প্রাচীন গ্রীক শহর স্পার্টার মানুষগুলো এমন এক সামাজিক শ্রেণী স্তরে বিভক্ত ছিল, যা শহরটিকে আশপাশের বহু শহরের চেয়ে আলাদা হিসেবে তুলে ধরেছিল। সামাজিক এই শ্রেণী বিভক্তির একেবারে উপরে ছিলেন দুজন রাজা, যাদের অভিজ্ঞ কাউন্সিল হতে মনোনীত করা হতো। অভিজ্ঞদের এই কাউন্সিল শহরের অভিজাত স্পার্টিয়াটসদের দ্বারা গঠিত হয়েছিল, যারা শহরের সবচেয়ে প্রবীণ হিসেবে সম্মানিত। এই কাউন্সিল মূলত রাজাদের ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করত, যাতে শহরের শৃঙ্খলা বজায় থাকে।
অভিজাত স্পার্টিয়াটসদের পরের সম্মানিত শ্রেণী হলো পেরিওসি, এরা হলেন স্পার্টার মধ্যবিত্ত শ্রেণী। এর বাইরে আরও এক শ্রেণীর লোক বাস করত যারা ‘হেলটস’ নামে পরিচিত। এদের সমাজের সবচেয়ে নিচু স্তরের হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু জনসংখ্যার দিক থেকে এরাই সবচেয়ে বেশি ছিল!
গ্রীক ভূগোলবিদ পাউসেনিয়াসের মতে, “হেলটসরা হেলোস নামক এক অঞ্চল থেকে এসেছে, যাদের উপর স্পার্টানরা প্রভাব খাটাতে শুরু করে। একসময় স্পার্টানরা হেলটসদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয় , সে যুদ্ধে হেলটসরা পরাজিত হয়। পরাজিত হওয়ার পর সবাইকে স্পার্টানদের দাস হওয়ার শর্তে জীবন ভিক্ষা দেওয়া হয়।”
গ্রীক ইতিহাসবিদ থুসিডিডাস অবশ্য হেলটসদের উৎপত্তি নিয়ে ভিন্ন মতামত দিয়েছেন। তার মতে,
“হেলটসরা মেসেনীয়দের বংশধর ছিল এবং খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীতে স্পার্টানরা তাদের উপর আক্রমণ করে। এরপর থেকেই হেলটসরা স্পার্টানদের দাসে পরিণত হয়।”
স্ট্র্যাবোর জিওগ্রাফিতে আরও একটি বর্ণনা পাওয়া যায়। যেখানে দাবি করা হয়, স্পার্টানরা শুরুতেই কাউকে দাস বানায়নি। বরং সবাই সাধারণ নাগরিক হিসেবেই স্পার্টায় বসবাসের সুযোগ পান। শহরের সবাই তখন সমান সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত। কিন্তু রাজা আগিস আইয়ের রাজত্বকালে তিনি রাজ্যের মানুষদের সকল অধিকার তুলে নেন। বিনিময়ে তাদের রাজ্যের প্রজা হিসেবে অভিহিত করেন। এই ঘটনা সবাই নীরবে মেনে নিলেও হেলটসরা এমন অপমান মেনে নিতে রাজি ছিল না। তারা বিদ্রোহ করে বসে এবং রাজার সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু তারা রাজকীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে নির্মমভাবে পরাজিত হয়, রাজার শর্ত মেনে নেওয়ার পর তাদের মুক্তি দেওয়া হয়। এভাবেই মূলত হেলটসরা সম্মানিত এক জাতি থেকে দাসে পরিণত হয়।
হেলটসরা দাসে পরিণত হলেও গ্রীকদের অন্যান্য শহরের দাসদের থেকে তারা অনেক ভিন্ন ছিল। যেখানে দাস মানে পরিচয়-পরিবারহীন একজন মানুষকে বোঝায়, সেখানে তারা নিজের পরিবার এবং পরিচয় নিয়ে বাস করত। যদিও তাদের নিজস্ব জমি-জমা ছিল না, কিন্তু তারা রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে পরিচয় লাভ করেছিল।
স্ট্র্যাবো আরও যোগ করেন, হেলটসরা স্বাধীনচেতা হওয়াতেই রাজার চোখে উদ্ধত হিসেবে পরিচিত হয়। কিন্তু নতি স্বীকার করে নেওয়ার পর তারাও অন্য দাসদের মতো সকল পরিসেবা পেতে থাকে। একজন আদর্শ নাগরিক হওয়ার চেয়ে তাদের প্রজা হিসেবেই দেখতে চেয়েছিলেন রাজা। তাই প্রজাদের মৌখিক স্বীকৃতি অনেক দরকারি ছিল, যাতে তারা রাজ্যে ঝামেলার কারণ না হয়ে দাঁড়ায়।
স্পার্টার পুরুষরা খেলাধুলা , সামরিক প্রশিক্ষণ, যুদ্ধ, রাজনীতির মতো ব্যাপারগুলো নিয়ে সবসময় ব্যস্ত থাকত। তাই এগুলোর বাইরে অন্য কিছুতে মনোযোগ দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। বিশেষ করে কৃষিকাজে তারা কখনো সময় দিতে পারত না। তাই কৃষিকাজে হেলটসরা বেশি বেশি নিয়োগ পেতে লাগল। বাড়ি তৈরি, স্পার্টা যোদ্ধাদের অস্ত্র আনা-নেওয়া, সেগুলো পরিষ্কার রাখার পাশাপাশি তারা অন্যদের ব্যক্তিগত কাজ করেও জীবিকা নির্বাহ করত। যুদ্ধের সময় এলে হেলটসদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো যাতে তারা শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়তে পারে। এভাবেই তাদের জীবনচক্র আবর্তিত হতো।
গ্রীক ইতিহাসবিদ হেরাডোটাস উল্লেখ করেন, খ্রিস্টপূর্ব ৪৭৯ সালে প্লাটিয়ার যুদ্ধে হেলটসরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল। সেই যুদ্ধে প্রায় ৩৫,০০০ হেলটস সৈনিক হিসেবে স্পার্টানদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। তাদের মূল দায়িত্ব ছিল নিজ শিবিরের তাঁবুগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সেই সঙ্গে শত্রুর গতিবিধির দিকে নজর রাখা। যাতে যুদ্ধের প্রথম প্রহরেই স্পার্টা যোদ্ধারা বিজয়কে নিজেদের অনুকূলে নিয়ে আসতে পারে। তাছাড়া হেলটসদের সামনের সারিতেও রাখা হত অনেক সময়, যাতে স্পার্টার মূল বাহিনী কিছু বাড়তি সময় নিতে পারে।
যুদ্ধ বাদেও হেলটসরা সমাজের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল, যেহেতু তারা কৃষিকাজসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজে অবদান রাখছিল, যেসব কাজ সমাজের উঁচুরা কখনো করার কথা ভাবত না। তারপরও সমাজের উঁচু শ্রেণীর লোকজনদের সঙ্গে তাদের সুসম্পর্ক বজায় ছিল না। কারণ উঁচু শ্রেণীর মানুষগুলো তাদের খুব একটা ভালো চোখে দেখত না। তাছাড়া হেলটসরা সংখ্যায় এত বেড়ে গিয়েছিল যে, রাজার নিয়োগকৃত অঞ্চলকেন্দ্রিক নেতারা তাদের সামলে রাখতে হিমশিম খেত।
সংখ্যাধিক্যের কারণে তারা যেকোনো সময় বিদ্রোহ করে বসারও সম্ভাবনা ছিল। তারপর গ্রীকদের সম্ভাবনা সত্যি হিসেবে প্রমাণিত হয়। হেলটদের এই বিদ্রোহটি খ্রিস্টপূর্ব ৬৬৫ সালের দিকে সংগঠিত হয়েছিল এবং এই বিদ্রোহ দ্বিতীয় মেসেনিয়ান যুদ্ধ হিসেবেও পরিচিত। এরই ঠিক ৪০ বছর আগে প্রথম মেসেনিয়ান যুদ্ধটি সংগঠিত হয়েছিল। স্পার্টা এবং আরগোসের মধ্যে চলমান হিসিয়ের যুদ্ধে স্পার্টা পরাজয় বরং করে। এতে স্পার্টা দুর্বল হয়ে পড়লে হেলটরা স্পার্টার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে, যে বিদ্রোহটি দমন করতে স্পার্টার প্রায় ২০ বছর সময় লেগেছিল।
হেলটসদের কয়েকটি বিদ্রোহ
হেলটসদের বিদ্রোহের ইতিহাস বেশ পুরনো। তাদের বেশিরভাগ কাজই ছিল চোরাগোপ্তা হামলা, পাশাপাশি বাণিজ্যিক কাফেলার উপর আক্রমণ করে লুট করত তারা। এগুলো প্রথমদিককার কর্মকান্ড হলেও একসময় তারা সংগঠিত হয় এবং শক্তিশালী বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেয়।
পোসেনিয়ান প্লট
ইতিহাস থেকে জানা যায়, সর্বপ্রথম হেলটসরা যে বিদ্রোহ করেছিল সেটা পোসেনিয়ান বিদ্রোহ হিসেবে পরিচিত। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে পোসেনিয়ার জনগণের উস্কানিতে হেলটসরা বিদ্রোহ করে বসে। রাজা সেই সময় হেলটসদের সঙ্গে আলোচনা করতে সম্মত হন এবং তাদের বৈধ নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। বিনিময়ে তিনি হেলটদের সমর্থন চান তার রাষ্ট্রীয় কাজে। তাদের জন্য এই প্রস্তাব খুবই লোভনীয় ছিল। তাই তারা এটাকে ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখতে শুরু করলেও একসময় শান্ত হয়ে আসে সবাই।
মেসেনিয়ান যুদ্ধ
খ্রিস্টপূর্ব ৪৬৪ সালে স্পার্টায় বিশাল এক ভূমিকম্প হয়, যার সুযোগ নিয়ে হেলটসরা বিদ্রোহ শুরু করেছিল। বহু ঐতিহাসিকের মতে, দুটো ঘটনার সঙ্গে যোগসূত্র কেবলই কাকতালীয়। কিন্তু গ্রিককেন্দ্রিক ইতিহাসবিদরা এই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেন।
থুসিডিডাসের মতে, থোরিয়া এবং আইথাইয়ার হেলটসরা ভূমিকম্পের সুযোগে পেরিওসি দখলের চিন্তা করছিল। আর এই বিদ্রোহে যোগ দেওয়া বেশিরভাগই মেসেনিয়ান বংশের ছিল। মূল হেলটস জাতি তখনো সংখ্যালঘু ছিল এই অঞ্চলে। তাই স্পার্টা যখন কাঁপছিল, ইউরোটাস নদীর এপারে দাঁড়িয়ে হেলোটসরা স্পার্টা দখল করে নেওয়ার স্বপ্ন দেখছিল। কারণ তাদের মনে হয়েছিল এই দুর্যোগের সময় তারা নিরস্ত্র থাকবে। কিন্তু তাদের ভুল প্রমাণ করে দিয়ে স্পার্টা হাতে অস্ত্র তুলে নিলে হেলটসরা পালিয়ে যায়। যুদ্ধে কেবল মেসেনিয়ানরাই এগিয়ে গিয়েছিল, যা ব্যর্থ হয়ে যায়। কিন্তু জাতি হিসেবে হেলটসদের সীমাবদ্ধতা তারা নিজ চোখে দেখতে পায়। সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে তাদের পিছিয়ে যেতে হয়েছিল। তারাই আবার সংখ্যায় একসময় স্পার্টাসহ অন্য সবাইকে ছাড়িয়ে যায়।
এছাড়াও বেশ কয়েকটি যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল স্পার্টা এবং হেলটসদের মাঝে। বছরের পর বছর ধরে চলমান এসব যুদ্ধের কোনো আনুষ্ঠানিক বিজয় পায়নি হেলটসরা। কখনো নিজেদের এলাকাগুলো সাময়িক নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছিল, কখনো বা গ্রিক কর্তারা তাদের শান্ত রাখতে বিভিন্ন চুক্তির আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু হেলটসরা কখনো চূড়ান্ত বিজয়ের স্বাদ লাভ করতে পারেনি।
ইতিহাসের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/