তবে আখেরে তা আপনার জন্যই মঙ্গল বয়ে আনবে।
সন্তানের সংস্পর্শে থাকুন
সন্তানের খোঁজখবর নেয়ার চেষ্টা করুন। অবসর সময়ে তাকে ফোন করুন, টেক্সট মেসেজ পাঠান। সে কেমন আছে, কোনো সমস্যায় আছে কি না, সে ব্যাপারে জানতে চেষ্টা করুন। সম্ভব হলে ছুটিতে তাকে দেখতে যান। এতে করে আপনার উৎকন্ঠা ও দুশ্চিন্তা অনেকাংশেই কমে আসবে। তবে খেয়াল রাখবেন, আপনার খোঁজ নেয়ার ধরন এবং মাত্রা যেন আপনার সন্তানের বিরক্তির কারণ হয়ে না দাঁড়ায়।
নিজেকে সময় দিন
সন্তান দূরে চলে গেছে, এ নিয়ে হায়-হুতাশ আর বিলাপ না করে নিজের প্রতি মনোনিবেশ করুন। ইতোপূর্বে সন্তান লালনপালন করার ব্যস্ততায় যে শখের কাজগুলো হয়ে ওঠেনি, সেগুলোয় মন দিন। আত্মীয়-স্বজন ও পুরনো বন্ধু-বান্ধবকে সময় দিন। নিজের একটি আলাদা জগৎ তৈরি করুন। দেখবেন, সন্তানের শূন্যতা আর আগের মতো কষ্ট দিচ্ছে না।
সঙ্গীকে সময় দিন
অনেকেই সংসার জীবনে এতটা ব্যস্ত হয়ে পড়েন যে, তারা ভুলেই যান তাদের দাম্পত্য সঙ্গীর প্রতিও তাদের কিছু দায়িত্ব রয়েছে। এ দায়িত্বগুলো পালন করে দাম্পত্য জীবনকে আরো মধুময় করে তোলার আদর্শ সময় এটিই। তাই নিজের সঙ্গীর প্রতি সচেতন হোন, তাকে সময় দিন। এতে সন্তানের শূন্যতার কষ্টও কিছু লাঘব হবে।
সাহায্য নিন কাউন্সেলিংয়ের
যদি এমনটাই হয় যে আপনার সন্তানের বিচ্ছেদ আপনি কোনোভাবেই সহ্য করতে পারছেন না, সেক্ষেত্রে কোনো মনোবিদের সহায়তা নেয়া যেতে পারে। তিনি আপনার সমস্যা চিহ্নিত করে সেটার সাথে মোকাবিলা করার উপায় শিখিয়ে দিতে পারেন। এক্ষেত্রে ফ্যামিলি থেরাপি বেশ কাজে দেয়।