করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সংখ্যা বাড়ছে এক্সপোনেনশিয়াল তথা গুণোত্তর হারে। এই গুণোত্তর হার ব্যাপারটা কী? একটা উদাহরণের সাহায্যেই ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করা যাক।
ইতালির কথাই বিবেচনা করা যাক। গত ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ইতালিতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল মাত্র ৩ জন। ২২ তারিখে এই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ৯ জনে, ২৩ তারিখে ৭৬ জনে, ২৪ তারিখে ১৭৬ জনে। গত ১৬ মার্চের হিসেব অনুযায়ী দেশটিতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ২৪,৭৪৭ জন। শেষ দুই সপ্তাহের রেকর্ড থেকে দেখা যায়, সেখানে প্রতি চার দিনে আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে।
এই চিত্র খুবই ভয়াবহ। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ৮ দিনের মধ্যেই দেশটিতে আক্রান্তের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে। এবং উদ্বেগের ব্যাপার হচ্ছে, এই চিত্র শুধু ইতালির না। আশঙ্কা করা হচ্ছে স্পেন, ফ্রান্স, এমনকি আমেরিকাতেও শীঘ্রই ভাইরাসটি এভাবেই মানুষের মধ্যে ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করবে।
কেন ভাইরাসটি এভাবে ছড়াচ্ছে? কারণ এটাই এই ভাইরাসের বৈশিষ্ট্য। ধরুন, প্রথমে কেউ একজন এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলো। যেহেতু এর উপসর্গ তাৎক্ষণিকভাবেই প্রকাশিত হয় না, তাই আপাতদৃষ্টিতে সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থাতেই তার কাছ থেকে ভাইরাসটি আরো দুজন বা তিনজনের মধ্যে সংক্রমিত হতে পারে। ফলে একদিন পর আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াতে পারে ৪ জনে। এর পরদিন তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে আরো তিনজন নতুন করে সংক্রমিত হলে এই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াতে পারে ১২ জনে। অল্প সময়ের মধ্যেই এই সংখ্যা পৌঁছে যেতে পারে হাজারে এবং এরপর লাখে।
করোনাভাইরাস তথা এ ভাইরাসের ফলে সৃষ্ট রোগ কোভিড-১৯ এর সবচেয়ে বড় বিপদটা ঠিক এখানেই। এ কথা সত্য, এখন পর্যন্ত অন্য অনেক মহামারীর তুলনায় কোভিড-১৯ এ মৃত্যুর হার তুলনামূলকভাবে কম। কিন্তু যখন লক্ষ লক্ষ মানুষ কোনো রোগে আক্রান্ত হয়, তখন শতকরা হার কম হলেও মোট মৃতের সংখ্যা অনেক বেশি হতে পারে। কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রে এই সংকট আরো ভয়াবহ এই কারণে যে, অন্য অনেক রোগের তুলনায় এটা ছড়ায় অত্যন্ত দ্রুত। এতটাই দ্রুত যে, ইউরোপ-আমেরিকার মতো উন্নত রাষ্ট্রগুলোরও একসাথে এত বিপুল সংখ্যক রোগীর চিকিৎসা করার মতো সামর্থ্য নেই।
এর ফলাফলটা আমরা দেখতে পাচ্ছি ইতালিতে। সেখানে মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা ২৪ হাজার ছাড়িয়ে যাওয়ায় হাসপাতালগুলো রোগীদের স্থান সংকুলান করতে পারছে না। গুরুতর অবস্থায় পৌঁছে যাওয়া সব রোগীকে তারা আইসিইউতে স্থান দিতে পারছে না, তাদের জন্য ভেন্টিলেটরের ব্যবস্থা করতে পারছে না। ফলে সুচিকিৎসা না পেয়েই অনেককেই মৃত্যুবরণ করতে হচ্ছে। যদি রোগটা এত দ্রুত না ছড়াত, তাহলে হয়তো এদের অনেককেই বাঁচানো সম্ভব হতো।
ঠিক এখান থেকেই এসেছে ‘ফ্ল্যাটেনিং দ্য কার্ভ’ (Flattening the Curve) এর ধারণাটি। এবং বলা হচ্ছে, কোভিড-১৯ এর মহামারী থেকে নিজে বাঁচার এবং দেশকে বাঁচানোর আপাতত এটাই একমাত্র উপায়। ফ্ল্যাটেনিং দ্য কার্ভ বিষয়টা কী? এর আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে লেখচিত্রকে শুইয়ে দেওয়া। ব্যাখ্যা করা যাক। উপরের চিত্রটি লক্ষ্য করুন। এখানে বাম পাশের কার্ভটি হচ্ছে যদি কোনো ধরনের প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হয়, তাহলে কী ঘটতে পারে, তার চিত্র। এক্ষেত্রে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা অতি অল্প সময়ের মধ্যে বৃদ্ধি পেয়ে দেশের স্বাস্থ্যখাতের ধারণক্ষমতাকে ছাড়িয়ে যাবে। ফলে অবধারিতভাবে বিনা চিকিৎসায় প্রচুর মানুষ মৃত্যুবরণ করবে।
কিন্তু যদি কোনোভাবে সংক্রমণের হারকে একটু কমিয়ে আনা যায়, তাহলে কী ঘটবে? সেটাই দেখা যাচ্ছে ডান পাশের কার্ভটির ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রেও অনেক মানুষ আক্রান্ত হবে, কিন্তু এখানে সময়ের সাথে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধির হার হবে অনেক কম। এখানে প্রথমে কিছু মানুষ আক্রান্ত হবে, এরপর ধীরে ধীরে অন্যরা আক্রান্ত হবে, কিন্তু ততদিনে আবার প্রথমে আক্রান্তদের একটা বড় অংশ সুস্থ হয়ে উঠতে থাকবে। ফলে জনজীবন অচল হয়ে পড়বে না, আক্রান্তদের কেউ বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে না।
এটাই হওয়া উচিত এই সময়ের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য- যেন আক্রান্তের হারকে শ্লথ করে দেওয়া যায়, যেন কোনো নির্দিষ্ট সময়ে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দেশের স্বাস্থ্যখাতের ধারণ ক্ষমতাকে ছাড়িয়ে না যায়। কিন্তু কীভাবে এই লক্ষ্য অর্জন করা যাবে? কীভাবে এই কার্ভকে ফ্ল্যাট করে দেওয়া যাবে? এই বিষয়টি অত্যন্ত চমৎকারভাবে উঠে এসেছে ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে, যেখানে তারা কয়েকটি কম্পিউটার সিমুলেশনের মাধ্যমে পুরো ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করেছে।
ওয়াশিংটন পোস্ট ২০০ জন অধিবাসীর একটি শহরের কথা কল্পনা করেছে। ঐ শহরে প্রথমে একজন ব্যক্তি আক্রান্ত হয়, এবং এরপর তার কাছ থেকে বাকিদের মধ্যে ভাইরাসটি ছড়াতে থাকে। উপরের ভিডিওটি প্লে করে আপনি এই সিমুলেশন দেখতে পারেন। এখানে প্রতিটি বিন্দু হচ্ছে একেকজন মানুষ। বিন্দুগুলো যখন আক্রান্ত হয়, তখন তারা বাদামী বর্ণ ধারণ করে। এরপর আবার সুস্থ হয়ে গেলে বেগুনী বর্ণ ধারণ করে।
উপরের প্রথম ভিডিওটি লক্ষ্য করুন। এখানে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় খুবই স্বল্প সময়ের মধ্যে ২০০ জনের মধ্যে প্রায় সবাই এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। এবার দ্বিতীয় ভিডিওটি চালু করুন। এখানে একই শহরের একটু ভিন্ন পরিস্থিতিকে তুলে ধরা হয়েছে। এখানে প্রথম সংক্রমণের সংবাদ পাওয়ামাত্রই একটি দেয়াল তুলে কিছু এলাকাকে পুরো শহর থেকে বিচ্ছিন্ন বা লক ডাউন করে ফেলা হয়েছে। এতে প্রথমদিকে শহরের অংশ নিরাপদ ছিল। কিন্তু কোনো এলাকাকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে রাখা প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার। তাই একটা সময় পরে সেখান থেকে দুই-একজন আক্রান্ত ব্যক্তির মাধ্যমে ভাইরাসটি যখন শহরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে, তখন আগের মতোই দ্রুতগতিতে বাকিরা আক্রান্ত হতে শুরু করে।
এবার তৃতীয় এবং চতুর্থ ভিডিও দুটি (উপরের দুটি) দেখুন। এখানে কোনো এলাকাকে বিচ্ছিন্ন করা হয়নি, কিন্তু এখানে শহরের কিছু মানুষ সোশ্যাল ডিসট্যান্স তথা সামাজিক দূরত্ব পালন করেছে। এই সোশ্যাল ডিসট্যান্স কী? এটা সেলফ কোয়ারেন্টিনের মতো নিজেকে পুরোপুরি ঘরে বন্দী করে ফেলা না, বরং সামাজিক সংস্পর্শ বাঁচিয়ে চলা। অর্থাৎ আপনি জরুরি প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হবেন ঠিকই, কিন্তু ভিড় এড়িয়ে চলবেন, অন্য কোনো মানুষের এক মিটারের মধ্যে যাবেন না, কারো সাথে হাত মেলাবেন না, কারো দেওয়া কোনো কিছু খালি হাতে ধরবেন না, ধরলেও পরমুহূর্তেই সাবান দিয়ে ভালো করে হাত ধুয়ে ফেলবেন। অর্থাৎ ভাইরাসটিকে আপনি কোনোভাবেই নিজের শরীরে প্রবেশ করতে দিবেন না।
তৃতীয় ভিডিওটির ক্ষেত্রে শহরটির ২০০ জনের মধ্যে প্রতি আটজনের মধ্যে একজন এবং চতুর্থ ভিডিওটির ক্ষেত্রে প্রতি চারজনের মধ্যে একজন সামাজিক দূরত্ব পালন করছে। এবং ফলাফল আপনি নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছেন। ভাইরাস সংক্রমণের হার অবিশ্বাস্যভাবে কমে গেছে। ভিডিও চারটি থেকে পরিষ্কারভাবেই দেখা যাচ্ছে, এই সোশ্যাল ডিসট্যান্সই হচ্ছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রুখে দেওয়ার সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি। খুব বেশি দিন না, যদি দুই-তিন সপ্তাহ পর্যন্ত দেশের এক-চতুর্থাংশ মানুষ সোশ্যাল ডিসট্যান্স পালন করে, তাহলে অবিশ্বাস্যভাবে কার্ভকে ফ্ল্যাট করে দেওয়া যাবে। তখনও অবশ্য অনেক মানুষ ভাইরাসে আক্রান্ত হবে, কিন্তু সেটা এতটাই ধীরে গতিতে যে, সবার পক্ষেই সুচিকিৎসা পাওয়া সম্ভব হবে। বিনা চিকিৎসায় কাউকে মৃত্যুবরণ করার ঝুঁকিতে থাকতে হবে না।
তো আর দেরি কেন? মানবতার স্বার্থে না হয় সপ্তাহ দুয়েক একটু কষ্ট করে সামাজিক দূরত্ব পালন করলেনই। আপনার একটুখানি সচেতনতা, একটুখানি কষ্ট স্বীকারই হয়তো পারে আপনার এবং আপনার আশেপাশের মানুষদের, বিশেষ করে বৃদ্ধদের প্রাণ রক্ষা করতে।
করোনাভাইরাস নিয়ে আরও জানতে পড়ে নিন এই লেখাগুলো: