সংবাদ সম্মেলন তখন প্রায় শেষ পর্যায়ে। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে প্রশ্ন করা হলো, টেস্টে আফগানিস্তান একদম নতুন একটি দল। তবুও যে মানসিকতা নিয়ে খেলল, তাতে ওদের কাছ থেকে আমাদের কিছু শেখার আছে কি না?
বেশ দৃঢ় কণ্ঠেই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন মাহমুদউল্লাহ। তবে তার উত্তর শুনে ঠিক ‘চক্ষু চড়ক গাছ’ না হলেও সংবাদ সম্মেলন কক্ষের সবাই যেন একটু নড়েচড়ে উঠলেন। একটা দম্ভধ্বনি অনুরণিত হয়েছে তার উত্তরের মধ্য দিয়ে। অথচ গোটা ক্রিকেট বিশ্বে চাউর হয়ে গেছে, সেপ্টেম্বর মাসে হোম কন্ডিশনে মাহমুদউল্লাহদের দম্ভকে গুড়িয়ে দিয়ে গেছে আফগানরা।
মাহমুদউল্লাহর উত্তরটা ছিল এমন,
‘আমার মনে হয় না, আফগানিস্তানের কাছ থেকে কিছু শেখার আছে। আমাদের ভুলের পরিমাণ বেশি ছিল। সেই কারণে রেজাল্টটা ভালো হয়নি। তবে ওদের কৃতিত্ব দিতে হবে, ওরা ভালো ক্রিকেট খেলেছে। একই সঙ্গে আমরা খুব বাজে ক্রিকেট খেলেছি।’
গত ২৪ সেপ্টেম্বরের ঘটনা এটি। ত্রিদেশীয় টি-টোয়েন্টি সিরিজের ফাইনাল ম্যাচটা পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছিল রাত ৯টায়। পুরস্কার বিতরণীর পরপরই আফগানিস্তান অধিনায়ক রশিদ খান সংবাদ সম্মেলনে আসেন। রশিদ খান বিদায় নেয়ার পর থেকে শুরু হয় সাংবাদিকদের অপেক্ষার আরেক প্রহর। বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক, কোচ বা প্রতিনিধি হয়ে কোনো ক্রিকেটারের আসার খবর নেই। ড্রেসিংরুমের পানে চেয়ে সংবাদকর্মীরা। ম্যাচ জিতলে অধিকাংশ সময় সংবাদ সম্মেলনে এমন বিলম্ব করে থাকে বাংলাদেশ দল।
কিন্তু সেদিন বৃষ্টিতে পরিত্যক্ত হয়েছিল ফাইনাল ম্যাচ। পরে সাড়ে ১০টার পর মিডিয়া ম্যানেজারের সঙ্গে সংবাদ সম্মেলনে আসেন মাহমুদউল্লাহ। অধিনায়ক সাকিবের ডেপুটি তিনি। ওই সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পালনে নিজের আগ্রহের কথা জানিয়েছেন তিনি। সঙ্গে আফগানদের কাছে শেখার কিছু নেই জানিয়ে সবাইকে কিছুটা বিস্ময়ও উপহার দিয়েছেন।
১০ বছর ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলছেন, তিন ফরম্যাটে ৩১১টি ম্যাচ খেলেছেন, সেঞ্চুরি সাতটি, হাফ সেঞ্চুরি ৪১টি (২০১৯, ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত)। এত অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মাহমুদউল্লাহ হয়তো এমনটা বলতেই পারেন।
চট্টগ্রামে মাহমুদউল্লাহ নিজে ক্যারিয়ারের ৪৬তম এবং বাংলাদেশ ১১৫তম টেস্ট খেলেছিল, যেখানে আফগানদের দাপটে নতজানু হয়ে ছিল বাংলাদেশ। বৃষ্টির বদন্যতার পরও ম্যাচের পঞ্চম দিনের শেষ বিকেলে ৭০ মিনিট ব্যাটিংয়ের চ্যালেঞ্জ নিতে পারেনি স্বাগতিকরা। বাংলাদেশকে রাজ্যের গ্লানি উপহার দিয়ে অসাধারণ জয় তুলে নিয়েছিল তৃতীয় টেস্ট খেলতে নামা আফগানরা। ওই ম্যাচে খোদ মাহমুদউল্লাহ দুই ইনিংসে সর্বসাকুল্যে ১৪ রান করতে পেরেছিলেন। এই ডানহাতি ব্যাটসম্যান দুই ইনিংসে উইকেটে অবস্থান করতে পেরেছেন মাত্র ৩৪ বল!
দেশের প্রতি নিজেদের সমর্পণে সদা প্রস্তুত রশিদ খান
চট্টগ্রামে গত ২১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ইনিংসের অষ্টম ওভারে ব্যথা নিয়ে উঠে যান রশিদ খান। হ্যামস্ট্রিংয়ের টান পড়লেও সবাইকে অবাক করে দিয়ে মাঠে নামেন আফগান অধিনায়ক। দলের প্রতি নিবেদন নিয়েই করেন তিন ওভার বোলিং। খুড়িয়ে খুড়িয়েই ১৪ ও ১৬তম ওভারে বোলিং করেন রশিদ খান। তারপরও ওই দুই ওভারে মাহমুদউল্লাহ ও আফিফকে ফেরান তিনি। অবশ্য তৃতীয় ওভারে এসে বেশ খরুচে বোলিং করেন এই লেগ স্পিনার। সাকিব-মোসাদ্দেকের ব্যাটে ওই ওভারেই ম্যাচে জয়ের দুয়ারে চলে যায় বাংলাদেশ।
হ্যামস্ট্রিংয়ের চোট নিয়েও বোলিং করা ঠিক ছিল কি না, জানতে চাইলে সংবাদ সম্মেলনে রশিদ খান দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে তুলে ধরেছিলেন অগাধ দেশপ্রেমের কথা। ১০ ভাগ ফিট থাকলেও দেশের জন্য খেলতে প্রস্তুত তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে রশিদ খান বলেছেন,
‘আমার মনে হয়, বোলিং করা উচিত ছিল না। কিন্তু যখন দলের আপনাকে প্রয়োজন, তখন তো থাকতেই হবে। বিশেষ করে যে দেশ থেকে আমরা এসেছি, আমরা আসলে নিজেদের প্রতি তেমন একটা মনোযোগী নই। যখন এটা দেশের ব্যাপার হয়ে ওঠে, নাগালের মধ্যে না থাকলেও আমরা নিজেদের সমর্পণ করতে পারি। আমরা যেমনটা দেখেছিলাম আসগরকে অ্যাপেনডিক্স অস্ত্রোপচার করানোর ৪ দিন পরই জিম্বাবুয়েতে বিশ্বকাপ বাছাইয়ে মাঠে আসতে, এবং বলতে যে, ‘না, আমি খেলব!’ তরুণরা এখান থেকেই শিখেছে। আমার যদি ১০ ভাগ সুযোগ থাকে খেলার, অবশ্যই তা আমি করব। কারণ, আমি নিজের দেশকে ভালবাসি, এবং আমার দেশটি জিততে চায়। নিজস্ব ব্যাপারের চেয়ে এটাই আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’
মাত্র তৃতীয় টেস্ট খেলতে নেমেও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভালো করার প্রেরণার যোগান সম্পর্কে জানতে চাইলে আফগান অধিনায়ক বলেছেন,
‘এটা শুধু এই কারণে যে, তারা খেলাটা ভালবাসে। প্রকৃতিপ্রদত্ত মেধা আছে এখানে, যা আমার মনে হয় অধিকাংশ দেশেরই নেই। আমাদের যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা নেই, আমাদের মাঠও নেই সেখানে (আফগানিস্তানে)। কিন্তু প্রকৃতিপ্রদত্ত মেধাগুলো বেরিয়ে আসছে। ব্যাটিংয়ের দিক থেকে, বোলিংয়ের দিক থেকে, কিংবা ফিল্ডিংয়ে তারা (বর্তমান দল) স্বভাবজাত খেলাটাই খেলছে। তাই এ মুহূর্তে আমাদের কিছু একাডেমি হয়েছে। তরুণ খেলোয়াড়রা অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে এখন। আসল কারণটাই হচ্ছে ছেলেদের স্বভাবজাত খেলা এবং ভাল করার আকাঙ্ক্ষা।’
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তিন ফরম্যাট খেলছে আফগানিস্তান, খুব বেশি দিন হয়নি। এর মাঝেই টেস্ট, টি-টোয়েন্টিতে প্রায় আলাদা দল গঠন করে ফেলেছে আফগানরা। তাতেই মিলছে সাফল্য। দুই ফরম্যাটে ভিন্ন দল সম্পর্কে রশিদ খান বলেছেন,
‘আমার মনে হয়, টেস্টের চেয়ে টি-টোয়েন্টিতে আমাদের পুরোপুরিই ভিন্ন রকমের দল। নবী আর আসগর উভয়েই টেস্ট এবং টি-টোয়েন্টি খেলে। আমার মনে হয়, তারা অনেক ক্রিকেট খেলেছে, তাই তারা জানে টি-টোয়েন্টি থেকে কীভাবে টেস্টে প্রত্যাবর্তন করতে হয়। একজন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার হিসেবে পরিস্থিতির সঙ্গে আপনাকে অবশ্যই মানিয়ে নিতে হবে। আমাদের টি-টোয়েন্টিতে ভিন্ন কিছু ছেলে আছে। দেশে তারা খুব ভাল একটা ক্যাম্প করেছে। টেস্টের জন্য আমাদের দুবাইয়ে খুব ভাল ক্যাম্প হয়েছিল। অধিনায়ক হিসেবে এটা আমার জন্য খুবই স্বস্তিদায়ক। ভিন্ন ফরম্যাটের জন্য ভিন্ন ভিন্ন দল পাওয়া খুবই ভাল ব্যাপার। অধিনায়ক হিসেবে তাদের পেয়ে আমি বেশ খুশি।’
মাহমুদউল্লাহর চোখে টি-টোয়েন্টিতে উন্নতির জায়গা
আগামী বছর অস্ট্রেলিয়ায় আইসিসি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলবে বাংলাদেশ। বিশ্বকাপের আগে এই সময়টাতে এই ফরম্যাটে অনেক ম্যাচ খেলবে বাংলাদেশ। সদ্যসমাপ্ত ত্রিদেশীয় টি-টোয়েন্টি সিরিজে দলের অনেক উন্নতির জায়গা খুঁজে পেয়েছেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। তার চোখে ধরা পড়েছে আরও কিছু জায়গা, যেখানে উন্নতি প্রয়োজন।
ঘরোয়া ক্রিকেটে ২০১২ সালে বিপিএল টি-টোয়েন্টি শুরু হয়েছে। ছয়টি আসর শেষ হওয়ার পর এই ফরম্যাটে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়, জানতে চাওয়া হয়েছিল মাহমুদউল্লাহর কাছে।
গত ২৪ সেপ্টেম্বর ফাইনাল ম্যাচ পরিত্যক্ত হওয়ার পর সংবাদ সম্মেলনে টি-টোয়েন্টি দলের সহ-অধিনায়ক বলেছেন,
‘আমার মনে হয়, ক্রিকেট খেলাটা এমন, যেখানে উন্নতির শেষ নেই। গত আট বছরে যে অবস্থানে ছিলাম, এখন মনে হয় অনেক ভালো অবস্থানে আছি। আর টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের টেম্পো ধরা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মাঝে আমরা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলাম, আমরা আদৌ স্কিল ক্রিকেট খেলব, নাকি পাওয়ার ক্রিকেট খেলব। ওই জায়গা থেকে আমরা বেরিয়ে এসেছি। আমার আমাদের সম্পর্কে অবগত যে, কোন ধরনের ক্রিকেট আমাদের সাথে যায়।’
টি-টোয়েন্টিতে ম্যাচের মাঝে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সেখানে মানসিক দিকটাও গুরুত্বপূর্ণ। নভেম্বরে ভারত সফরেও তিনটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলবে বাংলাদেশ। সেখানে ভালো করতে হলে করণীয় সম্পর্কে মাহমুদউল্লাহ বলেছেন,
‘বেশ কয়েকটি ম্যাচে ১৩-১৪ ওভার কিংবা ১৫ ওভারের সময় আমাদের ছয়-সাত উইকেট চলে গিয়েছিল। এই বিষয়গুলো নিয়ে কোচও কথা বলেছে, সাকিবও কথা বলেছে। গ্রুপ হিসেবেও কথা বলেছি। দিনশেষে আমাদেরও অনেক কিছু করার আছে। অনুশীলনে নিজেকে আরো পরিণত করা, প্লাস হচ্ছে ডিসিশন মেকিং। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে, এবং আপনি কোন বোলারকে ব্যবহার করছেন, কোন সময়টায়, বিশেষ করে, দল কি চাচ্ছে। এই জিনিসগুলো অনেক সময় বিবেচনা করতে হয়। এই জিনিসগুলো নিয়ে আমাদের মনে হয় আরো কাজ করতে হবে। মানসিক ব্যাপারগুলো আছে, এবং আমার মনে হয়, ভারতের সঙ্গে যে ম্যাচ আছে, সেখানে আমাদের এভাবে খেলতে হবে। তা না হলে তাদের হারানো বেশ কঠিন হবে আমাদের জন্য।’
উন্নতি করতে হবে, এমন জায়গাগুলো সম্পর্কে মাহমুদউল্লাহ বলেছেন,
‘আমি ব্যক্তিগতভাবে এটা মনে করি। কারণ, কিছু কিছু ডিপার্টমেন্টে আমাদের উন্নতির জায়গা আছে। বেশ কিছু ডিপার্টমেন্ট ছিল, যেখানে আমরা আরো ভালো করতে পারতাম। ইনশাল্লাহ, আমরা আগামী সিরিজে এই জিনিসগুলো নিয়ে কাজ করব।’
ত্রিদেশীয় সিরিজ: শেষ বেলায় মিলেছে স্বস্তির সন্ধান
আফগানদের কাছে টেস্টে হারের স্মৃতি নিয়ে ত্রিদেশীয় টি-টোয়েন্টি সিরিজ খেলতে নেমেছিল বাংলাদেশ। প্রথম ম্যাচেই খর্বশক্তির জিম্বাবুয়ে কাঁপিয়ে দেয় বাংলাদেশকে। ১৮ ওভারে ম্যাচে ৫ উইকেটে ১৪৪ রান তুলেছিল জিম্বাবুয়ে। রান তাড়া করতে নামা বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইন মুহূর্তেই ধ্বংসস্তুপে রূপ নেয়। টপ অর্ডারের আসা-যাওয়ার মিছিলে ৬০ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে বসে স্বাগতিকরা। সাকিব, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহদের বিদায়ে চোখ রাঙাচ্ছিল হার। তারপরই আটে নেমে দৃশ্যপট বদলে দেন আফিফ হোসেন। এই তরুণ তুর্কি প্রথম বলেই চার মারেন। মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতের সঙ্গে তার ভয়ডরহীন ব্যাটিংয়ে ওই ম্যাচে হারের লজ্জা এড়ায় বাংলাদেশ। আফিফ ২৬ বলে ৫২ (৮ চার, ১ ছয়), মোসাদ্দেক অপরাজিত ৩০ রান করেন।
দ্বিতীয় ম্যাচে আফগানদের সামনে পড়তেই আবার নতজানু বাংলাদেশ দল। বাজে সময়ের ঘূর্ণাবর্তে থাকা দলটা এবারও আফগান স্পিনে ধরাশায়ী হয়। মিরপুরে গত ১৫ সেপ্টেম্বর ২৫ রানে ম্যাচ জিতে যায় রশীদ খানের দল। ৪০ রানে ৪ উইকেট হারানোর পরও নবী-আসগর আফগানের ব্যাটিং-দৃঢ়তায় ৬ উইকেটে ১৬৪ রান করে দলটি। নবী ৫৪ বলে অপরাজিত ৮৪ রানের বিস্ফোরক ইনিংস খেলেন।
ব্যাটিংয়ে নামার আগে আরেক দফা তালগোল পাকিয়ে বসে বাংলাদেশ। ওপেনিংয়ে পাঠানো হয় মুশফিককে। টি-টোয়েন্টিতে প্রথমবার ওপেনিংয়ে এসে ৩ বল খেলেই ফিরেছিলেন নির্ভরযোগ্য এই মিডল-অর্ডার ব্যাটসম্যান। সাকিব-মুজিবের শিকার হওয়ার পর মাহমুদউল্লাহর ৩৯ বলে ৪৪, সাব্বিরের ২৭ বলে ২৪ রানে হারের ব্যবধান কমিয়েছিল বাংলাদেশ। মুজিব-রশিদদের পাশাপাশি মিডিয়াম পেসার ফরিদ-গুলবাদিনরাও বল হাতে কাঁপিয়েছেন বাংলাদেশকে।
টেস্টের পর টি-টোয়েন্টিতেও আফগানদের কাছে হেরে অনেকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিল বাংলাদেশের টিম ম্যানেজমেন্ট। নির্বাচকরা দলে এনেছিলেন অনেক পরিবর্তন। দল থেকে বাদ দেয়া হয় রানখরায় থাকা সৌম্য সরকারকে, সঙ্গে মেহেদী হাসান, আবু হায়দার রনি, ইয়াসিন আরাফাত মিশু বাদ পড়েন। দলে আনা হয় নাঈম শেখ, নাজমুল হোসেন শান্ত ও আমিনুল ইসলাম বিপ্লবকে। যাদের মধ্যে নাঈম শেখের নামটিই শুধু ত্রিদেশীয় সিরিজের আগে আলোচনায় ছিল। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হোমে চারদিনের ম্যাচ খেলে ফেরা শান্তকে টি-টোয়েন্টি দলে নিয়ে আসেন নির্বাচকরা। মূলত ব্যাটসম্যান হলেও লেগ স্পিন করতে পারার কারণে সুযোগ দেয়া হয় বিপ্লবকে। অভিজ্ঞ দুই পেসার শফিউল ইসলাম ও রুবেল হোসেনকে ফেরানো হয় দলে।
হুট করে সিরিজের মাঝপথে দলে এত পরিবর্তন অস্থিরতার প্রতীকই বহন করে। টানা ব্যর্থতায়, বিশেষ করে আফগানদের কাছে নাকানি-চুবানি খাওয়াটা ডেকে আনছিল লজ্জার ঢেউ। চট্টগ্রামে নিজেদের তৃতীয় ম্যাচে অনায়াসেই জিম্বাবুয়েকে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। মাহমুদউল্লাহ ৪১ বলে ৬২, লিটন দাস ৩৮ ও মুশফিকের ৩২ রানে ৭ উইকেটে ১৭৫ রান করেছিল বাংলাদেশ। শফিউল, মুস্তাফিজ ও অভিষিক্ত লেগ স্পিনার বিপ্লবের বোলিংয়ে ৩৯ রানের জয় এসেছিল।
সাগরিকায় পরের ম্যাচেও জিতেছিল সাকিব বাহিনী। অবশেষে আফগানদের হারাতে সক্ষম হয় বাংলাদেশ। ২০১৪ সালের পর প্রথমবার এবং টানা চার ম্যাচ হারের পর টি-টোয়েন্টিতে আফগানদের পরাজিত করতে পেরেছিল বাংলাদেশ, যা দলের ভেতর স্বস্তির বাতাস ছড়িয়ে দিয়েছিল। পাথর ভার নেমে যাওয়ার মতো অবস্থা তৈরি করে এই জয়।
দুই ওপেনারের ব্যাটে ছুটছিল আফগানদের রানের চাকা। ১০ ওভারে আফিফ ব্রেক-থ্রু এনে দেন বাংলাদেশকে। ওই ওভারে তার অফস্পিনের শিকার হন হযরতউল্লাহ জাজাই ও আসগর আফগান। হঠাৎ পথ হারানো আফগানরা আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি, ১৩৮ রানের পুঁজি গড়ে তারা।
পরে ১০৪ রানে ৬ উইকেট হারালেও অধিনায়ক সাকিবের দায়িত্বশীল ব্যাটিংয়ে জয়ের বন্দরে তরী বেড়াতে সক্ষম হয় বাংলাদেশ। সাকিব ৪৫ বলে অপরাজিত ৭০ রান (৮ চার, ১ ছয়) করেন, মোসাদ্দেক অপরাজিত ১৯ রান করেন।
ফাইনাল বৃষ্টিতে পরিত্যক্ত হলেও হোমে টি-টোয়েন্টিতে এখনও বলার মতো শক্তি হতে পারেনি বাংলাদেশ। ত্রিদেশীয় সিরিজে সর্বোচ্চ তিনটি ম্যাচ জিতলেও বাংলাদেশের পারফরম্যান্স সন্তোষজনক ছিল না। শান্তকে টি-টোয়েন্টিতে খেলানোর চিন্তা পুরোই ফ্লপ, দুই ইনিংসে ১৬ রান করেছেন তিনি। চার ম্যাচ খেলে লিটন দাস ৬১, মুশফিক ৬৩ রান করলেও দু’জনই ধারাবাহিক ছিলেন না। টেস্টে, ওয়ানডেতে রানখরায় থাকা মাহমুদউল্লাহ সর্বোচ্চ ১২৬ রান করেছেন, সাকিব ৯৬ রান করেন।
বল হাতে সাইফউদ্দিন, শফিউল ভালো করেছেন। সাইফউদ্দিন চার ম্যাচে ৭টি, শফিউল দুই ম্যাচে ৪ উইকেট পান। দু’জনই নতুন বলে ভালো বোলিং করেছেন, উইকেট এনে দিয়েছেন দলকে। কিন্তু মুস্তাফিজ চার ম্যাচে ৪ উইকেট পেলেও বোলিংয়ে নজর কাড়তে পারেননি। নতুন বলে তার অকার্যকারিতা আবারও প্রদর্শিত হয়েছে। সবচেয়ে আশা জাগিয়েছেন সাইফউদ্দিন। নতুন বলে সুইং করিয়েছেন, লক্ষ্যভেদী ইয়র্কারে বোল্ড করেছেন। ইনজুরি, ফিটনেসের ইস্যু ছাপিয়ে আসা শফিউলও দলের প্রয়োজন মেটানোর মতো বোলিং করেছেন। এদের ভিড়ে একাদশেই সুযোগ হয়নি রুবেল হোসেনের।
মিরপুর ও চট্টগ্রামে উইকেটের পার্থক্য ত্রিদেশীয় সিরিজে বড় ভূমিকা রেখেছে। মিরপুরে দাপট দেখিয়েছিলেন রশীদ খান-মুজিবরা। সাগরিকার উইকেটে স্পিনারদের জন্য তেমন কিছুই ছিল না। তাই ছোবল তুলতে পারেননি তারা। মিরপুরে দুই ম্যাচ জেতা আফগানরা চট্টগ্রামে দু’টি ম্যাচই হেরেছিল। এমনকি জিম্বাবুয়ের কাছেও প্রথমবার টি-টোয়েন্টিতে হারের স্বাদ নিতে হয়েছে আফগানদের।
মাহমুদউল্লাহ বলেছেন, আফগানদের কাছে কিছু শেখার নেই। কিন্তু আদতে চিত্রটা এমন নয়। যত দ্রুত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে আফগানরা, বিশ্বমানের ক্রিকেটার তৈরি করছে, তা থেকে শেখার আছে অনেক কিছু। মাঠের ক্রিকেটে তাদের আগ্রাসী মানসিকতা, জয়ের সুতীব্র আকাঙ্ক্ষা, দেশের জন্য সর্বোচ্চটা নিংড়ে দেয়ার প্রচেষ্টা থেকে শেখার অনেক কিছুই রয়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের। কারণ, এসব দিকগুলোতে এখনই আফগান ক্রিকেটারদের সঙ্গে মাহমুদউল্লাহ-সাব্বিরদের খেলায় বিস্তর ব্যবধান পরিলক্ষিত হয়। মাহমুদউল্লাহ হয়তো সেটি দেখেও না দেখার ভান করতে পারেন। মুখের বুলিতে সব হয় না, বাস্তবে রশীদ খানদের চেয়ে মাহমুদউল্লাহদের পিছিয়ে পড়ার অনেক দৃশ্যই ২২ গজে ফুটে উঠেছে সেপ্টেম্বর মাসে দুই ফরম্যাটে আফগানদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের দ্বৈরথে।