Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

এক রোহিঙ্গা স্কুলশিক্ষক এবং তার গণহত্যার ডায়েরি (৭ম পর্ব)

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থীর মধ্যে একজন ফুতু। তার এবং তার পরিবারের করুণ কাহিনী উঠে এসেছে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিনের Sarah A. Topol-এর The Schoolteacher and the Genocide শিরোনামের একটি সুদীর্ঘ আর্টিকেলে। আমাদের এই সিরিজটি সেই আর্টিকেলেরই অনুবাদ। এটি হচ্ছে সিরিজের সপ্তম পর্ব

সবগুলো পর্ব: ১ম পর্ব | ২য় পর্ব | ৩য় পর্ব | ৪র্থ পর্ব | ৫ম পর্ব | ৬ষ্ঠ পর্ব | ৭ম পর্ব | ৮ম পর্ব | ৯ম পর্ব | ১০ম পর্ব

নিউ ইয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিনে ফুতুকে নিয়ে লেখা আর্টিকেলটি; Image Source: Twitter

(আগের পর্বের পর থেকে)… গণগ্রেপ্তারের পরের দিনগুলোতে যারা পাহাড়ের উপর পালিয়ে গিয়েছিল, তারা আবার দুনসে পাড়ায় ফিরে আসতে শুরু করে। যারা ধানক্ষেতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল, তারাও রাতের অন্ধকারে ফিরে আসে। শেষপর্যন্ত গ্রামবাসীরা মোট ১০ জনকে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়, যাদেরকে আটক করার পর বিজিপি আর ছাড়েনি। এদের মধ্যে বিদেশি প্রতিনিধিদলের জন্য অনুবাদ করা দ্বিতীয় অনুবাদকও ছিলেন। এই লোকগুলোকে কোথায় আটকে রাখা হয়েছে কিংবা তাদের উপর নির্যাতন করা হচ্ছে কিনা, তার খোঁজেই তাদের আত্মীয়-স্বজনদের পরবর্তী দিনগুলো কেটে যেতে থাকে।

দুনসে পাড়ার অধিবাসীদের ছোট পৃথিবী দিনে দিনে আরো সঙ্কুচিত হয়ে আসছিল। বিধিনিষেধগুলো তখনো বলবৎ ছিল। পুরুষরা পাহাড় থেকে কাঠ কাটতে কিংবা সমুদ্র থেকে মাছ ধরতে পারত না। অথচ তাদের পরিবারের জন্য খাবার দরকার ছিল, বিয়ের জন্য ফি পরিশোধ করা বাকি ছিল, দুই শিশু আইনের অতিরিক্ত সন্তানের নিবন্ধনের জন্য ঘুষ দিতে হচ্ছিল। মরিয়া হয়ে কেউ কেউ কাঠের টুকরা সংগ্রহের জন্য লুকিয়ে পাহাড়ে উঠে যেতে শুরু করে। অন্যরা নৌকা বা জাল দিয়ে মাছ ধরা নিষিদ্ধ বলে নিজেদের শরীরের সাথেই প্লাস্টিকের ব্যাগ বেঁধে সমুদ্রের দিকে ছুটে যেতে থাকে।

২০১৬ সালের ৯ অক্টোবরের হামলার পর থেকে আরসার শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছিল। তারা স্থানীয় নেতৃবৃন্দ, বিশেষ করে ইমামদের নেতৃত্বে কয়েক ডজন গ্রামে গোপন সেল প্রতিষ্ঠা করে। তারা অর্থ ও অধিকারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে হতাশাগ্রস্ত যুবকদেরকে দলে টেনে নেয়। কিন্তু একইসাথে তাদের আরেকটি বিপজ্জনক দিকও প্রকাশ পেতে থাকে। তারা রোহিঙ্গাদেরকেও টার্গেট করতে শুরু করে এই সন্দেহে যে, তারা বিজিপির গুপ্তচর। তারা এক ডজনেরও বেশি গ্রামের প্রধান এবং অন্যান্য স্থানীয় প্রশাসকদেরকে হত্যা করে।

ফয়েজ উল্লাহর উপর চারদিক থেকে চাপ আসছিল। তিনি যদি আরসার কথা রিপোর্ট করেন, তাহলে তাকে শত্রুপক্ষের সাথে সহযোগিতার অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। অন্যদিকে সামরিক বাহিনী তাকে আরসা সম্পর্কিত তথ্যের জন্য চাপ দিচ্ছিল, যদিও তার কাছে আসলে দেওয়ার মতো কোনো তথ্য ছিল না। গ্রামবাসীরা কসম কেটে বলেছিল, তারা কখনোই সত্যিকারের কোনো আরসা সদস্যকে কাছ থেকে দেখেনি বা তাদের কথা শোনেনি। কিন্তু কে জানে পাহাড়ের উপর কী ঘটছে, যেখানে তাদের আইনগতভাবে যাওয়ারই অনুমতি নেই।

গ্রাম অবরুদ্ধ হওয়ার পর থেকেই স্কুল বন্ধ ছিল। পড়ানোর মতো কোনো ছাত্র না থাকায় ফুতু নিজেই বইগুলো নেড়েচেড়ে দেখছিলেন। তিনি সংবাদপত্র পড়ে এবং রেডিও শুনে সময় কাটাচ্ছিলেন, কিন্তু ধীরে ধীরে তিনি অধৈর্য হয়ে উঠতে শুরু করেছিলেন। ছাত্রছাত্রীরা তাদের রাখাইন সহপাঠীদের চেয়ে পেছনে পড়ে যাচ্ছিল। তিনি গ্রামের লোকদেরকে বলাবলি করতে শুনছিলেন, স্কুল যদি আবার চালু হয়, তবুও তারা তাদের বাচ্চাদেরকে সেখানে ফেরত পাঠাবেন না। মিডল স্কুলটির অবস্থান চেইন খার লি গ্রামে, দুনসে পাড়ার চেকপোস্ট পেরিয়ে আরও প্রায় এক ঘণ্টার হাঁটা পথ দূরে। অভিভাবকরা তাদের সন্তানদেরকে অফিসারদের কাছাকাছি কোথাও যেতে দিতে ইচ্ছুক ছিলেন না।

একদিন ফুতু দেখতে পেলেন, গ্রামে অভিযানের সময় অফিসারদের দ্বারা তোলা একটি ভিডিও ফেসবুকে পোস্ট করা হয়েছে। ঘটনাটি ‘তদন্ত’ করার জন্য একটি কমিশন দুনসে পাড়ায় আসে। পরে গ্রামবাসীরা জানতে পারে, কয়েকজন অফিসারকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এদের মধ্যে ফুতুর পরিচিত একজন অফিসারও ছিল।

এটা ছিল সেই বিরল ঘটনাগুলোর মধ্যে একটা, যেখানে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের জন্য সামরিক বাহিনী বা পুলিশ নিজেদের কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও গ্রামে কিছুই বদলায়নি। ঐ রাতে আটককৃত লোকেরা তখনো নিখোঁজ ছিল। গ্রামবাসীরা জানতে পারে, তাদের মধ্যে একজন পুলিশের হেফাজতে থাকা অবস্থায় মারা গেছে।

গ্রীষ্মকাল এসে পড়লেও আইয়ুব তখনো ছাড়া পাননি। তার পরিবার একজন আইনজীবী রেখেছিল। তিনি তাদেরকে জানান, পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে ৩০ আগস্টের মধ্যে তিনি তাকে মুক্ত করতে পারবেন, কিন্তু তাদেরকে ধৈর্য ধরতে হবে।

ফুতু বসন্তকালটি পার করেন প্রাইমারি স্কুল পুনর্নির্মাণের উপর মনোনিবেশ করে। তারা সমস্ত উপকরণ জোগাড় করে ফেলেছিলেন এবং ২০১৭ সালের আগস্টের মধ্যে নতুন ছাদের কাজ প্রায় শেষ করে এনেছিলেন। কিন্তু ঠিক এমন সময় তাদের জীবন আবার ওলট-পালট হয়ে যায়।

Children barely survived the grueling trek, coping with hunger,  exhaustion, and extreme weather— conditions even adults could hardly bear.
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জীবন; Image Source: Himaloy Joseph Mree

২৫ আগস্ট গভীর রাতে দুনসে পাড়া এবং চেইন খার লি গ্রামের অধিবাসীরা প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দে একত্রে ঘুম থেকে জেগে ওঠে। চারপাশ থেকে এত বেশি আওয়াজ আসছিল, মনে হচ্ছিল যেন মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। সেদিন রাতে ফুতু চেইন খার লি গ্রামে স্কুলের ছাত্রাবাসে ঘুমাচ্ছিলেন। তার স্ত্রী, যিনি কয়দিন আগেই তাদের দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন, ফুতুর ভাইকে বললেন ফোন করে ফুতুর খোঁজ নেওয়ার জন্য। কিন্তু ফোনের নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছিল না। গোলাগুলির আওয়াজ চেইন খার লির দিক থেকেই আসছিল, ফলে তারা ফুতুর জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে উঠতে শুরু করেন।

গ্রামের লোকেরা ফয়েজ উল্লাহকে দেখতে গিয়েছিল, কিন্তু তিনি বুঝতে পারছিলেন না তাদের কী করা উচিত। যদিও পাশের গ্রামে গোলাগুলি চলছিল, কিন্তু তারা নিজেদেরকেই প্রবোধ দিচ্ছিল, সামরিক বাহিনী হয়তো দুনসে পাড়ায় নাও আসতে পারে। “আমরা নিরীহ মানুষ,” তারা নিজেরাই পুনরাবৃত্তি করছিল।

চেইন খার লি গ্রামে ফুতু যখন গোলাগুলির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে জেগে ওঠেন, তখন তার কেবল পরিবারের কথাই মনে পড়ছিল। তার এক বন্ধু তাকে চুপ করে বসে থাকতে বলল, কারণ এই গোলাগুলির মধ্যে রাস্তায় বেরোলেই বিপদ হতে পারে। সময় গড়াতে থাকে, কিন্তু বুলেটের বৃষ্টি আগের মতোই অবিরাম ঝরতে থাকে। তারপরেও ভোরের দিকে ফুতু ঝুঁকি নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

ভোরের আলোয় তিনি প্রধান সড়কের উপর নিরাপত্তাবাহিনীকে গোলাগুলিরত অবস্থায় দেখতে পাচ্ছিলেন। তার উত্তরে, সমুদ্রসৈকত ছিল শান্ত, ঢেউগুলো তীরের কোলে আছড়ে পড়ছিল। ফুতু দৌড়াতে শুরু করলেন। যখন তিনি বাড়িতে এসে  পৌঁছলেন, ততক্ষণে তার বাড়ি খালি হয়ে গেছে। ফুতু সবসময়ই দ্রুত এবং সুশৃঙ্খলভাবে চিন্তা করতে পারতেন, কিন্তু ঘর খালি দেখে তিনি ভেঙে পড়লেন। রাজ্যের বিক্ষিপ্ত চিন্তাভাবনা এসে ঘিরে ধরল তাকে: “কীভাবে আমি আমার পরিবারকে খুঁজে বের করব? আমি এখন কী করব? কীভাবে আমি নিজেকে রক্ষা করব?”

ফুতু বড় গ্রামের দিকে ছুটে গেলেন। তিনি আশা করছিলেন, তার পরিবার হয়তো সেখানে তার শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে উঠতে পারে। সেখানে পৌঁছে তিনি অপরিচিত এক মহিলাকে সেই বাড়িতে আশ্রিত অবস্থায় দেখতে পেলেন। কিন্তু মহিলাটি তার স্ত্রী বা তার শ্বশুর-শাশুড়ি কাউকেই দেখেনি।

বুলেট বৃষ্টির সাথে ধীরে ধীরে বজ্রপাতের মতো ভারী অস্ত্র এবং বিস্ফোরণের আওয়াজ যুক্ত হচ্ছিল। ফুতু বাড়ি বাড়ি গিয়ে তার পরিবারের কথা জিজ্ঞেস করতে থাকেন। গ্রামের প্রধান মসজিদে তিনি একদল লোককে পরিকল্পনা করতে দেখতে পেলেন: “যাদের ছোট বাচ্চা আছে তারা পাহাড়ে দিকে চলে যাবে, আর যারা বয়স্ক তারা গ্রামেই থাকবে।” সেখানে কয়েকজন ফুতুকে তার খালার বাড়িতে খোঁজ নিতে বলল। তাদের ধারণা ফুতুর পরিবারকে তারা সেদিকে যেতে দেখেছে।

শেষপর্যন্ত খালার বাড়িতে গিয়ে ফুতু যখন তার বাবা, মা, স্ত্রী এবং শিশুদের সবাইকে একসাথে নিরাপদে দেখতে পান, তখন এক মুহূর্তের জন্য স্বস্তির একটি অনুভূতি ঘিরে ধরে তাকে। সেদিন সকালেই তার পরিবার সেখানে পালিয়ে এসেছিল, কিন্তু তারা বুঝতে পারছিল না কীভাবে ফুতুর সাথে যোগাযোগ করে তাকে সংবাদ পাঠাবে। ফুতু তার বাবাকে রাস্তায় দেখা ঘটনাগুলোর বর্ণনা দিতে শুরু করেন।

“আমাদের এখন কী করা উচিত?” তার বাবা জিজ্ঞেস করলেন।

“আমাদের অন্য কিছু করার সুযোগ নেই।” ফুতু সিদ্ধান্ত নিলেন। “আমরা এলাকার মানুষদেরকেই অনুসরণ করব।”

রোহিঙ্গা শরণার্থী; Image: Time

পাহাড়ে যাওয়ার রাস্তাটি এক জায়গায় প্রধান সড়কের সাথে মিলিত হয়েছিল, যার উপর সামরিকবাহিনীর ট্রাকগুলো অবস্থান করছিল। যদিও ট্রাকগুলো চেইন খার লির বাইরে নিশ্চল অবস্থায় বসেছিল, কিন্তু যেকোনো মুহূর্তে সেগুলো এদিকে যাত্রা শুরু করতে পারত। ফুতু এবং তার পরিবার দ্রুত যাত্রা শুরু করার সিদ্ধান্ত নিলো। তারা শুধু আশা করছিল ট্রাকগুলো যেন জীবন্ত হয়ে না ওঠে।

যাত্রা শুরু করার পর প্রথমে ফুতুদের পরিবারের সদস্যরা পাশাপাশি থাকার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু দুই বাচ্চার ভারে তরুণ দম্পতিটির গতি শ্লথ হয়ে আসছিল। ফুতুর স্ত্রী বহন করছিল একেবারে ছোট ছেলেটিকে, আর ফুতুর কোলে ছিল আরেকটু বড়টি।

শতশত মানুষ বর্ষার পানিতে পিচ্ছিল হয়ে থাকা পাথুরে পাহাড়ের উপর দিয়ে ধাক্কাধাক্কি করে এগোনোর চেষ্টা করছিল। কিছুক্ষণ যাওয়ার পরেই ভিড়ের মধ্যে ফুতুদের পরিবারের সদস্যরা একে অন্যের থেকে আলাদা হয়ে গেল। ফুতুর স্যান্ডেল মাটিতে আটকে গেল। তিনি সেগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। জামাকাপড় বলতে তার কাছে ছিল শুধু একটি লাল টি-শার্ট, একটি ট্রাউজার এবং একটি রেইনকোট।

পাহাড়ের উপরে উঠার জন্য পরিবারগুলো একে অন্যের সাথে লড়াই করেছিল। যে যেভাবে পারছিল, শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ব্যবহার করে মাটি আঁকড়ে ধরে এরপর নিজেকে উপরের দিকে ঠেলে দিচ্ছিল এগিয়ে যাওয়ার জন্য। অবশেষে যখন তাদের ঊর্ধ্বযাত্রা শেষ হলো, তখন তারা নিচে অবস্থিত গ্রামগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করল। সেখানে চেইন খার লির আকাশজুড়ে ধোঁয়ার কুণ্ডলী এবং লোহিত শিখা একসাথে নাচানাচি করছিল, আর নিচে মাটিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে ছিল মানুষের মৃতদেহ ।

দুনসে পাড়াকে জনশূন্য বলে মনে হচ্ছিল। কয়েকজন যুবক সাহস করে খাবারের সন্ধানে চেইন খার লির দিকে যাত্রা করল। তারা ফিরে এলো পোড়া চাল এবং পোড়া লাশের গল্প নিয়ে। অন্ধকার ঘনিয়ে এলো। ফুতু এবং তার পরিবার পাহাড়ের উপরেই রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলো। সেখানে পাহাড়ের একটি খাঁজের নিচে প্রায় দুই ডজন মানুষের সাথে তারা আশ্রয় নিলো।

পরদিন সকালে কুয়াশার মতো শান্ত, অপ্রাকৃত এবং স্বর্গীয় একটি পরিবেশ বিরাজ করছিল। দুনসে পাড়ায় ফয়েজ উল্লাহ তখনো আশাবাদী ছিলেন, সামরিক বাহিনী হয়তো সেখানে আসবে না। একদিন কেটে গেল, তারপর দুদিন। ধীরে ধীরে পাহাড়ে আত্মগোপন করা মানুষগুলো ফিরে আসতে শুরু করল। তাদের গ্রামটি হয়তো এবার বেঁচে গেছে।

ফুতু এবং তার পরিবার প্রথমে বোশোরা নামে অন্য একটি গ্রামে গিয়ে সেখানে দুই রাত কাটাল। তারা দোয়া করছিল এই দুর্দিন যেন শেষ হয়ে যায়। তারা কয়েকটি হাঁড়ি, শুকনো মাংস এবং বড় একটি তেরপল জোগাড় করে রেখেছিল, যদি আবার তাদেরকে পালাতে হয় তার প্রস্তুতি হিসেবে।

২৮ আগস্ট ভোরবেলা নিরাপত্তাবাহিনী গুলি চালাতে চালাতে দুনসে পাড়া এবং বোশোরায় প্রবেশ করল। গ্রামবাসীরা হঠাৎ করেই বুঝতে পারল, তারা কখনোই নিরাপদ ছিল না। ফুতু এবং তার পরিবার আবারও পালাতে শুরু করল। তারা তাদের পেছন থেকে বিস্ফোরণের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিল। তারা আবারও পাহাড় বেয়ে উঁচু থেকে উঁচুতে উঠে গাছের নিচে আশ্রয় নিলো।

দুনসে পাড়ায় তখনও যারা রয়ে গিয়েছিল, সামরিকবাহিনী প্রবেশ করার পর তারাও একই পথ ধরে পালাতে শুরু করলো। ফয়েজ উল্লাহর পরিবার তাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। তারা যখন দৌড়াচ্ছিল, তখন একটি গুলি এসে পেছন থেকে ফয়েজ উল্লাহর শরীর ভেদ করে চলে গেল। তিনি খুন হলেন তাদের হাতে, যাদেরকে তিনি সন্তুষ্ট করতে চেষ্টা করছিলেন। তিনি মারা গেলেন তাদের সামনে, যাদেরকে তিনি আশ্বস্ত করতে চেষ্টা করছিলেন।

পরিস্থিতি এতই বিশৃঙ্খলাময় ছিল, এতই আকস্মিক ছিল যে, মায়েরা তাদের সন্তানদেরকে ছেড়ে দিয়েছিল। বয়স্ক দাদা-দাদীরা, যারা দৌড়াতে পারছিল না, তাদেরকে ছেড়ে তারা নিজেরা পালাতে শুরু করেছিল। পেছনে ফেলে যাওয়া এই মানুষগুলো পুড়ে মারা গিয়েছিল তাদের নিজেদের হাতে নির্মিত বাড়িগুলোর ভেতরেই। এক মায়ের মৃতদেহের সন্ধান মিলেছিল নৌকার ভেতর, যাকে সেখান পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তার লাশ পুড়ে কয়লা হয়ে গিয়েছিল, এরপরও সেটিকে টুকরো টুকরো করে কাটা হয়েছিল।

পাহাড়ের উপর থেকে ফুতু তার পৃথিবীকে ছাই হয়ে যেতে দেখলেন, ঠিক যেমন নিরাপত্তাবাহিনীর অফিসাররা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল। ফুতু নিচে আধ ডজনের মতো গ্রাম দেখতে পাচ্ছিলেন। সবগুলো গ্রাম ছিল উজ্জ্বল লোহিত শিখার উপরে ঘন কালো ধোঁয়ার আস্তরণ দ্বারা আবৃত।

ফুতুর মনে পড়ল তার স্কুলটির কথা, যে স্কুলটি তিনি নিজ হাতে তৈরি করেছিলেন; তার বই এবং সংবাদপত্রগুলোর কথা, যেগুলো তিনি পড়েছিলেন এবং সংগ্রহ করেছিলেন; তার ডায়েরিগুলোর কথা, যেগুলো তিনি লিখেছিলেন। তার মনে পড়ল তার সংগৃহীত জ্ঞান, গল্প এবং প্রমাণগুলোর কথা, যেগুলো তিনি যত্নের সাথে তিলে তিলে জড়ো করেছিলেন এই বিশ্বাসে যে, সেগুলো টিকে থাকবে তার মৃত্যুর পরেও; তিনি নিখোঁজ হলেও কিংবা তাকে গুলি করে হত্যা করা হলেও।

পরবর্তী পর্ব পড়ুন এখান থেকে

সবগুলো পর্ব: ১ম পর্ব | ২য় পর্ব | ৩য় পর্ব | ৪র্থ পর্ব | ৫ম পর্ব | ৬ষ্ঠ পর্ব | ৭ম পর্ব | ৮ম পর্ব | ৯ম পর্ব | ১০ম পর্ব

This article is in Bangla language. It's a translation of the article "The Schoolteacher and the Genocide" by Sarah A. Topol, published in The New York Times Magazine.

Featured Image: New York Times

RB-SM

Related Articles