কারো পরিচিতি প্রকাশের জন্য নাম খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এ কথা শুধু ব্যক্তি মানুষের ক্ষেত্রেই নয়, সমানভাবে প্রযোজ্য একটি দেশের জন্যও। কারণ নামের মাধ্যমেই ফুটে ওঠে কোনো দেশ, অঞ্চল বা জাতির হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। তাই একটি দেশের নামকে কখনোই হালকাভাবে নেয়া উচিত না।
অন্য আর সব দেশের মতো আমাদের বাংলাদেশের নামকরণেরও রয়েছে লম্বা ইতিহাস। সাধারণভাবে আমরা অনেকেই মনে করি, বাংলা ভাষায় কথা বলা মানুষের বাস, তাই এই দেশের নাম বাংলাদেশ। তবে শুধু কি তা-ই? মোটেই নয়। বরং এই নামটি অধিগ্রহণের প্রাক্কালে বাংলাদেশকে পাড়ি দিতে হয়েছে বিশাল পথ।
বাংলাদেশের সন্ধান পাওয়া যায় সেই প্রাচীন গ্রিক ও লাতিনদের রচনায়। সেই খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দ থেকেই গ্রিক ও লাতিনদের রচনায় উল্লেখ পাওয়া যায় ‘গঙ্গারিডাই’ নামক একটি দেশ বা রাজ্য ও জনগোষ্ঠীর, যার অর্থ দাঁড়াতে পারে ‘গঙ্গা দ্বারা সমৃদ্ধ’ বা ‘গঙ্গাঋদ্ধি’ কিংবা ‘গঙ্গা হৃদয়ে যার’ বা ‘গঙ্গাহৃদি’। রূপভেদে আবার ‘গঙ্গারিডাই’-এর পরিবর্তে ‘গঙ্গারিডেই’, ‘গঙ্গারিদুম’ ও ‘গঙ্গারাইডেস’ শব্দগুলোরও দেখা পাওয়া যেত।
গ্রিক পর্যটক মেগাস্থিনিস তার ‘ইন্ডিকা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছিলেন এই রাজ্যের কথা। তার মতে, এই রাজ্যের বিস্তার ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের বঙ্গ অঞ্চল বা বর্তমান বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে। অনেক গ্রিক ও লাতিন ঐতিহাসিকই মনে করেন, আলেকজান্ডার তার ভারতবর্ষ অভিযান থেকে সরে এসেছিলেন যে কয়টি কারণে, তার মধ্যে প্রধানতম হলো গঙ্গারিডাই আক্রমণের ব্যাপারে তার ভীতি। তিনি আশঙ্কা করেছিলেন, গঙ্গারিডাই আক্রমণ করতে গেলে পরিণতি হবে ভয়াবহ।
ঐতিহাসিক টলেমি ও পেরিপ্লাস গ্রিক ইতিহাসে উল্লেখ করেছেন, গঙ্গারিডাইয়ের রাজার বাসস্থান ছিল ‘গঙ্গে’। তবে গঙ্গারিডাই রাজার রাজধানী গঙ্গের ঠিক কোথায় অবস্থিত ছিল তা গ্রিক লেখকগণ সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেননি।
ড. গৌরীশঙ্কর দে ও অধ্যাপক শুভ্রদীপ দে তাদের ‘প্রসঙ্গ: প্রত্ন-প্রান্তর চন্দ্রকেতুগড়’ বইয়ে বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার প্রত্নস্থল চন্দ্রকেতুগড় সম্ভবত উল্লিখিত বিখ্যাত প্রাচীন বন্দর-রাজ্য ‘গঙ্গারিডাই’-এর রাজধানী বা ‘গঙ্গে’ বন্দর। আবার বাংলাদেশের কোনো কোনো ঐতিহাসিক মনে করেন, খুলনার কুমার নদীর তীরে গঙ্গে বা গঙ্গারিডাই রাজার বাসস্থান ছিল। বর্তমান সুন্দরবনের হরিণ ঘাটাকে তারা গঙ্গে বলে কল্পনা করে থাকেন।
সুতরাং গঙ্গারিডাই ও গঙ্গের ব্যাপারে এখনো যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে, তাই বিতর্কও হতেই পারে। আমরা বরং নজর ফেরাই এই গঙ্গারিডাই কীভাবে ‘বঙ্গদেশ’ বা ‘বঙ্গ’ নামে পরিচিতি লাভ করল।
‘বাঙালির ইতিহাস’ বইয়ে ড. মোহাম্মদ হাননান, ১৭৬৮-১৭৮৮ সালের মধ্যে গোলাম হোসায়ন সলীম জইদ পুরী কর্তৃক রচিত ‘রিয়াজ-উস-সালাতীন’ গ্রন্থ হতে ‘বঙ্গ’ নামের উৎপত্তি নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন। সেখানে বঙ্গ নামের ঐতিহাস প্রেক্ষাপটে মুসলিম চিন্তা-চেতনার দিকটি উন্মোচিত হয়েছে। বলা হয়েছে, মহাপ্লাবন পরবর্তী সময়ে হযরত নূহ (আঃ), তার স্ত্রী, সন্তানসহ ৮০ জন নর-নারী আল্লাহর হুকুমে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েন, সেখানে বংশবৃদ্ধি শুরু করেন, এবং তাদের বংশধররাই পৃথিবীকে নতুনভাবে সাজান।
নূহ (আঃ) এর এক পুত্র হাম এশিয়া অঞ্চলে বংশবৃদ্ধির কাজে নিয়োজিত হন। তারই এক পুত্র হিন্দের নামানুসারে ‘হিন্দুস্থান’, সিন্দের নামানুসারে ‘সিন্ধু’, আর বঙ্গের নামানুসারে ‘বঙ্গদেশ’ নামের উৎপত্তি হয়।
আবার বঙ্গ নামকরণের পেছনে হিন্দুদের পৌরাণিক তত্ত্বও বিদ্যমান। পৌরাণিক মতে, বঙ্গের নাম এসেছে রাজা বালির পুত্রের নাম থেকে। সেখানে দাবি করা হয়, রাজা বালির এক পুত্র অঙ্গ শাসন করতেন পশ্চিমবঙ্গ, খুলনা ও বরিশাল অঞ্চল। আরেক পুত্র বঙ্গ শাসন করতেন ঢাকা, ময়মনসিং ও ত্রিপুরা অঞ্চল। এবং সর্বশেষ পুত্র পুন্ড্র শাসন করতেন উত্তরবঙ্গ ও আসাম অঞ্চল। এই পুত্রের নামানুসারেই তাদের শাসনকৃত অঞ্চলগুলো অঙ্গ, বঙ্গ ও পুন্ড্র নাম লাভ করেছে।
অর্থাৎ বঙ্গ নামকরণ নিয়েও যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। এখন আমরা উদ্ঘাটনের চেষ্টা করতে পারি কীভাবে বঙ্গ থেকে ‘বাংলা’ নামটি এলো। এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন। তার মতে, ‘বাংলা’ শব্দের উচ্চারণ হয়েছে ‘বঙ্গ’ থেকেই, যেটি মূলত ছিল একটি সংস্কৃত শব্দ। আর্যরা নাকি অঞ্চলকে ‘বঙ্গ’ হিসেবে অভিহিত করত। পরবর্তীতে এ অঞ্চলে বসবাসকারীরা ‘বঙ্গ;-এর সাথে ফার্সি ‘আল’ প্রত্যয় যোগ করে, যাতে শব্দটির নবরূপ দাঁড়ায় ‘বাঙাল’ বা ‘বাঙ্গালাহ্’।
এক্ষেত্রে সৈয়দ আনোয়ার হোসেন মূলত ইতিহাসবিদ আবুল ফজল (আইন-ই-আকবরীর রচয়িতা) বর্ণিত ইতিহাসকে গ্রহণ করে বলেছেন, মুসলমান শাসনামলে বিশেষ করে ১৩৩৬ থেকে ১৫৭৬ সাল পর্যন্ত সুলতানি আমলে এবং ১৫৭৬ সালে মোঘলরা বাংলা দখল করার পরে এই অঞ্চলটি বাঙাল বা বাঙ্গালাহ্ নামেই পরিচিতি পায়।
‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থে আবুল ফজল লিখেছিলেন, বঙ্গ শব্দের অর্থ জলাভূমি। এর সাথে আল যুক্ত হয়ে হয়েছে বাঙ্গালাহ্। আল মানে শুধু চাষের খেতের (জমির) আলই নয়, ছোট-বড় বাঁধ অর্থেও এটি ব্যবহৃত হতো। প্রাচীনকালে রাজাগণ ১০ গজ প্রশস্ত উঁচু ২০ গজ বিশাল আকার আল নির্মাণ করতেন। বর্তমানেও বৃহত্তর বরিশাল ও ফরিদপুরের অনেক স্থানে ‘বাঙলা’ দেয়া শব্দটি জলা ভূমিতে বাঁধ দেয়া অর্থে ব্যবহৃত হয়। বাংলা বন্যা ও বাদলের দেশ, বাংলার সাথে তাই আল (বাঁধ) ঘনিষ্ঠে অনুষঙ্গ।
সে যা-ই হোক, পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন রাজারা ক্ষমতায় আসীনকালে এই বাংলাকে বিভিন্ন নাম দেন। যেমন- বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার, আসামের মতো কয়েকটি প্রদেশ নিয়ে গঠিত সাম্রাজ্যের নামকরণ করেছিলেন ‘বঙ্গ’।
ব্রিটিশ শাসনামলে এই অঞ্চলের নাম হয় ‘বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি’। এরপর ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সময় গোটা বাংলায় একটা প্রশাসনিক বিভাজন হয়। বাংলার পশ্চিম অংশ হয়ে যায় ‘পশ্চিম বঙ্গ’ এবং পূর্ব অংশ হয়ে যায় ‘পূর্ব বাংলা’।
১৯৪৭ সালে দেশভাগ হবার পর বাংলাদেশ যখন পাকিস্তানের অংশ হলো, তখন থেকে এর নামকরণ নিয়ে এক নতুন বিতর্ক সৃষ্টি হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা বাংলার মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে এর নাম ‘পূর্ব পাকিস্তান’ করার চেষ্টা করে। ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত কাগজে-কলমে যদিও ‘পূর্ব বাংলা’ নামটিই প্রচলিত ছিল, কিন্তু ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নামকরণের তৎপরতাও জারি ছিল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে করাচিতে ১৯৫৫ সালের ২৫ আগস্ট পাকিস্তান গণপরিষদের বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন,
“স্যার, আপনি লক্ষ্য করে থাকবেন যে, তারা পূর্ব বাংলার স্থলে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ বসাতে চায়। আমরা বহুবার দাবি জানিয়ে এসেছি যে, [পূর্ব] পাকিস্তানের পরিবর্তে আপনাদের [পূর্ব] বাংলা ব্যবহার করতে হবে। ‘বাংলা’ শব্দটির একটি ইতিহাস আছে, আছে নিজস্ব একটি ঐতিহ্য…। আর যদি পূর্ব পাকিস্তান নাম রাখতেই হয়, তাহলে বাংলার মানুষের জনমত যাচাই করতে হবে। তারা নামের এই পরিবর্তন মেনে নিবে কি না সেজন্য গণভোট নিতে হবে।”
কিন্তু এরপরও, ১৯৫৫ সালের ১৪ অক্টোবর ‘পূর্ব বাংলা’ নামটি পরিবর্তন করে সরকারিভাবে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ রাখা হয়।
১৯৬০’র দশকের মাঝামাঝি থেকে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ ধারণাটি প্রকৃষ্ট রূপ ধারণ করতে থাকে। এরপর আসে ১৯৬৯ সাল, শুরু হয় আইয়ূব পতন আন্দোলন। সেসময় গণঅভ্যুত্থানে একটি স্লোগান নিয়মিতই দেয়া হতো: “বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।” অর্থাৎ এ অঞ্চলকে অনেকেই মনে-প্রাণে ‘বাংলাদেশ’ হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করে দিয়েছিল।
‘বাংলাদেশ’ নামকরণের দাবি চূড়ান্ত রূপ লাভ করে ১৯৬৯ সালের ২৮ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের একটি ভাষণের পর থেকে। যারা ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নামটি বদলাতে চাচ্ছিলেন তাদের যুক্তির প্রধান ভিত্তি ছিল, যেহেতু পশ্চিম পাকিস্তানের এক ইউনিট ভেঙে গেছে এবং প্রশাসনিক ইউনিট হিসেবে সিন্ধ, বেলুচিস্তান, পাঞ্জাব এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলের সাবেক প্রাদেশিক নাম পুনর্জীবিত হচ্ছে, তাই পাকিস্তানের পাঁচটি প্রদেশের মধ্যে সবচেয়ে পূর্বে অবস্থিত প্রদেশের নাম আর ‘পূর্ব পাকিস্তান’ রাখা সংগত হবে না।
এরপর আসে ৫ ডিসেম্বর, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ৬ষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভা। সেখানে তৎকালীন নেতারা এ অঞ্চলের জন্য বিভিন্ন নাম প্রস্তাব করেন। যেমন: ‘স্বাধীন পূর্ব বাংলা’, ‘বাংলা’, ‘বেঙ্গল’, ‘ইস্ট বেঙ্গল’, ‘বঙ্গ’, ‘বঙ্গ দেশ’, এবং ‘বাংলাদেশ’। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অধিকাংশ নেতাকর্মীই ছিলেন ‘বাংলাদেশ’ নামটির পক্ষে। শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু প্রস্তাবিত ‘বাংলাদেশ’ নামটিই সকলে একবাক্যে মেনে নেন।
‘কারাগারের রোজনামচা’ বইয়ে বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণার উদ্ধৃতি রয়েছে। ওইদিন আলোচনায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন,
“একসময় এদেশের বুক হইতে, মানচিত্রের পৃষ্ঠা হইতে ‘বাংলা’ কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকু চিরতরে মুছিয়া ফেলার চেষ্টা করা হইয়াছে।… একমাত্র ‘বঙ্গোপসাগর’ ছাড়া আর কোনও কিছুর নামের সঙ্গে ‘বাংলা’ কথাটির অস্তিত্ব খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই।… জনগণের পক্ষ হইতে আমি ঘোষণা করিতেছি আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম ‘পূর্ব পাকিস্তান’ এর পরিবর্তে শুধুমাত্র ‘বাংলাদেশ’।”
এর পরদিন ৬ ডিসেম্বর বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ‘বাংলাদেশ’ নামকরণের খবর ছাপা হয়, এবং আতাউর রহমান খান ‘পাকিস্তান অবজার্ভার’-এ বঙ্গবন্ধুর এই নামকরণের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বিবৃতি দেন। এছাড়া ন্যাপের আধ্যাত্মিক গুরু মওলানা ভাসানী ৭ ডিসেম্বর প্রকাশ্য জনসভায় পূর্ব পাকিস্তানের পুনঃনামকরণ সমর্থন করে বলেন, ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে ‘বাংলাদেশ’ নামকরণই হবে সঠিক এবং যথার্থ। তিনিও যুক্তি দেন যে, যেহেতু এক ইউনিট ভেঙে গেছে, তাই ‘বাংলাদেশ’ নামটি পুনরুজ্জীবিত হওয়া উচিত। সেই থেকে নথিপত্রগুলোয় ‘পূর্ব পাকিস্তান’ লিখতে হলেও কেউ মুখে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ উচ্চারণ করতেন না। সবাই বলতেন ‘বাংলাদেশ’।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা ঘোষণায়ও ‘বাংলাদেশ’ নামটি ব্যবহৃত হয়। বঙ্গবন্ধুর ইপিআর-এর বেতার বার্তা এবং পরবর্তীতে কালুরঘাট থেকে প্রচারিত স্বাধীনতার ঘোষণায়ও স্বাধীন দেশের নাম ‘বাংলাদেশ’-ই উল্লেখ করা হয়। পরবর্তীতে মুজিবনগর সরকার স্বাধীনতার যে ঘোষণা প্রচার করে, তাতেও বলা হয় এই দেশটির নাম হলো ‘বাংলাদেশ’।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয় ও বিজয় লাভ করে। এরপর ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর যখন প্রথম সংবিধান প্রণীত ও গৃহীত হয় সেই সময়ও দেশটির সাংবিধানিক নাম দেয়া হয় ‘বাংলাদেশ’।
তবে ‘বাংলাদেশ’ নাম নিয়ে বিরোধিতাও কিন্তু কম হয়নি। ১৯৬৯ সালে বাঙালি রাজনীতিকেরা যখন ‘বাংলাদেশ’ নামকরণের দাবিতে সোচ্চার হয়েছিলেন, তখন জামায়াত-ই-ইসলামী এর বিরোধিতা করেছিল। ১৯৬৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকার তৎকালীন মার্কিন কনস্যুলেট ওয়াশিংটনকে একটি এয়ারগ্রাম বার্তায় জামায়াতের এই ‘বাংলাদেশ’ নামকরণ বিরোধিতার তথ্য জানিয়েছিল। মার্কিন কনস্যুলেটের ভাষ্যমতে, শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা ভাসানী, আতাউর রহমান খান প্রমুখ বাঙালি রাজনীতিক সমস্বরে ‘বাংলাদেশ’ নামকরণের দাবি তুলেছেন। আর জামায়াত বাঙালি রাজনীতিকদের প্রতি ইঙ্গিত করে উর্দুর পরিবর্তে বাংলা ভাষা প্রচলনে তাঁদের ভূমিকার সমালোচনা করেছে।
এছাড়া আতাউর রহমান খান যে ‘পাকিস্তান অবজার্ভার’ পত্রিকায় ‘বাংলাদেশ’ নামকরণের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছিলেন, সেখানেই ১৫ ডিসেম্বর জামায়াতের ‘বাংলাদেশ’ ও বাংলা ভাষাবিরোধী একটি বিবৃতি ছাপা হয়। সেখানে সাবেক এমপিএ এবং তৎকালীন করাচি জামায়াত-ই-ইসলামীর যুগ্ম সম্পাদক মাহমুদ আজম ফারুকী অভিযোগ করেন যে, ‘বাংলাদেশ’ নামকরণের দাবি পাকিস্তানের অখণ্ডতা এবং সংহতির প্রতি হুমকি এবং এর মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদের অদেশপ্রেমিক সুর নিহিত। জামায়াতের নেতা ফারুকী আরও যুক্তি দেন,
“অতীতে বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ‘ভাষার প্রশ্ন’ তুলেছিলেন। তাঁরা উর্দুর বিরোধিতা করেছিলেন। অথচ জাতীয় ভাষা হিসেবে উর্দু ‘সর্বসম্মতিক্রমে’ গৃহীত হয়েছিল। ওই নেতাদের ভূমিকার কারণে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বিভেদ আরও বিস্তৃত হয়েছে।”
বলাই বাহুল্য, ‘বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ’ বলতে তিনি পূর্ব পাকিস্তানীদেরই বুঝিয়েছিলেন, এবং সে কথা নির্দিষ্টভাবে মার্কিন কনস্যুলেটও ওয়াশিংটনকে অবহিত করেছিল।
আরো একটি দুঃখজনক ব্যাপার হলো, বাংলাদেশ সেই ১৯৭১ সালেই স্বাধীন হলেও, দেশের সব সীমান্ত পিলার থেকে পাকিস্তানের নাম সরাতে ৪৮ বছর সময় লেগেছে।
উল্লেখ্য, ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর ভারত ও তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান সীমান্তে ৮ হাজারের বেশি পিলারে ‘ভারত-পাকিস্তান’ শব্দ দুটি লেখা হয়েছিল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও দেশের সাতক্ষীরা, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, জামালপুর, সুনামগঞ্জ, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা এবং চট্টগ্রামে ভারতের সঙ্গে পিলারগুলোতে ‘পাকিস্তান’ শব্দটি থেকে যায়। অবশেষে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে, পিলারগুলো থেকে ‘পাকিস্তান’ শব্দটি তুলে সেখানে ‘বাংলাদেশ’ নামটি বসানোর কথা এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানায় বিজিবি।
ইতিহাসের চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কেঃ roar.media/contribute/
বাংলাদেশের ইতিহাস সম্পর্কে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইগুলোঃ